প্রভাত পট্টনায়েক
আয় ও সম্পদের উপার্জন ও সম্পদের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বৈষম্য নয়া-উদারবাদী জমানায় নাটকীয় কায়দায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সত্যটুকু স্বীকার করতে কোথাও কোনও বিতর্ক নেই। প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী টমাস পিকেটি নিজস্ব লোকজনকে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণার মাধ্যমে সেই বৈষম্যের প্রকৃত চেহারা খুঁজে পেতে চেয়েছেন। সেই উদ্দেশ্যে সমীক্ষাও করতে গিয়ে তারা আয়কর সংক্রান্ত তথ্যের উপরেই মূলত নির্ভর করেছেন। এতেই জানা গেছে, সর্বোচ্চ আয় ও সম্পদের অধিকারী এমন ১ শতাংশের হাতে কোনও একটি দেশের মোট সম্পদের কত শতাংশ কুক্ষিগত রয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সত্যানুসন্ধানে সমীক্ষার জন্য এমন পদ্ধতি আদৌ কতদূর কার্যকরী সেই নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কিন্তু পিকেটির সমীক্ষালব্ধ ফলাফল এতই চমকপ্রদ যে তার চোটে কেউই আর মুখ খুলছেন না। আমরা যদি নিজেদের দেশের দিকেই তাকাই তাহলে কি দেখতে পাচ্ছি? ১৯৮২ সাল নাগাদ ভারতের সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ধনীদের হাতে দেশের মোট সম্পদের ৬ শতাংশের চাইতে অল্প কিছু বেশি সম্পত্তি ছিল। ২০১৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে সেই অংশীদারিত্ব পৌঁছে গেছে প্রায় ২২ শতাংশে। পিকেটি ও চ্যান্সেলের যৌথ সমীক্ষায় ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে বুঝতে ২০১৪ সালকে বুনিয়াদি বর্ষ (বেস ইয়ার) ধরা হয়েছে। তাতেই এমন তথ্য উঠে এসেছে। ভারতে আয়কর ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ১৯২২ সালে, তারপর থেকে আজ অবধি ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি কখনো এত উৎকট অবস্থায় উন্নীত হয়নি।
টমাস পিকেটি এমন অবস্থার একটি তাত্ত্বিক ব্যখ্যাও হাজির করেছেন। যদিও সেই তত্ত্বের গোড়ায় পুঁজিবাদী অর্থশাস্ত্র সম্বন্ধীয় এমন একটি স্বতঃসিদ্ধ তিনি যুক্ত করে রেখেছেন যার সত্যতা শুধু যে পরীক্ষামূলক ভাবেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে তা নয়, সাধারণ যুক্তি এমনকি পাগলেও একথা বোঝে যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটাই এমন যাতে বেকারির ঝামেলা কখনো মেটে না। মিটে গেলে পুঁজিবাদ নিজেই আর চলতে পারে না। কিন্তু পিকেটি নিজস্ব তাত্ত্বিক ব্যখায় সেটাই বুনিয়াদী অনুমান হিসাবে নির্ধারিত করে সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়েছেন। উপার্জন কিংবা আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধির উৎস সন্ধানে আমাদের খুব বেশি ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় না, এমনকি সেই অবস্থার একটা তাত্ত্বিক ব্যখ্যা দিতে গেলেও সমাধানসুত্রগুলি সহজেই মেলে। পুঁজিবাদী উৎপাদনে ব্যবহার্য প্রযুক্তি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ, উৎপাদনের হার সবই এর উপরে নির্ভরশীল। নয়া-উদারবাদ বিশ্ব-অর্থনীতিকে একটি সাধারণ মঞ্চে এনে হাজির করিয়েছে বলেই চলতি উৎপাদনে প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের কাজটি আগের তুলনায় সহজ হয়ে গেছে। এর প্রভাবে শ্রমজাত পণ্য উৎপাদনের হার (একটি নির্দিস্ট সময়ে পণ্য উৎপাদনের গতি) বেড়ে চলে। ফলে যে অবস্থা তৈরি হয় তাতে জিডিপি যত বাড়ে, কর্মচ্যুতির হার বাড়ে আরও বেশি। উন্নয়নের প্রতিটি পর্যায়ে সম্পদ সৃষ্টির (উৎপাদনের গড় হার) হার বাড়তে থাকে, আর সেই প্রত্যেক পর্বেই শ্রমশক্তির উৎপাদন ক্ষমতা (লেবর প্রোডাক্টিভিটি) এমন হারে বেড়ে চলে যাতে একদিকে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়, আরেকদিকে কাজ হারানোর ঘটনা বাড়তে থাকে। সমাজে কি ঘটে? চাকরির প্রত্যাশায় লাইনে দাঁড়ানো বেকারদের (ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রে যাদের শ্রমশক্তির মজুত বাহিনী বলে) সংখ্যায় আপেক্ষিক বৃদ্ধি ঘটে। এর জোরে ন্যুনতম মজুরি কমিয়ে রাখা যায়। ফলে কম পয়সায় বাড়তি খাটিয়ে নেওয়া বৃদ্ধি পায়, মুনাফার হার আরও বেড়ে যায়। আয়ের নিরিখে উৎকট বৈষম্যের ভিত এটাই। নয়া উদারবাদ আগাগোড়া পুঁজিপতি শ্রেণিকে আরও আরও বেশি হারে বিপুল মুনাফা লুটের সুযোগ করে দিয়েছে।
ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদের পরিমানের দিকে তাকালেও একই অবস্থা দেখা যাবে। সম্পদের নিরিখে বৈষম্য পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের অন্তর্গত দেশসমূহে নয়া উদারবাদি জমানায় এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ক্রেডিট স্যুইসের তথ্য বলছে ২০০-২০২১ এই পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে, যদিও ব্রাজিল কিংবা ভারতের মতো দেশে সেই নিয়ে যেমনটা ঢাক পেটানো চলছে, আমেরিকায় ততটা হয়নি। সম্পদের বৈষম্য প্রসঙ্গে কারোর পাহাড়প্রমান সম্পদের তালিকায় স্টক মার্কেট থেকে প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে এমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ধরা হয় যে অনেকেই সেইসব হিসাবকে গুরুত্ব দিতে চান না। কুবেরের ধনের মতো ধনীদের বিপুল সম্পদের খতিয়ানও যে সন্দেহের উর্ধে না, একথাও অনেকাংশেই ঠিক। শেয়ার বাজার যখন তেজি অবস্থায় থাকে তখন স্টকের পরিমানে বাস্তবিক কোনও পরিবর্তন না হলেও শুধুমাত্র অতিসক্রিয় নড়াচড়ার (পড়ুন আদান-প্রদান) কারনেই ধনীদের সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। ঠিক উল্টোটা ঘটে যখন শেয়ার বাজারে মন্দা নেমে আসে। ২০০০ সালে ভারতে সর্বোচ্চ সম্পদশালীদের (জনসাধারণের ১ শতাংশ) মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল গোটা দেশের মোট সম্পত্তির ৩২ শতাংশ, ২০২১ সালে সেই পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৪০.৬ ব্রাজিলে শতাংশ। এই একই পর্বে বৃহৎ পুঁজিপতি ১ শতাংশের সম্পদ ছিল ৪৩ শতাংশ, হয়েছে ৪৯.৩ শতাংশ। জনসাধারণের ক্ষুদ্রতম অংশের (মাত্র ১ শতাংশের) মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণে এমন অত্যাশ্চর্য হারে বৃদ্ধির পিছনে কোনও দৈবের অদৃশ্য হাত নেই। একটু ভাবলেই উপলব্ধি করা যায়, এমনটা হওয়ার বাস্তবিক কারনগুলি আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে।
বৈষম্যের জন্য দায়ী এমনসব কারনের মধ্যে অন্যতম হল উপার্জন বা আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট ফারাক। সেই ফারাকের শিকড় নিহিত রয়েছে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পরিমাণে। নয়া-উদারবাদের প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধন সহজ হয়েছে, দ্রুততর হয়েছে। এর প্রভাবে উৎপাদনের হার বেড়েছে, উদ্বৃত্তের পরিমাণও বেড়েছে সেই অনুযায়ী। সকলেই জানি উদ্বৃত্ত উৎপাদনের উপরে মালিকানা একমাত্র পুঁজিপতির, যদিও উৎপাদনের চরিত্র সামাজিক। সুতরাং উদ্বৃত্ত উৎপাদনের হার যত বৃদ্ধি পায় মুনাফার হার বা বৈষম্যের হারও তদনুযায়ীই বেড়ে চলে। উদ্বৃত্ত সম্পদের উপরে একচেটিয়া ব্যাক্তি-মালিকানার বিষয়টিকে আলোচনার বাইরে রাখা হলে একমাত্র সঞ্চয়ের মাধ্যমেই সম্পত্তি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে এমন যুক্তি মেনে নিতে কারোর কারোর আপত্তি থাকতে পারে। তারা হয়ত বস্তুগত সম্পদে (ফিজিক্যাল অ্যাসেটস) বিনিয়োগকেই এমন সঞ্চয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রসঙ্গ বলে ধরে নেবেন। কিন্তু সেইসব বিনিয়োগ ব্যতিরেকেও সঞ্চয়ের আরেকটি কায়দার কথা মনে রাখতে হয়। কোনও একটি দেশের বাজারে নতুন কোন বিনিয়োগ নেই, তখনও সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে সেই কায়দাতেই। এতে এক দেশের সঞ্চিত অর্থ অন্য দেশকে ঋণ হিসাবে দেওয়া হয়, প্রাপ্য সুদ সহ সেই অর্থই সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম ভিত্তি। একটি দেশের মোট আয়ের পরিমাণে সেই দেশের অল্পসংখ্যক ধনীদের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি যে হারে হয়, তার চাইতেও দ্রুত হারে তাদের সঞ্চিত সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে দেশের মোট সম্পদ বৃদ্ধির হারের চাইতেও সেই দেশের পুঁজিপতিদের সম্পত্তি বৃদ্ধির হার বেশি হচ্ছে। অতএব, উপার্জন বা আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য সম্পত্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যকে বাড়িয়ে দেয়, তরান্বিত করে এমনটা কোনও কল্পনা নয়, এটাই বাস্তবতা।