People Be On Your Guard! It’s Cuba Again!

সজাগ বিপ্লবী কিউবা রাস্তায়

ময়ূখ বিশ্বাস

কোপায় মারাদোনার দেশের জয়ে যখন আমরা বুঁদ, ঠিক সেই সময় মারাদোনার প্রিয়, চে-ফিদেলের বিপ্লবের কিউবা আবার আক্রান্ত মার্কিন ষড়যন্ত্রে।

কয়েক দিন আগে চীনা শিল্পপতি জ্যাক মার বহুজাতিক সংস্থা আলিবাবা কিউবার জন্যে প্রচুর ওষুধ ও করোনা প্রতিরোধী সরঞ্জাম পাঠাচ্ছিলো। কিন্তু যে পণ্যবাহী বিমান ভাড়া করা হয়, সেই কোম্পানি শেষ মূহুর্তে বেঁকে বসে। কারণ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হেল্মস-বার্টন আইন দেখিয়ে বিমান সংস্থাকে হুমকি দেয়। বলে কোনোও মার্কিন নাগরিক বা কোম্পানি কিউবাকে সাহায্য করতে পারবে না। অন্য দেশ যেন কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় না রাখে, সেই চেষ্টাও লাগাতার করেছে আমেরিকা। হাতের কাছে উদাহরণ হলো, ১৯৭৪-এ বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য আমেরিকা যে খাদ্য–সাহায্য পাঠাতে অস্বীকার করে, তার কারণ ছিল নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাংলাদেশ কিউবায় পাট রপ্তানি করেছিল। কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন অবরোধ আজ থেকে না। সেই ১৯৬২ থেকে। যে বছর বব ডিলানের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ,সেই বছরই কিউবার উপর পুরোপুরি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। অপরাধ ‘আ্যঙ্কেল শ্যাম’ এর নাকের ডগায় বসে বিপ্লবোত্তর কিউবায় জাতীয়করণ। এরফলে এখনোও অবধি কিউবার ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার ডলার। অনৈতিক অবরোধে, ওষুধের অভাবে মারা গিয়েছে হাজারো কিউবান শিশু। কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অঘোষিত যুদ্ধ সুফল বয়ে আনেনি, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামাও তা স্বীকার করেন। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কিউবার বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধের বিরোধিতা করে প্রস্তাব নিয়েছে। সাম্প্রতিক কালেও এই বর্বর অবরোধের অবসান চায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ। এই নিয়ে টানা ২৯ বার। এবারো কিউবার সঙ্গে ছিলো বিশ্ব। আবার এ প্রশ্নে একঘরে হয়ে পড়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। অবরোধের অবসান চেয়ে ভোট দিয়েছিলো বিশ্বের ১৮৪ টি দেশ। বিপক্ষে ছিলো শুধু ট্রাম্পের উত্তরসূরি বাইডেনের আমেরিকা এবং ইজরায়েল। ভোটদানে বিরত থেকেছে ‘লাতিন আমেরিকার ট্রাম্প’ ও মোদির বন্ধু বোলসানারোর ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং ইউক্রেন। সব কটাতেই এখন আছে মার্কিন তাবেদার প্রশাসক।

সোভিয়েতের পতনের পর থেকে কিউবা বাধ্য হয়েছে অর্থনীতিতে অনেক বদল আনতে। যার অন্যতম ছিলো ট্যুরিজমের প্রতি অত্যাধিক নির্ভরশীলতা। কিন্তু করোনা মহামারির পর থেকে দেশটিতে ট্যুরিজম থেকে আয় কমেছে। টান পড়ছে ভাঁড়ারে। আবার নব্বই দশকের মতোই প্রধান খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে কিউবাবাসীকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ফ্যার্মেসিতেও ওষুধ নেই। কিউবা অসাধারণ করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বানালেও, অবরোধের ফলে সরঞ্জাম ও কাঁচামালের অভাবে হঠাৎ বাড়ন্ত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে হলদিয়া বন্দর থেকে ১০০০০ টন খাদ্যশস্য  নিয়ে ‘ক্যারিবিয়ান প্রিন্সেস’ জাহাজ গেছিলো হাভানা সিপিআই(এম) এর উদ্যোগে। কিউবার পাশে দাঁড়ানোর জন্যে। আজ অনেক দেশ কিউবার পাশে দাঁড়াতে চাইলেও করোনা পরিস্থিতিতে সম্ভব হচ্ছে না। এই অসুবিধার সুযোগ নিচ্ছে আমেরিকা। অবরোধ, করোনায় বিপর্যস্ত সমাজে সংকটকে উস্কানি দিচ্ছে সেই মার্কিনীরা। কৃত্রিমভাবে সামাজিক সংকট তৈরী করে কিউবান বিপ্লবকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে চাইছে তারা। মার্কিন-মদতপুষ্ট প্রতিবিপ্লবী প্রতিবাদীরা যত না প্রতিবাদ করেছে, মায়ামি থেকে মার্কিনীরা তার থেকে বেশী পোস্ট করেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। বিজেপির আইটি সেলের মতোই অজস্র ফেক একাউন্ট তৈরী হয়েছে এই ক’ঘন্টায়। ঠিক যেমন বলিভিয়াতে অতি দক্ষিণপন্থী অভ্যুত্থানের সময়ে সিআইএ ৬৮০০০ ফেক প্রোফাইল তৈরী করেছিলো অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে। কিউবার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যাদের কোনোও ফলোয়ার নেই। কিন্তু কিউবা নিয়ে ফেক নিউজ ছড়িয়েই যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার জয়ের ছবি বা মিশরের জয়ের ছবি কিউবা বলে চালাচ্ছে। এরসাথে কিউবার মানুষকে সে দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার জন্য তথাকথিত ‘রেডিও মার্তির’ মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা তো চলেছেই।

তবে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি, সামাজতান্ত্রিক লড়াকু মানুষ ও প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ-কানেলের নেতৃত্বে প্রশাসন তৈরী। ওরা অভ্যস্ত এই প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে। এর পিছনে আছে কিউবার জনগণের মতাদর্শগত অবস্থান এবং পার্টির নিরন্তর বিপ্লবী সংগ্রাম। প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ কানেল বলেছেন, “দেশ অস্থিতিশীল হলে বৈপ্লবিক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে বিক্ষোভকারীদের। পাশাপাশি আমরা সকল বিপ্লবী এবং কমিউনিস্টদের রাস্তা দখলে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।” ইতিমধ্যেই রাস্তাগুলো বিক্ষোভকারীদের থেকে পুনরুদ্ধার করেছে কমরেডরা। নয়া দিল্লির কিউবান দূতাবাসের এক কর্মী আমাদেরকে শান্ত হাভানার সেই ছবি দিয়েই আশ্বস্ত করলো। বললো, কিউবায় বিপ্লবের শিকড় অনেক গভীরে। এখন কিউবার পার্টি, প্রশাসন রাস্তায় মানুষের সাথে কথা বলছেন। যেখানে অশান্তি হয়েছে, প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ কানেল নিজে সেই অঞ্চলে মিছিল করেছেন ও মানুষের সাথে কথা বলেছেন। যেমন অবরোধকালীন অবস্থায় সরকারের সীমাবদ্ধতা ও অনবদ্য লড়াইয়ের কথা বুঝিয়েছেন। কিউবার রাষ্ট্রপতি দিয়াজ বলেছেন, ‘ওরা (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোস্তরা) যদি কিউবার জন্য কিছু করতে চায়, ওরা যদি সত্যিই আমাদের জনগণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়, ওরা যদি কিউবার সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে আগে ওরা অবরোধ প্রত্যাহার করুক, তারপর আমরা দেখব।’ উনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, বিপ্লবকে দুর্বল করা অথবা কিউবার জনগণকে আত্মসমর্পণ করাতে মার্কিন দেশ ও তার বন্ধুরা কিছুতেই পারবে না। তিনি আরোও বলেন, ‘যে কোনও কেন্দ্র থেকে, যে কোনও ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধের প্রাচীর গত ছয় দশক ধরে অক্ষত। কিউবার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে যে কোনও সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ, তা সে চাপ সৃষ্টি কিংবা কঠোর বিধি আরোপ, অথবা আরোও কোনও নির্মম কায়দাই হোক না কেন, তাকে রুখে দেবে কিউবার বিপ্লবী জনগণ।’

