Science and Materialism

Science, Philosophy (and Politics?) -Evidence to Ancient India (Part- II)

প্রাককথন

ভারতে বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য অবশ্যই প্রাচীন।

দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীও একইরকম পুরানো।

কিন্তু ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে এই উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চায় যেন কিছুটা ছেদ পড়ে, প্রায় একইসময়ে প্রসারিত হতে থাকে মায়াবাদের দর্শন।

আজকের ভারতে অতীত ভারতবর্ষের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের নামে যা কিছু চলছে তার শিকড় রয়েছে আধিপত্যকামী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। এ এক এমন ধারণা যা বহুর সাধারণ পরিচিতির জোরে অল্পের উপরে নির্লজ্জ্ব আধিপত্য চাপিয়ে দিতে চায়। শুধু তাই না সেই গাজোয়ারির পক্ষে যুক্তির অজুহাতে বহুবিধ অপবিজ্ঞান, অবিজ্ঞান ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীকেই সত্য বলে চালিয়েও দিতে চায়।

এই আবহে বস্তুনিষ্ঠ, প্রকৃত বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটানো বিশেষ প্রয়োজন। এই কাজ কেবল সমাজ জীবনের প্রয়োজন তাই নয়, একান্ত জরুরী রাজনৈতিক কর্মসূচি।

সেই রাজনীতির মূল কথা আঁধার চিরে চারপাশে আলো টেনে আনা।

আমরা যেন মনে রাখি, গোটা পৃথিবীর উপরে মানুষের বিজয় সম্ভব হয়েছিল কেবল এই জন্য না যে তারা শ্রেষ্ঠ প্রাণী , বরং এই কারণেই যে মানুষ প্রথমে কৌম, পরে যুথবদ্ধ ও সবশেষে যৌথ জীবন যাপনকে সমাজে রূপান্তরিত করেছিল। সেই সমাজব্যবস্থার গোড়ার কথা একটাই, অনেকে মিলে এক। কেবলমাত্র একের জোরে ব্যাপারটা আদৌ ঘটেনি।

এমনটা কেন ঘটল সেই প্রসঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে যাদের আচার্য্য বলা হয় তাদেরই অন্যতম ডক্টর প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নিজস্ব ব্যখ্যা রয়েছে। একসময় বিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাদ সাহাও ভারতীয় দর্শনের ভাববাদী ধারার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা লেখেন। ভারতের ইতিহাস প্রসঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত চর্চায় দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি, দার্শনিক উপলব্ধির অনুসন্ধানে রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রমুখেরা বস্তুনিষ্ঠ ও কার্যকরী ভুমিকা পালন করেছেন। প্রাচীন ভারতের দর্শন ও বস্তুবাদের দেশীয় উৎস অনুসন্ধানে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ’দের পাশাপাশি দার্শনিক, অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়’রাও আজকের প্রজন্মের জন্য অনেক কিছুই রেখে গেছেন।

রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল সেই ইতিহাস, সেই ঐতিহ্যের সাথে আজকের প্রজন্মকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে ধারাবাহিক কিছু লেখা প্রকাশ করার।

সেই উদ্দেশ্যেই আমরা যোগাযোগ করি শ্যামাশীষ ঘোষের সাথে। আগে শিবপুর বি ই কলেজ (আজকের আই আই ই এস টি) থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং’র ছাত্র ছিলেন। মূল পড়াশোনার পাশাপশি এক লম্বা সময় তিনি ভারতে বস্তুবাদ ও বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস প্রসঙ্গে বিভিন্ন বইপত্র ইত্যাদি নাড়াচাড়া করেছেন, এখনও করছেন।

ছোট ও বড়দের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইতিহাসকে জনপ্রিয় করার কাজেও তার কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে।

সেই অভিজ্ঞতা ও আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু আমাদের বারংবার মনে রাখার, অন্যদের মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার এ দুয়ের ফলাফল এই আলোচনা।

