Remembering Chandrasekhar Azad

অঞ্জন বসু

১১৮ বছর আগে অমর এই বিপ্লবীর জন্ম হয়েছিল ১৯০৬ সালের ২৩ শে জুলাই | দেশের মানুষ গদ্দারদের নিয়ে আর রাজ্যের মানুষ চাল চোর ,কাটমানি খোরদের নিয়ে মেতে আছে ,কে খোঁজ রাখে আজাদ এর মত বিপ্লবীদের |

সে দিনটা একটু অন্যরকম ছিলো, বলিষ্ঠ ও দীর্ঘকায় মানুষটির মুখ থমথম করছে রাগে এবং প্রিয় “কমরেডদের” হারানোর সম্ভাব্য বেদনায় (কমরেড শব্দটি ব্যবহার করলাম কারণ ভগৎ সিংও তার সাথীদের কমরেড বলতেন) |

যে কমরেডদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ” হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন ” আজ সেই কমরেডদের মধ্যে তিনজনের উপর মৃত্যুর খাঁড়া ঝুলছে, যে কোনো সময় ব্রিটিশ আদালত ভগৎ সিং,সুখদেব ও রাজগুরু’র ফাঁসির আদেশ ঘোষণা করতে পারে |

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেক বিপ্লবী সুখদেওরাজ তিনি বললেন “পন্ডিতজী ইংরেজ পুলিশ সারা দেশ তোলপাড় করে আপনাকে খুঁজছে, সমস্ত পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশ জুড়ে পোষ্টারে পোষ্টারে ছয়লাপ করে ফেলেছে আপনার গ্রেপ্তারীর জন্য,আপনি রাশিয়া চলে যান ” |

ফুঁসে উঠলেন পন্ডিতজী তথা সেই দীর্ঘকায় মানুষটি “পালিয়ে যাবো? বিসমিল,আশফাক ,রোশন সিং ,রাজেন্দ্রনাথদের আত্মত্যাগকে ভুলে যাবো? ভগৎকে ভুলে যাবো? একজন বিপ্লবী কখনোও আত্মসমর্পণ করে না সুখদেওরাজ সে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে|”

আর তাছাড়া যতক্ষণ আমার কাছে এই পিস্তল আর চল্লিশটা বুলেট রয়েছে ততোক্ষণ পুলিশের ক্ষমতা নেই আমাকে গ্রেপ্তার করে,আমি আজাদ ছিলাম,আজাদ আছি এবং আজাদই থাকবো “|

উপরিউক্ত ঘটনার তারিখ ছিলো ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ , স্থান এলাহাবাদের আলফ্রেড পার্ক (বর্তমানে যেটি শহিদ চন্দ্রশেখর আজাদ পার্ক নামে পরিচিত ) , সেই পার্কে বসেই দীর্ঘকায় মানুষটি ও সুখদেওরাজ কথাবার্তা বলছিলেন |

অন্যদিকে দশ হাজার টাকার পুরস্কার বীরভদ্র তেওয়ারীর মনে লোভের জন্ম দিয়েছে ,এই তো সুযোগ চন্দ্রশেখর আজাদকে ধরিয়ে দিতে পারলেই নগদ কড়কড়ে দশ হাজার টাকা পকেটে ঢুকবে , এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়? অতএব সে চুপিচুপি থানার দিকে চললো |

“কি বলছিস চন্দ্রশেখর আজাদ আলফ্রেড পার্কে রয়েছে”?

জি হুজুর নিজের চোখে দেখেছি ,আজাদ এবং তার এক সাথী রয়েছেন সেখানে |

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন ডি এসপি বিশ্বেশ্বর সিং “পেয়েছি আজাদকে হাতের মুঠোয়, ধরতে পারলেই প্রোমোশন পাক্কা,উফ ব্যাটা কম জ্বালিয়েছে ইংরেজ সরকারকে?”

নিমেষে খবর চলে গেলো সবকটা জায়গায় ” দু গাড়ী ভর্তি সশস্ত্র পুলিশ ” রওনা দিলো আলফ্রেড পার্কের দিকে ,উত্তেজনায় ফুটছে বিশ্বেশ্বর সিং |

সেই দীর্ঘকায় মানুষটিই ছিলেন অকুতোভয় বীর শহিদ চন্দ্রশেখর আজাদ ,যার নামে ইংরেজ পুলিশ তো বটেই গুন্ডারাও ভয় পেতো |

সেই ১৯২০ /২১ সালে অর্থাৎ অসহযোগ আন্দোলনে এলাহাবাদে নারীরা বিলিতি মদের দোকানের সামনে পিকেটিং শুরু করলে ইংরেজ সরকার গুন্ডা নামিয়ে মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে ,তখন বলিষ্ঠ চেহারার চন্দ্রশেখর আজাদ গুন্ডাদের পিটিয়ে তাদের উচিত শিক্ষা দেন |

