১৯ জুন ২০২২ (রবিবার)
দ্বিতীয় পর্ব
কেন বিক্ষোভ
বিজেপি মুখপাত্রের উদ্দেশ্যমূলক ধর্মীয় অবমাননাকর মন্তব্যের প্রতিবাদে স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবী ও দেশজুড়ে ঝড় উঠেছে। পৃথিবীর ২০-র বেশি দেশ ও আর্ন্তজাতিক সংগঠনের তীব্র প্রতিবাদে বিজেপি তাঁকে সাময়িকভাবে দল বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দিল্লী পুলিশ (যারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে) কোনও আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কেন? দেশজুড়ে প্রতিবাদের মুখেও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তার দলের মুখপাত্রের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে নারাজ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেমেছে দেশের নানা প্রান্তে ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগণ। বেশিরভাগ স্থানেই প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক রাস্তাতেই হয়েছে ও হচ্ছে।
হোক প্রতিবাদ – তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কিন্তু দেশের বেশ কিছু জায়গা সহ পশ্চিবঙ্গেরও কয়েকটি স্থানে হিংসাত্মক ঘটনা এবং দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/06/Collage-Maker-05-Jun-2022-03.43-PM-1024x576.jpg)
ঘোলা জলে ছিপ ফেলছে তৃণমূল
রাজ্যে যখন এই পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে, তখন তৃণমূল দল এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছিলেন। প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিল সভা সমিতি সংগঠিত করা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ। কিন্তু যদি প্রতিবাদ বিক্ষোভ হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, লুটপাট করার লোকেরা রাস্তার দখল নেওয়ার চেষ্টা করে, তখনই প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাজ্যে এই পরিস্থিতি তৈরী হওয়ার পর রাজ্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ প্রথম দুদিন কার্যত কোথাও নীরব দর্শক আবার কোথাও প্রচ্ছন্ন মদত দাতার ভূমিকা গ্রহণ করে। তৃণমূলের কিছু মন্ত্রী-এম.এল.এ.- নেতারা মুসলমান জনগণের মধ্যে তাঁদের ক্রমহ্রাসমান প্রভাব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দাঙ্গা থামানোর পরিবর্তে তা বাড়াতে রাস্তায় নেমে পড়ে, কোথাও প্রকাশ্যে কোথাও পর্দার আড়ালে থেকে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/06/download-5.jpg)
জ্যোতি বসু ও বামপন্থীদের ভূমিকা
১৯৬৮ সাল। তখন প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পুলিশ মন্ত্রী ছিলেন শ্রী জ্যোতি বসু। হুগলী জেলার তেলেনিপাড়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। খবর পেয়েই রাত ১২টার সময় সেখানে পৌঁছান জ্যোতি বসু। পুলিশ আধিকারিকদের নির্দেশ দেন – কাউকে দাঙ্গা করতে দেখলেই প্রয়োজনে গুলি চালাবেন। দাঙ্গাকারীদের রাজনৈতিক দল- জাত-ধর্ম কিছুই দেখার দরকার নেই। ফলে দ্রুত সেই দাঙ্গা নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। একইভাবে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে দেশ জুড়ে ভয়ানক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সহ কোথাও কোথাও দাঙ্গাবাজরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। তখনও মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একইভাবে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নির্দেশ দেন – কেউ দাঙ্গা করতে এলে প্রয়োজনে গুলি চালাবেন, দাঙ্গাকারীদের রাজনৈতিক দল- জাত-ধর্ম কিছুই দেখার দরকার নেই। পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য একইভাবে বলতেন – এরাজ্যে কেউ দাঙ্গা করতে আসলে মাথা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। আর এখনকার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন আর.এস.এস প্রধান মোহন ভগবতকে ফুল মিষ্টি পাঠিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে। দাঙ্গা বাঁধলে মমতা ব্যানার্জী সরকারের পুলিশ নীরব দর্শক হ’য়ে যায় কার নির্দেশে?
এই জন্যই পশ্চিম বাংলার দীর্ঘতম সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলতেন – সরকার না চাইলে দাঙ্গা কখনও হয় না।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/06/ERpEHCIUUAEIiiD.jpg)
তৃণমূলী কায়দার বিভেদের রাজনীতি
এখনকার তৃণমূল সরকার সব ধরনের ধর্মীয়-ভাষাগত- জাতিগত বিভেদকে শুধু প্রশ্রয় দেয় তাই নয়, প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করে। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্র বিভাজনের রাজনীতিকেই হাতিয়ার করেছেন বারে বারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। কখনও গোর্খা বনাম লেপচা, কখনও রাজবংশী বনাম অরাজবংশী, কখনও আদিবাসী বনাম অনাদিবাসী, কখনও বাংলাভাষী বনাম অবাংলাভাষী, কখনও মুসলমান বনাম হিন্দু এই সব বিভাজনের রাজনীতিকে ক্ষমতায় থাকার জন্য বারে বারে ব্যবহার করে থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
একদিকে দেশের ভয়াবহ আর্থিক পরিস্থিতিতে নাজেহাল মোদির সরকার, অন্যদিকে রাজ্যব্যাপী ব্যাপক দুর্নীতি আর জঙ্গলের রাজত্বে তিতিবিরক্ত বাংলার মানুষ। একের পর এক তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি মানুষের সামনে প্রকাশিত হচ্ছে। বালি-কয়লা- পাথর-চাকরি সব জায়গায় অবাধ তোলাবাজি চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য থেকে শুরু ক’রে তৃণমূলের বড়-মেজো- ছোট নেতারা কোটি কোটি টাকার বেআইনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। বোমা পিস্তল নিয়ে তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট রাজ চালাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায় দিদির ভাইরা।
নতুন কলকারখানা হওয়া তো দূরের কথা বরং রাজ্যে একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে। কাজের সন্ধানে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ কোটি টাকা দেনার দায়ে রাজ্য দেউলিয়া হয়ে গেছে মমতা ব্যানার্জীর রাজত্বে। বাড়ছে মানুষের ক্ষোভ।
এই পরিস্থিতিতে দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষকে বিভক্ত করার ঘৃণ্য রাস্তা বেছে নিয়েছে বিজেপি, আর তাতে বাতাস দিচ্ছে তৃণমূল নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/06/1647178056_factory.jpg)
বামপন্থীদের দায়িত্ব
অন্যদিকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা নিয়ে লড়াই গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে বামপন্থীরা।
আদানী- আম্বানীদের হাতে দেশ তুলে দেওয়া যাবে না, খাদ্যদ্রব্য সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমাও, বেকারদের হাতে কাজ দাও, বিভেদের রাজনীতি বন্ধ করো – এইসব দাবী নিয়ে রাস্তায় থাকাটাই বামপন্থীদের অন্যতম প্রধান কাজ এখন।
রাজ্যে দুর্নীতি- তোলাবাজি- জঙ্গলরাজ বন্ধ করো, সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না, বেকারদের হাতে কাজ দাও, ১০০দিনের কাজ দাও – কাজের মজুরী বাড়াও, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম চাই, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষদের সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা দিতে হবে, বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করো – এইসব দাবী নিয়ে উত্তাল করতে হবে সমগ্র বাংলাকে।
এটাই এখন সময়ের দাবী। এটাই এখন বামপন্থীদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই প্রতিদিন রাস্তায় আন্দোলন-বিক্ষোভ- মিছিলে অস্থির ক’রে দিতে হবে রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে।আর প্রতিরোধ করতে হবে মোদি সরকারের দেশ বেচার আর মানুষকে ভাগ করার চক্রান্তকে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/06/download-6.jpg)