Science and Philosophy Cover (5))

Philosophy, Science and Politics in Ancient India: A Discussion (Part VI)

প্রাককথন

গত পাঁচটি পর্বে ভারতের অতীত ঐতিহ্য, ইতিহাসের অংশ হিসাবেই বিজ্ঞানচর্চা, বস্তুবাদী দর্শনের উদ্ভব, বিকাশের আলোচনা করা হয়। হিন্দুত্ববাদের দাবী দেশের ইতিহাস আর মহাকাব্যিক কাহিনী নাকি একই। এহেন দাবী নিছক মস্করা কিংবা অবুদ্ধির আস্ফালন নয়, বরং ঠিক বিপরীত। ঐ দাবীর ভিত্তি সাম্প্রদায়িক, বিভেদের রাজনীতি যারা লোকজনকে বোঝাতে চান ভিন্ন ধর্মীয় আস্থা, ভিন্ন জাতি-বর্ণের পরিচিতি এমনকি অন্য ভাষা, অন্য রুচীর যাবতীয় কিছুই উদ্ভুত সমসাময়িক সংকটের জন্য দায়ী। এই সিদ্ধান্তটুকু তারা আগেই নিয়েছেন, একে সমর্থন যোগাতে যাবতীয় আয়াস পরে সাজিয়ে নেওয়া হয়। ইতিহাসের বিকৃতি, অসত্য অর্ধসত্যের প্রচার সবই পরিকল্পনামাফিক, আর তাই আগাগোড়া রাজনৈতিক।

এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় নিজেদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করতে হয়। সঠিক অবস্থানের জন্য সঠিক তথ্য জানা জরুরী। সেই ভাবনা থেকেই এই সিরিজ।

বিজ্ঞানমনস্কতার সাথে ইতিহাস, দর্শন এবং শেষ বিচারে রাজনীতির সহাবস্থানটি আদৌ বৈরি না (যেমনটা প্রচার চলে) বরং এগুলি একে অন্যের জন্য একান্ত জরুরী।

প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত। আজ এই সিরিজের উপসংহার, শেষ পর্ব।  

শ্যামাশীষ ঘোষ

ষ্ঠ পর্ব

উপনিষদ, সংহিতা ও উপসংহার

প্রাচীন ভারতের প্রকৃত বস্তুবাদী দর্শন এবং বৈজ্ঞানিক ভাবনার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতের দর্শনশাস্ত্র লোকায়ত এবং চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’, ‘সুশ্রুত সংহিতা’-এ। নানা দার্শনিক মতের মধ্যে বিতর্কের ধারা চালু ছিল প্রাচীন ভারতে। কিন্তু দেখা যাবে লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের প্রতি তীব্র ক্রোধ দেখা দিয়েছিল প্রায় সব মতবাদের দার্শনিকদের মধ্যে এবং ফলস্বরূপ এই মতবাদের গ্রন্থগুলি ধ্বংস করা হয়েছিল। একইভাবে, প্রাচীন ভারতীয় আইন প্রণেতারা চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যেকার ইতিবাচক বিজ্ঞানের অঙ্গীকারের তীব্র বিরোধিতায় নেমেছিলেন, চিকিৎসক এবং শল্যচিকিৎসকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন। আইন প্রণেতারা অবশ্য কোথাও চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি তাদের অবজ্ঞার আসল ভিত্তি প্রকাশ করেন নি, চিকিৎসকদের অশুচি বলে নিন্দা করেছেন। এর সুনির্দিষ্ট কারণের দিকে তাকানোর প্রয়োজন আছে।

