Science and Philosophy Cover (2)

Philosophy, Science and Politics in Ancient India: A Discussion (Part II)

প্রাককথন

প্রাচীন ভারতেও বস্তুবাদের চর্চা ছিল, বিষয়টি আচমকা আকাশ থেকে পড়েনি। অবশ্যই সে সময়ের বাস্তবতা, সীমাবদ্ধতার ছাপ তখনকার দর্শনে রয়েছে, কিন্তু যে কায়দায় বলে দেওয়া হয় ভারতের প্রাচীনত্ব মানেই আধ্যাত্মিকতা এবং ভাববাদ তেমনটা আদৌ আমাদের ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাসের কম আলোচিত অংশকে তুলে ধরতেই চার্বাকদের কথাবার্তা সামনে আনতে হবে। এবারের প্রতিবেদনের মূল বিষয় বিজ্ঞানচেতনার সঞ্চারপথে অনুষঙ্গ হিসাবেই বস্তুবাদী ধারণার গড়ে ওঠার কাহিনী। ইতিহাস নির্দিষ্ট পর্বে মানব সমাজের স্বাভাবিক বিকাশেরই ফলাফল ছিল বস্তুবাদী দর্শনের উদ্ভব অর্থাৎ বিজ্ঞান ও দর্শনের মাঝে কোনও বাধা নেই বরং তার একে অন্যকে পথ দেখানোর কাজই করে এসেছে- এটাই আজকের প্রসঙ্গ।  

জ্ঞানচর্চার বস্তুগত বাধ্যবাধকতা ও ঐতিহাসিক বিকাশকে কিভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয় তাকে সহজে, সকলের সামনে তুলে ধরাই আমাদের উদ্দেশ্য।

প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে।

মোট ছয় পর্বের আলোচনা।

আজ দ্বিতীয় পর্ব।

শ্যামাশীষ ঘোষ

পর্ব ২

অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক সত্য এটিই যে জিজ্ঞাসার পথ বেয়েই বিজ্ঞানচেতনার শুরু। পূবে বা পশ্চিমে কোথাও হঠাৎ একদিন আকাশ থেকে বস্তুবাদী ভাবনার বর্ষণ শুরু হয়নি। প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চা অর্থাৎ একটি যুক্তিবাদী প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষানির্ভর জ্ঞানচর্চার কথা যদি বলতে হয় তাহলে সেই সময়কার দার্শনিক ভাবনাগুলি কিরকম ছিল এবং তার মধ্যে কতটা যুক্তিবাদী প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নির্ভর ভাবনা ছিল সেটার অনুসন্ধান আবশ্যিক’। প্রাচীন ভারতে – বা যে কোনো সভ্যতার একেবারে প্রাচীন সময়ে – সেই অর্থে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। বোঝা দরকার, ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে কোন মত বিজ্ঞান-চেতনার পুষ্টি জুগিয়েছে, কোন মত বিজ্ঞানের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করেছে।

প্রকৃতি যে রহস্যময়তা নিয়ে মানুষের কাছে দেখা দিয়েছিল সভ্যতার সেই ঊষালগ্নে, সেই রহস্য উন্মোচনের জন্য মানুষের প্রচেষ্টার মধ্যেই আমাদের বিজ্ঞান এবং দর্শনের সেই প্রাচীন রূপগুলিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যাঁরা এই রহস্য সমাধানের পথ নিয়ে চিন্তা করতেন, তাঁরাই ছিলেন সেই সময়কার দার্শনিক। আর এই দার্শনিক ধারার প্রধান দুটি রূপের মধ্যে একটিই – বস্তুবাদী দর্শন – প্রকৃত অর্থে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের কাজে কার্যকরী ভূমিকা নিতে সক্ষম ছিল। এই ধারার দার্শনিকেরাই সে যুগের বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানীর আদিরূপ। সেই সময়ের সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলির অর্থাৎ অনুমান-উপলব্ধি নির্ভর জ্ঞানের বদলে, যারা প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নির্ভর জ্ঞানের কথা বলেছেন, তাঁদেরই আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক বলব।

প্রাণিজগতে বিবর্তনের ধারা থেকেই মানুষের উদ্ভব – বস্তুজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুরু থেকেই মানুষের নিরন্তর চেষ্টা প্রকৃতিকে বোঝার, প্রকৃতিকে ব্যবহার করে সভ্যতার বিকাশের কাজ। প্রকৃতি থেকে পাওয়া হাতিয়ার ব্যবহার করা, তারপরে সেই হাতিয়ারকে উন্নত করে, দলবদ্ধ হয়ে তবেই মানুষ বেঁচে থাকতে, এগিয়ে চলতে পেরেছে। প্রাথমিক সময়ের জীবন ছিল যাযাবরের – প্রকৃতির থেকে খাদ্য সংগ্রহ করা, শিকার করা, পশুপালন করতে শেখা – ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে একত্রিত। এরপর কৃষির বিকাশ সম্ভব করল এক জায়গায় স্থায়ী বসতি স্থাপন – অস্তিত্বে এলো গ্রাম। প্রকৃত অর্থে শুরু হলো মানবসভ্যতার বা আমাদের ইতিহাসের। কৃষির উদ্বৃত্তই সম্ভব করে তুললো অন্য পেশাগুলি। দরকার হয়ে পড়লো একটি কেন্দ্রীয় পরিচালন ব্যবস্থা এবং একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশার মানুষ, যাঁরা কৃষিকাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। গড়ে উঠল নগর। তখনও পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যা করেছিল, তা ছিল বিভিন্ন কৌশলের বিকাশ।

কৃষি থেকে সমাজে সমৃদ্ধির ফল কিন্তু সকলের কাছে সমানভাবে এলো না। সমাজে এলো শ্রেণিবিভাগ – একদল মানুষের হাড়ভাঙা খাটুনির উপর নির্ভর করে সমাজের হর্তাকর্তা, উৎপাদনের উপকরণের মালিক আরেকদল স্বল্পসংখ্যক মানুষের জীবনযাপন। রোজকার জীবনযাপনের জন্য নিজেদের পরিশ্রম না-থাকায়, এই সম্প্রদায়ের হাতে সময় থাকতো অফুরান। নানা বিষয় নিয়ে ভাবনার সময় পেতেন তাঁরা – ভবিষ্যতের দার্শনিক।   

দর্শনের কাজ জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান। সক্রেটিসের মতে, প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই জীবনকে পরীক্ষা করা হলো দর্শন। এখানে লক্ষণীয় হল, এই দর্শনের ভিত্তি বস্তুর উপর নয়, প্রকৃতির উপর নয়, বিশুদ্ধ চিন্তার উপর – এই ঝোঁকটিই জন্ম দিয়েছে ভাববাদী দর্শনের। অন্যদিকে, বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিটি ছিল খুবই স্বাভাবিক। মানুষের খাদ্য, শিকার করার উপাদান, কৃষিকাজের উপাদান ও ফল, আশ্রয়স্থান সবকিছুই বস্তু-নির্ভর। সুতরাং, নতুন নতুন কৌশলের উদ্ভাবন করে, এগুলিকে উন্নত করে এগিয়ে চলার, সকলের জীবনে সমৃদ্ধি আনার, ভাবনার যে স্বাভাবিক বস্তুবাদী ঝোঁক থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। সমাজের অভ্যন্তরে তাত্ত্বিক দার্শনিক বিতর্কের এই সাধারণ চরিত্রটি ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই, প্রকৃতপক্ষে শ্রেণি সমাজের প্রথম গঠনের থেকেই। ধারাবাহিক সংগ্রাম চলে আসছে দুটি প্রধান বিরোধী প্রবণতার মধ্যে – কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও সক্রিয়। একটি, আনুষ্ঠানিক এবং ভাববাদী; অন্যটি, ব্যবহারিক এবং বস্তুবাদী।

ভাববাদী দিকটি শাসক, সুবিধাভোগী এবং প্রতিষ্ঠিত ধর্মের পক্ষ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলে এসেছে, সবকিছু এখন যেমন আছে, চিরকালই তেমন ছিল। এগুলিকে পরিবর্তন করার চেষ্টা অসম্ভব, এবং সমাজের পক্ষে অশুভ। বিজ্ঞানের বিকাশের প্রতি পদে এটি বাধা দিতে সচেষ্ট থেকেছে। বিকাশের নানা পরিস্থিতিতে নতুন নতুন ব্যাখ্যায় ভাববাদী দর্শন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিদ্যমান অসন্তোষগুলিকে অলীক হিসাবে ভাবানোর এবং বিদ্যমান অবস্থাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য।

বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, তার ব্যবহারিক প্রকৃতি এবং বৈপ্লবিক প্রভাবের কারণে, বহু শতাব্দী ধরেই শাসকের বিরোধিতা পেয়ে এসেছে। এর অন্তর্নিহিত শক্তি ছিল শাসকের চিন্তার কারণ। এটি ছিল মূলত বস্তু এবং তার গতিবিধির একটি দর্শন, মানুষের চোখ দিয়ে প্রকৃতি এবং সমাজের ব্যাখ্যা – যেটি মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণ করতো। সদা চলমান বস্তুজগতের নিয়মগুলি শিখে একে পরিবর্তন করার জন্য মানুষের শক্তির উপরেই এর জোর ছিল। দেবীপ্রসাদ বলেছেন, বস্তুবাদী দর্শনের ধারাবাহিক বিজয় সত্ত্বেও, ভাববাদী দর্শনের নানা রূপে আবির্ভাব ও বিকাশ, ফলত এই সংগ্রামের বিদ্যমানতা, দেখায় যে এটি মূলত কোনো দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক লড়াই নয়, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ক্রোড়ে লালিতপালিত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতিফলন।   

বিজ্ঞানের গুরুত্ব আজ আর আলাদা করে বলার দরকার নেই। একে বুঝতে গেলে বিজ্ঞান এখন কী করছে তা জানার সাথে সাথে এটি কীভাবে এইরকম হয়ে উঠলো, সমাজের ধারাবাহিক রূপগুলিতে অতীতে এটি কীভাবে সাড়া দিয়েছে, এবং কীভাবে আবার তার প্রয়োজনে সমাজকে পাল্টে নিয়েছে, সে-সম্পর্কে সচেতন হওয়াও প্রয়োজন। প্রাচীন সময়ে বিজ্ঞান প্রায়শই পরিচয়যোগ্য আকারে ছিল না। সেই প্রাচীন সময়ের বিজ্ঞানকে খুঁজে নিতে হয় সেই সময়কার সাংস্কৃতিক জীবনের নানান সাধারণ দিক থেকে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যেটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট, তা হল বেঁচে থাকা ও জীবনধারনের প্রয়োজনে মানুষ কীভাবে উপলব্ধ উপাদানগুলি কার্যকরীভাবে ব্যবহার করেছে এবং দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কীভাবে সেগুলির রূপান্তর ঘটিয়েছে। বিজ্ঞানের যে মূল স্রোত, তা এসেছে আদিম মানুষের কৌশল থেকেই। প্রথম দিকের সময়কালের আলোচনা পুরো বাদ দিয়ে মধ্যযুগীয় বা আধুনিক বিজ্ঞানের আলোচনায় প্রবেশ করলে, তা হবে বিভ্রান্তিকর। আমাদের এই সৌরমণ্ডলের একটি আধুনিক উপলব্ধি হঠাৎ কোনো আধুনিক প্রতিভাধর মানুষের মাথা থেকে এসেছে, তা নয়। সেই প্রাচীনকালের গ্রীসের দার্শনিক থালেসের থেকে টলেমি, কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিওর হাত ধরে নিউটনে এসে এই আধুনিক বিশ্বচিত্র তৈরি হতে পেরেছে। এই চিত্রও চূড়ান্ত, তা নয়। আবার আদিম প্রস্তর যুগে যে নিউটনের আবিষ্কারের মতো আবিষ্কার কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না, সমাজসচেতন হলেই তা বোঝা সম্ভব। বিজ্ঞান, তার স্বভাবগত কারণেই পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানের পদ্ধতি কোনো স্থির বিষয় নয়, একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া, নতুন নতুন পদ্ধতির ধারাবাহিক বিকাশের মাধ্যমে।

ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদ, প্রধানত ঋগ্বেদ থেকে উদ্ভূত একধরণের প্রোটো-বস্তুবাদী ভাবনা থেকে শুরু হয়েছিল। নিরুক্তকার যাস্ক বেদের যাজ্ঞিক-সম্প্রদায়সম্মত সুপ্রাচীন বস্তুবাদী ব্যাখ্যা করেছেন, যে ব্যাখ্যানুসারে দেবতা ‘অপুরুষবিধ’ অর্থাৎ অচেতন পদার্থ। অচেতন পদার্থে কল্পনায় দেবত্ব আরোপিত হয়েছে। বৈদিক চিন্তাধারার বিকাশ বোঝার জন্য, অবশ্যই মনে রাখা দরকার, বেদ সেই অর্থে কোনো দার্শনিক বিষয় ছিল না। প্রাচীন ভারতে পরবর্তীকালে যে জটিল দর্শনের মারপ্যাঁচ আমরা দেখি, সেই জাতীয় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিক বৈদিক কবিদের মধ্যে থাকা সম্ভব ছিল না। ঋগ্বেদের মূল বিষয়বস্তু দেবতাদের স্তব এবং তাঁদের কাছে প্রার্থনা। ঋগ্বেদের সব সূক্তই যজ্ঞের উদ্দেশ্যে রচিত নয় বা যজ্ঞে ব্যবহৃত হত না। সূক্তগুলি মূলত তিনটি ধরণের: দেবতার রূপবর্ণনা; আপ্যায়ন – দেবতার তুষ্টিবিধান; প্রার্থনা – বিজয়, শত্রুবিনাশ, পশুধন, স্বর্ণ, স্বাস্থ্য, শস্য, সন্তান, রোগমুক্তি এবং সর্বোপরি দীর্ঘ পরমায়ুর। স্তব ও প্রার্থনাই ঋগ্বেদের তিন-চতুর্থাংশ। সমস্ত ঋকে সমস্ত যজ্ঞে ঋগ্বেদের মানুষ চেয়েছে এই পৃথিবীতে দীর্ঘকাল ধরে সুস্থ নির্বিঘ্ন স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করতে। ঋগ্বেদ কখনোই একথা বলেনি যে মর্ত্যজীবন বন্ধন, এর থেকে মুক্তিই পরম লক্ষ্য; বরং বারবার দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছে, জীবন আনন্দের। এই মানসভূমিতেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’।

ঋগ্বেদ একটি তাত্ত্বিক মেজাজের প্রতিনিধিত্ব করে যা পরবর্তীকালের সর্বাধিক স্পষ্টভাষী বস্তুবাদী লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের মধ্যে দেখা যায়। এর ধ্বংসাবশেষের উপরেই পরবর্তীকালে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীকালে বেদের যজ্ঞ বা বিভিন্ন আচারগুলি যখন প্রার্থিত ফল দিতে প্রায়শই ব্যর্থ হচ্ছে, নানাবিধ সংশয় ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে, তখন এইগুলির প্রশমনের জন্য ক্রমাগত নানা ধরণের দার্শনিক মতের উদ্ভব হয় – প্রধানত উপনিষদগুলিতে আমরা যা দেখতে পাই। বস্তুবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ভাববাদ। ভাববাদ অনুসারে, চেতনা বা চৈতন্য-স্বরূপ পদার্থই প্রকৃত জগৎ-কারণ বা পারমার্থিক সত্য। চলতি কথায়, এই চেতন-পদার্থের জন্য আত্মা, পরমাত্মা, ঈশ্বর, পরব্রহ্ম প্রভৃতি রকমারি শব্দের প্রচলন আছে। ভাববাদের মূল কথা হলো, কোনো-না-কোনো অর্থে চেতন-পদার্থই পারমার্থিক সত্য; অতএব চোখে পড়া পদার্থরাশি বা বস্তুজগৎ অপ্রধান বা চৈতন্য-নির্ভর; তার কোনো স্বাধীন বা নিজস্ব সত্তা মানা যায় না।

ভারতীয় দর্শনের সাধারণ ভাণ্ডারে জমা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে দার্শনিক উপাদান – কমবেশি দু’হাজার পাঁচশো বছরের দার্শনিক ক্রিয়াকলাপের ফল। এই ক্রিয়াকলাপের স্পষ্ট সূচনা উপনিষদে, যার প্রথমটি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে অনুমিত। এরকম একটি ব্যাপক দার্শনিক ঐতিহ্যের মুখোমুখি হয়ে, অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ একে সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য একটি বুদ্ধিমান শৃঙ্খলা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় দর্শনে বৈধ বলে বিবেচিত পদ্ধতির মূল বক্তব্য হল ধারণার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দার্শনিক অবস্থানের দিকে এগোনো বা তার অ্যান্টিথিসিসের সাথে একটি থিসিসের মোকাবিলা – দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। উপনিষদ যুগেই বিতর্কের কলা এবং তা থেকে ভারতীয় যুক্তিবিজ্ঞানের এক বিস্তৃত বিকাশ দেখা গিয়েছিল – প্রধানত প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকদের জন্য, যাঁরা ভারতীয় বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রকৃত পথিকৃৎ।

এই প্রসঙ্গে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ বলেছেন: ‘ভাববাদী ও বস্তুবাদী দার্শনিক চিন্তাধারায় যে বিপরীতমুখী প্রবণতা, উভয়ের মধ্যে সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক। ভাববাদ অথবা বস্তুবাদ উভয়ের কেউই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই – উভয়েই এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে – সব সময়েই একে অন্যকে খারিজ করছে এবং এই যে নতুন নতুন প্রকরণের মধ্য দিয়ে উভয়ের মধ্যে যে সংগ্রাম চলছে, সেটাই হল মানবিক চিন্তাধারা বিকাশের নিয়ম’।

সামগ্রিকভাবে দার্শনিক কার্যকলাপ সম্পর্কে বোঝার প্রথম বিষয়টি হলো এর মধ্যে প্রাথমিক বা মৌলিক দ্বন্দ্বের খোঁজ। ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে আলোচিত দার্শনিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নগুলির মধ্যে স্পষ্টতই এইরকম একটি সমস্যা আছে – বস্তুগত জগৎ বা প্রকৃতির বাস্তবতার সমস্যা। এই সম্পর্কে অনুসন্ধান ভারতীয় দার্শনিকদের দুটি পারস্পরিক বিরোধী শিবিরে বিভক্ত করে। দার্শনিকদের একাংশ প্রমাণ করতে চান যে চূড়ান্ত বাস্তবতা হল বিশুদ্ধ ‘আত্মা’। এই দার্শনিকদের ভারতীয় ভাববাদী হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এঁদের মধ্যে পরিভাষা এবং অন্যান্য পার্থক্য আছে, কিন্তু সেগুলি গুরুত্বের দিক থেকে গৌণ। প্রাথমিকভাবে যা আগ্রহের তা হলো সেই মৌলিক বিষয়গুলি, যা তাঁদের একত্রিত করে। তাঁদের নিজস্ব অবস্থানের প্রতিষ্ঠার জন্য, তাঁদের অ্যান্টিথিসিস – বস্তুগত জগৎ মূলত বাস্তব – নাকচ করা বাধ্যতামূলক ছিল।

অভিজ্ঞতা এবং যুক্তি সাধারণত জ্ঞানের একটি বৈধ উৎস; স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বিশ্বাস হয় যে, শারীরিক বা বস্তুগত বিশ্বের নিজস্ব একটি বাস্তবতা রয়েছে। একজন মানুষ সরাসরি সমস্ত ধরণের বস্তুগত জিনিস অনুভব করে। যুক্তির সাহায্যেও, একজন বিভিন্ন জিনিসের অস্তিত্ব অনুমান করে। এইরকম প্রমাণের সামনে বস্তুজগতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জন্য ভাববাদীকে অবশ্যই বিপদে পড়তে হয়। তবে তাঁদের রাজনৈতিক দায় এটিকে টিকিয়ে রাখা। তাই একে পরিশীলিত করে কিছু ভাববাদীরা বললেন, আমরা আসলে যা অনুভব করি তা হলো সেটি সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব সংবেদন বা ধারণা। অভিজ্ঞতা ও যুক্তির বিচার, ততটা নির্ভরযোগ্য নয়। ব্যবহারিক জীবনের স্থূল উদ্দেশ্যে কেউ যুক্তিসঙ্গতভাবে এর উপর নির্ভর করতে পারেন, কিন্তু গভীর দার্শনিক বিষয়ে নয়। এইভাবে, ব্যবহারিক জীবনের ‘বিষয়’ আর দর্শনের ‘বিষয়’ আলাদা করতে হয়। বলা হলো, চূড়ান্ত সত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, সাধারণত বৈধ বলে বিবেচিত হওয়া জ্ঞানের উৎসের কোনও বৈধতা নেই।

আমরা দেখব, ভারতীয় দর্শনের দীর্ঘ যাত্রায় বস্তুজগতের প্রতি অবজ্ঞাই ভাববাদের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। এইরকম ভাবনাই বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বিকাশের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে পরবর্তী সময়ে। এঁরা অভিজ্ঞতা ও যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেন যে ধর্ম বা শাস্ত্রগুলি প্রকৃত পথপ্রদর্শক, কারণ এগুলিতেই সত্যের প্রকাশ লিপিবদ্ধ রয়েছে। বস্তুজগতের অস্তিত্ব আছে বলে মাঝেমাঝে মানুষের ভ্রম হয়। এইগুলির অপসারণের সাথে সাথে একজন স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেন – যাকে মোক্ষ বা নির্বাণ বলা হয় – যা বস্তুগত জগতের মিথ্যা প্রদর্শনীতে আচ্ছন্ন হওয়া থেকে মুক্তি। খেয়াল করুন ঋগ্বেদের জীবনে আনন্দের জন্য অসীম আগ্রহ এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে পালানোর ভাবনায় – মোক্ষ।

ভারতীয় দার্শনিকদের অপর অংশটি – প্রকৃতপক্ষে তাঁদের অধিকাংশই – বস্তুজগতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার প্রবণতার ঘোরতর বিরোধী। বস্তুজগৎকে মূলত বাস্তব বলেই দেখেন তাঁরা। এই দার্শনিকরা ভারতীয় ভাববাদের অ্যান্টিথিসিসের অর্থাৎ প্রাথমিক বস্তুবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। বস্তুজগতের বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে এই দার্শনিকরা ভাববাদকে, তার সমস্ত প্রভাবের সাথে, তাঁদের নিজস্ব অ্যান্টিথিসিস হিসাবে বিবেচনা করা বাধ্যতামূলক মনে করেন, যা প্রত্যাখ্যান বা খণ্ডন করতে হয়। তবে বস্তুজগতের বাস্তবতাকে নিছক মেনে নিলেই একজন দার্শনিক বস্তুবাদী হয়ে যান না। দার্শনিক হিসেবে বস্তুজগতের প্রকৃতি ও গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে হয়। এইভাবে পদার্থের প্রকৃতির একটি সন্তোষজনক তত্ত্ব বিকশিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

এইভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভাববাদ এবং তার অ্যান্টিথিসিসের মধ্যে মৌলিক বিতর্ক চলতে থেকেছে, যদিও ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে দুটি ধারার সমস্ত প্রতিনিধি সমস্ত বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে ঐক্যমত নন। দেবীপ্রসাদ এই বিতর্ককে ভারতীয় দর্শনের মৌলিক স্ববিরোধিতা হিসেবে দেখেছিলেন কারণ, এটি ভারতীয় দর্শনের সমগ্র ইতিহাসে একমাত্র বিতর্ক, যার প্রতি কোনও উল্লেখযোগ্য দার্শনিক উদাসীন থাকতে পারেন নি। ভারতীয় দর্শনে প্রকৃত দার্শনিক খ্যাতির অধিকারী সকলেই হয় ভাববাদের প্রতি বা তার অ্যান্টিথিসিস বস্তুবাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতীয় দর্শনে আলোচিত বহু সমস্যা – বিশেষ করে যেগুলি আমাদের সময়ের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ – চূড়ান্তভাবে এই বিতর্কের মধ্যেই নিহিত। ভারতীয় দর্শনে আলোচিত এই প্রধান দ্বন্দ্বের বাইরেও আমরা অত্যন্ত বিশেষায়িত বিতর্কও দেখতে পাই। কিন্তু এগুলির আবেদন খুবই সীমিত এবং এগুলির কোনওটিই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে চলমান মৌলিক দার্শনিক সংগ্রামের – ভাববাদ এবং তার অ্যান্টিথিসিসের মধ্যেকার বিতর্ক – মতো তাৎপর্যপূর্ণ নয়।

ঋণ স্বীকার:

১) সুকুমারী ভট্টাচার্য – প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য

২) সুকুমারী ভট্টাচার্য – বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য

৩) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে

৪) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – লোকায়ত দর্শন

৫) Debiprasad Chattopadhyay – Science and Philosophy in Ancient India

৬) Debiprasad Chattopadhyay – History of Science and Technology in Ancient India – The Beginnings

৭) হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় – চার্বাক দর্শন

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত
Spread the word

Leave a Reply