শমীক লাহিড়ী
ভবিষ্যতের ঘোষণাপত্র
২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮ সাল। লন্ডনে ২৩ পাতার ছোট্ট একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হলো। লন্ডনের বিশপস গেট, ৪৬এ, লিভারপুল স্ট্রিটের ছোট্ট একটি ছাপাখানায় এটি ছাপা হয়েছিল। মাত্র কয়েকশো কপি ছেপে বেরিয়েছিল একদম সাদামাটা চেহারার পুস্তিকাটি। নাম – ‘ম্যানিফেস্টো ডেয়ার কমুনিস্টিশেন পার্টাই’ – বাংলা ভাষায় যার অর্থ কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্তেহার।
২৩ পাতার এই ঘোষণাপত্র পৃথিবীর ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবার ঠিকানা হবে, এটা সেদিন কেউই বোঝেননি। এই ঘোষণাপত্রে প্রথম শোষণহীন পৃথিবীর কথা ঘোষণা করেছিলেন কার্ল হাইনরিখ মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। এই ইশতেহারে তাঁরা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণিকে দেখালেন – পুঁজিবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এই পরাজয়কে তরান্বিত করার জন্য শ্রমিকশ্রেণির কর্তব্য পুঁজির বিরোধিতা করা ও বুর্জোয়াদের উচ্ছেদের জন্য বৈপ্লবিক সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়া। এইখানেই তাঁদের ঐতিহাসিক ঘোষণা – সমগ্র ইয়োরোপ পুঁজিবাদের ভূত দেখছে।
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে দীর্ঘ ২৪ বছর এটি আর ছাপা হয়নি। আর আজকের পৃথিবীতে, যখন প্রায় গোটা পৃথিবী পুঁজিবাদীদের দখলে, সেখানেও সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় অন্যতম এই ২৩ পাতার ঘোষণাপত্রটি।
ভূতের ভয়
মার্কসের মৃত্যুর ১৩৫ বছর বাদে পুঁজিবাদ আজও কমিউনিজমের ভূত দেখে। তারা যতই প্রচার করুক মার্কসবাদ অচল, পুরনো দস্তাবেজ – কিন্তু প্রতিদিন মার্কসবাদকে আক্রমণ করেই পুঁজিবাদের সমর্থক অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকদের বক্তৃতা করতে হয় অথবা লিখতে হয়। মার্কসবাদ যদি এত অপ্রাসঙ্গিকই হবে, তাহলে প্রতিদিন তার সমালোচনায় এত আগ্রহী কেন পুঁজিবাদীরা!
এটা ঠিক জীবদ্দশায় শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মার্কসকে প্রতিদিন সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। কখনও তাঁর বিরোধী মতবাদের বিরুদ্ধে, আবার কখনও নিজের জীবনের তীব্র দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ তাঁকে তাড়িয়েছে। কেন? কারণ তারা মার্কসের বিপ্লবী তত্ত্বকে ভয় পেয়েছিল। পুঁজিবাদের পক্ষের গবেষকরা অনেক সময়ে মার্কসকে একজন ব্যর্থ বিপ্লবী মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী প্যারি কমিউন ছিল ব্যর্থ বিপ্লব। মার্কসের কথায়, এই প্রচারে অবশ্য বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ অথবা বুদ্ধিজীবীরা কেউই প্রভাবিত হননি। তাঁরা ব্যাঙ্গ করে বলতেন, মার্কসের মৃত্যুর সময় তাঁর সমাধিতে মাত্র ১১ জন উপস্থিত ছিলেন।
তাঁরা আরও যুক্তি দেন কমিউনিস্ট ইশ্তেহার তো ২৪ বছর ধরে ছাপাই হয়নি। এমনকী ১৮৬৭ সালে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ – ‘ক্যাপিটাল’- এর প্রতিও সেই সময়ে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। ৪ বছরে মাত্র ১ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুর ৩ বছর পরে ১৮৮৬ সালে এটা প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
১৮৪৫ সালে মার্কসের লেখা ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কেউ প্রকাশই করেন নি। ঐ সময়ে তাঁর লেখা ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ অথবা ‘ইকনমিক ও ফিলসফিকাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট, ১৮৪৪’ অপ্রকাশিত ছিল ১৯২০ সাল পর্যন্ত। এইরকম অনেক উদ্ভট উদাহারণ দিয়ে মার্কসবাদ বিরোধীরা মার্কসকে আক্রমণ করেন। কিন্তু একবারও বলেন না যে – তাঁর মৃত্যুর পর এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ‘ক্যাপিটাল’-এর আরও ২টি খণ্ড প্রকাশিত হয়, যেগুলি আজও পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের মধ্যে অন্যতম।