অপস্তম্ব, গৌতম বা বশিষ্ঠ – এই তিন কর্তৃপক্ষ হলেন প্রাচীনতম ভারতীয় আইন প্রণেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট, যাঁদের রচনাগুলি – যাকে ধর্মসূত্র বলা হয় – সাধারণত খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৩০০ এর মধ্যের সময়কালের বলে ধরা হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর আক্রমণের মূল হোতা ছিলেন এঁনারাই। একজন চিকিৎসক দ্বারা প্রদত্ত খাবার উচ্চবর্ণের সদস্যদের গ্রহণ করার পক্ষে খুব নোংরা; একজন ব্রাহ্মণের অবশ্যই কোনও কারিগর বা শল্যচিকিৎসকের কাছ থেকে খাবার গ্রহণ করা উচিৎ নয়, যাঁরা অন্তর্নিহিতভাবে অশুচি; চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত খাদ্য গণিকা প্রভৃতি দ্বারা প্রদত্ত খাদ্যের মতোই অপবিত্র; একজন ব্রাহ্মণ যিনি চিকিৎসা অনুশীলনের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করেন তিনি দ্বিজ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার অধিকার হারান – এই সবই ছিল যুক্তি-বিবর্জিত আক্রমণের ধরণ। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ/চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত অর্থাৎ মনুর সবচেয়ে বিখ্যাত ভাষ্যকারদের সময় পর্যন্ত চিকিৎসা ও তার অনুশীলনকারীদের প্রতি এমনই ঘৃণা প্রকাশ অব্যাহত থাকে। ভারতীয় আইন বইগুলির মধ্যে সর্বাধিক বিশিষ্ট হল মনুস্মৃতি, সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীর সংকলন। মনুর বিধান ছিল উচ্চবর্ণের সদস্যদের জন্য চিকিৎসকদের কাছ থেকে খাবার গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। তদনুসারে, অন্যান্য অন্তর্নিহিত অশুচি ব্যক্তিদের মতো চিকিৎসকদেরও যজ্ঞে অংশ নিতে দেওয়া হবে না, কারণ তাঁদের উপস্থিতি যজ্ঞের পবিত্রতা নষ্ট করে।

স্পষ্টতই দ্বিজ বা বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণির সদস্যকে চিকিৎসা অনুশীলনের জন্য কোনও অনুমোদন না-দেওয়ার ফলেসমাজে একটি ব্যবহারিক সমস্যা উপস্থিত হয় – এর অনুশীলন কারা করতে পারে? মনু এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন: ‘অম্বাস্থদের মধ্যে চিকিৎসা অনুশীলন সীমাবদ্ধ রাখতে হবে’। অম্বাস্থরা, যদিও ঐতিহাসিকভাবে কিছু প্রাচীন উপজাতির সদস্য বলে মনে হয়, মনু বলেন, ‘বৈশ্য স্ত্রীদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ পুরুষদের মিলনে তাঁদের জন্ম হয়’, যা বৌধায়নের প্রাচীন আইন বিধিতে বর্ণিত একটি উদ্ভট কাহিনী এবং যা পরবর্তীকালের আইন প্রণেতাদের দ্বারা পুনঃসমর্থিত হয়েছে।

অথচ চরক সংহিতায় আমরা দেখি একজন চিকিৎসকের জন্য প্রয়োজনীয় চারটি অপরিহার্য যোগ্যতা হল:

১) চিকিৎসা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুর স্বচ্ছ দখল,

২) বিস্তৃত অভিজ্ঞতা,

৩) ব্যবহারিক দক্ষতা

এবং

৪) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা।

চরক সংহিতার আরেকটি অনুচ্ছেদে বলা আছে: ‘চিকিৎসকদের মধ্যে যারা অর্থ বা অন্য কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই জীবের প্রতি সমবেদনার সাথে নিরাময় কৌশলটি অনুশীলন করেন, সমস্ত কর্তব্যের মধ্যে মহৎ হিসাবে, তিনি হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেন এবং এর ফলে সর্বোচ্চ ধরণের সুখের অধিকারী হন’।

এই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেই আইন প্রণেতাদের এত ঘৃণার উৎপত্তি পুরোহিত প্রতিষ্ঠানগুলির থেকে এবং শ্রেণি-বিভক্ত সমাজের আদর্শকে বৈধতা দেওয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্য রয়েছে, যার মধ্যে পুরোহিতরাই ছিলেন প্রাচীনতম মতাদর্শবিদ। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল তাঁদের গণতান্ত্রিক আচরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা। সকল প্রকার লোক চিকিৎসকের কাছে ছুটে যায়। সুতরাং, চিকিৎসা অনুশীলনটি মানুষের সাথে অযৌক্তিক মিশ্রন ঘটায়। শ্রেণিবদ্ধ বা বর্ণশ্রম সমাজে এটি চলতে দেওয়া যায় না।