এখানেই শেষ নয় , ১৯২৩ সালে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল,যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জি,রামপ্রসাদ বিসমিল,আশফাকউল্লা খানেদের সঙ্গে মিলিত হয়ে উত্তরপ্রদেশে ” হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন ” গঠন করেন এবং পরিকল্পনানুযায়ী ১৯২৫ সালের ৯ ই আগস্ট কাকোরী স্টেশনে ৮ নং ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে আটজন বিপ্লবী সরকারী অর্থ লুঠ করেন,চন্দ্রশেখর আজাদ এদের অন্যতম ছিলেন |

অন্যদিকে পুলিশ চিরুণী তল্লাশী চালিয়ে মোট চুয়াল্লিশ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে “কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা” শুরু করে এবং বিচারে রামপ্রসাদ বিসমিল ,আশফাকউল্লা খান,রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ি ও রোশন সিং এর ফাঁসি হয় এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে র কঠোর শাস্তি হয় |

সরকারী দমননীতির ফলে দল প্রায় ভেঙ্গে পড়ে ,তখন চন্দ্রশেখর আজাদ আত্মগোপন করে থাকাকালীন লয়ালপুরের তরুণ যুবক ভগৎ সিং এর সঙ্গে মিলিত ভাবে দলকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন , ভগৎ সিং ১৯২৮ সালের ৮ ই ও ৯ ই সেপ্টেম্বর দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে দলের নতুন নাম দেন “হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন”, এবং এই পার্টির “কম্যান্ডার ইন চিফ” হন বলরাজ ওরফে চন্দ্রশেখর আজাদ |

এখানেই শেষ নয় , ১৯২৮ সালের ৩০ শে অক্টোবর লাহোরে সাইমন কমিশন বিরোধী মিছিলে পুলিশ প্রচন্ড লাঠিচার্জ করে ,ফলে বর্ষীয়ান নেতা লালা লাজপত গুরুতর ভাবে আহত হন এবং ১৭ ই নভেম্বর লাহোর হাসপাতালে লালাজীর মৃত্যু হয় ,এই বর্বরতার যোগ্য জবাব দিতে ভগৎ সিং,রাজগুরু ,চন্দ্রশেখর আজাদ, সুখদেবের পরিকল্পনানুযায়ী ১৭ ই ডিসেম্বর লাহোরে প্রকাশ্যে পুলিশের আই জি সন্ডার্সকে হত্যা করেন এবং ছদ্মবেশে ভগৎ সিং ও দূর্গা ভাবী কলকাতায়,রাজগুরু লখনৌতে এবং চন্দ্রশেখর আজাদ সাধুর ছদ্মবেশে মথুরা চলে যান |

ঠিক একবছর পর অর্থাৎ ১৯২৯ সালের ৮ ই এপ্রিল ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লীর আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ করেন দুটি অতি স্বৈরাচারী বিল “ট্রেড ডিসপিউট” ও “পাবলিক সেফটি বিল” পাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, চন্দ্রশেখর আজাদ চাননি ভগৎ সিং যান এই অভিযানে, কারণ পুলিশ তখনোও সন্ডার্স হত্যা মামলার ফাইল বন্ধ করেনি ,কিন্তু শেষপর্যন্ত ভগৎ সিং এর যুক্তি আজাদকে মেনে নিতে বাধ্য করে যে ভগৎ সিং এই কাজ যথাযথভাবেই সম্পন্ন করতে পারবেন |

আইনসভায় বোমা নিক্ষেপের পরে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত উভয়েই আত্মসমর্পণ করেন এবং এদের দুজনের ধরা পড়ার পরেই দুর্ভাগ্যবশত সুখদেব,জয়দেব কাপুর,কমলনাথ তেওয়ারী,শিব বর্মা,গয়াপ্রসাদ এরাও ধরা পড়ে যান ,তবে এবারেও চন্দ্রশেখর আজাদ,যশপাল,ভগবতীচরণ ভোরা পুলিশের হাতের বাইরেই থেকে যান |

একদিকে ১০ই জুলাই পুন্চ হাউসে “লাহোর মামলা” শুরু হয় এবং অন্যদিকে চন্দ্রশেখর আজাদ সক্রিয় হয়ে ওঠেন রীতিমতো, ১৯২৯ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর সকালে বড়লাট লর্ড আরউইনের স্পেশ্যাল ট্রেনে বোমা নিক্ষেপ করা হয় ,তবে বড়লাট বেঁচে যান |

