Red November :’Kept Press’ and An American in Petrograd- Chandan Das

‘কেপ্ট প্রেস।’ লিখেছিলেন জন হবসন।অর্থাৎ সংবাদপত্র রক্ষিতার ভূমিকায়।কার? দেখা যাক।

পুরো নাম জন অ্যাটকিনসন হবসন। জন্ম ১৮৫৮-তে। ইংল্যান্ডের ডার্বিতে। হবসনের মৃত্যু ১৯৪০-এ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে। সাম্রাজ্যবাদের জন্ম এবং ফ্যাসিবাদকে জন্ম দেওয়া — দুয়েরই সাক্ষী হবসন। সাহিত্যে গোড়ায় আগ্রহ থাকলেও যৌবনে সাংবাদিকতাকেই বেছে নেন। বাবা উইলিয়াম হবসন ছিলেন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের মালিক। উপরের দুটি শব্দ সংবাদপত্রের ভূমিকা বোঝাতে হবসন লিখেছিলেন একটি বইয়ে। সেই বইটির নাম,‘দি ওয়ার ইন সাউথ আফ্রিকা –ইটস কজেজ অ্যান্ড এফেক্টস।’

সরাসরি ‘কেপ্ট’? তাও উনবিংশ শতাব্দীর শেষে?

তাহলে হবসন কে — এই প্রশ্নটাই জরুরি।

আদৌ কমিউনিস্ট ছিলেন না তিনি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় খনি মালিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংবাদপত্রগুলির ভূমিকা প্রসঙ্গে হবসন লিখেছিলেন,‘‘the great factory of public opinion.” ফ্যাক্টরি! অর্থাৎ জনমত বানানোই যাদের কাজ — এবং মালিকদের পক্ষে। সেই প্রসঙ্গেই দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদপত্রগুলির চরিত্র বোঝাতে গিয়ে বইটির ২২৯ নং পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন,“a small confederacy of international financiers working through a kept press.”

Anglo Boer War 1899-1902

সোজা কথা বলাই ভালো। হবসনের মত। সাম্রাজ্যবাদ যখন পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে তখন থেকেই মিডিয়াকে তারা দখল করেছে, পরিচালিত করেছে, তার সুফল ভোগ করেছে। এবং পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের সংগ্রামী জনতার বিরুদ্ধে — ‘জনমত গড়ে’ তুলে। কখনও যুদ্ধের পক্ষে। কখনও ধর্মের নামে।

হবসনের শিক্ষা? ‘জার্নালিস্টিক এথিক্স’ আসলে ‘সৎ তৃণমূল’র মত। হয় না — অবাস্তব। তা যেমনই হোক — সংবাদপত্র কিংবা পোর্টাল। হয় তা লড়াকু মানুষের পক্ষে। নয়তো শাসকের ‘কেপ্ট।’

পুঁজিবাদ ঠিক কবে সাম্রাজ্যবাদ হলো? দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা যায় না। কিন্তু সময়কাল লেনিন নির্দিষ্ট করে গেছেন। ১৯১৫-র ডিসেম্বরে বুখারিনের ‘ইম্পিরিয়াজম অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড ইকনমি’-র ভূমিকা লিখেছিলেন লেনিন। সেখানে তিনি লেখেন,‘‘…the stage…was reached approximately at the end of the nineteenth and the beginning of the twentieth centuries.” অর্থাৎ পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার প্রক্রিয়া মোটামুটিভাবে চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ, অ্যাংলো-বুয়র যুদ্ধ এবং সোভিয়েত বিপ্লবের প্রথম প্রচেষ্টার সময়কালে।

অর্থাৎ ১৮৯৮ থেকে ১৯০৫ — এই সময়কালে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান। ১৮৯৮-এ স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকায় অ্যাংলো-বুয়র যুদ্ধ ১৮৯৯ থেকে ১৯০২। লেনিনের কথায় এই দুটি যুদ্ধ এবং ১৯০০-তে ইউরোপে অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল বিশ্ব ইতিহাসের নয়া পর্বের ‘প্রধান ঐতিহাসিক মাইলফলক।’ অ্যাংলো-বুয়র যুদ্ধের দিকে নিবিড় লক্ষ্য ছিল হবসনের। উনিশ শতকের শেষদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশেষত হীরে এবং সোনার খনি আবিষ্কৃত হওয়াই ছিল সেই যুদ্ধের অন্যতম মুখ্য কারণ। সেখানকার অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে জন হবসনের ‘সাইকোলজি অব জিঙ্গোইজম’ বইয়ে। সেটির প্রকাশ কাল ১৯০১। আর তারপরের বছর, ১৯০২-এ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রসিদ্ধ বই — ‘ইম্পিরিয়ালিজম: এ স্টাডি।’

মার্কস-পরবর্তী পৃথিবীতে মার্কসবাদকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা ‘ইম্পিরিয়ালিজম: দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৬-তে। লেনিন তাঁর একাধিক লেখায় অ্য়াটকিনসন হবসনের ব্যাখ্যা, লেখার উল্লেখ করেছিলেন।

সেই হবসন দেখিয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে সংবাদপত্রকে ব্যবহার করে। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেস নয়, বিভিন্ন লেখায় হবসন লন্ডনের তথাকথিত বড় সংবাদপত্রগুলির ন্যক্কারজনক ভূমিকাও তুলে ধরেছিলেন। হবসনের কথায়,‘‘turn first to the press, by far the most potent instrument in the modern manufacture of public opinion.” যেখানে এই কথা লিখলেন, সেটি ‘দি ওয়ার ইন সাউথ আফ্রিকা — ইটস কজেজ অ্যান্ড এফেক্টস’ বইয়ের একটি অধ্যায়। অধ্যায়টির শিরোনাম — দ্য অ্যাবিউজ অব প্রেস।’

সাম্রাজ্যবাদের যুগে ‘প্রেস’ অথবা ‘মিডিয়া’র ভূমিকা এটাই। ফর্ম বদলাতে পারে — সংবাদপত্রের অনেকটা জায়গা নিয়ে নিতেই পারে অনলাইন এডিশন, পোর্টাল। কিন্তু উদ্দেশ্য একই থাকবে। থাকছেও।

উদাহরণ? ‘বামফ্রন্ট বেছে বেছে মুসলামনদের জমি নিয়ে নিচ্ছে’ কিংবা ‘জ্ঞানেশ্বরী নাশকতা সিপিএম-র চক্রান্ত’, ‘তৃণমূলকে হটাতে পারে শুধু বিজেপি’ — এই ধরনের ‘ওপিনিয়ন ম্যানুফ্যাকচারিং’ আমরা দেখেছি। কেন? ভারতে আম্বানী, আদানীদের লুটের মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার পথে প্রধান বাধা কমিউনিস্টরা। তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ। তাই সেখানে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে জনমত নির্মাণ ছিল সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম হাতিয়ার। মিডিয়া সেই ভূমিকাই পালন করেছিল।

২০১২তে হিলারি ক্লিন্টন তাই মহাকরণে এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জির পিঠ চাপড়ে দিতে।

কিন্তু তারপরও ইলিশের রূপোলি ধারা থাকে, স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতারের দৃষ্টান্ত হিসাবে। তাই এক আমেরিকান সাংবাদিকের কলমে গড়ে ওঠে নক্ষত্র খামারের নির্মাণ-পর্ব।

John Reed (1887-1920)

আমেরিকার শাসকদের ক্রোধ লোকটির প্রতি স্বাভাবিক। প্রথমত, লোকটিও আমেরিকান। দ্বিতীয়ত, পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ডে। তবু পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিষ্ঠাবান প্রচারক হওয়ার বদলে হয়েছেন র‌্যাডিক্যাল। তৃতীয়ত, সবচেয়ে যা মারাত্মক — সোভিয়েত বিপ্লবের মত ‘ইতরদের হিংসা, বিশৃঙ্খলা’-র  অনুপুঙ্খ বিবরণ লোকটি সংগ্রহ করেছেন প্রকাশ্যে — পেত্রোগ্রাদের কাদাভরা রাস্তায় হেঁটেচলে, নোংরা দেওয়াল থেকে সযত্নে গোছা গোছা ইশ্‌তেহার, ঘোষনাপত্র সোল্লাসে সংগ্রহ করে। ছদ্মবেশে রাশিয়া গেছেন। সেখানে মজুর, সৈনিক, কৃষকদের চিৎকার, তর্কের মাঝে পা মুড়ে বসে, তাঁদের আলোচনা থেকে ‘নোট’ নিয়েছেন। আর সেই সব কিনা গুছিয়ে বয়ে এনেছেন দেশে। লিখেছেন লুকিয়ে — খোদ নিউ ইয়র্কে বসে।

লোকটির নাম জন রীড। সাংবাদিক। এক মূর্তিমান বিপন্নতা — সাম্রাজ্যবাদের। 

তাঁর যাবতীয় কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তবু দমানো যায়নি। জেলে ভরা হয়েছিল। তিনি তাও নত হননি। এমন একটি খুপড়ি খুঁজে বের করেছিলেন, যার হদিশ আমেরিকার তৎকালীন পুলিশ, গোয়েন্দারা পায়নি। এক চিলতে ঘরটির মাথার উপর রেল। তার পায়ের নিচেও রেল। সারাদিন ঘরঘর, কানে তালা লাগানো শব্দ। তার মধ্যে বসে তিনি টাইপরাইটারে ঝড় তুলেছেন। লেখা হয়েছে এযাবৎকালে পৃথিবীর মহত্তম নক্ষত্র খামারের নবান্নের দিনলিপি — ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’।

১৯১৯-এ ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’-র প্রথম প্রকাশ। আমেরিকায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৩-এ। অর্থাৎ ৯৯ বছর আগে।

নিজের সেই সৃষ্টির জন্য অজুহাত হিসাবে জন রীড কী কী বলেছেন? দিনটি ছিল ১লা জানুয়ারি, ১৯১৯। নিউ ইয়র্কে বসে জন রীড বইটির ভূমিকা শেষ করেন। ভূমিকার শেষ লাইনে রীড লিখছেন,‘‘এ সংগ্রামে আমার মনোভাব নিরপেক্ষ ছিল না। কিন্তু মহান এই দিনগুলোর কাহিনী বলার সময় আমি বিবেকবান রিপোর্টারের চোখ দিয়েই ঘটনাগুলো দেখার চেষ্টা করেছি, সত্য কথনেই যে আগ্রহী।’’

নিরপেক্ষতার নামে সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বের মুখে এক আমেরিকান ‘বিবেকবান’ সাংবাদিকের এটাই থাপ্পড়। 

Spread the word

Leave a Reply