Science and Materialism

Science, Philosophy (and Politics?) -Evidence to Ancient India (Part- III)

প্রাককথন

ভারতে বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য অবশ্যই প্রাচীন।

দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীও একইরকম পুরানো।

কিন্তু ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে এই উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চায় যেন কিছুটা ছেদ পড়ে, প্রায় একইসময়ে প্রসারিত হতে থাকে মায়াবাদের দর্শন।

আজকের ভারতে অতীত ভারতবর্ষের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের নামে যা কিছু চলছে তার শিকড় রয়েছে আধিপত্যকামী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। এ এক এমন ধারণা যা বহুর সাধারণ পরিচিতির জোরে অল্পের উপরে নির্লজ্জ্ব আধিপত্য চাপিয়ে দিতে চায়। শুধু তাই না সেই গাজোয়ারির পক্ষে যুক্তির অজুহাতে বহুবিধ অপবিজ্ঞান, অবিজ্ঞান ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীকেই সত্য বলে চালিয়েও দিতে চায়।

এই আবহে বস্তুনিষ্ঠ, প্রকৃত বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটানো বিশেষ প্রয়োজন। এই কাজ কেবল সমাজ জীবনের প্রয়োজন তাই নয়, একান্ত জরুরী রাজনৈতিক কর্মসূচি।

সেই রাজনীতির মূল কথা আঁধার চিরে চারপাশে আলো টেনে আনা।

আমরা যেন মনে রাখি, গোটা পৃথিবীর উপরে মানুষের বিজয় সম্ভব হয়েছিল কেবল এই জন্য না যে তারা শ্রেষ্ঠ প্রাণী, বরং এই কারণেই যে মানুষ প্রথমে কৌম, পরে যুথবদ্ধ ও সবশেষে যৌথ জীবন যাপনকে সমাজে রূপান্তরিত করেছিল। সেই সমাজব্যবস্থার গোড়ার কথা একটাই, অনেকে মিলে এক। কেবলমাত্র একের জোরে ব্যাপারটা আদৌ ঘটেনি।

এমনটা কেন ঘটল সেই প্রসঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে যাদের আচার্য্য বলা হয় তাদেরই অন্যতম ডক্টর প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নিজস্ব ব্যখ্যা রয়েছে। একসময় বিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাদ সাহাও ভারতীয় দর্শনের ভাববাদী ধারার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা লেখেন। ভারতের ইতিহাস প্রসঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত চর্চায় দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি, দার্শনিক উপলব্ধির অনুসন্ধানে রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রমুখেরা বস্তুনিষ্ঠ ও কার্যকরী ভুমিকা পালন করেছেন। প্রাচীন ভারতের দর্শন ও বস্তুবাদের দেশীয় উৎস অনুসন্ধানে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ’দের পাশাপাশি দার্শনিক, অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়’রাও আজকের প্রজন্মের জন্য অনেক কিছুই রেখে গেছেন।

রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল সেই ইতিহাস, সেই ঐতিহ্যের সাথে আজকের প্রজন্মকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে ধারাবাহিক কিছু লেখা প্রকাশ করার।

সেই উদ্দেশ্যেই আমরা যোগাযোগ করি শ্যামাশীষ ঘোষের সাথে। আগে শিবপুর বি ই কলেজ (আজকের আই আই ই এস টি) থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং’র ছাত্র ছিলেন। মূল পড়াশোনার পাশাপশি এক লম্বা সময় তিনি ভারতে বস্তুবাদ ও বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস প্রসঙ্গে বিভিন্ন বইপত্র ইত্যাদি নাড়াচাড়া করেছেন, এখনও করছেন।

ছোট ও বড়দের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইতিহাসকে জনপ্রিয় করার কাজেও তার কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে।

সেই অভিজ্ঞতা ও আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু আমাদের বারংবার মনে রাখার, অন্যদের মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার এ দুয়ের ফলাফল এই আলোচনা।