প্রাচীন ঋগ্বৈদিক কবি বা ঋষিদের পৌরাণিক কল্পনায়, অশ্বিন বা নাসাত্য নামে পরিচিত যমজ দেবতাদের তাদের চিকিৎসা দক্ষতার জন্য অত্যন্ত প্রশংসা করা হয়েছিল। তাঁরা দেবতাদের চিকিৎসক এবং মানুষের সবচেয়ে বন্ধু। যজুর্বেদের সময়ে এসে দেখা গেল, পুরোহিতরা এই প্রাচীন দেবতাদের সম্পর্কে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাদের হীনপদস্থ করে এবং ঘোষণা করে যে তারা তাদের চিকিৎসা পেশার কারণে অধঃপতিত। পুরোহিতদের হাত থেকে এমনকি দেবতারাও রেহাই পায়নি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ, সামগ্রিকভাবে প্রকৃতির জ্ঞানের বিষয়গুলি বৈদিক সাহিত্যে শ্রেণিবদ্ধ আকাঙ্ক্ষার উত্থানের সাথে সাথে পাল্টে যায়। একটি সুবিধাভোগী সংখ্যালঘু প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তৃত্বের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একটি মতাদর্শ যা প্রকৃতির উপর এক ধরণের রহস্যময় পর্দা টানতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ যা সহ্য করতে পারে না তা হল প্রকৃতির প্রত্যক্ষ জ্ঞান। উপনিষদের মহান ভাববাদী দার্শনিক যাজ্ঞবল্ক্য এই সূত্রের ব্যাখ্যা দিয়েছেন: ‘স্বয়ং দেবতারা যদি বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ গোপন করিতে পছন্দ করেন, তাহা হইলে মরণশীলগণ প্রকৃতপক্ষে সেই জ্ঞান অনুসন্ধান করিতে পারেন, কেবল দেবতাদের অগ্রাহ্য করিয়া’।

সরকারীভাবে অনুমোদিত সামাজিক আদর্শে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অব্যাহত নিন্দা এর অবক্ষয় এবং শেষ পর্যন্ত তাত্ত্বিক পতনের জন্য সবচেয়ে গুরুতর বাহ্যিক কারণ বলে মনে হয়। আইনপ্রণেতাদের নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য, এর পরবর্তী প্রতিনিধিরা আয়ুর্বেদের সৃজনশীল সময়কালে আয়ুর্বেদের মহান তাত্ত্বিক অর্জনকে প্রায় মুছে ফেলার আদর্শিক প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছেন বলে মনে হয়। এর ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের এবং অপবিজ্ঞানের একটি বিভ্রান্ত সমাবেশে পরিণত হয়। ফলাফলটি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির জন্য একটি বিপর্যয়। আরও বেশি বিপর্যয়ের কারণ ছিল শ্রেণিবদ্ধ সামাজিক আদর্শ কেবল বিজ্ঞানকেই পঙ্গু করা নয়, দর্শনকেও কলুষিত করেছে।

উপনিষদের সাথে যুক্ত ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি আমাদের ভারতীয় দার্শনিক চিন্তার প্রাচীনতম দলিল। উপনিষদের দার্শনিকগণ যে তাঁদের যুগের শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ্কগণের অন্যতম, তাতে সন্দেহ নেই। তবে যেটা আলোচনার দরকার তা হল প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মারাত্মক বিপদ। প্রকৃতির বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানের জন্য উৎসাহ এই দৃঢ় বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত যে একমাত্র এটিই মানবতার ভাগ্যের উন্নতির সম্ভাবনা রাখে। এইসব নিষেধাজ্ঞার ফলে তা নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। দর্শন এইভাবে শুধু বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন নয় – বিশুদ্ধ যুক্তি বা বিশুদ্ধ চিন্তার সর্বশক্তিমানের এক অদ্ভুত বিভ্রমের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জ্ঞান আর বস্তুর জ্ঞান হতে চায় না। এটি হতে চায় বিষয়ের জ্ঞান – নগ্ন অহং বা বিশুদ্ধ আত্মার। প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে, অধিবিদ্যকের চেতনা আরও দূরবর্তী পরিস্থিতিতে উঠতে থাকে যেখানে কেবল চিন্তাই অবশিষ্ট থাকে এবং চিন্তা করা জিনিসগুলি ম্লান হয়ে যায়। যাজ্ঞবল্ক্য যেমন ঘোষণা করেছেন, এটি কেবল চেতনার একটি সমষ্টি।