সেই ধারাবাহিকেরই আজ দ্বিতীয় পর্ব।

শ্যামাশীষ ঘোষ

দ্বিতীয় পর্ব: বিজ্ঞান এবং দর্শন – প্রাথমিক আলোচনা

মানব সভ্যতার বিকাশ একটি বিস্ময়কর এবং চিত্তাকর্ষক প্রক্রিয়া তো বটেই। সুদূর অতীতে নদনদীর তটভূমি ধরেই শুরু হয়েছিল মানবসভ্যতার বিকাশ। সিন্ধু ও গঙ্গা, হোয়াংহো এবং অক্সাস, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস এবং নীল নদের অববাহিকা ধরে গড়ে উঠেছিল মহান সভ্যতাগুলি– ভারতীয়, চীন, গ্রীক, ইরাকী এবং মিশরীয় সভ্যতা।

প্রাণিজগতে বিবর্তনের ধারা থেকেই মানুষের উদ্ভব– বস্তুজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পূর্বপুরুষ বনমানুষদের থেকে উদ্ভবের পর থেকেই মানুষ নিরন্তর চেষ্টা করেছে প্রকৃতিকে বোঝার, প্রকৃতিকে ব্যবহার করে এগিয়ে চলার, সভ্যতার বিকাশের কাজ। অবশ্য আজকের নিরিখে সেগুলিকে সভ্যতা বলতে অনেকেই অস্বীকার করবেন। প্রকৃতি থেকে পাওয়া হাতিয়ার ব্যবহার করা, তারপরে সেই হাতিয়ারকে উন্নত করে, দলবদ্ধ হয়ে তবেই মানুষ বেঁচে থাকতে, এগিয়ে চলতে পেরেছে। প্রাথমিক সময়ের জীবন ছিল যাযাবরের– প্রকৃতির থেকে খাদ্য সংগ্রহ করা, শিকার করা, পশুপালন করতে শেখা– ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে একত্রিত। এরপর কৃষির বিকাশ সম্ভব করলো এক জায়গায় স্থায়ী বসতি স্থাপন – অস্তিত্বে এলো গ্রাম।

প্রকৃত অর্থে শুরু হলো মানবসভ্যতার। বড় আকারের সেচ ব্যবস্থা বা বাঁধ নির্মাণের কাজের জন্য বেশ কিছু গ্রামের মানুষজনের একত্রিত হওয়ার প্রয়োজন হলো। স্বাভাবিকভাবেই দরকার হয়ে পড়লো একটি কেন্দ্রীয় পরিচালন ব্যবস্থা এবং একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশার মানুষ, যাঁরা কৃষিকাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। কৃষির উদ্বৃত্তই সম্ভব করে তুললো অন্য পেশাগুলি। গড়ে উঠল নগর – নগরসভ্যতা – সভ্যতার ফল। তখনও পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যা করেছিল, তা ছিল বিভিন্ন কৌশলের বিকাশ। এই কৌশলগুলির সাথে তত্ত্বের যোগই ভবিষ্যতে সম্ভব করবে বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ।

সমাজে সমৃদ্ধির ফল কিন্তু সকলের কাছে সমানভাবে এলো না – কেন্দ্রীভূত হতে থাকলো অল্পসংখ্যক মানুষের কাছে, যাঁরা সমাজের হর্তাকর্তা, উৎপাদনের উপকরণের মালিক। সমাজে এলো শ্রেণিবিভাগ – একদল মানুষের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির উপর নির্ভর করে আরেকদল স্বল্পসংখ্যক মানুষের জীবনযাপন। রোজকার জীবনযাপনের জন্য নিজেদের পরিশ্রম না-থাকায়, এই সম্প্রদায়ের হাতে সময় থাকতো অফুরান। নানা বিষয় নিয়ে ভাবনার সময় পেতেন তাঁরা – ভবিষ্যতের দার্শনিক।   