স্বপ্নের বাস্তবায়ন
‘ইলেভেন থিসিস অন ফয়েরবাখ’ যা মার্কস ১৮৪৫ সালে লিখেছিলেন এবং ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানেই তাঁর বিখ্যাত উক্তিঃ ‘‘এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সব দার্শনিক নানাভাবে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু আসল কথা হলো পরিবর্তন করা।’’ অন্যান্য দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদদের চাইতে এইখানেই মার্কস অনন্য। তিনি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্নকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে এনেছিলেন, যাকে অস্বীকার করার মতো কোনো তত্ত্ব এখনও পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেন নি। শোষণমুক্ত সমাজ কোনো স্বপ্ন নয়, এটা সম্ভব – কেমনভাবে সম্ভব এই তত্ত্বের আবিষ্কারই মার্কসকে মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে। যাঁরা বলতেন মার্কস বিপ্লবী, কিন্তু কেবল এমনই এক স্বপ্ন দেখান, যা কখনও সম্ভব নয় – কিন্তু মাত্র ৭১ দিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘প্যারি কমিউন’ তাঁদের প্রথম ধাক্কা দিয়েছিল।
১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র গঠনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বড়ো ধাক্কা খায় মার্কসবাদ বিরোধীরা। এরপর বিংশ শতকের মধ্যভাগে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাস্তায় হেঁটেছিল।
তৎকালীন সোভিয়েতের সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদী দুনিয়ার অর্থনীতিকে পিছনে ফেলে প্রমাণ করেছিল, মার্কসের মতবাদ মানবমুক্তির এবং মানবসভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মতবাদ। ১৯২০-১৯৩০-এর দশকে যখন আমেরিকা সহ সমগ্র ইয়োরোপ গভীর আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত, তখন তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্র নিজের দেশের সব মানুষের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজ, উন্নত জীবনধারণের ব্যবস্থা করে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়াকে বলা হতো ইয়োরোপের পিছনের উঠোন, অর্থাৎ সবচাইতে পশ্চাদগামী দেশ। সেই সময় সেদেশের ৮০ শতাংশ মানুষই ছিল নিরক্ষর। ১৯১৭ সালে সেদেশের ৯১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১লক্ষ ১২ হাজার। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৪১ সালে অর্থাৎ মাত্র আড়াই দশকের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮০০, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৬ লক্ষ ৬৭ হাজার।
রবীন্দ্রনাথ ও সোভিয়েত
১৯৩০ সালে অর্থাৎ বিপ্লবের মাত্র ১৩ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণ করে তাঁর অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছিলেন – “আপাতত রাশিয়ায় এসেছি – না এলে এজন্মের তীর্থ দর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।’’ তিনি আরও লিখেছিলেন – “দেখতে পাচ্ছি, বহুদূরব্যাপী একটা ক্ষেত্র নিয়ে এরা একটা নূতন জগৎ গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে লেগে আছে। দেরি সইছে না ; কেননা জগৎ জুড়ে এদের প্রতিকুলতা, সবাই এদের বিরোধী – যত শীঘ্র পারে এদের খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে – হাতে হাতে প্রমাণ করে দিতে হবে, এরা যেটা চাচ্ছে সেটা ভুল নয়, ফাঁকি নয়। হাজার বছরের বিরুদ্ধে দশ-পনেরো বছর জিতবে বলে পণ করেছে।’’
সে দেশের জনশিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “আমি নিজের চোখে না দেখলে কোন মতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না যে, অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায়নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতের জন্য এদের সমান চেষ্টা।’’
কোন পথ – সাম্য না বৈষম্য?
আমাদের দেশে স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরেও ৬-১৭ বছর বয়সী ৩ কোটি ২২লক্ষ শিশু বিদ্যালয় শিক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেছে (২০১৭-১৮সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা) এবং ৭৪ শতাংশ যুবক-যুবতীই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় না। যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক বাদেও সব শিশু-কিশোর-তরুণকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারে না, সেই ব্যবস্থার পক্ষে কি আমরা থাকব,নাকি যে সমাজতন্ত্র দশ বছরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ নবীন প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে মনুষ্যত্বের সম্মান দিয়েছে – সেই ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রয়োগ করার লড়াই করব!
রাশিয়ার চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন – “এখানে এসে যেটা সব চেয়ে আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে এই ধনগরিমা ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এদেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহূর্তে অবারিত হয়েছে। চাষা-ভুষো সকলেই আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। এইটে দেখে আমি যেমন বিস্মিত তেমনি আনন্দিত হয়েছি।”
সবাইকে শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল কারণ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সেখানে ‘‘ধনগরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ” অবসান হয়েছিল। সব মানুষই সমান। সব মানুষেরই সমান অধিকার দেশের সম্পদের উপর – এই হলো সমাজতন্ত্রের মূল মন্ত্র। মানব সভ্যতার অগ্রগতির অর্থ গুটিকতেক মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন নয়। এখন পৃথিবীর ১ শতাংশ ধনীর হাতে সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ, বাকি ৬৯০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের দ্বিগুণ। এই পৃথিবীর ৭৫০ কোটি মানুষের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দিনে সাড়ে ৫ মার্কিন ডলারের কম রোজগার করে।
এর অর্থ কিন্তু এটা নয় যে, ভারতের গরিব মানুষ ৫×৮২=৪১০ টাকা দৈনিক রোজগার করে। ভারতীয় শ্রমজীবী মানুষের জন্য ভারত সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭৮ টাকা। আর বিরাট সংখ্যক বেকার যুবক-যুবতী কার্যত আয়হীন জীবনযাপন করে। উল্টো দিকে মুকেশ আম্বানির ২০২১ সালে দৈনিক রোজগার ছিল ২১০ কোটি টাকা এবং তাঁর বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ৭.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা। গৌতম আদানির ২০২১ সালে দৈনিক রোজগার ছিল ১৬১ কোটি টাকা এবং তাঁর একারই সম্পদের পরিমাণ ১০.৯৪ লক্ষ কোটি টাকা। ভারতে ১০ শতাংশ ধনী দেশের মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশের মালিক, বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র ২৩ শতাংশ। ‘ধনগরিমার এই ইতরতার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা’ বহাল থাকবে, নাকি এর অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই হবে – এই প্রশ্নের মুখে আজ দাঁড়িয়ে মানবসভ্যতা।
ভ্যালেন্তিনা নাকি গৃহে অন্তরীণ?
১৯৬৩ সালে রাশিয়ার সূতাকলের একজন মহিলা শ্রমিক ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা-কে মহাকাশে পাঠিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র দেখিয়েছিল নারী স্বাধীনতার অর্থ কী। আর ২০২১ সালে বিজেপি শাসিত দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে বক্তৃতা করেছেন – ভারতীয় আদর্শ নারী মানে তারা কেবলমাত্র গৃহস্থালীর কাজ করবে। যে ‘মনুস্মৃতি’ দেশের শাসকদলের সমাজ সম্পর্কিত ধারণার উৎস, সেখানে বলা হয়েছে – নারী ছেলেবেলায় পিতার অধীন, বিবাহের পর স্বামীর অধীন এবং শেষ বয়সে সন্তানের অধীন থাকবে। আমরা আমাদের দেশের নারীদের ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা তৈরির জন্য চেষ্টা করব, নাকি ‘মনুস্মৃতি’ অনুযায়ী গৃহবন্দি করে রাখব? কোন সমাজব্যবস্থার জন্য আমরা লড়াই করব?
কনসেনট্রেশন ক্যাম্প না মুক্ত আকাশ
লেনিনের নেতৃত্বে ইয়োরোপের পিছিয়ে-থাকা উঠোন হয়ে উঠেছিল শিক্ষা-বিজ্ঞান-শিল্পকলা-ক্রীড়া-প্রযুক্তি-অর্থনীতিতে পৃথিবীর অন্যতম অগ্রগামী দেশ। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর জনগণ স্তালিনের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ত হিটলার-মুসোলিনি-তোজোর ‘অক্ষ বাহিনী’-কে হারিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল। না হলে সমগ্র পৃথিবীর প্রতিবাদী ও সংখ্যালঘু মানুষকে ঢুকতে হতো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা গ্যাস চেম্বারে। সভ্যতা এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ভূমিকা এই পৃথিবী কোনদিনই ভুলতে পারবে না।
আজ সেই ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি পৃথিবীর অনেক দেশেই শোনা যাচ্ছে। আমাদের দেশের বিজেপি সরকার বিশ্ব ফ্যাসিবাদের ‘অক্ষশক্তি’তে নাম লিখিয়েছে। যদিও ট্রাম্প-বোলসোনেরো-মোদী ‘অক্ষশক্তি’র পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন অনেকটাই ধূলিসাৎ হয়েছে, প্রথম দুই ব্যক্তির নিজেদের দেশের নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ায়।কী চাই আমরা – ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সভ্যতা রক্ষার মরণপণ লড়াই, নাকি ফ্যাসিবাদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ? আজকের পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে অনেকটাই দুর্বল করেছে।
সেদিনের বিশ্ব পরিবর্তন
শুধু নিজের দেশের মানুষের জন্যই নয়, ১৯১৭-র বিপ্লব তৎকালীন পৃথিবীতে মুক্তিকামী মানুষের অন্যতম অনুপ্রেরণার কাজ করেছে।
১) নভেম্বর বিপ্লব মার্কসবাদের প্রথম সফল এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রয়োগ।
২) পৃথিবীর ১১টি সাম্রাজ্যবাদী দেশ ১০৭টি দেশকে পরাধীন করে রেখেছিল। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে অনুপ্রাণিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলন একের পর এক দেশকে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত করেছিল। ৬০টি দেশ স্বাধীন হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে।
৩) ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই প্রায় একাই করতে হয়েছিল সোভিয়েতকে। ২ কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল সোভিয়েত। গোটা পূর্ব ইয়োরোপ, পোলান্ড, পূর্ব জার্মানি, যুগোস্লোভিযা, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়ায় তৈরি হয়েছিল সমাজতন্ত্র। তৈরি হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক শিবির। পৃথিবীর সামরিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছিল। বিপ্লব হলো চীনে। ভিয়েতনাম, গণতান্ত্রিক কোরিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, কিউবা শুধু মুক্ত হলো তাই নয়, সেখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলো।
৪) শুধু ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার নয় – শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কাজ, খাদ্য ইত্যাদি অধিকার মৌলিক অধিকার রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নয়া সোভিয়েতে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবকে রুখতে পুঁজিবাদী দেশগুলিও ‘সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও অর্থনীতি’ তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিল।
৫) জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছিল নয়া সোভিয়েতে। এর আগে আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, চেচনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া ইত্যাদি দেশগুলি ছিল জাতিদাঙ্গায় জর্জরিত। ৭৪ বছরের সোভিয়েতের ইতিহাসে জাতিদাঙ্গার একটিও ঘটনা ঘটেনি। ১৯৯১-এর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, আর জাতিদাঙ্গা-যুদ্ধ এখন প্রতিদিনই বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এই দেশগুলিতে।
৬) শুধু অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক নয়, চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল সমাজবাদ। শুধু একার জন্য ভোগ নয়, সামাজিক চাহিদা পূরণের দর্শন এসেছিল মানুষের চেতনায়। সামাজিক মূল্যবোধ তৈরির কাজ – সমাজবাদের অন্যতম কথা।
আজকের বিশ্ব ও পুঁজিবাদ
