Janam Theatre.jpeg

Safdar Hashmi: A Memoir

সুমিত গাঙ্গুলি

কিছু কিছু মৃত্যু কাঁধ থেকে নামানো যায় না। আর বর্বরতা চিরকালই নির্বোধ। সফদর হাশমির ক্ষেত্রে এমনটাই ভেবেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। তিনি লিখেছিলেন,

‘সফদার হাসমি মানে জাগা,

জেগে থাকা, জাগানো’।

Safdar Hashmi

স্টিফেন কলেজের ছাত্র, চাইলেই ভাল চাকরি করতে পারতেন তিনি, কিন্তু ছাত্র আন্দোলন থেকে আইপিটিএ, তারপর ‘জনম’ অর্থাৎ জননাট্য মঞ্চ —এই যাত্রাপথই ছিল সফদরের জীবন। তারই মধ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সদস্যপদ অর্জন। এই সফদরই আমাদের পরিচিত সফদর হাশমি।

হানিফ হাশমি এবং কমর আজাদের সন্তান সফদর ১২ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব আলীগড়ে কাটে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেন। খুব সামান্য সময়ের জন্য গাড়ওয়াল, কাশ্মীর এবং দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি প্রেস ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়াতে কাজ শুরু করেছেন। দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রেস ইনফরমেশন অফিসার হিসাবে কাজ করেন। তার অফিস ঘরে ঝোলানো থাকতো ঋত্বিক ঘটকের ছবি। তলায় ক্যাপশন ‘The unparalleled film genius’। ১৯৮৪ সালে তিনি সিপিআই(এম)-র সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কাজ করার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন।

সফদর হাশমির নাটক রাস্তায়, গলিতে, রাজপথে আলোড়ন তুলেছিল ৭০-৮০-র দশকে। জন্মলগ্ন থেকেই জনতার নজর কেড়ে নেয় জনম। একাধিক পথনাটক প্রায় প্রতিদিনই অভিনীত হতে থাকে দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। শ্রমজীবী মানুষের কন্ঠস্বরে পরিণত হয় এই নাটক।

তাত্বিক ভাবে সফদর সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে দেখেছিলেন বুর্জোয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিতান্ত্রিক শিল্প ও যৌথ শিল্প সৃজনের মধ্যেকার গুণগত পার্থক্যের দিক থেকে। তিনি লেখেন, ‘The issue is not where the play is performed (and street theatre is only a mode of ensuring that art is available to the people), but the principal issue is the ‘definite and unresolvable contradiction between the bourgeois individualist view of art and the people’s collectivist view of art’.

১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সাধারন দর্শকদের জন্য খোলা আকাশের নিচেই ‘জনম’ প্রসেনিয়াম ও স্ট্রিট থিয়েটার মঞ্চস্থ করত। যখন ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং রাজনৈতিক থিয়েটার করা কঠিন হয়ে ওঠে, তখন সফদার হাশমি গাড়োয়াল, কাশ্মীর এবং দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতে শুরু করেন।

জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে তিনি আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসেন। ১৯৭৮ সালে জনম স্ট্রিট থিয়েটারে বড় পরিসরে কাজ শুরু করে। ‘মেশিন’ নামে একটি নাটক ২০ নভেম্বর ১৯৭৮ তারিখে ২,০০,০০০-এর বেশি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সভায় মঞ্চস্থ করা হয়। এরপর একে একে মঞ্চস্থ হয় কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে ‘গাঁও সে শহর তক’, ফ্যাসিবাদ বিষয়ক নাটক ‘হত্যারে’ ও ‘অপহরণ ভাইচারের কে’, বেকারত্ব নিয়ে ‘তিন কোটি’, নারীদের অবস্থা  নিয়ে ‘অওরাত’ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ে ‘ডিটিসি কি ধান্ধলি’।

হাশমি কয়েকটি তথ্যচিত্র এবং দূরদর্শনের জন্য একটি টিভি ধারাবাহিকও তৈরি করেন। যার মধ্যে ‘খিলতি কলিয়ান’ গ্রামীণ ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোকপাত করে। তিনি শিশুদের জন্য বই এবং ভারতীয় মঞ্চের সমালোচনাও লিখেছেন।

হাশমি ছিলেন জনম-এর পরিচালক এবং তার মৃত্যুর আগে সংগঠনটি শ্রমজীবী অঞ্চল, কারখানা এবং ওয়ার্কশপে ২৪টি স্ট্রিট থিয়েটারের প্রায় ৪,০০০ প্রদর্শনী মঞ্চস্থ করে।