দর্শনের কাজ জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন অপরীক্ষিত জীবন যাপন করার কোনো মূল্য নেই। তিনি জগতের সমস্ত কিছুকে প্রশ্ন করেছিলেন। সমস্ত কিছুর অনুসন্ধান করেছিলেন। তাঁর কাছে দর্শন হল জীবনকে পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষা কিভাবে করতেন তিনি? প্রশ্ন আর উত্তর দিয়ে। অর্থাৎ, সক্রেটিসের মতে, প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই জীবনকে পরীক্ষা করা হলো দর্শন। এখানে লক্ষণীয় হলো, এই দর্শনের ভিত্তি বস্তুর উপর নয়, প্রকৃতির উপর নয়, বিশুদ্ধ চিন্তার উপর – এই ঝোঁকটিই জন্ম দিয়েছে ভাববাদী দর্শনের। এই দর্শনের ঐতিহাসিক কারণ নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে।

অন্যদিকে, বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিটি ছিল খুবই স্বাভাবিক। মানুষের খাদ্য, শিকার করার উপাদান, কৃষিকাজের উপাদান ও ফল, আশ্রয়স্থান সবকিছুই বস্তু-নির্ভর। সুতরাং, নতুন নতুন কৌশলের উদ্ভাবন করে, এগুলিকে উন্নত করে এগিয়ে চলার, সকলের জীবনে সমৃদ্ধি আনার, ভাবনার যে স্বাভাবিক বস্তুবাদী ঝোঁক থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

সমাজের অভ্যন্তরে তাত্ত্বিক দার্শনিক বিতর্কের এই সাধারণ চরিত্রটি সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই। ধারাবাহিক সংগ্রাম চলে আসছে দুটি প্রধান বিরোধী প্রবণতার মধ্যে – কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও সক্রিয়। একটি, আনুষ্ঠানিক এবং ভাববাদী; অন্যটি, ব্যবহারিক এবং বস্তুবাদী। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে এই সংঘাতকে প্রভাবশালী হিসাবে দেখা গেলেও, এটি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে, প্রকৃতপক্ষে শ্রেণি সমাজের প্রথম গঠনের থেকেই, কারণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত উভয় পক্ষের সাধারণ সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে কখনোই সন্দেহ ছিল না।

ভাববাদী দিকটি শাসক, সুবিধাভোগী এবং প্রতিষ্ঠিত ধর্মের পক্ষ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলে এসেছে, সবকিছু এখন যেমন আছে, চিরকালই তেমন ছিল। এখানে মানুষের কিছু করার নেই। এগুলিকে পরিবর্তন করার চেষ্টা অসম্ভব, এবং সমাজের পক্ষে অশুভ। বিজ্ঞানের বিকাশের প্রতি পদে এটি বাধা দিতে সচেষ্ট থেকেছে। আবার যেখানে বিজ্ঞানের অগ্রগমন ঠেকানো যায়নি, সেখানে সেই পরিস্থিতিতে কোনো নতুন ভাববাদী ব্যাখ্যায় একে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করেছে। তাঁদের এই ব্যবস্থার নিখুঁততা নিয়ে বক্তব্য সাধারণ মানুষের কাছে অনেক সময়েই গ্রহণযোগ্য হয়নি। সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। সুবিধাভোগী সম্প্রদায় তাই অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়েছে, এই ব্যবস্থার আদর্শ –  ভালো, সত্য এবং সুন্দর চিরন্তন এবং প্রশ্নের অতীত – প্রমাণের। এই কল্পিত পৃথিবীতে যেহেতু সেটি পাওয়া যাচ্ছে না, একটি নিখুঁত স্বর্গেই এর সন্ধান করা দরকার। প্রতিটি পর্যায়ে ভাববাদী দর্শন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বর্তমান অসন্তোষগুলিকে অলীক হিসাবে ভাবানোর এবং বিদ্যমান অবস্থাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানের উন্নয়নে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, তার ব্যবহারিক প্রকৃতি এবং বৈপ্লবিক প্রভাবের কারণে, বহু শতাব্দী ধরেই শাসকের সমর্থন পায়নি, সাধারণভাবে সরকারি দর্শনের অংশ হতে পারেনি, যদিও এটি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিতও ছিল না। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত শক্তি ছিল শাসকের চিন্তার কারণ। এটি ছিল মূলত বস্তু এবং তার গতিবিধির একটি দর্শন, মানুষের চোখ দিয়ে প্রকৃতি এবং সমাজের ব্যাখ্যা – যেটি মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণ করতো। সদা চলমান বস্তুজগতের নিয়মগুলি শিখে একে পরিবর্তন করার জন্য মানুষের শক্তির উপরেই এর জোর ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ধ্রুপদী বস্তুবাদ দার্শনিকভাবে বিশেষ এগোতে পারেনি, কারণ এটি সমাজ এবং তার পরিবর্তনের সাথে একে সংযুক্ত করতে পারেনি। এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বস্তুবাদের সম্প্রসারণ ও রূপান্তরই ছিল মার্কস এবং তাঁর অনুসারীদের কাজ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রথম কার্যকর হওয়া নতুন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, পরবর্তীকালে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হতে শুরু করেছে।

