১৭ জুলাই, ২০২২, রবিবার
১৬ জুলাই নয়া দিল্লীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র পলিট ব্যুরোর সভা শেষ হয়েছে।
জনসাধারণের রুটিরুজির উপরে ক্রমবর্ধমান আঘাত
২০২০-২২ পর্বে মাত্র ০.৮ শতাংশ হারে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনেই সেই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
বেকারত্ব: সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই) সম্প্রতি ২০২২ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল পর্বে সারা দেশের বেকারত্বের তথ্য প্রকাশ করেছে। দেশের মধ্যে প্রায় দু’কোটি মানুষ, যাদের বয়স ২০ থেকে ২৪, তাদের হাতে কোন কাজ নেই। এই বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৪২ শতাংশ। একসাথে বিবেচনা করলে, ১৫ বছরের বেশি বয়সী যে ৩ কোটি বেকার ভারতীয় কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়ঃসীমার বেকার সংখ্যা তার প্রায় ৮০ শতাংশ।
সারা দেশের জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশই কর্মক্ষম। এদের ৬১.২ শতাংশই চাকরির সন্ধান করা থামিয়ে দিয়েছেন, কারণ কাজের সুযোগ নেই। মুনাফায় শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ক্রমশ কমছে, বর্তমানে সেই সূচক নেমে এসছে ৩৮.৮ শতাংশে। আমাদের দেশের ইতিহাসে এমন অবস্থা এখনও অবধি সর্বনিম্ন।
শ্বাসরোধী মূল্যবৃদ্ধিঃ ২০২২ সালের মে মাসে পাইকারি বাজারের দ্রব্যমূল্যের বার্ষিক সূচক (ডব্লিউ পি আই) বাড়তে বাড়তে ১৫.৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে, ১৯৯৮ সালের পর থেকে এই সূচক এখনও অবধি সর্বাধিক। খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.৪ শতাংশ হারে, জ্বালানীর ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি ৪০.৬৩ শতাংশ, সাধারণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামবৃদ্ধির গড় প্রায় ১০.১১ শতাংশ।
এহেন মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার পাশাপাশি দেশের জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতাকে ক্রমশ নিচের দিকে ঠেলে দিয়ে জীবনমানের অবনমন ঘটাচ্ছে। এরই প্রভাবে দেশীয় বাজারে চাহিদার সংকট তৈরি হচ্ছে। সেই চাহিদার সংকট উৎপাদনী ক্ষেত্রে সংকোচন ঘটাচ্ছে, এর ফলে কর্মরত হয়েও কাজে যুক্ত থাকার সুযোগ ক্রমশই আরও কমছে।
অসাম্যের উৎকট অবস্থাঃ আমাদের দেশে অসাম্যের জন্য দায়ী তিনটি কারণ। কর্পোরেট গোষ্ঠীর সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাত, ধান্দামূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং জাতীয় সম্পদের বেপরোয়া লুট। এই তিনের সম্মিলিত প্রভাবেই রোজগার ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক অসাম্য তৈরি হয়েছে। বম্বে ষ্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত কোম্পানিগুলির সমবেত সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯.৩ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি (২০২১-২২ সালের হিসাব)। মহামারীর আগে ২০১০-২০২২ দশকে ঐ কোম্পানিগুলিরই মুনাফার গড় হার যা ছিল, শুধুমাত্র ২০২১-২২ সালেই তা বেড়েছে তিনগুন। ২০২০-২১ সালের হিসাবকে বিবেচনা করলে মুনাফার হার বেড়েছে ৭০ শতাংশেরও বেশি।
অবিলম্বে অতি-ধনীদের উপরে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সম্পত্তি কর চাপানো উচিত। সেই অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে জনকল্যাণে, একান্ত প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণে। নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে, একইসাথে দেশীয় বাজারে চাহিদার সংকট মেটাতে হবে।
মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প
এমএনরেগা প্রকল্পে কাজ করেছেন কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রাপ্য মজুরী বকেয়া রয়েছে এমন সবার মজুরী অবিলম্বে মিটিয়ে দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে।
গ্রামীণ এলাকায় কর্মক্ষম যুবসমাজের জন্য এমএনরেগা প্রকল্পই সবচাইতে বেশি কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারে, আরও কার্যকরীরূপে এই প্রকল্পের পরিসর বাড়াতে হবে।
আধার ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা খারিজ করতে হবে
শিশুদের পুষ্টির জন্য সহায়ক প্রকল্পে আধার ব্যবহারের বাধ্যতা সংক্রান্ত নির্দেশটি অবিলম্বে খারিজ করতে হবে। জাল উপভোক্তা ঠেকানোর অজুহাতে ছ’মাস থেকে ছ’বছর বয়সী লক্ষ লক্ষ শিশুদের আধার সংযুক্তি ব্যাতিত পুষ্টির অধিকার খর্ব করা চলে না, এই অধিকার ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনে সুরক্ষিত। বর্তমানে ৭.৯ কোটি শিশু এই প্রকল্পের আওতাধীন, সরকারী নথি অনুযায়ী জন্ম নেওয়া শিশুদের মাত্র ২৩ শতাংশেরই আধার কার্ড রয়েছে। শিশুদের পুষ্টির সুচকে সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে নিচে থাকা দেশগুলির অন্যতম হল আজকের ভারত।
শিক্ষার উপরে আক্রমণ
