তাপস দাস
আমার নাম ইলিয়াস তিরকি। আমি থাকি মাঞ্জা, মারাপুর, বেলগাছি, তিরহানা, ওরড, জাবরা, আশাপুর, মেরি ভিউ, কিরণচন্দ্র, অটল, দমদমা, বীজয়য়নগর, আজমাবাদ, সাতভাইয়া ডিভিশন, টুকুরিয়া চা বাগানে, নকশালবাড়ি হাতিঘিষা থেকে ৫-৭ কিলোমিটারের মধ্যে পাহাড়ের দিকে। পেশায় আমি চা শ্রমিক। বয়স পয়তাল্লিশ। চা বাগানের গিরমিক লাইন থেকে চিঠি লিখছি কেমন আছি আমি, কেমন আছি আমরা-
আমরা ছোটোবেলায় চা বুদাতে বড় হয়েছি। হামরি মান ছোটে সেহি চা বুদা কা নিচে খেল খুদকে বড়ে হুই হি। হামে ওহেন সেহি দেখাত রহি হামার মায়ে বাপ মান বাগান মা কামাত আবত রহি। আসার সময় দেখতাম মা শাড়ির কোচার মধ্যে চাফুল তুলে নিয়ে আসতো। এই চা ফুল রাতে বেছে রাখা হত। সকালবেলায় চা ফুলের ভাজা আর চা ভাত, চা ভাত মানে ভাতের মধ্যে চিনি ছাড়া লাল চা পান্তার মত; সাথে লঙ্কা পুড়িয়ে সানা, চা ফুল ভাজা আর চা ভাত খেয়ে মা বাবা সারাদিনের জন্য কাজে বেরিয়ে যেত। এইভাবে ছোটোবেলায় আমাদের সংসার দেখেছি। তখন হাজরি বহুত কম ছিল আমাদের। আমাদের তখনও অনটন ছিল। আমাদের বাবা দাদুরা কোদাল ডোসকা মাছ ধরার ফাঁদ নিয়ে নদীতে যেত। মাছ ধরে নিয়ে আসতো। নদী নালাতে গিয়ে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরতো। এইভাবে মাছের স্বাদ পেতাম আমরা। আমাদের মাংসও খেতে ইচ্ছে করতো। সপ্তাহে শনিবার টাকা পাওয়া যেত, বাবা মা হাটে গিয়ে ছাগলের নাড়ি ভুঁড়ি কিনে নিয়ে আসতো। সেই নাড়ি ভুঁড়ি রান্না হত, ওখান থেকেই আমরা মাংসের স্বাদ পেতাম।
ছেলেবেলায় গল্প শুনতাম, দাদুরা বলতো- তাদের মা বাবারা রাঁচি, দুমকা লোহারদগা জায়গা থেকে এসেছিল। তখন এসব এলাকায় চা বাগান গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ সময়ের কথা বলছি। কয়েক পিড়ি আগের কথা। ওরা রাঁচি, দুমকা, লোহারদগায় নিজেদের জমি ছেড়ে এসেছিল একটু ভালো থাকার জন্য। আত্মীয় পরিজন ছেড়ে এসেছিল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা উত্তরবঙ্গ, আসাম, ডুয়ার্সে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এখানে বন জঙ্গল ছিল, বন জঙ্গল কেটে আমরা পরিষ্কার করলাম। কোদাল দিয়ে কুপিয়ে এই অনুর্বর মাটিকে আমরা উর্বর করলাম। তারপর এখানে আসতে আসতে গড়ে উঠলো চা বাগান। এখানে গিরমিক লাইন তৈরি হল। এই লাইনগুলোতে আমরা বসবাস করা শুরু করলাম। কয়েক প্রজন্ম এই চা বাগানে আমাদের কাটছে। আমরাও গিরমিক লাইনেই ছোটো থেকে বড় হলাম। যখন কেউ আমাদের কাছে জানতে চাইতো- আমাদের বাড়ি কোথায়? আমররা গিরমিক লাইনের বাড়িটাকেই দেখাতাম। আমাদের এক একটা পরিবারে কাছে পনেরো কাঠা, কারো কাছে আঠারো কাঠা, কারো কাছে সাত কাঠা, কারো কাছে দশ কাঠা। এই জমিতেই আমাদের বাড়ি ঘর। আমার ঠাকুমা, মা বাগানে কাজের শেষে এই জমিতে নিজের মত করে সংসার সাজিয়েছিল। কোম্পানি কোয়াটার দিয়েছিল। আমরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেতাম, বোনাস পেতাম। আমাদের স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল। কাজের সুবিধার জন্য আমাদের ছাতা দেওয়া হত। ত্রিপল দেওয়া হত। কোম্পানি বাগান থেকে চটও দেওয়া হত। হাজিরা কম থাকলেও, এই সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে আমাদের চলে যেত।