এই ভাববাদী এবং বস্তুবাদী প্রবণতার মধ্যে লড়াই আদিকাল থেকেই দর্শনের ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক বৈশিষ্ট। বস্তুবাদী দর্শনের ধারাবাহিক বিজয় সত্বেও, ভাববাদী দর্শনের নানা রূপে আবির্ভাব ও বিকাশ, ফলত এই সংগ্রামের বিদ্যমানতা দেখায় যে এটি মূলত কোনো দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক লড়াই নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ক্রোড়ে লালিতপালিত, রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতিফলন।   

বিজ্ঞানের গুরুত্ব আজ আর আলাদা করে বলার দরকার নেই। আমাদের নিজেদের জীবনেই আমরা চোখের সামনে দেখছি বিজ্ঞান কীভাবে পাল্টে দিচ্ছে আমাদের সভ্যতার বুনন। একে বুঝতে গেলে বিজ্ঞান এখন কী করছে তা জানার সাথে সাথে এটি কীভাবে এইরকম হয়ে উঠলো, সমাজের ধারাবাহিক রূপগুলিতে অতীতে এটি কীভাবে সাড়া দিয়েছে, এবং কীভাবে আবার তার প্রয়োজনে সমাজকে পাল্টে নিয়েছে, সে-সম্পর্কে সচেতন হওয়াও প্রয়োজন। সমাজের সাথে বিজ্ঞানের নিবিড় যোগাযোগ বুঝতে পারলে তবেই আমরা সমাজের কল্যাণকারী ভূমিকায় কীভাবে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো যায় সেটি বুঝতে পারবো।

একটি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকা বিশ্বের একটি, স্মরণের বাইরে চলে যাওয়া, প্রাচীন সমাজ থেকে, বিভিন্ন ধারণাগুলি অপরিবর্তিতভাবে নেওয়ার আশা খুবই কম। বিজ্ঞানের উৎস অধ্যয়নের কাজে আমরা যত পিছনের সময়ে চলে যাই, ততই আসলে কী হয়েছিল তা খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ে। প্রাচীন সময়ে বিজ্ঞান প্রায়শই পরিচয়যোগ্য আকারে ছিল না। সেই প্রাচীন সময়ের বিজ্ঞানকে খুঁজে নিতে হয় সেই সময়কার সাংস্কৃতিক জীবনের নানান সাধারণ দিক থেকে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যেটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট, তা হল বেঁচে থাকা ও জীবনধারনের প্রয়োজনে মানুষ কীভাবে উপলব্ধ উপাদানগুলি কার্যকরীভাবে ব্যবহার করেছে এবং দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কীভাবে সেগুলির রূপান্তর ঘটিয়েছে। বিজ্ঞানের যে মূল স্রোত, তা এসেছে আদিম মানুষের কৌশল থেকেই।

