কুশল চট্টোপাধ্যায়
‘এটাই নিয়ম’
গহীন অন্ধকারে
কেউ কী গান ধরে??
হ্যাঁ গান ধরে বৈকি
অন্ধকারের গান ধরে।’
হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। যতবার অন্ধকার নেমে এসেছে, ততবার অন্ধকার চিরে গান ধরেছেন কেউ না কেউ। আচ্ছা মানুষের প্রথম আবিষ্কার বা ডিসকভার কী, যেখান থেকে আধুনিক মানুষের যাত্রা শুরু?? আগুন, পাথরে পাথর ঠুকে একটা ফুলকিকে আগুনের রূপ দেওয়া। ওই, অন্ধকারে আলোর গান। সেই আদিম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে আঁধার নেমে এসেছে যতবার, মানুষ দিকভ্রান্ত হয়েছে যতবার, প্রশ্নে দাঁড়িয়েছে সভ্যতার অস্বিত্ব, ততবার উত্তরে দিকভ্রান্ত নাবিক তার ডেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ধ্রুবতারা, গেয়েছে আলোর গান। এই পথ নির্দেশক ধ্রুবতারাটাই হলো “আর্ট” বা শিল্প, জাহাজের ক্যপ্টেন হলেন ওই পথ দেখতে পাওয়া মানুষগুলো, যারা অনেক তারার মাঝেও ধ্রুবতারাটাই দেখতে পায়, আর আলোর গান হলো হাতুড়ি। এবার ভাবছেন, “আর্ট” তো বুঝলাম কিন্তু আর্টের সাথে হাতুড়ির সম্পর্ক কী??
“Art is not a mirror to reflect the world, but a hammer with which to shape it.” …
শিল্প আসলে সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখানোর আয়না নয় বরং একটা হাতুড়ি, সমাজকে পিটিয়ে তার সঠিক রূপ দেওয়ার জন্য। এই হাতুড়ি হলো শিল্পর হাতুড়ি, যা পিটিয়ে অন্ধকারের জেনোসাইড হয়, ওই যে আলোর গান বা আলোর gun…
শিল্প বা আর্ট তৈরি হয়েছে মানুষের বেসিক নিড থেকেই। গুহা মানুষের শিকার ধরার পদ্ধতি শেখানোর অঙ্গবীন্যাসে অভিনয় হোক বা হাতিয়ার নিক্ষেপণের জন্য গুহার গায়ে আঁকা ছবিই হোক, এসবই এসেছে মানুষের বেঁচে থাকার অঙ্গ হিসেবে। আর্ট বিনোদন বা অবসর যাপন নয় বরং সারভাইভ করার তাগিদ। অভিজ্ঞতা আর অভিযোজনে গুহা মানুষ চাষ করতে শিখেছে, গোষ্ঠী বদ্ধ হয়েছে এবং ক্রমেই তৈরি হয়েছে উদবৃত্ত। ঠিক এর সাথে সাথেই রূপ বদলেছে আর্ট। মানুষ যখন চাষ করতে শিখলো তখন আর তার শিকারের প্রয়োজন হলো না, বা কমে গেলো। প্রথমে অবসর যাপনের মাধ্যম, পরে পুঁজির হাত ধরে আর্ট হয়ে উঠেলো বিনোদন এবং ক্রমশই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হলো আর্ট। পুঁজির আশকারায় রাষ্ট্রের সুনাম গীতি প্রদশর্নে মিললো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, মিললো খ্যাতি এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। বাস্তব বিমুখ, সাধারণ মানুষের থেকে দূরে, সত্যের বিপরীতে গিয়ে আর্ট হয়ে উঠলো মস্তির মন্তাজে মায়ার মেগালোডন।
এই ব্যাপক অবক্ষয়ের মুখে দাঁড়িয়েও এমন কেউ কেউ ছিলেন যাঁরা পুঁজির হাত ধরে রাস্তায় চলতে রাজি ছিলেন না, বরং উত্তাল সমুদ্রে দিকহারা জাহাজ নিয়ে ধ্রুবতারা খুঁজে পথ দেখিয়েছিলেন। এঁদের হাতেই ছিলো সমাজ বদলের হাতুড়ি আর গলায় ছিলো আলোর গান। তাঁরা দেখিয়েছিলেন আর্ট কারো তাবেদারী করে না, আর্ট আসলেই সারভাইভাল তাগিদ। আর্ট বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে, মানুষের মনের কথা বলে, অধিকারের কথা বলে, সত্যের অন্বেষণ করে, বেঁচে থাকার কথা বলে। মানবতার পক্ষে সওয়াল করে, আর্টকে আবার তার বেসিক সারভাইভাল প্রিন্সিপালে ফিরিয়ে আনলেই দাঁত নখ বেরিয়ে পড়ে রাষ্ট্রর। “হার জোর জুলুম কি টক্কর মে সংঘর্ষ হামরা নারা হ্যায়”, সফদার হাশমী ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের গুণ্ডাবাহিনী ও পুলিশের হাতে খুন হন। শ্রমিকের দুর্দশা, অসহায়তা কথা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর কথা তার নুক্কর নাটকে বলেছিলো সফদার। কিউবা রেভলিউসনে ১৯৭০ সালে কিউবান মিলিটারি ওই দেশের প্রায় সকল সচেতন শিল্পীকে কিউবার ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে কারারুদ্ধ করে। এই কারাগারেই ছিলেন ভিক্টর হারা। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই “ঐক্যবদ্ধ মানুষের জয়ের গান” গাইতে শুরু করেন হারা, তাঁর সাথে কারাগারেই গলা মেলান হাজার হাজার মানুষ। হারাকে সরিয়ে অন্য সেলে একা পাঠানো হয়, গান ছাড়েননি তবু। প্রথমে বুটের নীচে থেঁতলে দেওয়া হয় হাত, এই পৈশাচিক কান্ড চলে প্রায় দু ঘন্টা ধরে, পরে গুলি করে খুন করা হয় হারাকে।হারার ওই নরক অত্যাচার সহ্য করা বীভৎস দেহ এনে দেখানো হয় ওই স্টেডিয়ামের বাকি মানুষদের। পরে ওই লাশ শহরের মাঝে ফেলে দিয়ে আসে মিলিটারি। “‘হার-আ’ কে জিতনেভালোকো বাজীগর কেহেতে হ্যায়। তার ছয় বছর পরেই এই বর্বর শাসনের অবসান ঘটিয়ে সফল হয় কিউবান রেভলিউসন। এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। আর তাই আমরা আজও বেঁচে আছি, আজও কবিতা বলি, আজও কৃষ্ণচূড়া ফোটে। স্টেইন গানের গুলিতে জাঁঝরা হয়ে যাওয়া গার্সিয়া লোরকা হোক বা দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ ভারভারা রাও হোক, ওরা বিশ্বাস করেছেন, “তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখে সন্ত্রাসের মুখোমুখি – ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয় স্থির দৃষ্টি রেখে এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়”। অন্ধকারে ধরা আলোর গান এমনই যার সুরে সুর মেলায় ভিয়েতনাম আর আমেরিকা একসাথে, এই গান প্রশ্ন করে শাসককে “কত হাজার মরলে তবে, মানবে তুমি শেষে বড্ডো বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে”। শাসকের চোখ রাঙানি, পুঁজির হাতছানি, খ্যাতির উগ্র খিদের বদলে যাঁরা বেছে নেন মানুষের দুঃখ, জীবন, নগ্ন বাস্তব, তাঁরাই লেখেন ভুখা পেটের উপাখ্যান আর তাঁরাই হলেন, পিপলস আর্টিস, গণশিল্পী। যতবার ঘন অন্ধকারে সভ্যতা ঢেকেছে আঁধার চিরে আলোর গান ধরেছেন এনারাই।
আজকেও আমরা এক ঘোর অন্ধকারময় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি। হ্যাঁ ধ্রুবতারা আছে, কিন্তু দিকভ্রান্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন আর সেটা দেখে না। পুঁজির শক্তি, রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যক্তিজীবনে অনুপ্রবেশ মানুষকে এমন এক ডিলিউশনে রাখতে সক্ষম যেখানে মিথ্যেকথা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এই ভীষন পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করা খুব কঠিন, তবুও শিল্পের হাতুড়ি পারে পুঁজির পাঁজর ভেঙে ইতিহাস লেখার জন্য।
‘তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়— অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।’
লেখক অন্যতম তরুণ নাট্যকার হিসাবে পরিচিত, বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনেরও কর্মী