করোনা আক্রান্তের চিকিৎসায় বেআব্রু কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালগুলি। হু হু করে বাড়ছে পরীক্ষা করতে আসা রোগীর চাপ। অথচ খালি আইসোলেশন বেডের সংখ্যা যেমন কমে আসছে, তেমনই চূড়ান্ত অভাব চিকিৎসকের। প্রয়োজনীয় মাস্কও অমিল।
রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল কারো সর্দি কাশি জ্বর হলে তার জন্য আলাদা লাইন হবে। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালগুলিতে তার কোনও চিত্র দেখা যায়নি। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও অমিল বহু হাসপাতালে, অপরিষ্কারের অভিযোগও প্রায় সর্বত্র। রাজ্যের বহু হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড এখনও নেই। নানা অব্যবস্থার অভিযোগ এসএসকেএম হাসপাতালের বিরুদ্ধেও।
করোনা ভাইরাস আক্রান্ত এক যুবক বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ভর্তি। তা সত্ত্বেও বুধবারও এই হাসপাতালে তেমন কোনও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। বুধবার করোনা সন্দেহে ৭ জন ভর্তি হয়েছেন এখানে। এপর্যন্ত এখানে ১৭ জন ভর্তি আছেন বলে জানা গিয়েছে সুপারের বক্তব্যে। হাসপাতালসূত্রে জানা গিয়েছে আর মাত্র ২-৩টি বেড মিলবে এখানে। কিন্তু তারপর? করোনা সন্দেহ হলে রেফার করতে হবে অন্য হাসপাতালে। বুধবার দুপুর সওয়া একটায় সর্দি কাশি নিয়ে বেলেঘাটা আইডি’তে জরুরি বিভাগে লাইন দিয়েছিলেন মুম্বাই ফেরত জোকার বাসিন্দা এক যুবক। সন্ধ্যা ৬টার সময়েও তিনি পরীক্ষা করতে নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছাতে পারেননি। ত্রিবেণী থেকে দুপুর ১২টায় এক প্রৌঢ়াকে নিয়ে এসেছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। বিকাল পাঁচটাতেও দেখা গিয়েছে তিনি ঠায় বসে রয়েছেন। লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর বাড়ির লোকজন। দিনভরই লম্বা লাইন ক্রমশ ক্ষোভ থেকে বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে। লক্ষীকান্তপুর থেকে পরিবারের একজনকে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন সুদর্শন ঘোষ। তিনি তীব্র অভিযোগ জানিয়ে এদিন বলেন, এ বড় একটা বিভীষিকা অথচ মাত্র ১জন চিকিৎসক পরীক্ষা করছেন। এটা কি ধরনের পরিষেবা? এখানে তো বেশিরভাগই পরীক্ষা করতে এসেছেন নিজেদের তাগিদেও। এরপর শুনছি বেডও অমিল হয়ে যাবে। তাহলে কী দাঁড়াবে অবস্থা? অন্যদিকে এসএসকেএম হাসপাতালেও এই ধরনের উপসর্গের রোগীদের জন্য আলাদা কোনও কাউন্টার খুঁজে পাননি বহু রোগী ও তাদের পরিবার।
যোধপুর পার্ক, কাটজুনগর, সল্টলেকের এজে ব্লকে এবং উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে করোনা শঙ্কায় কয়েকজন ব্যক্তিকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। কয়েকজনকে গৃহ পর্যবেক্ষণে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানা যায় ৫০৩, যোধপুর পার্ক এবং জি-২০ কাটজুনগর এই ঠিকানার বাড়িতে সদ্য ইতালি থেকে ফিরেছিলেন কয়েকজন। বিমানবন্দরের তরফে সেই তথ্য মেলার পরেই তাঁদের খোঁজ শুরু করে পুলিশ। তাঁদের খোঁজ পাওয়ার পরে পুলিশের তরফে তাঁদের বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে, সল্টলেক এজে ব্লকের এক ব্যক্তি লন্ডন থেকে ফিরেছেন। গত ১২ তারিখে তিনি কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন। বুধবার তাঁর বাড়িতে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শারীরিক পরীক্ষা করে বিধাননগর পৌরসভার একটি মেডিক্যাল টিম। জানা গিয়েছে, শরীরে কোনও করোনা উপসর্গও নেই। তবুও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ওই যুবক এবং তাঁর বাবাকে কয়েকদিনের জন্য আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে উত্তর বটতলা থানা এলাকার হাতিবাগানে ইংল্যান্ড ফেরত এক যুবককে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে গৃহ পর্যবেক্ষণে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ভবনের তরফে।
