Pandemic and Left Ideology – Sushovan Patra

১।
২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩। ১৫ দিন পর জার্মানি তে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। রাইখস্ট্যাগের কোয়ার্টার-প্যালেসে সন্ধেবেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি গোপন সভা। আমন্ত্রিত জার্মানির জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষায় দায়বদ্ধ শীর্ষ শিল্পপতিরা। সভার উদ্যোক্তা নাৎসি পার্টির চারজন শীর্ষ নেতা -গোয়েরিং, গোয়েবলস, কোষাধ্যক্ষ স্যাফট এবং চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার।
বক্তৃতায় হিটলার বলেছিলেন, “গণতন্ত্রের গর্ভে ব্যক্তি মালিকানা পুষ্ট হতে পারে না। ব্যক্তি মালিকানার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে প্রয়োজন একজন সর্বশক্তিমান নেতার ব্রজকঠিন লৌহমুষ্ঠি। গণতন্ত্রের লালিত্যময় কোমল করস্পর্শেই কমিউনিস্ট চেতনা জার্মান সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছে। কমিউনিস্টদের চিরতরে মুছে ফেলতে, জাতীয়তাবাদের পুনঃ-জাগরণ ঘটিয়ে ব্যক্তি মালিকানার স্বর্ণগর্ভ ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে আমি বদ্ধপরিকর। নির্বাচনে ফলাফল যাই হোক, ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখতে হবে আমাদেরই। প্রয়োজনে অস্ত্রের প্রমত্ত শক্তিতে। আশাকরি আপনাদের সাহায্য পাবো।” সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্ত্যেষ্টি প্রস্তাবে উল্লসিত শিল্পপতিদের ২লক্ষ ৭১হাজার রাইখসমার্ক অনুদানে মুহূর্তে উপচে পড়েছিল স্যাফটের ঝুলি।
২৭শে ফেব্রুয়ারি বার্লিনের লাস্যময়ী রাতের নিকষ অন্ধকার চিরে আগুন জ্বলেছিল রাইখস্ট্যাগে। গেস্টাপো চিফ রুডলফের উদ্দেশ্যে বিকট চিৎকারে গোয়েরিং বলেছিলেন “এটা কমিউনিস্টদের কাজ। কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। প্রতিটি কম্যুনিস্ট কে এখুনি গুলি করে মারতে হবে।” মুহূর্তে নিষিদ্ধ হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি, তাঁদের পত্রিকা, তাঁদের সভা-সমাবেশ। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১০,০০০ কমিউনিস্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি, ভার্সেই পিস-ট্রিটির বয়ে বেড়ানো ক্ষত, কমিউনিস্টদের গ্যালন কতক রক্ত আর শিল্পপতিদের রাইখসমার্কে সওয়ার হয়ে, ২৩শে মার্চ অভিষিক্ত হয়েছিল নাৎসি জার্মানি।
তামাম দুনিয়ার তাবড় ফ্যাসিস্টদের উত্থান হয়েছে, মন্দ অর্থনীতির প্রেক্ষাপটেই, জাতীয়তাবাদের সং সেজেই, সবকা সাথ/সবকা বিকাশের গান গেয়েই আর দেশের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের ঢং করেই। সেই উত্থানের ক্যাটালিস্ট হয়েছে কখনও ১৯৩০’র আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা, কখনও দুর্নীতিগ্রস্ত ইউপিএ-২’র পলিসি প্যারালাইসিস। দ্রুত মুখোশ বদলেছে ফ্যাসিস্টদের, বিকাশের গরু গাছে চড়েছে, ঘৃণার বারুদে দেশ সেজেছে। বিদ্বেষের ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনে ঘৃতাহুতি করেছে সেদিনের গোয়েবলস থেকে আজকের অর্ণব গোস্বামীরা। সর্বশক্তিমানের ৫৬ ইঞ্চির আড়ালে, নিশ্চিন্তে, মুনাফা লুটে, ব্যক্তি মালিকানার মালাই চেটেছে সেদিনের রাইখসমার্ক অনুদানকারী শিল্পপতিরা আর আজকের আম্বানি-আদানিরা।

২।
পুঁজিবাদের স্বার্থেই আপনি শুনে থাকেন পুঁজিবাদের ন্যারেটিভ। ঐ যে, পাবলিক সেক্টর মানেই লোকসান। ইকনমির সর্বনাশ। কিম্বা প্রাইভেট সেক্টর মানেই বেটার ডিসিপ্লিন। বেটার সার্ভিস। এবং অবশ্যই বেটার ‘ইকনমি’। প্রাইভেট হলে পরিষেবা ভালো হবে, প্রাইভেট হলে কর্মসংস্থান হবে, সরকার কেন ভর্তুকি দেবে?, সরকার কেন লোকসানে চলবে? –চায়ের কাপে, অফিস ক্যান্টিনে এই সব পপুলিস্ট ন্যারেটিভের প্যাস্কাল সম চাপে ‘Welfare State’–র ধারণাটাই সমাজে আজকাল ডাইনোসর হয়ে গেছে। এমনিতে বড় লোকদের সম্পদ লুট করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া ‘রবিন হুড’র গল্প পড়ে যারা ‘বেশ করেছে’ গোছের ফিলিংস নিয়ে রাতে বালিশে মাথা রাখে; তারাই আবার নিজেদের নির্বাচিত সরকার, মাত্র ৫০টি কর্পোরেট সংস্থাকে ৬৮হাজার কোটির ঋণ মকুব করছে শুনলে ‘বড়ে বড়ে দেশো ম্যা এইসি ছোটি ছোটি বাতে হোতি রহতি হ্যা স্যানোরিটা’ বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
অথচ এমনটা ছিল না। ১৯৯৯ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ মিডিয়া হাউস বিবিসি নিউজ সাধারন মানুষ, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ -সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে একাধিক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার বিষয় হল, পৃথিবীর ইতিহাসে ঐ সহস্রাব্দের সেরা চিন্তাবিদ কে? কি আশ্চর্য সমাপতন ভাবুন ১৯৯৯-র অক্টোবরে যখন এই সমীক্ষা চালাচ্ছে বিবিসি ঠিক তখনই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দেওয়ার দশম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের ধারাবাহিক সমীক্ষা শেষে বিবিসি জানালো people’s choice for “greatest thinker” হলেন কার্ল মার্ক্স। রানার আপ হলেন আইনস্টাইন। নিউটন এবং ডারউইন যথাক্রমে তৃতীয় এবং চতুর্থ।
বরং একটা সময়ে পুঁজিবাদের, নিও-লিবারেল অর্থনীতির, ফ্রি-মার্কেট পলিসির আঁতুড়ঘর সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ের কোলে একটুকরো মঁ পেলেরিন সোসাইটির প্রবক্তারা ছিলেন নেহাত নগণ্য। আর তাঁদের তত্ত্বের উপর বিশ্বাস করা রাষ্ট্রনায়করা নগণ্যতর। আফসোস করে মঁ পেলেরিন সোসাইটির থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক প্রখ্যাত দার্শনিক ফ্রেডরিখ হায়েক বলতেন “আসলে নতুন ধ্যান ধারণা কে মেনে নিতে অনেক সময় কয়েক প্রজন্ম সময় লেগে যায়।” অন্যদিকে তার বন্ধু অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান বলতেন “সে প্রকৃত হোক বা অনুভূত, শুধুমাত্র সঙ্কটই পরিবর্তনের রাস্তা খুলে দেয়। সংকটকালেই এমন পদক্ষেপ গৃহীত হয় যে গুলো এতদিন ধরে অবাস্তব বা অসম্ভব মনে হত।”

৩।
অবিকল হয়েওছিল তাই। ১৯৭০-র অর্থনৈতিক সংকোচন, মুদ্রাস্ফীতি এবং ওপেক ওয়েল এমবার্গোর ত্রিফলা তে বিদ্ধ অর্থনীতির মুশকিল আসান হিসেবে রোনাল্ড রেগান, মার্গারেট থ্যাচারের মত ক্যারিশমাটিক অনুঘটকদের হাত ধরে প্রথম রাষ্ট্রনীতির রঙ্গমঞ্চে অভিষেক হয়েছিল নিও-লিবারেল অর্থনীতির। ফ্রিডম্যানের ব্যাকরণে যার মানেই হল আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের অহেতুক নাক গলানো বন্ধ করে জায়গা দিতে হবে মার্কেট কে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা সহ সমস্ত পরিষেবা হবে পণ্য। পৃথিবীর মার্কেট হবে উন্মুক্ত। হবে মনোলিথিক। জন্ম নেবে ‘ফ্রি-মার্কেট পলিসি’।
১৯৮৬-তে রোনাল্ড রেগানের ‘নাইন মোস্ট টেরিফাইং ওয়ার্ড’, ১৯৮৯-এ সোভিয়েতের পতন, ১৯৯১-এ আমাদের দেশের বাজারের উদারীকরণ, ১৯৯৬-এ বিল ক্লিনটনের “দি এরা অফ বিগ গভর্নমেন্ট ইস ওভার” -পরবর্তী ইতিহাসটা পৃথিবী জুড়ে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের, নিও-লিবারেল অর্থনীতির অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটানোর, অর্থনীতির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে বাজারের হাতে ছড়ি ঘুরানোর লাইসেন্স দেওয়ার, পরবর্তী ইতিহাসটা পৃথিবী জুড়ে নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চয়তার নীতি কে শিকেয় তুলে ‘Welfare State’ –র ধারণাটাকেই কবর দেওয়ার।

