বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কম্যুনিস্ট’ প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথের উত্তর, ‘সনাতন’-র বিদায় বিপ্লবে

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন কমিউনিস্ট, সোসালিস্টদের সম্পর্কে লিখছেন।
লেনিন তখন শিশু — ৭বছরের।

১৮৭৭। বাংলা ক্যালেন্ডারে ১২৮৪। জ্যৈষ্ট মাস। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘আনন্দমঠ’-র লেখকের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল — ‘বাহুবল ও বাক্যবল।’ সেই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন,‘‘যে সকল সামাজিক দুঃখ নিত্য ও অনিবার্য, তাহাও উচ্ছেদের জন্য মনুষ্য যত্নবান হইয়া থাকে। সামাজিক দারিদ্রতা নিবারণের জন্য যাহারা চেষ্টিত, ইউরোপে সোশিয়ালিস্ট, কম্যুনিস্ট প্রভৃতি নামে তাহারা খ্যাত।’

এর ১৭বছর পর বঙ্কিমচন্দ্র যখন মৃত্যুশয্যায়, লেনিন তখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। ১৮৯৪। লেনিন একটি বই লিখলেন — ‘জনগনের বন্ধুরা’ কেমন এবং কিভাবে তারা সোসাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে লড়ছে।’ এই বইটিতে লেনিন অতিবামপন্থী বুলি আওড়ানো, আসলে আপোষকামী এবং ধনী কৃষকদের স্বার্থরক্ষার কাজ করা নারদনিকদের চরিত্র তুলে ধরেন।

কোনও কোনও গবেষকের মতে বাংলায় ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটি প্রথম উল্লেখ করেন বঙ্কিমচন্দ্রই। এমনকি তাঁর লেখায় প্রথম আন্তর্জাতিক গঠনের তথ্যও পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলায় মার্কসবাদ চর্চা তখনও শুরু হয়নি। গড়ে ওঠেনি তেমন কোনও সংগঠন। যা প্লেখানভ জেনেভায় গড়ে ফেলেছেন ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ — প্রথম মার্সবাদী সংগঠন, ১৮৮৩-তে। ১৮৯৪-এ লেনিন পুরোদস্তুর মার্কসবাদী।

ভারত এবং রাশিয়া, কিংবা বাংলা এবং রাশিয়ার তুলনা আসছে কেন? কারন ভারত আর রাশিয়ার তুলনা লিখিত আকারে পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত দু’বার।

একবার ১৮৬৩-তে। প্লেখানভের ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ গড়ে ওঠার আগেই। আর একবার ১৯৩০-এ। প্রথমবার তুলনা শুনেছিলেন রেভারেন্ড জেম্‌স লঙ। রাশিয়াতেই। দ্বিতীয়বার রাশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের তুলনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

‘নীলদর্পন’ নাটকের ইংরাজি অনুবাদ করে জেম্‌স লঙ ব্রিটিশ শাসিত ভারতে একবছর কারাবাসের দন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন। জরিমানাও হয়েছিল তাঁর। সেই মামলার পর তিনি ইংল্যান্ড হয়ে রাশিয়া যান। রাশিয়ায় গিয়ে তৎকালীন সেই দেশ এবং বাংলার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। মূলত কৃষকদের যন্ত্রণায়।

রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন পার্থক্য। রাশিয়া সফরের সময় ১৯৩০-র ২০শে সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চিঠিতে লেখেন,‘‘আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশ জুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে যেতে পারত তা হলে ভারি উপকার হত। প্রতিদিনই আমি ভারতবর্ষের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে দেখি আর ভাবি, কী হয়েছে আর কী হতে পারত। আমার আমেরিকান সঙ্গী ডাক্তার হ্যারি টিম্বরস্‌ এখানকার স্বাস্থ্যবিধানের ব্যবস্থা আলোচনা করছে — তার প্রকৃষ্টতা দেখলে চমক লাগে — আর কোথায় পড়ে আছে রোগতপ্ত অভুক্ত হতভাগ্য নিরুপায় ভারতবর্ষ! কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের অবস্থার সঙ্গে এদের জনসাধারনের অবস্থার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য ছিল — এই অল্পকালের মধ্যে দ্রুত বেগে বদলে গেছে — আমরা পড়ে আছি জড়তার পাঁকের মধ্যে আকন্ঠ নিমগ্ন।’’