সেই ধারাবাহিকেরই আজ তৃতীয় পর্ব।

শ্যামাশীষ ঘোষ

প্রাচীন ভারতের দর্শনে বিতর্ক – পরিচিতি ও পদ্ধতি

প্রাচীন ভারতের দর্শনের আলোচনায় প্রবেশ করতে গেলে পরিভাষা প্রসঙ্গটি নিয়ে বলে নেওয়া দরকার, ইংরেজি মেটিরিয়ালিজম (Materialism) এর প্রতিশব্দ হিসাবে ‘জড়বাদ’, ‘ভুতচৈতন্যবাদ’ ইত্যাদি ব্যবহৃত হলেও, আমরা সাধারণভাবে ‘বস্তুবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করবো। আর ইংরেজি আইডিয়ালিজম (Idealism) এর প্রতিশব্দ হিসাবে ‘ভাববাদ’ শব্দ ব্যবহার করবো।

ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে ‘ভূত’ কথাটি মাটি, জল, আগুন ও বাতাস বলে চার রকম ভূতবস্তুর প্রাথমিক সত্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে, চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত সত্যি বলে স্বীকার করাটুকুই বস্তুবাদ বা সেই সময়ের পরিভাষায় ভূতচৈতন্যবাদ-এর পরিচায়ক নয়। ভূতচৈতন্যবাদ-এর দাবি, ভূতবস্তুই পরম সত্য, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল উপাদান – আত্মা প্রভৃতি কোনো স্বতন্ত্র পদার্থের কথা অবান্তর। ভূতচৈতন্যবাদ আখ্যা থেকেই বোঝা যায়, অন্তত ভারতীয় দর্শনে বিতর্কটা প্রধানতই চৈতন্য-র উৎপত্তি নিয়ে। নিছক দেহকে পঞ্চভূত থেকে উৎপন্ন স্বীকার করেও দেহ-অতিরিক্ত বা দেহ ছাড়াও আত্মার অস্তিত্ব মানা ‘ভূতচৈতন্যবাদ’-বিরোধী।

বস্তুবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ভাববাদ। ভাববাদ অনুসারে, চেতনা বা চৈতন্য-স্বরূপ পদার্থই প্রকৃত জগৎ-কারণ বা পারমার্থিক সত্য। চলতি কথায়, এই চেতন-পদার্থের জন্য আত্মা, পরমাত্মা, ঈশ্বর, পরব্রহ্ম প্রভৃতি রকমারি শব্দের প্রচলন আছে। ভাববাদের মূল কথা হলো, কোনো-না-কোনো অর্থে চেতন-পদার্থই বা মানস-ব্যাপারই পারমার্থিক সত্য; অতএব পরিদৃশ্যমান পদার্থরাশি বা বস্তুজগৎ অপ্রধান বা চৈতন্য-নির্ভর; তার কোনো স্বাধীন বা নিজস্ব সত্তা মানা যায় না।

ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদ, প্রধানত ঋগ্বেদ থেকে উদ্ভূত একধরণের প্রোটো-বস্তুবাদী ভাবনা থেকে শুরু হয়েছিল। এই ধারণাগুলি অবদমিত করার উদ্দেশ্যেই ভাববাদের আবির্ভাব, এবং নানারকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে তার বিবর্তন। অবশেষে এই ভাববাদের অ্যান্টিথিসিস হিসাবেই উদ্ভূত হয়েছিল বস্তুবাদ।  

বৈদিক চিন্তাধারার বিকাশ বোঝার জন্য, অবশ্যই মনে রাখা দরকার, এটি সেই অর্থে কোনো দার্শনিক বিষয় নয়। প্রাচীন ভারতে পরবর্তীকালে যে জটিল দর্শনের মারপ্যাঁচ আমরা দেখি, সেই জাতীয় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিক বৈদিক কবিদের পুরোপুরি মাথার উপর দিয়ে চলে যেত। ঋগ্বেদের মূল বিষয়বস্তু দেবতাদের স্তব এবং তাঁদের কাছে প্রার্থনা। ঋগ্বেদের সব সূক্তই যজ্ঞের উদ্দেশ্যে রচিত নয় বা যজ্ঞে ব্যবহৃত হত না। সূক্তগুলি মূলত তিনটি ধরণের:

১) দেবতার রূপবর্ণনা: দেবতার আকৃতি, বেশবাস, অলংকার, অস্ত্রশস্ত্র, রথ ও বাহনের বর্ণনা; দেবতার শৌর্য, কীর্তি ও পূর্বপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহের উল্লেখ।

২) আপ্যায়ন: দেবতার তুষ্টিবিধানে ভক্ত কি নৈবেদ্য করছেন – ভোজ্য, পানীয় ও স্তোত্র – তার বিবরণ; নতুন স্তব রচনার প্রতিশ্রুতি আর প্রাচীন স্তবগানের উল্লেখ।

৩) প্রার্থনা: প্রার্থিত বস্তু সারা ঋগ্বেদ জুড়েই প্রায় এক – বিজয়, শত্রুবিনাশ, পশুধন, স্বর্ণ, স্বাস্থ্য, শস্য, সন্তান, রোগমুক্তি এবং সর্বোপরি দীর্ঘ পরমায়ু। 

এঁরা মনে করতেন খাদ্য ও পানীয় দিয়ে শরীরকে পুষ্ট করা এবং দেবতাদের তুষ্ট রাখার চেয়ে আর কিছুই বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঋগ্বেদে অন্নের প্রশংসায় সূক্তের কিছু অংশ মোটামুটি এইরকম:

‘সুস্বাদু খাদ্য, মধুময় খাদ্য, আমরা তোমায় স্বাগত জানাই; আমাদের রক্ষাকর্তা হও … যেহেতু আমরা ফোটানো দুধ ও সিদ্ধ যবের সাথে তোমার মিশ্রণ পানীয় সোম উপভোগ করি, তাই হে শরীর তুমি পুষ্ট হতে পারো।’

এইরকম উল্লেখ ঋগ্বেদ জুড়ে – স্তব ও প্রার্থনাই ঋগ্বেদের তিন-চতুর্থাংশ। ঋগ্বেদের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। তবে এর সাক্ষ্য উপেক্ষা করার মতো নয়। এটি একটি তাত্ত্বিক মেজাজের প্রতিনিধিত্ব করে যা পরবর্তীকালের সর্বাধিক স্পষ্টভাষী বস্তুবাদী লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের মধ্যে দেখা যায়। তাঁদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে বলা হত যে এঁরা কোনও মহৎ আদর্শ সম্পর্কে অজ্ঞ, কেবল খাওয়া-দাওয়া নিয়েই ভাবে – নামটি চর্ব বা চিবানো এই অর্থে। এটি সম্ভবত কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু, যেটা নজরে আসে তা হলো চার্বাক দার্শনিক মতামত প্রাথমিক বৈদিক কবিদের সাধারণ তাত্ত্বিক মেজাজের সাথে খাপ খায়। এই কারণেই প্রাচীন বৈদিক চিন্তাধারাকে প্রাচীন প্রোটো-বস্তুবাদের পরিচায়ক হিসাবে বর্ণনা করার হয়। এর ধ্বংসাবশেষের উপরেই পরবর্তীকালে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে।

আমরা পরবর্তীকালে অবশ্য দেখি বেদে নানা সংশয়ের কথা, যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে যজ্ঞ বা বিভিন্ন আচারগুলি প্রার্থিত ফল দিতে প্রায়শই ব্যর্থ হচ্ছে। এইসব সংশয় যখন ক্রমাগত বাড়ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, তখন এইগুলির প্রশমনের জন্য ক্রমাগত নানা ধরণের দার্শনিক মতের উদ্ভব হয় – প্রধানত উপনিষদগুলিতে আমরা যা দেখতে পাই। বেদে সংশয় নামক পর্বে এগুলির কিছু বিস্তারে আলোচনায় যাবো আমরা।