আজ পুঁজিবাদী দুনিয়ার সবচাইতে বড়ো অসুখ ভোগবাদ। পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত একমুখী পৃথিবী আজ অসাম্য, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব, যুদ্ধ ও জাতিদাঙ্গায় বিধ্বস্ত।
পুঁজিবাদের প্রবল সমর্থক প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা, যিনি ‘The End of History and The Last Man’ লেখা বইয়ে পুঁজিবাদের অমরত্ব এবং সমাজতন্ত্রের মৃত্যু নিশ্চিত বলে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সাম্প্রতিককালে (১৭ অক্টোবর,২০১৮) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমার মনে হচ্ছে আজকের এই যুগসন্ধিক্ষণে কার্ল মার্কসের কয়েকটি কথা অত্যন্ত সত্য। অতিরিক্ত উৎপাদনের সংকট প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছিলেন – এর ফলে শ্রমিকশ্রেণির দুরাবস্থা আরও বাড়বে এবং বাজারে চাহিদাও অনেক কমবে, এটা ক্রমে সত্য বলেই প্রমাণিত হচ্ছে আজ।” তিনি সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে ঐ সাক্ষাৎকারে আরও বলেছেন – “বর্তমানে আয় এবং সম্পদের ভয়ংকর অসাম্য দেখা দিয়েছে। বণ্টন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করার প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবলমাত্র ফিরে আসতে পারে তাই নয়, এটা ফিরে আসা জরুরি। রেগান-থ্যাচার যে অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণাকে সামনে রেখে, যা এখনও চলছে, সেটা আজ নানাভাবে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে গেছে।”
ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন – “সামাজিক সাম্যের প্রশ্নে বর্তমান বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থা শ্রমিক সংগঠনগুলিকে ভীষণভাবে দুর্বল করেছে, যার ফলে তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা কমেছে এবং এক শ্রেণির ধনিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, যারা সর্বত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে।”
বিকল্পের সন্ধানে
আজকের পৃথিবীর সামনে নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থায় লগ্নিপুঁজির দাপটে অসহায় মানুষ বিকল্পের সন্ধান করছে। সমাজতন্ত্রই এর বিকল্প হতে পারে। একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের অন্ধ অনুকরণ হবে না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-সভ্যতা-সংস্কৃতি-গণতন্ত্র-ব্যক্তি অধিকারের অগ্রগতির সাথে সাযুজ্য রেখেই গড়ে উঠবে একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র, যা আজকের পৃথিবীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের দুর্দশার অবসান ঘটাতে পারে।
১৯১৭ সালের বিপ্লব ও ১৯৯১ সালে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের ঘটনাগুলি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অনেক অভিজ্ঞতা দিয়েছে। কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদা পূরণের যথাযথ উদ্যোগও অত্যন্ত জরুরি আজকের পৃথিবীতে। বাজার ব্যবস্থার অবসান সমাজতন্ত্রে কখনই হয় না, কিন্তু বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রের হাতে। তাই মানুষের প্রয়োজন এবং ইচ্ছার ভিত্তিতে বাজারের চাহিদা বৃদ্ধি ও তার জোগান নিশ্চিত করাও সমাজতন্ত্রের অন্যতম লক্ষ্য। সমাজতন্ত্র মানে দারিদ্র্যের সমবণ্টন নয় বরং প্রাচুর্যের সমবণ্টন। কয়েকজন বিলিওনিয়ার তৈরি নয়, এই ব্যবস্থায় সমাজে যে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হবে, তা সমগ্র সমাজের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করাই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য।
কেবলমাত্র ভোট দেওয়ার অধিকার নয় অথবা ভোটের আগের রাতে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে ভোট বিক্রির অধিকার নয় – সমাজতন্ত্র সবাইকে শিক্ষা-চিকিৎসা-বস্ত্র-খাদ্য-বাসস্থানের মৌলিক অধিকার দেয়। পুঁজিবাদ ভোটের অধিকারের বিনিময়ে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়।
নতুন সমাজতন্ত্রের লড়াই
এই মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষার লড়াই আজ পৃথিবীর মানুষের কাছে দারিদ্র্য-অশিক্ষা-বেকারত্ব-অসাম্য থেকে মুক্তির রাস্তা দেখাতে পারে। তাই পৃথিবীর বুকে নতুন চেহারায় যুগোপযোগী করে সমাজবাদ গঠনের লড়াই, আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পৃথিবীতে আরও বেশি জরুরি।