রাশিয়ার এই গুণগত পরিবর্তনের অনুঘটক ছিল নভেম্বর বিপ্লব। পৃথিবী জানে। ‘কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের’ মত রাশিয়াকে বলা হত ‘ইউরোপের পিছনের উঠোন।’ বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়া সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি কী ছিল? তাঁর দেখা রাশিয়াকে তিনি অভিহিত করলেন,‘পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাঙ্গন দ্বার।’ ঠিক কী লিখলেন ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩০-র চিঠিতে? কবি লিখলেন,‘‘মনে মনে ভাবছিলুম, ধনশক্তিতে দুর্জয় পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাঙ্গনদ্বারে ঐ রাশিয়া আজ নির্ধনের শক্তিসাধনার আসন পেতেছে সমস্ত পশ্চিম-মহাদেশের ভ্রূকুটিকুটিল কটাক্ষকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, এটা দেখবার জন্যে আমি যাবো না তো কে যাবে?’’

তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির বেশ কয়েকটি উপাদানের উল্লেখ আছে বাক্যটিতে। আর আছে সোভিয়েত সম্পর্কে প্রগাঢ় সমর্থন এবং অসীম শ্রদ্ধা।

কিন্তু ভারতের সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল যে রাশিয়ার, সেই ‘ইউরোপের পিছনের উঠোন’ কেমন ছিল?

রেভারেন্ড জেম্‌স লঙের রাশিয়া ভ্রমণের বিবরণে আছে তার ছবি।

১৮৬৪-র ৬ই জুন ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এ প্রকাশিত হয়েছিল জেম্‌স লঙের রাশিয়া সফরের বিবরণ। সেখানে লেখা হয়েছিল,‘‘রাশিয়ার ভূমিদাসকে দেখে তাঁর বাংলার রায়তের কথা মনে হয়েছিল, কারণ উভয়ের বিশেষ কোনও পার্থক্য ছিল না, এবং এক বর্ণের সামাজিক ও নৈতিক অবস্থা অন্য বর্ণের মতোই ছিল।’’

লঙ বলেছিলেন,‘‘আমি দেখে অবাক হয়েছিলাম যে সেন্ট পিটার্সবার্গের অনেকেই নীলদর্পণ মামলা সম্পর্কে অবহিত এবং বিভিন্ন জায়গায় আমাকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল…ভারত ও রাশিয়ার কৃষকদের তুলনামূলক অবস্থা নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ ও আগ্রহজনক কথাবার্তা হয়েছিল।…আমার কথা শেষ হবার পর তাঁরা বললেন যে নানা দিক দিয়ে বাংলার কৃষকদের অবস্থা প্রায় রাশিয়ার ভূমিদাসদের মতোই খারাপ।’’

এমন একটি দেশকে বদলে দিয়েছিল বিপ্লব। বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী — বলশেভিক পার্টি।

কেমন ছিল রাশিয়ার অর্থনীতি? ‘রুশদেশে পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ’ বইয়ে লেনিন ১৮৯৭-র জনগণনার পরিসংখ্যান উল্লেখ করে দেখান যে, দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১/৬ ভাগ ছিল ছোট, বড় কারখানা, নির্মাণ শিল্পে, ব্যবসায়ে, রেলপথ ও জলপথ, কাঠের ব্যবসাসহ এই ধরনের কাজে যুক্ত। বাকি ৫/৬ ভাগ ছিল কৃষিকাজে। সেই কৃষিকাজে ছিল জমিদারদের মারাত্মক অত্যাচার। ১৮৬১-তে ভূমিদাস প্রথা রদ হয়। কিন্তু তাতে কৃষকের অবস্থার দারুন কোনও পরিবর্তন হয়নি। ‘গ্রামের গরিবদের প্রতি’ লিখতে গিয়ে লেনিন দেখান তখন রাশিয়ায় প্রায় ১কোটি কৃষক পরিবার ছিল। এর মধ্যে অন্তত ৩৫লক্ষের অবস্থা এমন ছিল যে, তাঁদের চাষের কাজে প্রয়োজনীয় একটি ঘোড়াও ছিল না। আবার এই পরিস্থিতিতেই রেলপথ তৈরির কাজের হাত ধরে ১৮৯০-১৯০০-র মধ্যে রাশিয়ায় বড় বড় কারখানা গড়ে ওঠে। আর তার ফলে আধুনিক শিল্পের সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর জন্ম হয় — ১৯০০ সালের আগেই তাঁদের সংখ্যা প্রায় ২০লক্ষে পৌঁছে যায়।