যাজ্ঞবল্ক্য ও সনৎকুমারের মতো উপনিষদীয় ভারতের মহান প্রতিভাবান ব্যক্তিগণ, যাঁদের বিশুদ্ধ যুক্তির শ্বাসরুদ্ধকর উড়ান আজও বহু চিন্তাবিদের নিকট বিস্ময়কর – কেবল বিজ্ঞানের প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়ার দিকে এগিয়ে যান। এভাবেই বর্ণাশ্রম বা শ্রেণিবদ্ধ সামাজিক আদর্শের জন্য প্রয়োজনীয় পাল্টা মতাদর্শ – প্রকৃতির প্রত্যক্ষ জ্ঞানের আশঙ্কা এবং তাই নিন্দা – দর্শনকে অধঃপতিত করে এমন দিকে যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জন্য বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়। প্রথম পর্বেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের এই সংক্রান্ত অন্তর্দৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে।

আমাদের দেশে জনসাধারণের দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শন – এই দুটি কথা একসাথে বোঝায় যে দর্শন, সেটি লোকায়ত। লোকায়ত হলো ইহকাল-সংক্রান্ত দর্শন: যারা পরকাল মানে না, আত্মা মানে না, ধর্ম মানে না, মোক্ষ মানে না, তারাই লোকায়তিক। তারা মনে করে জল-মাটি-আগুন-হাওয়া দিয়ে গড়া এই মূর্ত পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য, আত্মা বলতে দেহ ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না। তাহলে এই মত অনুসারে লোকায়ত হলো দেহাত্মবাদ, বস্তুবাদ। ভাববাদীদের হাজার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চার্বাকমত খণ্ডন করা সম্ভব হয়নি। মতটির স্বকীয় শক্তির জন্যেই তা সম্ভব হয়নি। তার জন্যই হয়তো চার্বাকদের রচনা ধ্বংস করে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। তাছাড়া, মতটির মধ্যে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট যে-ভাবেই হোক-না-কেন একটা ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিরও ইংগিত পাওয়া যায়।

মানুষের দার্শনিক চেতনার জন্মও বাস্তব সমাজের ঘাত-গ্রতিঘাতেই, তবু নিছক এই ঘাতপ্রতিঘাত দিয়ে তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয়না। কোনো দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু শ্রেণীস্বার্থের দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই চলবে না – চার্বাকপন্থীরাও সুস্থ জড়বাদের এই প্রাথমিক সত্যকে যেন অনুভব করতে পেরেছিলেন। কেননা, বিপক্ষের হাতের বিশুদ্ধ বিচার-বুদ্ধি ও অভ্রান্ত তর্কপদ্ধতির দার্শনিক অস্ত্র সমস্ত জড়বাদ অবলীলায় খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে পারে। পরমসত্তা বিশুদ্ধ তর্কপ্রণালীর দাবি মানতে বাধ্য, এ কথা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে মানা হচ্ছিল, ফলে বুদ্ধির দাবি জড়বাদ কোনোমতেই মেটাতে পারে না। বিপরীতে, জড়বাদের প্রথম কথাই হল: ‘বাস্তবজগৎ বুদ্ধির দাবি মানতে বাধ্য নয়, বরং বুদ্ধিই বাস্তব জগতের দাবি মানতে বাধ্য’। চার্বাকপন্থী বিপক্ষের শ্রেণীস্বার্থটুকু প্রকাশ করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বিপক্ষকে নিরস্ত্র করতে কোমর বেঁধে লেগেছেন। 

অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন ইতিহাসের বিচারে এক ধরণের প্রোটো-বস্তুবাদের অস্তিত্ব ছিল বৈদিকসমাজ আবির্ভাবেরও আগে। এই বস্তুবাদী লোকায়ত দর্শন আবির্ভূত হয় তখনকার আদিবাসী ভিত্তিক সমাজের ক্রোড়ে। যৌথ শ্রম, যৌথ জীবন, যৌথ চিন্তা, যৌথ শিল্প ও সাহিত্যচর্চা – এসবই ছিল সমাজের বৈশিষ্ট। তখনও কায়িক ও মানসিক শ্রমের মধ্যে তফাৎ দেখা দেয়নি, সকলেই কায়িক ও মানসিক শ্রমে যুক্ত ছিলেন। সমাজের সকল সদস্যের মধ্যে ঐক্য ছিল চিন্তা ও কাজের, কায়িক এবং মানসিক বা বৌদ্ধিক শক্তির। প্রাথমিক সময়ের ঋগ্বেদেও – যদিও সেই অর্থে দার্শনিক গ্রন্থ নয় – আমরা এই বস্তুবাদী চিন্তার রেশ পাই। সমাজে শ্রেণিবিভাগের সাথে সাথেই কায়িক ও মানসিক শ্রমের মধ্যে তফাৎ দেখা দিতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ের বেদে এবং বিশেষ করে উপনিষদে এসে আমরা দেখতে পাই সমাজে কর্তৃত্বকারী ভাববাদী দর্শনের আবির্ভাব। আবার ওই বৈদিক সাহিত্যেই আমরা সেই সময়কার সমাজে প্রচলিত নানা আচার এবং চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে দানা বাঁধতে থাকা নানা প্রশ্ন ও সংশয়ের চিহ্ন দেখি। বস্তুবাদী ভাবনার পুনরুদ্গম দেখা যায়। সমাজে ফাটল আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে বৌদ্ধ, জৈন প্রমুখ অবৈদিক মতাদর্শগুলির প্রভাবে। বৈদিক সাহিত্যে নানা প্রশ্ন ও সংশয় এবং বস্তুবাদী চিন্তার অঙ্কুর – এগুলির মধ্যে অবশ্যই দেখা যাবে সংযোগের সূত্র।

এইরকম এক সময়ে এসে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় শঙ্করাচার্য বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্বতত্ত্বকে বড় আঘাত হানেন। বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিকাশকে কার্যকরীভাবে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। শঙ্কর প্রমুখ পরবর্তীকালের হিন্দু দার্শনিক এবং ধর্মশাস্ত্রকারগণ বোঝাতে চেয়েছেন সমগ্র বৈদিক সাহিত্যই অনাদি অপৌরুষেয় বাণী, যার সকল বিধানই তর্কাতীতভাবেই মেনে নিতে হবে। তাই বেদবাণী অনুসরণ করেই ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত মনুসংহিতায় শূদ্রদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী নৃশংস বিধানসমূহ রচিত হয়েছে। তারই রেশ বর্তমানেও চলছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত যে কোনো বস্তুবাদী দর্শনকে শঙ্কর ভয় করতেন। তাঁর কাছে মনুর বচন অলঙ্ঘনীয়। বৈদিক সামাজিক বিধান বিরোধী সকল যুক্তি অগ্রাহ্য। এজন্যই বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে সুপ্রাচীন কালে যেসব দর্শন ভারতবর্ষে আবির্ভূত হয়েছিল, ক্ষত্রিয় শক্তির সহায়তায় সুরক্ষিত কঠোর সামাজিক বিধানের দ্বারা সেইসব দর্শনের স্বাভাবিক বিজ্ঞানধর্মী বিকাশ রুদ্ধ করা হয়েছে। এই অবরোধ প্রক্রিয়ার রক্ষক সমাজবিধানের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা মনু, আর সর্বশ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক দার্শনিক প্রবক্তা শঙ্করাচার্য। ভূতচৈতন্যবাদী লোকায়ত দর্শন ব্রহ্মঅদ্বৈতবাদের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে সনাতন বৈদিক সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সে সমাজ ভারতবর্ষে এখনও চলছে। বাইরের চেহারা ঐতিহাসিক কারণে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু মূলটা ভারতের মাটিতে আজও শক্ত শিকড় গেড়ে বসে আছে।

