ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী
ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২২ সালে Pod Znamenem Marksizma পত্রিকায় লেনিনের লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম “On the Significance of Militant Materialism”। এই প্রবন্ধটিতে লেনিন মূলত সেই সময়ের রাশিয়ায় বস্তুবাদের পক্ষে লড়াইয়ের সামনে প্রধান বাধাগুলোকে চিহ্ণিত করেন। সাথে সাথে দর্শনের জগতে এই লড়াই কিভাবে লড়তে হবে তারও কিছু দিক নির্দেশ এই প্রবন্ধে আছে। একশো বছর পেরিয়ে গেলেও এই প্রবন্ধটির পুনঃপাঠ আজকের সময়ে জরুরি বলে মনে হয়।
শুরুতেই লেনিন বলেছেন যে, বস্তুবাদের পক্ষে লড়াইয়ে শুধু কমিউনিস্টরা থাকলেই চলবে না। কমিউনিস্ট নন, কিন্তু বস্তবাদী সেই অংশকেও এই লড়াইয়ে সামিল করতে হবে। আমাদের এটা মনে রাখা উচিত যে চলতি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জঙ্গী বস্তুবাদের ( militant materialism) লড়াইতে সামিল হতে চাইবেন এরকম চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবি পাওয়া খুব সহজ নয়। লেনিন বলছেন যে, ‘শিক্ষিত সমাজও আসলে পুরনো মূল্যবোধ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে”। এছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যা শাসক বুর্জোয়াদের দখলে তার প্রতিও এই ‘শিক্ষিত সমাজের’ আনুগত্য থাকে। তারা কার্যত ‘সরকারি দার্শনিক’ – এ পরিণত হয়ে যান। একশো বছর পরেও লেনিনের এই কথাটা আজও বাস্তব। শুধু তাই না, আজকে শিক্ষা ও জ্ঞানের সার্বিক পণ্যায়ণ বুদ্ধিজীবিদের আরো বেশি করে পুঁজির দাসত্ব করতে বাধ্য করছে। যদি জমি বন্ধক রেখে (বা লোন নিয়ে) জ্ঞান কিনতে হয়, তাহলে সেই জ্ঞান বিক্রী করেই সেই জমি ছাড়িয়ে আনতে হবে। জ্ঞানের এই কেনা বেচার চক্করে শুধুমাত্র বহু মানুষ শিক্ষার বাইরে থেকে যান তাই নয় ( অর্থাৎ শুধু সংখ্যায় শিক্ষার সংকোচন হয় তাই নয়), শিক্ষার গুণগত মানের পরিবর্তন ঘটে যায়। ‘শিক্ষিত’ ব্যক্তি শুধুমাত্র বৈষয়িক কারণে পুঁজির দাসে পরিণত হোন তা নয়, মতাদর্শগতভাবেও শাসকের দর্শনের শাসন মানতে বাধ্য হোন। তাই, এই ব্যবস্থার মধ্যে কমিউনিস্ট না হয়েও বা মার্কসবাদী না হয়েও যাঁরাই বস্তুবাদের পক্ষে দাঁড়াতে প্রস্তুত তাঁদের সবাইকে বস্তুবাদের পক্ষের লড়াইয়ে সামিল করতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চেতনায় গড়ে ওঠা মানুষ কেন ভাববাদী হবে? বা, প্রাক পুঁজিবাদী, পুরনো মতাদর্শের প্রভাবে থাকবে? লেনিন বলছেন যে তার উৎস আসলে আজকের সময়ের (সাম্রাজ্যবাদের যুগের) বুর্জোয়াদের ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত শ্রেণী চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে আছে। এই বুর্জোয়ারা যেমন সমস্তরকম হাল আমলের “ফ্যাশনেবল ফিলোজফি”র ধারক ঠিক একইরকমভাবে সমস্তরকমের ধর্মীয় গোঁড়ামিকেও ধারণ করে আছে। আমরা আমাদের দেশের বুর্জোয়াদের দেখলেও দেখতে পাব, যে আজকে নয়া-উদারনৈতিক দর্শনের সব থেকে “ফ্যাশনেবল” যা তার সাথে প্রাক পুঁজিবাদী গোঁড়ামির মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে তারা। আরো ভাল করে বললে , ধর্মীয় গোঁড়ামিকেই “ফ্যাশনেবল” করে তুলছে। আজকের সময়ে আমাদের কাছে “জঙ্গী বস্তুবাদ” মানে এই “ফ্যাশনেবল ধর্মীয় গোঁড়ামির” বিরুদ্ধে এক মুহূর্ত না থেমে সার্বিক মতাদর্শগত সংগ্রাম সংগঠিত করা।
লেনিন বলছেন যে, বস্তুবাদের লড়াইয়ে পুরনো বস্তুবাদী যারা, যারা হয়তো বা মার্কসবাদের বিচারে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী নয়, তাদের সমস্ত অবদানকে তুলে ধরতে হবে। লেনিন এঙ্গেলসের কথার উদাহরণ দিয়ে বলবেন, “এঙ্গেলস তাঁর সময়ের শ্রমিক নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তাঁরা যেন অষ্টাদশ শতকের জঙ্গী নাস্তিক সাহিত্যগুলো ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিলি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন’’। লেনিন আরো বলছেন যে, পুরনো, ঐতিহ্যবাহী বস্তুবাদী উপাদানকে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক নয়, এই অজুহাতে প্রত্যাখান করাটা আদৌ মার্কসবাদী সিদ্ধান্ত নয়। লেনিনের এই পরামর্শের মর্মবস্তু আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিত। আমাদের দেশে আমরা আজকে যে ধর্মীয় উন্মাদনার পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি তার পেছনে অতীতের দার্শনিক এবং ধর্মীয় রচনাগুলোর পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা জড়িয়ে আছে। যেমন ধরা যাক, রামায়ণ বা রামের গল্পকে ব্যাপক মানুষের কাছে যেভাবে উপস্থিত করা হয়েছে তা ‘রামায়ণ’ রচনার এক ধরণের পরিকল্পিত বিকৃতি। অথচ ভারতে এবং ভারতের বাইরেও রামায়ণ বা রামকথার যে বিপুল, বহুমাত্রিক প্রসার ছিল তা মানুষের চেতনা থেকে হারিয়ে গেছে। বা বলা ভাল সেগুলোকে পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই ‘রামে’র হিন্দুত্ববাদী সংস্করণের বিপরীতে সেই সমস্ত রচনাগুলোকে পুনরুদ্ধার করা এবং মানুষের সামনে হাজির করাটাও আজকের সময়ে বস্তুবাদের পক্ষে লড়াইয়ের অংশ হওয়া উচিত। আমাদের দেশের অতীত ঐতিহ্যে এরকম বহু উপাদান আছে যা আজকের সময়ে সব চেয়ে প্রভাবশালী একমাত্রিক হিন্দুত্বের বয়ানকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। যা, মেরুকরণের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক সহাবস্থানের , সহমর্মীতার ইতিহাস বহন করে। লেনিন বলছেন যে, শাসক শ্রেণীর মতাদর্শগত প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য “সম্ভাব্য সমস্ত দিক দিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছনোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে”।
লেনিন বলছেন, বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কারগুলোকে বস্তুবাদের চর্চার অংশ করতে হবে। যা না করলে, জঙ্গী বস্তুবাদ না জঙ্গী থাকবে, না বস্তুবাদী থাকবে। এই ক্ষেত্রে তাঁর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হল এই, বিজ্ঞান এবং বস্তুবাদ বিচ্ছিন্নভাবে নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বিজ্ঞান যদি এগিয়ে যায়, কিন্তু বস্তুবাদী দর্শন সেই বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করে এগোতে না পারে তাহলে সমাজ এগোবে না। যেমন ধরা যাক, হাজার হাজার বিজ্ঞানী মিলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে যদি এটা আবিষ্কারও করেন যে দুনিয়ার সমস্ত জাতি, বর্ণ, ধর্মের মানুষের পূর্বপুরুষ আসলে একই, তাহলেও এই আবিষ্কার আপনাআপনি জাতি, ধর্ম, বর্ণের বিভেদ মিটিয়ে দেবে না। ঐ আবিষ্কারকে দার্শনিক, মতাদর্শগত লড়াইয়ের অংশীদার করার সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ, শুধু দর্শনের জগতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী রাখলেই হবে না, বিজ্ঞানের জগতেও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী জরুরী। তা না হলে, চন্দ্রযান পাঠানোর সময় রকেটের গায়ে সিঁদুরের টিকা পরিয়েই পাঠানো হবে।
একদম শেষে লেনিন Ekonomist নামক একটি পত্রিকার একটি প্রবন্ধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করবেন। পি এ সরোকিন ( যিনি ১৯৩০ –র পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন) ছিলেন এই কাগজের প্রকাশক। সেই কাগজে একটি প্রবন্ধে তিনি রাশিয়ায় (১৯২২ সালে) বিবাহ বিচ্ছেদ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, সেই সম্পর্কজাত সন্তান ইত্যাদি বিষয়ে তাচ্ছিল্যমূলক কিছু কথা লেখেন। লেনিন সেই প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে বলছেন ,যে, সরোকিন আসলে দেখতে পারছেন না, যে কোনও বুর্জোয়া দেশে এই সমস্ত কিছুই রাশিয়ার থেকে বেশি ঘটছে। কিন্তু, লেনিনের পরের কথাটা হল আসল, যেখানে তিনি বলছেন, “বাকী দেশের সাথে রাশিয়ার তফাৎ হল যে আমরা এই ভণ্ডামিকে এবং মহিলাদের ও তাদের সন্তানদের [বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া মহিলা এবং বিবাহ বহির্ভূত সন্তান] অবমাননাকে পবিত্র বলে চিহ্ণিত করি না, বরং আমরা প্রকাশ্যে সরকারিভাবে এই ভণ্ডামি এবং অবমাননার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি”। নারীর ‘পবিত্রতা’র ধারণা, ‘জাতির পবিত্রতার’ ধারণা, বর্ণের ‘পবিত্রতার ধারণা’ আসলে একটি আপাদমস্তক বস্তুবাদ বিরোধী ধারণা। আমাদের দেশে ‘হিন্দুত্ববাদ’ তার জন্মলগ্ন থেকে দার্শনিকভাবে এই ‘পবিত্রতার’ ধারণাকে সমাজের মধ্যে লালন করেছে। লেনিন সরোকিনের মত বুদ্ধিজীবিদের আখ্যায়িত করছেন, “আধুনিক শিক্ষিত সামন্তবাদী” হিসেবে। আমরাও খেয়াল করলেই চারপাশে এরকম অসংখ্য আধুনিক শিক্ষিত সামন্তবাদীদের দেখতে পাব। তাই লেনিনের শেষ কথাটা হচ্ছে এরকম , মার্কসবাদের বা জঙ্গী বস্তবাদের পক্ষের লড়াইয়ের অবশ্য কর্তব্য হল “আধুনিক শিক্ষিত সামন্তবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা”।