অতীত বলে বার বার সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকে রুখে দেওয়া অভ্যাস করে ফেলেছে বিপ্লবী কিউবা। বে অফ পিগসে আমেরিকার ভাড়াটে সৈন্যদের ভাগিয়েছে। বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে  ৬৩৮ বার। এরসাথে কিউবার অর্থনীতি দুর্বল করার লক্ষ্যে অন্তর্ঘাতী তৎপরতা চলেছে সেই ১৯৬০ সাল থেকে। তাও কিউবা বার বার আরোও শক্তিশালী হয়ে লড়াই ফিরিয়ে দিয়েছে।

বিপ্লবী কিউবার সাফল্য আজ গোটা দুনিয়ায় স্বীকৃত। বিশেষত এই করোনাকালে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও কিউবা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ওয়াশিংটন যখন দেশে দেশে পাঠাচ্ছে ইয়াঙ্কি সেনা। আর সেসময় হাভানা পাঠায় সাদা পোশাকের ডাক্তার। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটি থেকে ইতালি থেকে ভেনেজুয়েলা কয়েক হাজার চিকিৎসক ও নার্স গেছে। গোটা দুনিয়ায় করোনাকে যুঝতে। নানা মহল থেকে দাবীও উঠেছে কিউবান মেডিক্যাল মিশনকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়ারও। যদিও সেসবে সমাজতান্ত্রিক কিউবার মাথাব্যাথা নেই। সেখানে প্রতি ১৭০ জন পিছু একজন ডাক্তার। সেখানে সর্বশক্তিমান আমেরিকায় ৩৯০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আর আমাদের ভারতে ১৪৫৬ জন পিছু একজন ডাক্তার। পপরিসংখ্যান বলে কিউবায় প্রতি বছর গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে আসা দু’তিনশো যুবক এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে একসঙ্গে পাস করে বেরোয়। এ সম্ভব ‘সকলের জন্যে শিক্ষা ও কাজ’ এর স্বপ্নপূরণ করা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই।

বছরের পর বছর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল সত্ত্বেও আজ কিউবা মানব উন্নয়নে গোটা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির। সেখানে হয়েছে বর্ণবিদ্বেষের অবসান। নিরক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যু তলানিতে। এসেছে মহিলাদের সমানাধিকার, ক্ষমতায়ন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা, গণিত, খেলাধূলায় সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে। কিউবায় গড় আয়ু ৭৯.৫ বছর। যেখানে আমেরিকায় ৭৮.৯৩, আর ভারতে প্রায় ৭০। পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুর মৃত্যু হার প্রতি এক হাজারে মাত্র ৫, যেখানে আমেরিকায় ৬.৫, আর ভারতে ৩৬.৬।

বিপ্লবের এই সাফল্য রক্ষা করতেই আজ রাস্তায় কিউবা। রাষ্ট্রপতি দিয়াজ আহ্বান জানিয়েছেন, ‘আমাদের দেশের সমস্ত বিপ্লবী, সমস্ত কমিউনিস্টদের আমরা রাস্তায় নামতে বলছি। বিশেষ করে যেখানে যেখানে আজ প্ররোচনা ছড়ানো হয়েছে, সেখানে সবাইকে রাস্তায় থাকতে বলেছি।’ তাই কিউবা আবার তৈরী। সকল কমিউনিস্ট, বামপন্থী ও দেশপ্রেমিক মানুষকে নিয়ে রাস্তায় ওরা। করানো। এইটাও একটা বড় শিক্ষা। আজ সিয়েরা মায়েস্ত্রা থেকে হাভানা। আওয়াজ উঠছে ‘ভিভা ফিদেল’! ‘ভিভা কিউবা’! …. ‘সমাজতন্ত্র অথবা মৃত্যু!’

Spread the word

Leave a Reply