তারপরে একদিন সরকার বদলে গেলো। নতুন সরকার প্রথমেই বলে দিল হরতাল করা যাবে না। আমরা ছোটোবেলা থেকেই দেখে এসেছি, আমাদের বড়রা বাগানে গেট মিটিং করতো। মালিককে চাপ দিত। সুযোগ সুবিধার জন্য আন্দোলন হত। হরতাল হত। বাগান বন্ধ হত। এই সরকার আমাদের হরতাল বন্ধ করে দিল। এখন গেট মিটিং করলে সবার আগে পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশের চোখ রাঙানি দেখতে হয়। আমরা আগেও গেট মিটিং করেছি। কিন্তু পুলিশের চোখ রাঙানি দেখিনি। আমাদের বাগানগুলোতে জাত পাতের রাজনীতি শুরু হল। ছোটো থেকে শুনে এসেছি ‘দুনিয়া কা মজদুর এক হও’, আমাদের একমাত্র পরিচয় ছিল আমরা শ্রমিক, কিন্তু আমরা দেখলাম জাতপাতের নতুন রাজনীতি। শ্রমিকের মধ্যে আমরা ভাগ হয়ে গেলাম বিভিন্ন জাতে। আগে আমাদের অনেক ইউনিয়ন ছিল, এখান আমাদের অনেক জাত হল। আমরা কেউ আদিবাসী বিকাস পরিষদ, কেউ গোর্খা মুক্তি মোর্চা হলাম।
বাগান তো আমাদের। সেই বাগানে আমাদের দাদুরা ছিল, বাবা কাকারা ছিল, আমরা ছিলাম। আমাদের সাত কাঠা, দশ কাঠা, চৌদ্দ কাঠা, আঠারো কাঠা জমির মধ্যে আমাদের কোয়াটার ছিল। কোয়াটারের পাশে ছিল গোয়ালঘর, ছাগলঘর, মুরগী ঘর। কোয়াটারের পিছনে ছিল এক টুকরো বাড়ি জমি। যেখানে আমরা সবজি চাষ করতাম। গরুর দুধ, ছাগল, মুরগী বিক্রি করে আমাদের দুটো পয়সা হত। আমরা অসুস্থ হলে সেই পয়সা দিয়ে বাবা ওষুধ কিনতেন। তারপর নতুন সরকার ২০২০ সালে আমাদের চা সুন্দরী প্রকল্প দিল। আমরা যেখানে থাকি, আমাদের সেই কোয়াটার নাকি ঘিঞ্চি, অস্বাস্থ্যকর। সরকার বললো আমরা বাগানে গিরমিক লাইনে যে কোয়াটারে আছি, তার চেয়ে ভালো কোয়াটার দিবে। আমাদের কলোনি হবে। উত্তরবঙ্গে প্রায় ৩৭০টি বাগানে চা সুন্দরী কলোনী হবে। ৩ লক্ষেরও বেশি শ্রমিকের নতুন চকচকে ঘর হবে। প্রতিটি পরিবারকে দুটি ঘর, একটি রান্না ঘর, একটি বারান্দা, একটি বাথরুম দিবে। কিন্তু আমাদের দিল একটি মাত্র ঘর, বারান্দা নেই। পায়রার খোপ। এক টুকরো বাড়ি জমি নেই। আমরা চাষ করবো কোথায়? গোয়ালঘর, ছাগল ঘর, মুরগী ঘরের জায়গা নেই। আমাদের জমি ছিল সতেরো কাঠা, আঠারো কাঠা, দশ কাঠা, পনেরো কাঠা, সেই জমি কেড়ে নিয়ে আমাদের দিল একটা ছোটো ঘর। যে ভিটে মাটিতে আমার বাপ দাদা মিশে গেছে, সেই জমি কেড়ে নিয়ে আমাকে ঘর ছাড়া করলো। এই বাগান ঝার জঙ্গল কেটে আমরা তৈরি করেছি, অনুর্বর জমিকে উর্বর আমরা করেছি, সেই বাগান থেকেই আমাদের তাড়িয়ে দিল। আমাকে দিল- চরাই কে খতা যেইসন ঘর। আমি তো জানি এটাই আমার মাটি, আমার মা, আমার বাসা, আমাকে আমার বাসা থেকেই সরিয়ে দিল।
আমাদেরকে এইভাবে জমি থেকে উৎখাত করে সরকার বাগানের ১৫% জমি চা পর্যটনের নামে বড় বড় কোম্পানি পুঁজিপতিদের দিয়ে দিচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি এই জমিতে বড় বড় হোটেল, দামী দামী স্কুল, বড় বড় হাসপাতাল তৈরি করবে। আমি সেখানে কাজ পাবো না। ওখানে কাজ করবে সুন্দর লোকেরা। আমি তো সুন্দর না। রোদে আমাদের চামরা পুড়ে গেছে। এটা ঘটেছে। নিউ চামটা চা বাগানে হোটেলে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়ও না। চা বাগানেরর জমি লিজ হোল্ড, নিরানব্বই বছরের, নয়’শ নিরানব্বই বছরের লিজ জমি আইন তৈরি করে ফ্রি হোল্ড করছে। এতদিন আইন ছিল চা বাগানের জমিতে সরকার কিছু করতে পারবে না। সেই জমি এখন সরকার যে কারো কাছে বিক্রি করে দিতে পারবে।
আমি শ্রমিক, আমি যাবো কোথায়? আমার আঠারো কাঠা, পনেরো কাঠা জমি ছিল, সেখান থেকে আমাকে উচ্ছেদ করে তিন কাঠা জমিতে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। আমার বাগান, আমার ঘর, আমার বাড়ি, গোয়ালঘর, ছাগলঘর মুরগীঘর কেড়ে নিয়ে আমাকে দিচ্ছে তিন কাঠা জলা জমি।
এবার আমি কোথায় যাবো?
লেখক পেশায় শিক্ষক
‘দুই মানবী এক জীবন’ বই’র রচনাকার হিসাবে সুপরিচিত