একে বোঝার এবং অনুসরণ করার চেষ্টা প্রয়োজন। অন্যথায় প্রথম দিকের সময়কালের আলোচনা পুরো বাদ দিয়ে মধ্যযুগীয় বা আধুনিক বিজ্ঞানের আলোচনায় প্রবেশ করলে, তা হবে বিভ্রান্তিকর – অনেককিছুকেই স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে মেনে নিতে হবে। আমাদের এই সৌরমণ্ডলের একটি আধুনিক উপলব্ধি হঠাৎ কোনো আধুনিক প্রতিভাধর মানুষের মাথা থেকে এসেছে, তা নয়। সেই প্রাচীনকালের গ্রীসের দার্শনিক থালেসের থেকে টলেমি, কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিওর হাত ধরে নিউটনে এসে এই আধুনিক বিশ্বচিত্র তৈরি হতে পেরেছে। এই চিত্রও চূড়ান্ত, তা নয়। আবার আদিম প্রস্তর যুগে যে নিউটনের আবিষ্কারের মতো আবিষ্কার কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না, সমাজসচেতন হলেই তা বোঝা সম্ভব।

বিজ্ঞান, তার স্বভাবগত কারণেই পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানের পদ্ধতি একটি স্থির বিষয় নয়, একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। সমাজ এবং বিশেষত এর শ্রেণি-সংক্রান্ত চরিত্রের, বিজ্ঞানের চরিত্রের সঙ্গে, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয় সামনে না-এনে বিজ্ঞানের প্রকৃত বিবেচনা সম্ভব নয়। মানুষ বা প্রকৃতির সত্য জানার একটিই সঠিক পথ রয়েছে এবং বিজ্ঞানীদের একমাত্র কাজ হল সেই পথের সন্ধান করা এবং মেনে চলা, এইরকম একটি পরম ধারণা বিজ্ঞানের ইতিহাসে বার বার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, এর নতুন নতুন পদ্ধতির ধারাবাহিক বিকাশের মাধ্যমে।

উপরে দেখানো সৌরমণ্ডলের আধুনিক ধারণার বিকাশের গতিপথ দেখায় বিজ্ঞানের আরো এক অনন্য বৈশিষ্ট– এর ক্রমসঞ্চয়নের প্রকৃতি। পূর্ববর্তী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিশাল ভাণ্ডারের উপর দাঁড়িয়েই আজকের বিজ্ঞানীর পদ্ধতিগুলি কার্যকরী হতে পেরেছে। এর সবগুলি সম্ভবত সঠিকও নয়, তবে সক্রিয় বিজ্ঞানীর ভবিষ্যতের কাজের জন্য এগুলি সবসময়েই একটি অগ্রসর প্রস্থানবিন্দু হিসাবে কাজ করেছে। বিজ্ঞানের এই ক্রমসঞ্চিত ভাণ্ডার নির্মিত হয় পর্যবেক্ষণ এবং ধারণাগুলির ক্রম দ্বারা। বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণ দিয়ে শুরু করে পরীক্ষায় যান – উদ্ভব হয় একটি তত্ত্বের। সকলেই পর্যবেক্ষণ করেন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কী এবং কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে, এবং তার থেকে কোন সাধারণ তত্ত্বে উপনীত হওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণ করেন তাঁর অনুভূতি-নিরপেক্ষ হিসাবে বিষয়গুলি এবং তাদের মধ্যেকার সম্পর্কগুলি দেখার জন্য।

যে কোনো সময়ের বিজ্ঞান হলো সেই তারিখ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সমস্ত ফলাফলের যোগফল। কিন্তু, সেই ফলাফল স্থির নয়। জানা তথ্য, নিয়ম এবং তত্ত্বের মোট সমাবেশের চেয়ে বিজ্ঞান অনেক বেশি। এটি নতুন তথ্য, নিয়ম এবং তত্ত্বগুলির একটি ক্রমাগত আবিষ্কার, সমালোচনা এবং প্রায়শই নির্মাণ এবং ধ্বংসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তা সত্বেও বিজ্ঞানের পুরো ইমারতটি ক্রমবর্ধমান, বিরামহীন ভাবে। আমরা বলতে পারি, এটি স্থায়ীভাবে মেরামতের অধীনে, কিন্তু এটি সবসময়েই ব্যবহার করা যায়।


ওয়েবডেস্ক এর পক্ষে প্রাককথন : সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply