Panchayat 12

Panchayat: A Story Of Loot (Part XII)

চন্দন দাস

দ্বাদশ পর্ব

কারখানাগুলি হল না। হলো না সিঙ্গুরে, শালবনীতে, রঘুনাথপুরে, পানাগড়ে, কোচবিহারে এবং আরও অনেক জায়গায়। সেগুলির কিছু চলে গেল অন্য রাজ্যে। কিছু হলোই না।

সেখানে কাজ করার কথা ছিল যাঁদের, তাঁরা রয়ে গেলেন নিজভূমে।

ফল কী দাঁড়ালো?

মমতা ব্যানার্জির ধারনা অনুসারে কৃষক কৃষক রইলেন। চাষের জমি, তা চাষযোগ্য না হলেও জমি রইলো। কৃষক ফসলের দাম না পেলেও চাষ করে চললেন। গ্রামে মহাজনের প্রভাব বাড়লো। সুযোগ বুঝে ফড়েদের দৌরাত্ম আরও বাড়লো। অথচ কী আশ্চর্য — রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত দপ্তরের নথী বলছে গ্রামে সুদখোর মহাজনদের আরও কোণঠাসা করতে আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৭-০৮-এ।

সময়ের দাবি তাই ছিল।

কিন্তু রাজ্যে শিল্পোদ্যগের ক্ষতি হওয়ার ফলে কয়েকটি পরিবর্তন ঘটে গেল। প্রথমত, চাষের উপর বেড়ে চলা চাপ আরও বাড়ল। ফলে কৃষকের ক্ষতি আরও বাড়ল। চাষের কাজের সুযোগ আরও কমল। দ্বিতীয়ত, যাঁরা নিজের পাড়ায়, জেলায় কিংবা রাজ্যে কাজ পেতেন কারখানাগুলিতে, যাঁরা সেই শিল্পগুলির উপর নির্ভর করে ছোট, ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার আশায় ছিলেন, তাঁরা চলে যেতে শুরু করলেন ভিনরাজ্যে। কৃষিনির্ভর গ্রামের যুবরা মূলত ভিন রাজ্যের ‘চিপ লেবার’-এ পরিণত হলেন। তৃতীয়ত, রাজ্যে বড়, মাঝারি, ছোট কারখানা, সেখানে রাজ্যের মানুষের কাজ — এই সবকিছু থেকে রাজ্যের আয় বাড়ত। যে টাকা পঞ্চায়েত, পৌরসভাগুলির মাধ্যমে খরচ করতে পারত সরকার। আবার রাজ্যে বাজারের সম্প্রসারণ ঘটত। যার সুফল মিলত রাজ্যেই।

ঠিক যা ভূমিসংস্কারের পরে ঘটেছিল। ভূমিসংস্কার ছাড়া পঞ্চায়েত সম্ভব ছিল? না। আর্থিক বিকাশের হাত ধরে গনতন্ত্র প্রসারিত হওয়ার দৃষ্টান্তই ভূমিসংস্কার এবং পঞ্চায়েত। ২০০১-০২ থেকে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত আর এক বিকাশের অপেক্ষায় ছিল শিল্পায়নের হাত ধরে। শিল্পের সম্ভাবনা ধ্বংস করে মূলত গ্রামীণ প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত শক্ত করেছে তৃণমূল এবং তার সহযোগীরা।

সূর্য মিশ্র কী লিখছেন? ২০০৭-এ মার্কসবাদী পথ পত্রিকায় তাঁর একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গে কৃষি বিকাশের প্রশ্নটি কী?’ সেখানে ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সংগ্রাম’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজ্যের তৎকালীন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী লিখলেন,‘‘কেবল কৃষির বিকাশের ভিত্তিতে শিল্পায়নের প্রশ্নই নয়। সব দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রশ্নটি এখন কৃষক ও কৃষির স্বার্থেই শিল্পায়নের প্রশ্ন। ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েতের ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে কৃষি ক্ষেত্রে রাজ্য ও রাজ্যের জনগন যে সাফল্য অর্জন করেছেন তা বিপদাপন্ন হবে যদি এখনই শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রের বিকাশ শুরু না হয়।’’

singur tata nano

অর্থাৎ শিল্পের বিকাশ না হলে ভূমিসংস্কার বিপন্ন হবে। পঞ্চায়েতও বিপন্ন হবে।

কেন? কৃষির উপর নির্ভরশীল বিপুল মানুষের কাজের কমাতে না পারলে কৃষির ক্ষতি। সেই মানুষগুলিরও ক্ষতি। শিল্প বাড়লে রাজ্যের আয় বাড়বে। সেই বাড়তি আয়ের একটি বড় অংশ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নানা ধরনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। পঞ্চায়েত আরও শক্তিশালী, গতিশীল হবে।

সেই সময়েই পঞ্চায়েতের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। সেই ‘পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা উন্নয়নের পথনির্দেশিকা’র ৩৬নং পাতায় লেখা হল —‘‘ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পোন্নয়ণের লক্ষ্যে রাজ্য সরকার যে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার সঙ্গে পঞ্চায়েতের জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা পরিকাঠামো উন্নতিসাধন করবে। পঞ্চায়েত সহায়তা নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে এই কাজ বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়নের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করেছে।’’

অর্থাৎ পঞ্চায়েতের কাজ বাড়ছিল। পঞ্চায়েত আরও কাজে যুক্ত হচ্ছিল।

এখন?