১৯৭৯ সালে তিনি সহকর্মী ও থিয়েটার অভিনেত্রী মলয়শ্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীকালে তিনি প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই) এবং ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’-এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন।

হাশমির রচনার মধ্যে দু’টি প্রোসেনিয়াম নাটক। প্রথমটি, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘এনিমিজ’ (১৯৮৩)-র রূপান্তর এবং ‘মোটেরামের সত্যাগ্রহ’ (এই নাটকে তিনি হাবিব তানভীরের সঙ্গে কাজ করেন,  ১৯৮৮ সালে)। এছাড়া অসংখ্য গান, টেলিভিশন সিরিজের চিত্রনাট্য, শিশুদের জন্য কবিতা ও নাটক এবং তথ্যচিত্র রয়েছে।

তাঁর সৃষ্টির আওয়াজ পৌঁছে যায় ক্ষমতার অলিন্দে বসা তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের কানে।

১৯৮৯ সালে ১ জানুয়ারি দিল্লিরই অদূরে শাহিবাবাগের ঝান্ডাপুরে পুলিশের নেতৃত্বে জনমের ওপর চড়াও হয় একদল লোক। লাঠি-রড দিয়ে এলোপাথারি মারধর করে সফদরকে। তাঁকে হাদপাতালে নিয়ে গিয়েও কোনও লাভ হয়নি। মাথার গুরুতর আঘাতের কারনে ২ জানুয়ারি মারা যান সফদর। তাঁর সঙ্গে প্রাণ হারান এক শ্রমিক, রাম বাহাদুর।

ওই বছরেরই ১০ জানুয়ারি দিল্লির সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলার সুযোগ পেয়ে শাবানা আজমি বলেন, “দিল্লি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে শাহিবাবাদ শহরে একটি পথ নাটক করার সময়, ১লা জানুয়ারী, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সদস্য এবং একজন সুপরিচিত সাংস্কৃতিক কর্মী সফদার হাশমিকে প্রকাশ্য দিবালোকে কংগ্রেস(আই) সমর্থক প্রার্থীর অনুগামীরা হত্যা করে। থিয়েটারে কাজ করার পাশাপাশি, সফদার একজন সমালোচক, অভিনেতা এবং ভাষ্যকার হিসাবে সিনেমাতেও অবদান রেখেছিলেন। আমরা চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং চলচ্চিত্রপ্রেমীরা এমন একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ জানাতে চাই যা একদিকে সৃজনশীলতাকে প্রচার করার দাবি করে এবং অন্যদিকে সাংস্কৃতিক কর্মীদের হত্যায় জড়িত থাকে।”

১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা পরবর্তী দিল্লিতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সফদর সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। আক্রান্ত মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার থেকে দাঙ্গা বিরোধী মিছিল সংগঠিত করার এক প্রধান নেতা ছিলেন তিনি। ‘কমিটি ফর কমিউনাল হার্মনি’র সবচেয়ে কমবয়সি নেতা ছিলেন সফদর। সফদরের সম্প্রীতির পক্ষে অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ একটি সংগঠন ওঁকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার  দিতে চায়। কিন্তু সফদর শর্ত দেন, ব্যক্তি সফদরকে নয়, দলকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। সংগঠকরা সফদরের এই প্রস্তাবে সম্মত হন। এরপর দেখা যায় পুরস্কারটি হাতে তুলে দেবেন তৎকালীন তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী, কংগ্রেস সাংসদ, হরি কৃষ্ণ লাল ভগত। ৮৪ সালের দাঙ্গায় এরই নামে শিখ নিধনের অভিযোগ ছিল। এই লোকটাকে দিয়ে জন নাট্যমঞ্চকে পুরস্কার দেওয়া হবে তাদের দাঙ্গা বিরোধী অবস্থানের জন্য! সফদর এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখ্যানের কারণ জানাতেই ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের দু’তারিখ প্রেস কনফারেন্স ডাকেন।

এই প্রেস কনফারেন্সে সফদর নিজেই রয়ে গেলেন অনুপস্থিত। এই প্রেস কনফারেন্স থেকেই সফদরের মৃত্যুর সংবাদ জানান ভারতীয় – হাবিব তানভির, গোবিন্দ দেশপাণ্ডে, এম কে রায়না। যে কনফারেন্স থেকে সফদর জানাতে চেয়েছিলেন– জাতি দাঙ্গায় ইন্ধন দেওয়াদের তাদের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করবেন না। কংগ্রেসী গুন্ডা মুকেশ শর্মা সফদরকে খুন করে সেই সুযোগটাই দেননি।

 কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের নাম সফদর হাশমি। জনম আজও রয়েছে। ২০১২ সালের ১২ এপ্রিল, হাশমির জন্মদিনে, দিল্লির  পটেল নগরের কাছাকাছি শাদি খাম্পুরে ‘স্টুডিও সফদার’ তৈরী করেছে। এর পাশেই একটি ক্যাফে ও বইয়ের দোকান, নাম ‘মে ডে বুকস্টোর’।

১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে, লেখক ভীষ্ম সাহনি এবং আরও অনেক শিল্পী মিলে ‘সফদার হাশমি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ (SAHMAT) প্রতিষ্ঠা করেন, যা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন শিল্পীদের জন্য একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। সফদার হাশমির লেখাগুলো পরবর্তীতে ‘The Right to Perform: Selected Writings of Safdar Hashmi’ (নতুন দিল্লি, ১৯৮৯) নামে প্রকাশিত হয়। 

প্রতি বছর ১ জানুয়ারি SAHMAT সফদার হাশমি মেমোরিয়াল ডে পালন করে ‘দৃঢ়তা দিবস’ হিসাবে, এবং দিল্লিতে ‘যশ্ন-ই-দৌরা’ নামে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করে। জনমও এই দিনটি পালন করে সাহিবাবাদের ঝান্ডাপুর গ্রামে স্ট্রিট থিয়েটারের আয়োজন করে, যেখানে সফদারকে হত্যা করা হয়েছিল।

১৯৯৮ সালে কেরালার কোঝিকোড়ে ‘সফদার হাশমি নাট্যসংঘম’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে থিয়েটার প্রশিক্ষণ দেয়।

সুন্দর সি পরিচালিত ২০০৩ সালের চলচ্চিত্র ‘আনবে সিভম’ এবং রাজকুমার সন্তোষী পরিচালিত ২০০৮ সালের ‘হল্লা বোল’  তার জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত। ‘হল্লা বোল’ চলচ্চিত্রে একটি দৃশ্য আছে, যেখানে স্ট্রিট থিয়েটারের এক কর্মীকে রাজনৈতিক দলের ভাড়া করা লোকেরা মারধর করে। এই ঘটনাই জনতার বিপ্লবের অনুঘটক হয়ে ওঠে।

১৯৮৯ সালে শিল্পী এম এফ হুসেন ‘ট্রিবিউট টু হাশমি’ নামে একটি চিত্রকর্ম তৈরি করেন, যা নিলামে ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যে বিক্রি হয়।

২০২০ সালে প্রকাশিত সুধন্ব দেশপান্ডে রচিত ‘Halla Bol: The Death and Life of Safdar Hashmi’ বইটিতে জনমের ‘হল্লা বোল’ নাটক মঞ্চস্থ করার সময় হাশমির ওপর হামলার ঘটনাবলীর বর্ণনা রয়েছে।  

লখনউ এর সংস্থা IRDS সফদার হাশমির মানবাধিকার সম্পর্কিত অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘সফদার হাশমি মানবাধিকার পুরস্কার’ প্রদান করে। দিল্লির মান্ডি হাউজের একটি রাস্তার নাম তার নামে রাখা হয়েছে।

সফদর যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তাঁর থিয়েটারের পদ্ধতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। উৎপল দত্ত নিজেই বলেছিলেন রাজনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছে এই ধাঁচ চলতে পারে, সর্বত্র নয়। কিন্তু যখন শিল্প কর্পোরেটের অনুগ্রাহী হয়ে যায়, পরিণত হয় শাসকের হাতের পুতুলে তখনই শুরু হয় সফদর হাসমির নাটক। তখন রাস্তায় রাস্তায় গান লেখেন সুর দেন সলিল চৌধুরী, কবিতা লেখেন সুকান্ত, সাহির, শৈলেন্দ্র, নাটক হয় উৎপল দত্ত, সফদর হাসমি, হাবীব তনবীর, জোছন দস্তিদারের পরিচালনায়, চলচ্চিত্র তৈরি করেন ঋত্বিক ঘটক। অভিনয় করেন একে হাঙ্গল, বলরাজ সাহনিরা। আর প্রতিবাদের কন্ঠস্বর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বলে – ‘বোল মজুরেঁ হাল্লা বোল’।

সফদর আজও রয়েছেন। চশমার ফাঁক থেকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে দেখছেন। হাসছেন… জানেন এ আঁধারের রাত কেটে যাবে।

তথ্যসুত্রঃ

Safdar Hashmi, The Enchanted Arch, Or the Individual and Collective Views of Art

(April 1983), The Right to Perform, pp. 28–29

ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

Spread the word

Leave a Reply