ভারতীয় দর্শনের সাধারণ ভাণ্ডারে জমা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে দার্শনিক উপাদান – কমবেশি দু’হাজার পাঁচশো বছরের দার্শনিক ক্রিয়াকলাপের ফল। এই ক্রিয়াকলাপের স্পষ্ট সূচনা উপনিষদে, যার প্রথমটি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে অনুমিত। তবে এর অনেকগুলিই আগে থেকে চলে আসা উপকরণের সংকলন। অতএব অনুমান করা যায় যে, উপনিষদের চিন্তাবিদগণ আরো পূর্ববর্তী যুগের। যে চিন্তাগুলি শেষ পর্যন্ত উপনিষদ দর্শন হিসাবে দানা বাঁধে তাদের নিজস্ব একটি প্রাচীন প্রাক-ইতিহাস রয়েছে। ভারতীয় দর্শনকে বুঝতে গেলে এর তাৎপর্যকে বোঝা দরকার।

এইরকম আদি যুগ থেকে শুরু করে, ভারতীয় দার্শনিক কার্যকলাপ চলে এসেছে জ্ঞানতত্ত্বের সর্বাধিক চুলচেরা সংজ্ঞাগুলির সময় পর্যন্ত, যা নব্য-ন্যায় নামে পরিচিত। উপনিষদ ও নব্য-ন্যায়-এর মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময়ে ভারতে দর্শনের হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়। সঠিক সংখ্যা সম্পর্কেও আমাদের কোনও ধারণা না থাকলেও জানা যায় যে সংখ্যাটা বেশ বিস্ময়কর। একাদশ শতাব্দীর কিছু সময় পরে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের পরে, পরবর্তী ভারতীয় বৌদ্ধদের বেশিরভাগ রচনার মূল ভারতীয় লেখাগুলি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এগুলি হারিয়ে যায়নি, কারণ এগুলি চীনা, মঙ্গোলীয় এবং তিব্বতি অনুবাদগুলিতে বেঁচে আছে। পরবর্তীকালের ভারতীয় বৌদ্ধদের দ্বারা রচিত যুক্তি ও জ্ঞানতত্ত্বের উপর হাতে গোনা কয়েকটি গ্রন্থের ভিত্তিতে তার সম্পর্কে আমাদের ইতিমধ্যে যে ধারণাটি রয়েছে, তা চিত্তাকর্ষক।

এরকম একটি ব্যাপক দার্শনিক ঐতিহ্যের মুখোমুখি হয়ে, অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ একে সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য একটি বুদ্ধিমান শৃঙ্খলা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় দর্শনে বৈধ বলে বিবেচিত পদ্ধতির মূল বক্তব্য হল ধারণার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দার্শনিক অবস্থানের দিকে এগোনো বা তার অ্যান্টিথিসিসের সাথে একটি থিসিসের মোকাবিলা – দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। এই পদ্ধতির উৎস খুঁজে পাওয়া যায় তাত্ত্বিক বিতর্কের প্রাচীন অনুশীলনের মধ্যে, উপনিষদের মধ্যেও। এর জন্য উপনিষদ-এর একটি শব্দ হল বাকওবাক্য, যার অর্থ প্রাচীন গ্রিকরা যাকে দ্বান্দ্বিক বলে, অর্থাৎ প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে বিতর্কের অনুরূপ। উপনিষদ যুগেই দার্শনিকদের একাংশের মধ্যে তাঁদের ‘জ্ঞান’ গুপ্ত রাখার প্রবণতা ছিল। কিন্তু, তা সত্ত্বেও বিতর্কের কলা এবং তা থেকে ভারতীয় যুক্তিবিজ্ঞানের চূড়ান্ত বিকাশকে আটকানো যায়নি – প্রধানত প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকদের জন্য, যাঁরা ভারতীয় বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রকৃত পথিকৃৎ। তাঁদের প্রাচীনতম উপলব্ধ কাজ – সুবিশাল চরক-সংহিতা সংকলিত হয়েছিল ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই। ধারণাগুলির লড়াইয়ের ভিতর থেকে তত্ত্বের ইতিবাচক সমৃদ্ধির সম্পর্কে প্রথম স্পষ্ট সচেতনতা দেখা যায় এখানে। এস এন দাশগুপ্ত ভারতীয় দর্শনের একমাত্র ঐতিহাসিক যিনি এটি উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ‘চরক-সংহিতার আগে বিতর্কের এই কলা চিকিৎসকদের মতো আর কোথাও এতটা ব্যবহারিক কারণে প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়নি। যেহেতু পূর্ববর্তী অন্য কোনও সাহিত্যে এর বিকাশের কোনও উল্লেখ নেই, তাই এটি অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত যে বিতর্কের কলা এবং এর অন্যান্য অনুষঙ্গগুলি ঐতিহ্যবাহী মেডিকেল স্কুলগুলিতে আদিকাল থেকেই বিকশিত হয়েছিল, সেখান থেকে তারা চরক-এর রচনায় স্থান পায়’।

বিতর্কের দুটি রূপ রয়েছে: ধ্বংসাত্মক এবং গঠনাত্মক। পরেরটি, জ্ঞান এবং এর ব্যাখ্যার জন্য উৎসাহের সহায়ক, জ্ঞানের প্রাক-বিদ্যমান ভাণ্ডারে সন্দেহ দূর করার মাধ্যমে দৃঢ় প্রত্যয়কে শক্তিশালী করে। প্রমাণ, যুক্তি এবং ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন সামনে আসে। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের কাজ ছিল এই প্রশ্নগুলির উত্থাপন করা ও উত্তর দেওয়া এবং এইভাবে ভারতীয় যুক্তি বা প্রোটো-যুক্তিবিদ্যার মূল ভিত্তি তৈরি হয়।

ভারতীয় যুক্তিশাস্ত্রের প্রথম যথার্থ রচনা খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর ন্যায়-সূত্র। এটির রচয়িতা জনৈক গোতম বা গৌতম বলে জানা যায় এবং মোটামুটি পঞ্চম শতাব্দীর বাৎস্যায়ন এর উপর প্রথম বিস্তৃত মন্তব্য করেন। যুক্তির ধারাবাহিকতায়, অনুমিত হয় যে চরক-সংহিতার প্রোটো-যুক্তিবিদ্যা সম্ভবত ন্যায়-সূত্রগুলিতে বিধিবদ্ধ যৌক্তিক অনুমানের উৎস।

একটি দার্শনিক অবস্থানের প্রতিষ্ঠা বা ‘চূড়ান্ত নির্ধারণ’ নির্ভর করে কোনও সমস্যার ‘সমালোচনামূলক তদন্তে’র উপর – প্রথমটি নির্ণয়, পরেরটি পরীক্ষাপরীক্ষা ছাড়া নির্ণয় হতে পারে না। অর্থাৎ দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ন্যূনতম পূর্ব-শর্ত হ’ল সমস্যাটির পরীক্ষা বা ‘সমালোচনামূলক তদন্ত’। পরীক্ষার আবার নিজস্ব অপরিহার্য পূর্বশর্ত ‘সন্দেহ’ – যাকে বলা হয় সংশয়। সুতরাং, ‘সন্দেহ’ ব্যতীত কোন ‘সমালোচনামূলক তদন্ত’ নেই।

বাৎস্যায়ন বলেছেন, ‘যা সম্পূর্ণ অজানা তার জন্য দার্শনিক যুক্তির প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে না, বা যা সম্পূর্ণরূপে জানা যায় তার জন্যও প্রাসঙ্গিক হতে পারে না। এর প্রাসঙ্গিকতা কেবল যার সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ সংশয় আছে, তার জন্য’। কারণ সংশয়ই সম্পূর্ণ অজানা ও সম্পূর্ণ জানা বিষয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে থাকে। ‘সন্দেহ’ কী – এই সম্পর্কে গৌতম এবং বাৎস্যায়ন একটি অসাধারণ উত্তর দিয়েছেন। দার্শনিকভাবে, ‘সন্দেহ’ হ’ল দুটি দার্শনিক অবস্থানের মুখোমুখি হওয়া, একে অপরের বিরোধিতা এবং হুমকি দেওয়ার বৌদ্ধিক পরিস্থিতি। ভারতীয় পরিভাষায় এগুলি হল পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ (বা বিপক্ষ)। এগুলির ইংরেজি সমতুল্য হ’ল ‘থিসিস’ এবং ‘অ্যান্টিথিসিস’। বাৎস্যায়ন সংক্ষেপে বুঝিয়েছেন, ‘সমালোচনামূলক তদন্ত’ ‘থিসিস’ এবং সন্দেহ সৃষ্টিকারী ‘অ্যান্টিথিসিস’-এর সংঘর্ষ এবং চূড়ান্ত নির্ধারণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এইভাবে ‘সন্দেহ’ হয়ে ওঠে দর্শনের সূচনা বিন্দু, সাথেসাথেই ‘সন্দেহের’ পূর্বশর্তগুলিও নির্দিষ্ট। ধারণার সম্মুখ সংঘর্ষ বা দুটি অবস্থানের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্ব – যার মধ্যে একটি অন্যটিকে ততটাই নাকচ বা নিশ্চিহ্ন করতে চায় যতটা অন্যটি প্রথমটিকে নাকচ বা ধ্বংস করতে চায় – এইভাবে দার্শনিক কার্যকলাপের অপরিহার্য পূর্বশর্ত গঠন করে। আবার ‘সন্দেহ’-এর বিভিন্ন রূপ আছে। একই জিনিস সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী দাবির ফলস্বরূপ সন্দেহের সৃষ্টি হয় – একটি থিসিস তার অ্যান্টিথিসিসের সম্মুখীন হয়।

এই পদ্ধতি অনুসারে, একজন ভারতীয় দার্শনিকের প্রথম যে জিনিসটি প্রতিষ্ঠা করা দরকার তা হ’ল তিনি যে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করতে চান তার বৈধতা প্রতিষ্ঠা। এটি করার উপায় হ’ল এটি দেখানো যে সমস্যাটি সম্পর্কে প্রকৃত ‘সন্দেহ’ রয়েছে, অর্থাৎ এটি সম্পর্কে দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান আছে। এগুলি হল ‘থিসিস’ এবং ‘অ্যান্টিথিসিস’ – ভারতীয় পরিভাষায় পক্ষ এবং বিপক্ষ। একজন ভারতীয় দার্শনিক, সাধারণভাবে, প্রথমে তাঁর বিপরীত, অর্থাৎ যে দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করে তার মুখোমুখি হন। ভারতীয় পরিভাষায় একে বলা হয় পূর্বপক্ষ – প্রতিপক্ষের ‘থিসিস’, বা, আরও সহজভাবে, নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘অ্যান্টিথিসিস’। কেবল কমবেশি এই ‘অ্যান্টিথিসিসে’র বিস্তৃত নাকচের ভিত্তিতেই তিনি নিজের ‘থিসিস’ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, যাকে বলা হয় সিদ্ধান্ত

এইভাবে, একটি গুরুতর দার্শনিক রচনায়, এই বিরোধিতার পক্ষে প্রথমে সমস্ত ধরণের যুক্তি দেওয়া হয়। অ্যান্টিথিসিস এইভাবে যতটা সম্ভব মজবুত প্রদর্শিত হয়। এর পরেই দার্শনিক তাঁর নিজের থিসিসের পক্ষে এটি ধ্বংস করতে এগোন। অর্থাৎ অ্যান্টিথিসিসকে সমস্ত সম্ভাব্য কৃতিত্ব দেওয়ার পরে, চূড়ান্ত খণ্ডন, দার্শনিকদের থিসিসের জন্য সম্পূর্ণ প্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করে। এর অর্থ থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব দ্বারা সৃষ্ট সন্দেহ কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন যত বেশি অগ্রসর হন, তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির মূল্য তত বেশি হয়।

এই যে প্রতিপক্ষের থিসিস বা পূর্বপক্ষ-এর বিস্তৃত খণ্ডন, তা অবশ্যই কোনো কাল্পনিক প্রতিপক্ষের অবস্থানের নয় – কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিক বা দার্শনিকদের অবস্থান, যাঁরা ঐতিহাসিকভাবে এটি রক্ষা করেছেন বলে জানা যায় – তার খণ্ডন। ভারতীয় দার্শনিক কার্যকলাপের পরিণত পর্বে ভারতীয় দার্শনিকগণ এই পদ্ধতি অনুসরণ করা বিশেষভাবে বাধ্যতামূলক বলে মনে করতেন। তা না হলে তাদের নিজেদের অবস্থান অরক্ষিত থেকে যায়, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিকরাও সর্বদাই তাঁদের নিজস্ব মতামতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, যা সম্ভব কেবল তাঁদের নিজস্ব পূর্বপক্ষ গঠনকারীদের নাকচ করেই করা সম্ভব।

এই প্রথার কারণে, পরবর্তীকালে চার্বাক দর্শনের, যার অনেকটাই প্রতিপক্ষদের দ্বারা বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, কিছুটা উদ্ধার সম্ভব হয়। চার্বাক দর্শন খণ্ডনের অভিলাসী সমস্ত দার্শনিকই তাঁদের পূর্বপক্ষ হিসাবে চার্বাক দর্শনের আলোচনা করেছেন, যদিও তার ফলে এর প্রামাণ্যতা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়।

এখন আমরা ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রবেশ করবো – আত্মার সমস্যা। এর সম্পর্কে একটা দার্শনিক অনুসন্ধান কেবল প্রাসঙ্গিক হতে পারে, যদি সেখানে দুটি মত থাকে – এর বাস্তবতাকে স্বীকার বা অস্বীকার করার। ঈশ্বর ও জগতের সমস্যাও তাই – বস্তুত যে কোন সমস্যা, যা নিয়ে কোনো থিসিস তার অ্যান্টিথিসিসের হুমকির মুখোমুখি।

সমস্ত ভারতীয় দার্শনিকই অবশ্য এই পদ্ধতি সম্পর্কে সমান উৎসাহী ছিলেন না। এঁরা ছিলেন ‘সমালোচনামূলক তদন্ত’ বা যৌক্তিক বিশ্লেষণের মূল চেতনার বিরোধী। তাঁরা বরং শাস্ত্রে বিশ্বাসের পথ অনুসরণ করতে পছন্দ করতেন। এই প্রবণতার সবচেয়ে বিশিষ্ট প্রতিনিধি হলেন চরম ভাববাদীরা, যাঁদের যুক্তিবাদের প্রতি বিদ্বেষ ভারতীয় আইন প্রণেতাদের কাছ থেকে প্রচণ্ড উৎসাহ লাভ করে। সমাজে একধরণের শৃঙ্খলা প্রবর্তনই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। এঁদের দৃষ্টিতে যুক্তি নিজে থেকে কোন কাজের নয় এবং এর একমাত্র কার্যকর উদ্দেশ্য হতে পারে ধর্মগ্রন্থে ইতিমধ্যে যা প্রকাশিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা এবং বিস্তার করা। তবে, যখন তাঁরা দেখেন যে তাঁদের নিজস্ব থিসিস অ্যান্টিথিসিসের হুমকির মুখে, তখন তাঁরা গৌতম ও বাৎস্যায়ন দ্বারা প্রণীত পদ্ধতির মৌলিক বিষয়গুলিকে বাস্তবে উপেক্ষা করতে পারেন না।

ওয়েবডেস্ক এর পক্ষে প্রাককথন: সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply