দেবরাজ দেবনাথ
“নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি-
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”
ভাষা ও ছন্দে একথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন এ দেশে রামকেন্দ্রিত ধর্মোন্মাদনা এত গণচেহারা গ্রহণ করেনি। রবীন্দ্রনাথের রামদর্শন আমাদের এমন এক বোঝাপড়ার সন্ধান দিতে পারে যা আর এস এস-এর রামপ্রকল্পের প্রতিভাষ্য হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ রামায়ণকে ইতিহাস বলেননি কখনও, মহাকাব্যই বলেছেন। ভারতের চিরন্তন সামগ্রী বলেছেন। দীনেশচন্দ্র সেনের রামায়ণী-কথার ভূমিকা লিখতে গিয়ে বরং এ-ও বলেছেন আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের অভাবে রামায়ণকে এককালে ইতিহাস বলা হলেও এখন এটিকে মহাকাব্য বলাই যথাযথ ও উপযুক্ত। অথচ আজকাল রামায়ণকে ইতিহাস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিদ্যায়তনিক মহলেও বিশেষ আয়োজন হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথের রাম-ভাবনা যে মুখোশধারী সনাতনীদের কাছে বিষবৎ হবে, তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথের রাম কেবল একভাবে ধরা দেয়নি, রামায়ণ ছিল তার কাছে ভারতের বিবিধতার, প্রকাণ্ডতার প্রকাশক। তিনি যখন জাভাযাত্রীর পত্রে লেখেন, “কৃষির হলবিদারণরেখাকে যদি কোনো রূপ দিতেই হয় তবে তাকে পৃথিবীর কন্যা বলা যেতে পারে। শস্যকে যদি নবদূর্বাদলশ্যাম রাম বলে কল্পনা করা যায় তবে সেই শস্যও তো পৃথিবীর পুত্র। এই রূপক অনুসারে উভয় ভাইবোন, আর পরস্পর পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ।” তখন আসলে তিনি স্বীকৃতি দেন রামায়ণের অমিত ভাষ্যকে, দশরথ জাতকে রামসীতার ভাইবোন হবার কথা আমরা পাই। এরকম আরও অসংখ্য রামায়ণের ভাষ্য আছে যেখানে রামায়ণের মূল কাহিনির কিছু অদলবদল ঘটেছে। ভারতের বিশালতা এই সকল রামায়ণকেই ধারণ করে থাকে, কোনো একটি ভাষ্য কোনো মানুষের কাছের হতে পারে, কিন্তু বাকি ভাষ্যদেরকেও একই আদলে গড়ে তোলবার চেষ্টা আসলে ভারতের সমৃদ্ধ মহাকাব্যিক ইতিহাসকেই কালিমালিপ্ত করা।
রবীন্দ্রনাথ কেবল কৃত্তিবাস পড়েননি, তিনি স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে বাল্মিকীর রামায়ণ পাঠ করেছিলেন। কিন্তু রামায়ণের মূল আবেদন তার কাছে বরাবর বেদনাত্মকই থেকেছে। বিচ্ছেদ, শোক থেকেই রামায়ণের উৎসার হয়েছে বলে মনে করতেন তিনি। সোনার তরী’র কবিতায়, পঞ্চভূতের প্রবন্ধে, এমনকি তরুণকালের বাল্মিকী প্রতিভাতেও রামায়ণ রবীন্দ্রনাথের কাছে চিরবেদনার কাব্য হিসাবেই প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু তিনি রামায়ণকে দেখেন আরও গভীরে। এক কৃষিসভ্যতার ক্ষয় ও ধ্বংস তিনি প্রত্যক্ষ করেন রামায়ণে। জাভাযাত্রীর পত্রেই উনি লিখছেন, ‘কৃষির ক্ষেত্র দুরকম করে নষ্ট হতে পারে- এক বাইরের দৌরাত্ম্যে, আর-এক নিজের অযত্নে। যখন রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে গেল তখন রামের সঙ্গে সীতার আবার মিলন হতে পেরেছিল। কিন্তু, যখন অযত্নে অনাদরে রামসীতার বিচ্ছেদ ঘটল তখন পৃথিবীর কন্যা সীতা পৃথিবীতেই মিলিয়ে গেলেন।’ লব অর্থে ছেদন আর কুশ অর্থে কৃষিফসল ধ্বংসকারী পরগাছা আসলে রামায়ণের অন্তে কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের অর্থনীতির ভেঙে যাবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই বিশ্লেষণ রবীন্দ্রনাথের।
অপর একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘রামচন্দ্র বানরগণকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদিগকে দলে লইয়া বহু দিনের চেষ্টায় ও কৌশলে এই দ্রাবিড়দের প্রতাপ নষ্ট করিয়া দেন;’ বলা বাহুল্য দ্রাবিড় অর্থে রামায়ণ বর্ণিত রাক্ষসদের নির্দেশ করছেন রবীন্দ্রনাথ। রামায়ণের এক বাস্তবানুগ নৃতাত্ত্বিক পাঠেও আগ্রহী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে কৃষিজীবী ও অ-কৃষিজীবী সমাজের দ্বন্দ্ব তার নজরে আসে। রবীন্দ্রনাথের কাছে রাম তাই বিশিষ্ট বীরপুঙ্গব দেবতা হিসাবে ধরা দেয়নি। এক আর্ত মহীয়ান মানুষ হিসাবেই ধরা দিয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরে রবীন্দ্রনাথের রামপ্রীতি বোঝাতে ও রামায়ণকে বাংলার আদিদেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে রবীন্দ্রনাথের ওজনকে কৌশলী ব্যবহার করতে বজরং দলের মতন হিন্দুত্ববাদী আউটফিটগুলি যোগীন্দ্রনাথ বসুর সরল কৃত্তিবাস গ্রন্থভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের লেখাকে দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরে থাকে। অথচ সেখানে রবীন্দ্রনাথই বলছেন, ‘সেই ভক্তিধারার অভিষেকে উচ্চ-নীচ, জ্ঞানী-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র সকলেই এক আনন্দের মহাযজ্ঞে সম্মিলিত হইয়াছিল… বাংলা রামায়ণ বিশেষভাবে সেই ভক্তিযুগেরই সৃষ্টি।’ অথচ আরএসএসের রাম-প্রকল্পে ভক্তি বা ভক্তিযুগের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। রাম এদের কাছে ভীতি ও বিভাজনের হাতিয়ার যা রবীন্দ্রনাথের ভক্তিসিঞ্জিত রামভাবনার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ, সাম্প্রতিক রামমন্দির উদ্বোধনে আদিবাসী রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না করা কিম্বা রামনবমীকে কেন্দ্র করে ঘটে চলা রক্তাক্ত অস্ত্রমিছিলগুলি থেকেই স্পষ্টত বোঝা যায় এ জিনিস।
এ হেন রবীন্দ্রনাথ যে বারংবার সঙ্ঘের কোপের মুখে পড়বেন তা স্বাভাবিক। সঙ্ঘের রামকে তার জন্মভূমির মন্দির বানাতে এক বিপুল দাঙ্গা-চক্রান্ত-ফ্যাসাদের আশ্রয় নিতে হয়, লেখার শুরুতেই দেখেছি রবীন্দ্রনাথের কাছে রামের জন্মভূমি কবি বা ভক্তের মনোস্থল, তা নিয়ে হাঙ্গামা করবার বা বিশেষ ঘটা করে আয়োজনে তাকে পাবার প্রয়োজন হয় না। সঙ্ঘের রাম তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের সবথেকে জরুরি উপাদান, অথচ রবীন্দ্রনাথ ও তার জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত ধারণা বরাবর উদারবাদী ও মানবতাবাদী। ন্যাশনালিজম সংক্রান্ত বক্তব্যগুলি পড়লেই আমরা জানতে পারব রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবাদের স্বরূপ। ১৯২১ সালে দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে একটি চিঠিতে লিখছেন কবি, ‘I love India but my India is an idea and not a geographical expression. Therefore, I am not a patriot. I shall ever seek my compatriots all over the world.’ ২০২৪ সালের সঙ্ঘী ভারতে এই কথাগুলি দেশদ্রোহিতার শামিল। সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে উৎখাত করতে তাই বারংবার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিজেপি সরকার। কখনও সিবিএসই-র সিলেবাস বা কখনও ইউজিসির সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গত ১০ বছরে।
ররবীন্দ্রনাথের মতন মানুষও মুসোলিনির সাক্ষাতে গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে তার মোহভঙ্গ ঘটে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগ্রামে গুরুদায়িত্ব পালনও করেন নানান সভাসমিতির অংশ হিসাবে জীবনের শেষবেলা অবধি। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ তাকে বড় পীড়া দিত। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী প্রেক্ষিত বা ইজরায়েলের দ্বারা প্যালেস্টাইনে ঘটে চলা গণহত্যা নিয়ে ভারতের একটা বড় অংশের বুদ্ধিজীবী মহল যেভাবে নীরব, রবীন্দ্রনাথ তেমনটা করতেন না নিশ্চিতভাবেই। আফ্রিকা থেকে আলবেনিয়া, চিন, মাঞ্চুরিয়া, ইতালি, স্পেন যেদেশে যখনি অন্যায় যুদ্ধের থাবা বসেছে, রবীন্দ্রনাথের কলম চলেছে তার বিরুদ্ধে। গোটা পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্ঘ যে কারণে হিটলার-মুসোলিনিকে আদর্শ বলে মনে করে, রবীন্দ্রনাথ সে কারণেই তাদের চক্ষুশূল।
অথচ খোদ বাংলাতেই বিজেপি ইদানিং ঘটা করে রবীন্দ্র-জয়ন্তী পালন করছে। কারণ রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী মনস্তাত্ত্বিক ইমপ্রিন্টকে অগ্রাহ্য করাটা মূর্খামি তাই রবীন্দ্রনাথকে তারা তাদের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করবার চেষ্টা করছে। সেকারণেই রবীন্দ্রনাথের কথা প্রেক্ষিতবিচ্ছিন্ন করে বীররসাত্মক রামের বাঙালিয়ানা দর্শাতে হাজির করছে কখনও, আবার কখনও রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীকেই ব্যবহার করছে রবীন্দ্রচিন্তারহিত শিক্ষাকে ব্যবস্থায়িত করতে।
রবীন্দ্রনাথের ভক্তিআপ্লুত লৌকিক রামভাবনা তার ভারতভাবনারই আরেকরূপ বলা চলে। এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদর্শন ও মানবতাবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না।