গ্রামের ক্ষমতা আমলাদের হাতে। মমতা ব্যানার্জি দিয়েছেন। গ্রাম সভা বন্ধ। মানুষের মতামত ব্রাত্য। অন্যদিকে গ্রামে কাজের চাহিদা আরও বেড়েছে গত এগারো বছরে। কিন্তু কৃষি আর কাজের সংস্থান আগের মত করতে পারছে না। তাই নন্দীগ্রামে চাষের জমিতে লোনা জল ঢুকিয়ে চিংড়ির চাষ করছেন কৃষকরা। ধান চাষ বন্ধ। কারন — ধান চাষে লাভ নেই। লাভ নেই, তাই খেতমজুরের কাজও কমেছে। 

সিঙ্গুরেও তাই। ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে সেখানে রেগার কাজ চেয়েছিলেন ১৩হাজারের কিছু বেশি গ্রামবাসী। ২০২১-২২-এ তা পৌঁছে গেছে প্রায় ৩৩ হাজারে। গ্রামে চাষে সারা বছর কাজের সুযোগ নেই। চাষে উপার্জনের সম্ভবনা ক্ষীণ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কাজের প্রয়োজন। কিন্তু শিল্প গড়ে ওঠেনি। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পও মার খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রেগার কাজের চাহিদা বাড়ছে।

গ্রামে নাভিঃশ্বাস। কাদের? মূলত যাঁরা গ্রামীণ শ্রমজীবী। তাঁদের একটি বড় অংশ আবার কৃষির সঙ্গে যুক্তও নন। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে এটিই ছবি। অসংগঠিত শ্রমিক, অকৃষিকাজে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা গ্রামাঞ্চলে বাড়ছিল — তা বামফ্রন্ট সরকারই উপলব্ধি করেছিল। তাঁদের একটি বড় অংশের কাজের জায়গা হতে পারত শিল্প এবং অনুসারী শিল্পে। যা উন্নততর পঞ্চায়েত গঠনে সহায়ক হত।

তার কিছুই হয়নি। তৃণমূল এবং তাদের সহযোগীরা শিল্পোন্নয়নে ধাক্কা মেরে পঞ্চায়েতেরও ক্ষতি করেছে।

এখন সিঙ্গুরে গত সাত বছরে রেগায় কাজের দাবি করা গ্রামবাসীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। নন্দীগ্রামে চাষের জমিতে লোনা জল ঢুকিয়ে ভ্যানামি তৈরি করতে হল কৃষককে।

কারন — কৃষি আর গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান ধারক থাকতে পারছে না। গ্রাম মানে শুধুই কৃষক, শুধুই কৃষিজীবী মানুষ — এই ধারনা ভেঙে যাচ্ছে। গ্রাম রূপান্তরের পর্যায়ে ছিল। মমতা ব্যানার্জি আর তার সহযোগিতা সেই গতিকে আটকে দিলেন। বামপন্থীরা এই কথা গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই বলছিলেন। তখন তাকে অনেকটাই তাত্বিক মনে হয়েছিল। ২০০৬-০৭-এ কথাগুলি ছিল অনেক স্পষ্ট উদাহরণসমেত।

এখন? গ্রাম তথা রাজ্যের এটাই প্রধান সঙ্কট। তার প্রভাব পড়েছে পঞ্চায়েতেও।

গ্রামের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব পড়ল ‘গ্রামের সরকার’-এ, অর্থাৎ পঞ্চায়েতে। যত আর্থিক অবস্থার উন্নতি, তত পঞ্চায়েতের বিকাশ — উন্নততর পঞ্চায়েত। তার বদলে হলো লুটের পঞ্চায়েত। তৃণমূলের নেতৃত্বে। কেন? বিকাশের পর্যায়ে থাকা গ্রামের সম্ভাবনা ধ্বংস করে আসলে গ্রামীণ সংস্কৃতিরও ক্ষতি করেছে তৃণমূল। যে কোনও ভাবে টাকা জোটাও — এই সংস্কৃতি এসেছে মূলত অনিশ্চয়তা থেকে। ‘অনুপ্রেরণা’ পেয়েছে তৃণমূলের নেতাদের। সামগ্রিকভাবে যা ছিল গনতন্ত্রের এক দৃষ্টান্ত তা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন দাসের এই প্রবন্ধটি মোট ১২ টি পর্বে প্রকাশিত হল।

Spread the word

Leave a Reply