২০২০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষা নীতি এবং মহামারীর সময়ে ব্যবহৃত অনলাইন পঠন-পাঠনকে স্বাভাবিক শিক্ষাক্রমের বিকল্প রূপে আগ্রাসী মনোভাবে সর্বত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ বিদ্যালয় ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে ক্রমশ বেড়ে চলেছে। শিক্ষাক্রমের অন্তর্গত বিজ্ঞানচেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়গুলিকেই জঘন্য কায়দায় আক্রমনের লক্ষ্য করা হচ্ছে।
আদিবাসীদের অধিকারসমূহে আক্রমণ
অরণ্য সংরক্ষণ আইনে নতুন সংশোধনী প্রণয়ন করে মোদী সরকার আদিবাসীদের অধিকারে ভয়ানক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। নয়া সংশোধনীর জোরে কর্পোরেটরা মুনাফার উদ্দেশ্যে দেশের বনাঞ্চল ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। এই আইনের ফলে গ্রাম সভা, আদিবাসী গোষ্ঠীসমূহ এবং অরণ্যের উপরে নির্ভরশীল জনজাতিগুলির অধিকার খর্ব করা হয়েছে। পূর্বতন আইনে বনাঞ্চলের জমি অন্য উদ্দেশ্যে এই সকল পক্ষের মতামত নেওয়া আবশ্যিক ছিল। নয়া আইনে আদিবাসী সমাজের সংবিধান স্বীকৃত অধিকারও খারিজ করা হয়েছে। অবিলম্বে নয়া আইন বাতিল করতে হবে।
নাগরিক অধিকারের উপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ
তিস্তা শীতলবাদ, মহম্মদ জুবেইর সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের উপরে প্রযোজ্য মামলাগুলি অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবী জানাচ্ছে পলিট ব্যুরো। নাগরিক অধিকার খারিজ করতেই এদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুয়ো খবর ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘৃণার পরিবেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচার চালায় হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক শক্তি। বিভিন্ন রাজ্যে যারাই এইসব ভুয়ো খবর সম্পর্কে জনসাধারণকে ওয়াকিবহাল করে তোলার কাজ করেন সংশ্লিষ্ট বিজেপি সরকারের তরফে বেছে বেছে তাদের উপরেই মামলা করা হচ্ছে। ঘৃণা ভাষণ প্রচারকারীদের বহাল তবিয়তে ছেড়ে রেখে যারা এসবের বিরোধিতা করছেন তাদেরকেই কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। ঘৃণা প্রচারের কর্মসূচিতে এমন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে।
বিধ্বংসী বন্যার প্রসঙ্গে
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিধ্বংসী বন্যা দেখা দিয়েছে। এই বন্যায় আক্রান্তদের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানাচ্ছে পলিট ব্যুরো। আসামে ইতিমধ্যেই বহু মানুষের জীবনহানি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হতে বাধ্য হয়েছেন, বহু সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট সহ অনেক জায়গাতেই বন্যার একইরকম প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বন্যায় আক্রান্তদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে উপযুক্ত ও কার্যকরী রিলিফের বন্দোবস্ত করতে হবে।
ভিত্তিহীন অভিযোগ খারিজ করতে হবে
ভারতের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি শ্রী হামিদ আনসারি’র প্রতি ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে যেসব ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে পলিট ব্যুরো তার তীব্র নিন্দা করছে। জাতিয়তাবোধ সমৃদ্ধ দক্ষ কূটনৈতিক, পণ্ডিতমন্যতা এবং এযাবৎ নিজের উপরে ন্যস্ত যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদনে কীর্তিমান শ্রী আনসারি সারা পৃথিবীতেই এক সমাদৃত ব্যক্তিত্ব।
ভারতের সংবিধানের প্রতি নিজের অচ্যুত দায়বদ্ধতার কারনেই শ্রী আনসারিকে আক্রমনের নিশানা করা হচ্ছে। অকারণে তাকে অপমান করলে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারতীয় সাধারণতন্ত্রকেই অমর্যাদা করা হয়, এমন ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য।
কেরালা সরকারের সাফল্য প্রসঙ্গে
বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে কেরালার এলডিএফ সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে, পলিত ব্যুরো এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। এলডিএফ সরকারের বিরোধিতায় কেরালায় কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। মনে রাখতে হবে ২০২১ সালে রাজ্যের জনগণের এক বিরাট অংশের সমর্থন নিয়েই (পূর্বের নির্বাচনের চাইতে বেশি) দ্বিতীয়বারের জন্য এলডিএফ সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর
সারা দেশে পার্টির সমস্ত ইউনিটই আগামী ১ থেকে ১৫ অগাস্ট ৭৫ তম স্বাধীনতা বর্ষ বিষয়ক কর্মসূচির আয়োজন করবে। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সাধারণতান্ত্রিক চরিত্রকে সুরক্ষিত রাখতে, ভারতের সংবিধান এবং নাগরিকদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের রক্ষায় জনসাধারণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েই ঐ কর্মসূচি আয়োজিত হবে।