কিন্তু পুঁজিবাদ প্রসারমান হলেও রাশিয়া তখন ছিল মূলত কৃষি নির্ভর, অর্থনীতির দিক থেকে পিছিয়ে থাকা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিকানার উপর ভিত্তি করে স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন শিল্পভিত্তিক দেশ। রাশিয়ায় বহাল ছিল জার-জমিদারতন্ত্র এবং জঘন্য স্বৈরতন্ত্র। অনেক জাতির বসবাস ছিল রাশিয়ায়। কিন্তু রাশিয়া ছিল সেই জাতিগুলির একটি কয়েদখানা। জাতির আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্ন তাই ছিল নভেম্বর বিপ্লবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

এমন দেশ স্বভাবতই ‘ইউরোপের পিছনের উঠোন’ হিসাবে চিহ্নিত হবে। তাই হয়েছিল।

রাশিয়ায় বিপ্লবের বিজয়ের, লেনিনের কথায় ‘বিজয়দৃপ্ত অভিযান’-র ৫টি মোদ্দা কারন চিহ্নিত করেছিল বলশেভিক পার্টি। সেখানে রাশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণীর দুর্বলতা, জারের সঙ্গে তাদের গাঁটছড়া, জমিদারদের স্বার্থরক্ষা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে চলার সুবিধা, শ্রমিক শ্রেণীর অনবদ্য নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা এবং মতাদর্শগতভাবে শক্তিশালী, পরীক্ষিত বলশেভিক পার্টির মত রাজনৈতিক সংগঠনের উপস্থিতির মত কারনের উল্লেখ আছে।

এছাড়া আরও একটি কারন চিহ্নিত করেছিল লেনিনের পার্টি। তা হলো শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর প্রশ্ন। কৃষক সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট অংশের ছিল শ্রমিক শ্রেণীর বলিষ্ঠ মিত্রর ভূমিকায়। যে মধ্য কৃষকরা দীর্ঘদিন দোদুল্যমান ছিল, তারাও নভেম্বর বিপ্লবের আগে গরিব কৃষকের সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়েছিল। শ্রমিক-কৃষকের এই মৈত্রীই ছিল নভেম্বর বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।

বুখারিন দাবি করেছিলেন যে কৃষকরা বুর্জোয়াদের পক্ষে। তারা সেই সময়ে চলা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পক্ষে। স্তালিন তার উত্তরে ব্যাখ্যা করেছিলেন কৃষক সমাজের বিভিন্ন স্তর। কেন গরিব কৃষকরা শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব চায় এবং বিপ্লবের অগ্রগতি, বিজয়ের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর পাশে থাকবে। নভেম্বর বিপ্লবে হয়েছিলও তাই।

আর আছে একটি ছোট কাহিনী।

নভেম্বর বিপ্লবের তিন মাস আগে হয়েছিল বলশেভিক পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেসন। পেত্রোগ্রাদে গোপনে হয়েছিল সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের সম্মেলন — ১৯১৭-র ২৬শে জুলাই থেকে ৩রা আগস্ট। লেনিন ছিলেন না সেই সম্মেলনে। তিনি তখন আত্মগোপনে — রাজলিভ স্টেশনের কাছে একটি পোড়ো ঘরে। ২৮৫ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ট্রটস্কির পক্ষাবলম্বী প্রেওব্রাঝেন্সকি সেই সম্মেলনে প্রস্তাব করেন যে রাষ্ট্রশক্তি দখলসংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা উচিত যে পশ্চিমে সর্বহারা বিপ্লব না হলে রাশিয়াকে সমাজতন্ত্রের দিকে পরিচালিত করা যাবে না।

জবাব দিয়েছিলেন স্তালিন।

স্তালিন বলেছিলেন,‘‘শুধু ইউরোপই যে আমাদের পথ দেখাবে, এই প্রাচীন ধারনা আমাদের ত্যাগ করতে হবে, মার্কসবাদ দুই রকমের হতে পারে — শাস্ত্রসর্বস্ব আর সৃজনশীল। আমি সৃজনশীল মার্কসবাদেরই পক্ষপাতি।’’

সৃজনশীল মার্কসবাদ কী করতে পারে?

রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণকে ‘তীর্থদর্শন’-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আর বলেছিলেন,‘সনাতন বলে যে পদার্থটা মানুষের অস্থিমজ্জায় মনে-প্রাণে হাজারখানা হয়ে আঁকড়ে আছে’ রাশিয়া সেই ‘‘সনাতনের গদি দিয়েছে ঝাঁটিয়ে, নূতনের জন্যে একেবারে নূতন আসন বানিয়ে দিলে।’’

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘অনিবার্য সামাজিক দুঃখ’ পরাজিত হয়েছে রাশিয়ায় ‘নূতনের জন্য আসন’ নির্মাণের বিপ্লবে।

Spread the word

Leave a Reply