অন্যদিকে ১৯৩০ সালের মে মাসে বড়লাট এক নতুন আইন পাস করে জানিয়ে দেন যে “অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতেও তাদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য চলবে ” তখন চন্দ্রশেখর আজাদ ভগৎ সিং দের জেল থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন কিন্তু এই পরিকল্পনা কার্যে পরিণত হবার আগেই ১৯৩০ সালের ২৮ শে মে রাভী নদীর তীরে এক জঙ্গলে বোমা পরীক্ষার সময় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে বোমা বিস্ফোরণে শহিদ হন বিপ্লবী ভগবতীচরণ ভোরা |

শেষপর্যন্ত ১৯৩০ সালের ৭ ই অক্টোবর লাহোর মামলার রায় বেরোয় এবং ভগৎ সিং,সুখদেব ও রাজগুরুর ফাঁসির আদেশ হয় ,যা সারাদেশে তুমুল বিক্ষোভের সূচনা করে |

এবার ফিরে যাই ফ্ল্যাশব্যাকে অর্থাৎ ১৯৩১ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি আলফ্রেড পার্কে যেখান থেকে এই লেখার সূচনা , আচমকাই আজাদের হাঁটুতে এসে লাগলো একটা গুলি , কি ব্যাপার ? গুলি কে চালালো ? সামনের দিকে তাকিয়ে আজাদ দেখতে পেলেন পুরো পার্ককে ঘিরে ফেলেছে পুলিশের দু দুটো গাড়ী,এবং নেমে আসছে সশস্ত্র ইংরেজ ও ভারতীয় সেনা |

আজাদ নিমেষে একটা বড় গাছের আড়ালে চলে গেলেন এবং সুখদেওরাজকে পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজের শেষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন ,একদিকে রাইফেলধারী ব্রিটিশ সেনা ,অন্যদিকে সামান্য পিস্তল সম্বল করে যুদ্ধ চালানো এক তরুণ বিপ্লবী |

গুলির আওয়াজে কান পাতা দায়,একটা গুলি আজাদের ডান হাতকে অকেজো করে দিলেও আজাদ বাঁ হাতের অব্যর্থ লক্ষ্যে ধরাশায়ী করে দিতে লাগলেন একের পর এক ইংরেজ সেনা ও অফিসারকে , ডি এসপি বিশ্বেশ্বর সিং আজাদকে “কদর্য ভাষায় ” গালাগাল করতে থাকলে আজাদের গুলি এই শয়তানের গালের হাড় চুরমার করে দিলো ,আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো বিশ্বেশ্বর|

ওদিকে আজাদের গুলিও ফুরিয়ে আসছে,নিজেও হয়েছেন রীতিমতো আহত , অন্তত দুটো গুলি তার পেটে লেগেছে ,তরল রক্তের ধারা গড়াচ্ছে ক্ষতস্থান থেকে,সে নিয়ে চিন্তিত নন আজাদ,তার চিন্তা একটাই গুলি শেষ হয়ে গেলে যে ধরা পড়ে যেতে হবে ,কিন্তু তিনি যে ধরা দেবেন না |

পিস্তলে মাত্র একটা গুলিই অবশিষ্ট ,সেটাই নিজের জন্য রেখে ,খানিকটা মাটি তুলে নিয়ে মাথায় ঠেকালেন , এবং বললেন ” হে আমার দেশমাতৃকা,আমায় ক্ষমা করো,আমি এইটুকুই করতে পারলাম তোমার জন্য” |

তারপর পিস্তলটা মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দিলেন এবং মূহূর্তে লুটিয়ে পড়লেন “বিপ্লবী সর্বাধিনায়ক ” চন্দ্রশেখর আজাদ |

যে গাছের নীচে আজাদ শহিদ হয়েছিলেন সে গাছটি ইংরেজ সরকার রাতারাতি কেটে ফেললেও দূর্গা ভাবী সেই জায়গাতে আরেকটি গাছের চারা বসিয়ে এসেছিলেন |

চন্দ্রশেখর আজাদ চরম সাহস,আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের এক জ্বলন্ত উদাহরণ,আজাদরা মারা যাননা বরং তারা তাদের কীর্তির মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকেন মানুষের মধ্যে,আজ এই দেশে চন্দ্রশেখর আজাদের মতো মানুষদের খুব দরকার |তাঁকে জানাই প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি |

” শহিদো কি চিতায়ো পর লাগেঙ্গে হর বরষ মেলে

বতন পে মিটনে বালো কি বাকি নিশান হোগি

সরফারোশি কি তমন্না অব হামারে দিল মে হ্যায়

দেখ না হ্যায় জোর কিতনা বাজু এ কাতিল মে হ্যা”

Spread the word

Leave a Reply