‘শূদ্র জাগরণ’? বদলে গেল গ্রামের সমাজ -চন্দন দাস…

১৫ অক্টোবর ২০২২, শনিবার

চতুর্থ পর্ব

বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে পঞ্চায়েতে কী বদল এসেছিল — তা বুঝতে তৃণমূল সরকারের আমলের বক্তব্য দেখা যাক।
রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মুখপত্র ‘পঞ্চায়েতী রাজ’। সেই পত্রিকায় কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের জনপ্রশাসনের শতবার্ষিকী অধ্যাপক প্রভাত দত্ত একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন। ২০১২-র এপ্রিল সংখ্যার ‘পঞ্চায়েতী রাজ’ পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগন’।


তার ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে তিনি লিখছেন,‘‘পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্তার নেতৃত্বে আছে গরিব মানুষের প্রতিনিধি। এদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভারতবর্ষে নজিরবিহীন। ১৯৭৮-’৮৩ সালে পঞ্চায়েতে বর্গাদারদের শতকরা হার ছিল ১.৮ শতাংশ। ভূমিহীন-সহ ৩ একরের জমি মালিকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ২১.৮ শতাংশ। ১৯৮৮-’৯৩ সালে এই প্রতিনিধিত্ব বেড়ে বর্গাদারদের ক্ষেত্রে হয় ৩.১৭ শতাংশ এবং ভূমিহীনদের ক্ষেত্রে হয় ৩০.১৭ শতাংশ। ফলে এ রাজ্যে ঘটেছে অবদমিত মনুষত্বের বিকাশ। সম্ভবত এ এক ধরনের ‘শূদ্র জাগরণ’।’’


অধ্যাপকের কথায় যা ‘শূদ্র জাগরণ’ তা আসলে দীর্ঘদিন ধরে সমাজে নিষ্পেশিত মানুষের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। উচ্চবর্ণের ধনী জোতদারসহ অন্যান্য অংশের একাধিপত্ব ভেঙে গেল ১৯৭৮-র পর। তফসিলি জাতি, আদিবাসী, সংখ্যালঘুসহ গ্রামের গরিব পঞ্চায়েতের সদস্য হতে শুরু করলেন। গ্রামোন্নয়নের পরিকল্পনায় তাঁদের মতামত সুনিশ্চিত হল। জেগে উঠল গ্রামীণ সমাজ পঞ্চায়েতকে কেন্দ্র করে।
বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০০৮-এ। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন হতোই — এ’ ছিল বামফ্রন্ট সরকারের নীতি। ২০০৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল দেখালো পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতা কাদের হাতে পৌঁছে দিতে পেরেছে বামফ্রন্ট।