আদিম সমাজে মানুষের প্রতিকূল শক্তি ছিল প্রকৃতি। সুতরাং প্রকৃতিতে দেবত্ব আরোপ করে কল্পিত দেবতার কাছে মানুষ তার কঠোর পরিশ্রমের সাফল্য প্রার্থনা করেছে। কিন্তু সভ্য সমাজের আবির্ভাবের পর প্রকৃতিকে বশীভূত করার প্রযুক্তিবিদ্যা মানুষ যখন আংশিকভাবে আয়ত্ত করেছে তখন মানুষের প্রতিকূল শক্তি রূপে দাঁড়িয়েছে মানুষ, শাসক শ্রেণি। কৌটিল্য, রাজকোষে অর্থাভাব ঘটলে নতুন কোনো দেবতার আবির্ভাব ঘটাতে হবে, এই ‘মূল্যবান’ পরামর্শ দিয়ে গেছেন। এখনও মাঝে মাঝে মাটি ফুঁড়ে স্বপ্নাদিষ্ট দেবতা জেগে ওঠে! যে ভাবেই হোক সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে শাসক শ্রেণির প্রতারণা থেকে সরিয়ে লীলাময় দেবতার তোষণে নিবদ্ধ করা প্রয়োজন ছিল।

শঙ্কর-এর নেতৃত্বে ভাববাদী দার্শনিক, ‘রাজশক্তি’ ও ‘পবিত্র শক্তি’র জোটের কাছে বস্তুবাদী দার্শনিকদের পরাজয় ছিল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক শক্তিরও পরাজয়। এই পরাজয় ছিল সংখ্যালঘু শোষকদের কাছে শ্রমজীবী মানুষের পরাজয়। প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান ও দর্শনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তিবাদী লোকায়ত এবং চিকিৎসাশাস্ত্র শুরু হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধটি প্রাথমিকভাবে আইন প্রণেতাদের কাছ থেকেই এসেছিল, অর্থাৎ যাঁদের বিজ্ঞান বা দর্শনের সাথে দৃশ্যত কোনও সম্পর্ক ছিল না। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যের স্পষ্ট বিরোধিতা। বিজ্ঞানীরা যেখানে প্রকৃতির উপরে মানুষের প্রভুত্ব অর্জনের তত্ত্ব ও অনুশীলনে আগ্রহী ছিলেন, আইন প্রণেতারা যেখানে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব অর্জনের তত্ত্ব ও অনুশীলনে আগ্রহী ছিলেন – প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বর্ণাশ্রম সমাজের আদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে উচ্চবর্ণের প্রভুত্ব কায়েম রাখার প্রচলিত অর্থনৈতিক শ্রেণিস্বার্থের তাগিদেই এইসব বিধান রচিত হয়েছে। চার্বাকের মত দর্শন লোকসমাজে গৃহীত হলে জনসাধারণের বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী ছিল। তবুও প্রকৃতিবিজ্ঞানের দিকে এই প্রাথমিক পদক্ষেপগুলি বিজ্ঞানচেতনার প্রতিশ্রুতি হিসেবে মহামূল্য বলেই প্রতীত হয়েছে।

চার্বাক সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থ কলুষিত সমাজদৃষ্টির বিপরীতে থেকেছেন। সুপ্রাচীন যুগে ঋষি চার্বাক মৃত্যুব্যবসায়ী শাসক শ্রেণি ও তাদের তাত্ত্বিক যাজ্ঞিক পুরোহিতদের চিনতে পেরেছিলেন। চার্বাকের বন্ধনমুক্তির প্রয়োজন আজ নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে। যারা এই সমাজের মৌলিক পরিবর্তন চান, তাঁদের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও দার্শনিক দৃষ্টি শাণিত করার জন্য লোকায়ত দর্শনসহ ভারতের সুপ্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়া একান্ত আবশ্যক।

ঋণ স্বীকার:

১) সুকুমারী ভট্টাচার্য – প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য

২) সুকুমারী ভট্টাচার্য – বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য

৩) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে

৪) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – লোকায়ত দর্শন

৫) Debiprasad Chattopadhyay – Science and Philosophy in Ancient India

৬) Debiprasad Chattopadhyay – History of Science and Technology in Ancient India – The Beginnings

৭) হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় – চার্বাক দর্শন

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

Spread the word

Leave a Reply