ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজে গঠিত ট্রাস্টের তহবিলে জমা করা অনুদানের অর্থে করছাড়ের সুবিধার কথা ঘোষণা করেছে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস (CBDT)। শুক্রবার এই মর্মে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৬১ সালের আয়কর আইনের ৮০-জি (80G) ধারা অনুযায়ী সেবা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ত্রান তহবিল কিংবা কোন ধর্মীয় স্থানের নির্মাণ অথবা মেরামতির জন্য কেউ অর্থ প্রদান করলে (ঐ আইনের ৫ নম্বর উপধারা অনুযায়ী) সেই অর্থের উপরে কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়। রাম মন্দির নির্মাণকল্পে গঠিত ট্রাস্টকে সেই আইনেরই আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
রাম মন্দিরের নির্মাণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট যে ২.৭৭ একর পরিমাণ জমির সীমানা নির্ধারণ করেছে (গত নভেম্বরের ৯ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট রামজন্মভূমি সংক্রান্ত রায় ঘোষণা করেছিল) তাকে সরকারি গেজেটে ঐতিহাসিক স্থান এবং জনসাধারনের অর্চনার জায়গা (place of historic importance and a place of public worship) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সারা দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রুখতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে সার্বিক লকডাউন জারী করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেশের গরীব, মেহনতি জনগন যারা মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ। সারা দেশের প্রত্যেকটি প্রান্তে অন্য রাজ্য থেকে কাজ করতে আসা পরিযায়ী শ্রমিকেরা আটকে পড়েছেন, তাদের কাছে বেঁচে থাকার মতো টাকাপয়সা নেই, খাবার নেই, প্রয়োজনীয় ওষুধের কোন সংস্থান নেই, এমনকি মাথা গোঁজবার ন্যুনতম আশ্রয়টূকুও নেই। এরা ঘরে ফিরতে চান – পরিবহনের কোন বন্দোবস্ত নেই। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে নিজেদের “ঘরে” ফিরে যেতে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছেন তারা। এভাবে ঘরে ফিরতে গিয়ে ক্লান্তিতে রেললাইনের উপরে ঘুমিয়ে পড়া শ্রমিকদের পিষে মেরেছে ট্রেনের চাকা, কোথাও আবার অন্যান্য পথ দুর্ঘটনার শিকারে মানুষের প্রান গেছে, কেউ আবার পথের উপরেই হাঁটতে হাঁটতে ধকল সহ্য করতে না পেরে মারা গেছেন। এরা ঘরে ফিরতে মরিয়া, কারণ এরা বেঁচে থাকতে চাইছেন।
সরকারের কাছে বারে বারে এদের জন্য বিনামূল্যে রেশন, আগামী তিন মাসের জন্য প্রতি মাসে ৭৫০০ টাকার ব্যবস্থা করার দাবী জানানো হয়েছে, এদের নিরাপদে যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ঘরে ফেরানোর জন্য আর্জি জানানো হয়েছে – সরকারি ঘোষণার লকডাউন এদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে, অথচ সেই সরকারই এদের দুর্দশায় সবচেয়ে বেশি উদাসীনতা দেখাচ্ছে! করোনা সংক্রমণের বিপদ থেকে যদি এরা বেঁচেও যান – দৈনিক আয়ের উপরে নির্ভরশীল অথচ এই অপরিণামদর্শী সার্বিক লকডাউনের ফলে কাজ হারানো শ্রমিক-মজুর পরিবারগুলী অনাহারে মৃত্যুর মুখে পড়বেন। “ডিজিটাল ইন্ডিয়ার” চাকচিক্যের দিনেও এটাই আজকের ভারত।
এই অবস্থায় সরকার একদিকে জাতীয় অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার ভয়ে আতংকিত হচ্ছে – জনগনকে আতংকিত করে তুলে এখন থেকেই ভবিষ্যতে ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘন্টার কাজের সময়ের গল্প শোনানো চলছে, অন্যদিকে জনগণের সেই ক্ষুদ্রতম অংশ যারা বড়লোক, যারা লকডাউনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ আদৌ নন, যারা প্রত্যক্ষ কর দেন বা আয়কর দেন তাদেরকে করছাড়ের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে! অত্যন্ত সাধারণ যুক্তিতেও দেশের ধনী অংশের উপরে এই সংকটের সময়ে আরও বাড়তি কর চাপিয়ে শ্রমিক-মজুর পরিবার গুলীর জন্য সংস্থানের সুযোগ তৈরি করাকে ন্যায় বলা যায় – অথচ সরকার সেই রাস্তায় না হেঁটে সরাসরি দেশের ধনী মানুষদের প্রতিই নিজেদের দায় স্বীকার করছে। ইতিমধ্যেই রিজার্ভ ব্যাংকের তরফে কুখ্যাত ঋণখেলাপিদের বকেয়া ঋণ “রাইট অফ” ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঋণ সবটাই পাবলিক সেক্টর থেকে নেওয়া – অর্থাৎ জনগণের টাকা।
যদি শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষদের জন্য সংকটকালে রেশন কিংবা অর্থবরাদ্দে সরকারী রাজকোষ ঘাটতির কুযুক্তিকে মেনেও নেওয়া হয় তা সত্বেও একথা এতটুকুও অত্যক্তি হবে না যে সম্ভাব্য সেই ঘাটতি যারা প্রত্যক্ষ কর দিতে সক্ষম তাদের থেকেই মিটিয়ে নেওয়া যেত।
কিন্তু জনজীবনের মূল সমস্যার প্রতি দেশের সরকার নিজস্ব শ্রেণী রাজনীতির কারনেই বিমুখ, অমানবিক, উদাসীন। আর সেকারনেই জনগণের বাঁচা-মরা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের বদলে তারা এই দুর্যোগের সময়েও রাম জন্মভূমি’র মতো বিষয়ে নিজেদের ব্যাস্ত রাখছে – সেই সংক্রান্ত তহবিলে বড়লোকদের দেওয়া অনুদানকে করছাড়ের সুবিধা দেওয়াই তাদের রাজনীতি।
দেশের সংকটের মোকাবিলা করতে স্বাধীনতার পর থেকেই কার্যকরী প্রধানমন্ত্রী ত্রান তহবিলকে এই অভূতপূর্ব সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবেই অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে কারণ সেই তহবিলের হিসাব ক্যাগ (CAG) দ্বারা নিরীক্ষিত (Audit) হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের তিনজন মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী সহ মোট চারজনকে নিয়ে PM Care’s নামে আরেকটি তহবিল খোলা হয়েছে যাতে দেশের জনগণের থেকে ইতিমধ্যেই এক বিপুল অর্থের যোগান দেওয়া হয়েছে – অথচ জনগণের দেওয়া সেই অর্থের হিসাব-নিকাশ করার এক্তিয়ার কোন সরকারি সংস্থার নেই!
এই পরিকল্পনাহীন লকডাউন দেশের জনগণের এক বিরাট অংশকে এক চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত দেশের সরকার জনগণেরই জীবন-জীবিকার কোনোরকম দায় নিতে চায়না! আজ দেশের মানুষ খাদ্য, কাজ আর ঘরে ফেরার আর্জি জানাচ্ছেন, তখন সরকারের তরফে উচ্চআয়কারিদের জন্য করছাড়ের ঘোষণা করা হচ্ছে – এই দৃশ্য শুধু অমানবিক কিংবা নির্মম তাই নয়, শ্রেণী এবং কায়েমিস্বার্থনিবিস্ট ঘৃণার রাজনীতির এত তীব্রতা ভারতে অভূতপূর্বও। এই ঘৃণা এখন ধর্ম, জাত-পাত কিংবা সম্প্রদায়ের পরিসর ছাপিয়ে উঠে সরাসরি আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বিভেদেও নিজস্ব উপস্থিতির স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বহুদিন ঘরে আটকে থেকেও নিজেদের ভালভাবে বাঁচিয়ে রাখার মতো সংস্থান যাদের রয়েছে তারা হয়ত এই প্রসঙ্গে ঈষৎ তেরছা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করবেন, এতে আর কিই বা এমন হবে এধরনের মন্তব্য ছুঁড়ে দেবেন দেওয়ালে আঁটা টেলিভিশন সেটের সামনে বসে প্রাতরাশ, দুপুরের লাঞ্চ, বিকালের জলখাবার কিংবা রাতে ডিনাররত অবস্থায়। তাদের মনে রাখা উচিত খাবার প্লেটে পরিবেশিত গরম সুস্বাদের পিছনে ঐ শ্রমজীবী মানুষগুলির অনেক ঘাম ঝরান ফসল রয়েছে- এবং সেখানেও যুগ যুগের অন্যায্যতা রয়েছে, প্রবঞ্ছনা রয়েছে, শোষণ রয়েছে। তারা নিজেদের আস্থানুজায়ী অর্থদান করতেই পারেন কিন্তু ঐ শ্রমিক-মজুর পরিবারগুলির মানুষেরা যদি নির্মম সরকারি উদাসীনতা সহ্য করতে না পেরে আগামীদিনে সরকম লৌকিক-অলৌকিক আস্থার উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেন তখন যা কিছু হতে পারে সেই সবও ভারতে নতুন ব্যাপার হবে!
সবশেষে বলা যায়, রাজনীতি প্রথম থেকে শেষ অবধি মানুষের জন্যই। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের কাঁধে পা রেখে ক্ষমতায় বসে পরে তাদেরকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে – সেই ইতিহাসের পাতা সরালেই বোঝা যায় সেইসব কুকর্ম যারা করেছেন তাদের পরিণতি কীরকম হয়। মন্দির হোক, মসজিদ হোক, গির্জা, গুরদুয়ারা এবং অন্যান্য যে কোন ধর্মীয়স্থানই হোক না কেন – আখেরে সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করবেন যারা তারা মানুষই – অন্য কিছু নয়। সেই মানুষদের বাঁচাতেই সরকার পদক্ষেপ গ্রহন করুক। বিভেদের রাজনীতির পরিনাম ভাল হয় না – অনেক দুর্দশার মধ্যেও এই লকডাউন আমাদের এও দেখিয়েছে সারা দেশেই নিরন্ন, বিপদে পড়া, আটকে থাকা মানুষকে রক্ষা করতে মানুষই এগিয়ে এসেছেন – এবার দেশের সরকারও অন্তত বলার মতো কিছু করুক!