২০০৮-এ রাজ্যে পঞ্চায়েতের তিনটি পর্যায়ে নির্বাচিত মোট সদস্য ছিলেন ৫১,৪৯৯জন। তার মধ্যে শুধু পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন ৪১,৮৮৪জন। তাঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু রয়েছেন প্রায় ২৪% —মোট ৯৭৩৫জন। পঞ্চায়েতে তফসিলী জাতিভুক্ত সদস্য ছিলেন ১৪,৫৭১ জন — প্রায় ৩৫%। আদিবাসী মানুষ ছিলেন ৩৩৯২ জন — প্রায় ৮.০৯%। তফসিলি জাতি এবং আদিবাসী — এই দুটি ক্ষেত্রেই সংরক্ষণের নির্দ্ধারিত সংখ্যার বেশি গ্রামবাসী নির্বাচিত হয়েছিলেন। পঞ্চায়েতগুলিতে মহিলা সদস্য ছিলেন প্রায় ১৫,০০০ — প্রায় ৩৬%।
জেলাগুলিতে মোট ৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৩৩৫১টি পঞ্চায়েত ছিল। পঞ্চায়েত সমিতির মোট সদস্য ছিলেন ৮৮৬০ জন। তার মধ্যে প্রায় ২২%, অর্থাৎ ১৯৪৩ জন মুসলিম। আবার জেলা পরিষদের ৭৫৫টি আসনের মধ্যে ২১.৩২% মানুষ অর্থাৎ ১৬১জন মুসলিম। তিনটি পর্যায় মিলিয়ে পরিচালনাকারীদের মধ্যে ১০,৮৩৯ জন সংখ্যালঘু মুসলিম।
পঞ্চায়েতে গণ অংশগ্রহণে দেশে পশ্চিমবঙ্গ পথপ্রদর্শক — এ’ কথা বললে তৃণমূলীরা চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু ওই একই প্রবন্ধে প্রভাত দত্তর বক্তব্য হলো,‘‘গ্রাম সভার মাধ্যমে জনগনের অংশগ্রহণের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্ব পায় ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের পূর্বে, ১৯৯২সালে তৈরি হয় গ্রাম সংসদ। সংবিধান সংশোধনের বাধ্যবাধকতার জন্য পঞ্চায়েত আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন হয় ১৯৯৪সালে।’’
অর্থাৎ মানুষের মতামত প্রতিষ্ঠা করায় দেশকে পথ দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে পঞ্চায়েত গড়ে তোলার আগে দেশে এই ব্যবস্থার হাল কী ছিল? কি করেছেন দেশের শাসকরা? ১৯৫৫ সালের বোম্বাই গ্রামীণ পঞ্চায়েত আইনে ছিল গ্রাম সভার উল্লেখ। কিন্তু বাস্তবে এই প্রতিষ্ঠান ছিল প্রায় অস্তিত্বহীন। একাধিক সরকারী প্রতিবেদনে এ সব তথ্য ধরা আছে। ১৯৬৩ সালের দিবাকর কমিটি মন্তব্য করেছিল যে গ্রাম সভায় জনগনের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। অধিকাংশ সভাতে কোরাম হত না। গ্রামবাসীদের অংশগ্রহণের জন্য বাস্তব পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূল। কারন রাজনৈতিক উদ্যোগের ঘাটতি এবং শ্রেণী-বিভক্ত ও জাতপাত-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা।
শুধু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছিল। যা দেশকে বিস্মিত করেছিল।
সরকারে এসেই মমতা ব্যানার্জি এখানেই আঘাত করেন। একদিকে বিরোধী দলের সদস্যদের জোর করে, ভয় দেখিয়ে, মেরে পদত্যাগ, দলত্যাগে বাধ্য করল তাঁর দল। আর তিনি পঞ্চায়েতের কাজ পরিচালনায় জেলা পরিষদগুলিকে এড়িয়ে আমলাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই ক্ষেত্রে তৎকালীন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের একটি চিঠির উল্লেখ করা যায়।

‘ডিয়ার মমতাদিদি’ সম্বোধন করে ২০১১-র ৩০ শে নভেম্বর জয়রাম রমেশ লেখেন,‘‘ সংবিধানের ২৪৩(জি) ধারা পঞ্চায়েতকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দিয়েছে যাতে তা স্বশাসিত সংস্থা হিসাবে কাজ করতে পারে। এই উপলব্ধিকে মনে রেখে, ২০০৫-র এম জি রেগা আইনে পঞ্চায়েতকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’’ এই প্রসঙ্গে জয়রাম রমেশের সতর্কতা —‘‘সংবিধানের ২৪৩(জি) ধারায় নির্দিষ্ট ভূমিকা যাতে কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।’’প্রসঙ্গত, জয়রাম রমেশের সেই চিঠির নং ছিল —এফ টি এস-৬৬৫৯২/২০১১।

তাতে কিছু হয়নি। গত ১১বছরে রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুরোপুরি আমলাদের মুঠোয় চলে গেছে।

ক্রমশ…

পশ্চিমবঙ্গয়ের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন দাসের এই প্রবন্ধটি ১২ টি পর্বে প্রকাশিত হবে।

Spread the word

Leave a Reply