নিও-লিবারেল অর্থনীতি দেখতে কেমন? গন্ধে কেমন? বর্ণে কেমন? স্বাদে কেমন? বুঝতে হলে চেখে দেখুন একটা তথ্য। থাকুক। গত সাতমাসে, করোনা আর লকডাউনের বাজারে, ভারতে নতুন করে বিলিওনিয়ার হয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে দেশে মোট ১১৭ জন – যাঁদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলার। সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিক মুকেশ আম্বানি – সম্পত্তির পরিমাণ ৮,৮২০ কোটি ডলার। আর উল্টোদিকে, লকডাউনের প্রথম ছ’মাসেই কাজ হারিয়েছেন অন্তত ৪১ লক্ষ মানুষ৷ এটা সরকারি হিসাব। প্রকৃত সংখ্যাটা হয়তো আরও কয়েকগুণ বেশি। রাষ্ট্রের দায়িত্বজ্ঞানহীন উদাসীনতায় পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় মারা গেছেন কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিক, ট্রেন চালিয়ে দেওয়া হয়েছে রেললাইনে ঘুমন্ত শ্রমিকদের, তাঁদের স্ত্রী-স্বামী-সন্তানদের দেহের ওপর দিয়ে।

৪।
আজ করোনা প্যান্ডেমিকের ধাক্কায় প্যারালাইজড অর্থনীতির প্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে আবার ঘুরে ফিরে আসছে মার্ক্সবাদের কথা। বিশ্ব জুড়ে অন্য স্রোত। কথায় বলে হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। ফ্রিডম্যান বেঁচে থাকলে বোধহয়য় বলতেন, ক্রাইসিস রিপিটস ইটসেলফ অ্যাস ওয়েল। সেদিন ১৯৭০-র অর্থনৈতিক সংকোচন, মুদ্রাস্ফীতি এবং ওপেক ওয়েল এমবার্গোর এক সংকট খুলে দিয়েছিল নিও-লিবারেল অর্থনীতির দরজা। আর আজকে ২০০৮-র মন্দার দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাবের মধ্যে করোনা প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে সেই নিও-লিবারেল অর্থনীতিকেই।
এমনকি নিও-লিবারেল অর্থনীতির অন্যতম প্রচারক ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ফিনান্সিয়াল টাইমসও গত ৪ঠা এপ্রিল সম্পাদকীয় তে লিখেছে “গত চার দশকের চালিকা নীতিগুলির র‍্যাডিকাল পরিবর্তন দরকার। সরকারকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। পাবলিক সার্ভিসে দায়বদ্ধ হতে হবে। শ্রমের নিরাপত্তা দিতে হবে। ধনীদের সুবিধাজনক নীতি পুনঃবিবেচনা করতে হবে। সর্বনিম্ন সাধারণ আয় এবং সম্পদ করের মতো বিষয়গুলিও আলোচনায় আসা দরকার।” উত্তরসূরি মার্গারেট থ্যাচারের ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে বরিস জনসন বলছেন “পাবলিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে।” স্পেন-আয়ারল্যান্ডের মত দেশ যখন জরুরী ভিত্তিতে সমস্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করছে, তখন ইতালি-ফ্রান্সে সাধারণ মানুষ সরকারে ব্যয় সংকোচ নীতি কে তুলোধোনা করছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রবল বেসরকারিকরণের ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে নিও-লিবারেল অর্থনীতির বধ্যভূমি আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প নাগরিকদের জন্য জিডিপি-র ১৩% সরকারী ব্যয় বরাদ্দ করছেন।

৫।
আজ থেকে মাস ৩ আগেও এই প্রতিটি উদাহরণ শুনলে অবাস্তব, অকল্পনীয় মনে হত। গায়ে চিমটি কেটে সত্যি শুনছি কিনা যাচাই করতে হত। আসলে করোনা প্যান্ডেমিক নিও-লিবারেল অর্থনীতি তে সম্পৃক্ত সমাজ ব্যবস্থাটাকে নতুন করে আর অসার করেনি। বরং অসার হয়ে যাওয় নগ্ন ব্যবস্থাটাকে সকলের কাছে বে-আব্রু করেছে। আর যার সূত্র ধরেই অর্থনীতির উপর সরকারের অধিক নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ মৌলিক পরিষেবার রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা, সম্পদ করের মত বিষয় গুলি যে আগামী দিনে গোটা দুনিয়া জুড়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের নিউক্লিয়াস হতে চলেছে তার লক্ষণ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
আসলে, চলতি প্যান্ডেমিক আরও উলঙ্গ করে দিয়েছে পুঁজিবাদকে। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, খদ্দের টানতে ব্যর্থ ধান্দার ধনতন্ত্র। অল্টারনেটিভ একটাই – একটাই বিকল্প। সমাজতন্ত্র। আর সেই প্রেক্ষিতেই আজকের নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা।
৬।
শেষ করব অভিজ্ঞতা দিয়ে। গর্ভাচেভ আর ইয়েলৎসিন দেখানো মুক্তবাজার অর্থনীতির রঙিন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে তখন ভাঙ্গছে সোভিয়েত। জনৈক মিখাইল’র সেই সময়ের অভিজ্ঞতা তাঁর নোবেল জয়ী “সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইমঃ দ্য লাস্ট অফ দ্য সোভিয়েতস” বইয়ে লিখেছেন বেলারুশিয়ান সাংবাদিকা স্বেতলানা অ্যালেক্সিভিচ -“সোভিয়েত ভাঙ্গার খুশিতে আমি মস্কোর হোয়াইট হাউসের সামনে মানব বন্ধনে হাত মিলিয়ে ছিলাম। কমিউনিজম আর যাতে কোনদিন ফিরে না আসে তার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম। আমরা বলেছিলাম কমিউনিজম চিরকালের জন্য মৃত। তারপর কেটে গেছে ২৫টা বছর। আমার ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কদিন আগে গিয়েছিলাম তার হোস্টেলে। দেখি ডেস্কের উপর পড়ে আছে মার্ক্সের দাস ক্যাপিটাল। আড়ি পেতে শুনলাম আমার ছেলে আলোচনা করছে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো নিয়ে। নিজের চোখ, আর কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল নিজের হাতে যে মার্ক্স কে কফিন বন্দী করে এসেছিলাম সেই মার্ক্সই কি আবার ফিরে এলো?”
হ্যাঁ, এলো। আসলে স্তালিনের নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে আপনি উঠতেই পারেন, সোভিয়েতের প্রশংসায় ‘অ্যানিম্যাল ফার্মের’ অর্গাজমে স্বর্গসুখ আপনি পেতেই পারেন, বলিভিয়ার নিবিড় অরণ্যে ঐ দাড়িওয়ালা গ্ল্যামারাস ডাক্তার ছেলেটার মৃত্যুর প্রতি নিরাসক্ত আপনি থাকতেই পারেন, তীব্র শৈত্য প্রবাহে রেড আর্মির লং-মার্চ কিংবা পাভেল করচাগিনের ইস্পাত কঠিন লড়াই কে ব্যঙ্গ আপনি করতেই পারেন, এমনকি ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের দাড়ির থেকে রামদেবের দাড়িই আপনার বেশি পছন্দ হতেই পারে; কিন্তু গীতার ‘শ্লোক’ থেকে কোরানের ‘সূরা’ হয়ে বাইবেলের টেস্টামেন্ট -কোথাও এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অর্থনীতির বিশল্যকরণী খুঁজে আপনি পাবেন না। পুঁজিবাদী বাজারে হিন্দু-মুসলমানের ক্যালোরির আলাদা হিসাব কষতে আপনি পারবেন না। মুক্তবাজারের মুনাফা তে ব্রাহ্মণ-দলিত’র ‘উদ্বৃত্ত শ্রমের’ পার্থক্য করতে আপনি পারবেন না। ধর্মের বুলি কপচে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতও জুটিয়ে আপনি দিতে পারবেন না। কারণ বাস্তব এটাই যে আপনার-আমার শ্রম আজ ‘বাজারের পণ্য’। বাস্তব এটাই যে শ্রমের শোষণেই পৃথিবী জোড়া সম্পদের এই প্রবল বৈষম্য। আর বাস্তব এটাও যে ধর্মশাস্ত্র বা অ্যাডাম স্মিথের ‘দি ওয়েলথ অফ নেশনশ’র পুঁজিবাদী মুক্ত বাজারে নয়; দাড়ি বুড়োর ‘দাস ক্যাপিটাল’ই বন্দী আছে অর্থনীতির সাম্য। এই নভেম্বর। এই প্যান্ডেমিক। এই পুঁজিবাদ। এই তিনের প্রেক্ষিতের সমাপতনের শিক্ষা একটাই। বিকল্প বামপন্থাই।

Spread the word

Leave a Reply