মাথাভাঙা মহকুমা হাসপাতালের আউটডোরে একজন ফিজিশিয়ান আর শল্য চিকিৎসকের রোগী দেখার কথা বুধবার। জেনারেল ফিজিশিয়ান ডাঃ গোপাল চক্রবর্তীকে ঘিরে গাদাগাদি লম্বা লাইন। মহিলা-পুরুষদের পাশাপাশি লাইন। প্রায় সবাই গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে। কারোর মুখে বাজারে পাওয়া সস্তার মাস্ক। অনেকেরই জ্বরের উপসর্গ, কারোর সর্দি-কাশি, কারুর আবার ডায়েরিয়া। প্রতিদিন আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসেন গড়ে ৬০০ জন রোগী। তার সাথে রোগীর পরিবারের লোক যোগ করলে সংখ্যাটা ঠিক কত দাঁড়ায় অনুমেয়। আউটডোরে নেই ন্যূনতম রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা! ইনডোরের ছবিটা আরও ভয়াবহ। বুধবার ১৮০ জন রোগী ছিলেন। নেই কোনও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।
একই অবস্থা বসিরহাটেও। হাসপাতালের আউটডোর- টিকিট কাউন্টার, বিভিন্ন ওষুধের দোকান, ২৫-৩০টির মতো প্যাথোলজিক্যাল সেন্টার, ৩টি স্ক্যান সেন্টার, ৫টি আলট্রা সোনোগ্রাফি সেন্টার। যেখানে প্রতিদিন আসা যাওয়া করে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। সর্বত্র মানুষের ছড়াছড়ি। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে কারোরই মুখে মাস্কের দেখা নেই। হাসপাতালের মূল প্রবেশ দ্বারে নেই কোনও পরীক্ষা কেন্দ্র। ডাক্তার, নার্স, ট্রেনিং প্রাপ্ত নার্স, সিকিউরিটি সার্ভিসের কর্মী, অন্যান্য কর্মচারী— মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক আছে ঠিকই। কিন্তু যার আয়ু চার ঘণ্টা। দিব্যি তা দিয়ে আটঘণ্টা ডিউটি করছেন ডাক্তার থেকে নার্স প্রত্যেকেই।
এদিকে হাওড়ার সত্যবালা আইডি হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি উত্তর হাওড়ার যুবক। গোলাবাড়ির বাসিন্দা এই যুবক নিউইয়র্ক থেকে ফিরে বেঙ্গালুরুতে যান। জ্বর সর্দি হয়ে অসুস্থতা বোধ করায় বুধবার নিজেই হাসপাতালে যান যুবক। মাত্র ১০টি বেড রয়েছে এখানে। নদীয়ায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৮৬৯জনকে হোম কোয়ারান্টিনে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অভিযোগ, হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মী, নার্স ও চিকিৎসকদের মাস্ক, হাত ধোবার স্টেরিলাইজার, হ্যান্ড গ্লাভস কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকদের সাথে রোগীদেরও কোনও নিরাপত্তা নেই বলে অভিযোগ।
করোনা উপসর্গ নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চারজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আরও একজনের ভর্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছেন বলে হাসপাতালের সুপার জানিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের আত্মীয় পরিজনদের অভিযোগ, আইসোলেশন ওয়ার্ডের চারিদিক মাকড়শার জালে ভর্তি। মশা ও মাছির উপদ্রব রয়েছে। নোংরা পরিবেশ আইসোলেশন ওয়ার্ডের। হাসপাতাল সুপার বলেন, সংস্কার ও পরিষ্কারের কাজ চলছে। পাশাপাশি করোনা আতঙ্কে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে রোগীদের ভিড় উপছে পড়েছে। পুরুলিয়ার হাসপাতালগুলিতেও অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি হয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ।
রবিবার রাতে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে রায়গঞ্জ মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন এক মহিলা। মেডিক্যাল কলেজের মহিলা মেডিসিন বিভাগের একটি ঘরে একাকিত্বে রাখা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের নির্দেশে রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজে আলাদাভাবে করোনা সন্দেহে ভর্তি রোগীদের জন্য আলাদা আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হলেও সেই রাতে সেটি বাইরে থেকে তালা বন্ধ ছিল।