প্রকাশ কারাত
২৬ জানুয়ারি আমরা সাধারণতন্ত্র দিবস পালন করি। কারণ আমরা একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান গ্রহণ করেছিলাম। ভারতের সংবিধান একটি অনন্য দলিল যেটি তৈরি করা হয়েছিল ভারতের গণপরিষদের দ্বারা। এই সংবিধান সেই সকল মূল্যবোধের আধার যেগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালে গড়ে উঠেছিল। এই স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতে আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের ধারণার জন্ম দেয়। একটা জাতিরাষ্ট্র যেটা হবে গণতান্ত্রিক,যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ। এই দেশ সমস্ত দেশবাসীকে অন্তর্ভূক্ত করবে নিজের মধ্যে। সকলকে দেশের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেবে-সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখবে। এই সংবিধানেই বলা আছে যে দেশের সকল নাগরিক – ধর্ম, ভাষা, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান। এইভাবেই ফরাসী বিপ্লবের সেই চিরন্তন ধারণাগুলি- সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ভাবনা আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়।
ভারতের মত একটা বৈচিত্র্যময় দেশে আমাদের সংবিধান সেই বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব সহকারে অন্তস্থ করে। যেমন আমাদের দেশে বহু ভাষা রয়েছে তাই সংবিধানের অষ্টম তফসিলে একাধিক ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধান অনুসারে ভারতে ২২টা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই সংবিধানই আবার যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে দেশের কাঠামো কেমন হবে সেটাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। যদিও সেটা সম্পূর্ণ রূপে যুক্তরাষ্ট্র না হলেও বহু যুক্তরাষ্ট্রীয় উপাদান এর মধ্যে রয়েছে। ভারতীয় ইউনিয়ানের বিভিন্ন রাজ্যগুলোর নিজেদের অধিকারের একটা নিজস্ব বৃত্ত আছে। যে কারণে বলা হয় ভারত হল বিভিন্ন রাজ্যের একটা ইউনিয়ান,অর্থাৎ এটা স্বীকৃত যে ভারত অনেকগুলো রাজ্যের সম্মেলনে গঠিত একটা প্রজাতন্ত্র।
সুতরাং, এই সংবিধান, যার জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতা থেকে এবং এটাই ছিল ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্মলাভের ভিত্তি। বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীন হওয়া অন্য কোন দেশে এইরকম গণতন্ত্রের বিকাশ দেখা যায়নি। যেমনটা আমরা জানি যে সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পরে আমাদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫২ সালে এবং তারপর থেকে আমরা নিয়মিত নির্বাচন সংগঠিত করে গেছি। জাতীয় স্তরে এবং রাজ্য স্তরে আমরা, মানে জনগণ সরকার নির্বাচিত করেছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারণা – এর ভিত্তিটা হল প্রজাতন্ত্রে নাগরিকত্বের ধারণায় সকলে সমান, আইনের চোখে এবং সংবিধানের চোখেও।
২০১৪ তে লোকসভা নির্বাচনে জিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সংবিধান ভয়ানক আক্রমণের সম্মুখীন। বিজেপি হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মুখ, আর শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ভারতের সংবিধানকে মানতে অস্বীকার করেছিল। এর প্রথম কারণ হল এরা স্বাধীনতার সংগ্রামের অর্জিত মূল্যবোধগুলোর সাথে সহমত নয়, আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে অস্বীকার করেছিল। তাদের হিন্দুত্বের আদর্শে তারা মনে করে যে হিন্দুরাষ্ট্রের মূল শত্রু হল মুসলমানরা সুতরাং তাদের মতে (আরএসএস) মূল লড়াইটা হল মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নয়। সেইজন্য তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে , স্বাধীনতার সেই লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হয়নি, সংবিধান প্রনয়নেও তাই তাদের কোন ভূমিকা ছিল না।
এমনকি যখন সংবিধান গৃহীত হয় আরএসএস বলেছিল মনুস্মৃতি এর থেকে ভালো সংবিধানের ভিত্তি হতে পারত। মনুস্মৃতি এমন একটা ধার্মিক গ্রন্থ যেখানে বলা হয় মহিলা ও নীচু জাতের মানুষদের অধস্তন হিসাবে দেখা উচিত। তারা বাকিদের সাথে সমানাধিকার পেতে যোগ্য নয়। এটাই হল আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী। সেইজন্য, এখন যখন প্রায় সাড়ে আট বছর ধরে তারা ক্ষমতায় রয়েছে তারা ভেতর থেকে সংবিধানকে বিপর্যস্ত করার নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে। সংবিধানকে সামনে রেখেই সংবিধানে উল্লেখিত সমস্ত আদর্শগুলোকে অবদমিত ও বিকৃত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা, যা বলে যে ভারতে সমস্ত ধর্মকেই সমান চোখে দেখতে হবে, সেখানে আমরা এমন একটা সরকার এমন একজন প্রধানমন্ত্রীকে দেখছি, যে বা যারা একটা ধর্মকেই গুরুত্ব দেয়- হিন্দু ধর্ম। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সরকারিভাবে রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন,মন্দির চত্বরের সংস্কার যেমন কাশীর বিশ্বনাথ করিডোরের সংস্কারের কাজ শুরু করা থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই উপস্থিত থাকেন। এই পর্যায় থেকে নীচের দিকে গেলেও দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের ,বিশেষ করে মুসলমানদের, কিছু ক্ষেত্রে খ্রীস্টানদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ,গুজরাটের মত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার জন্য তারা বাকিদের মত সমান অধিকার ও সমান সামাজিক অবস্থান থেকে বঞ্চিত হয়। অর্থাৎ ইতিমধ্যেই, বিজেপির শাসনে সংবিধান স্বীকৃত সমস্ত নাগরিকের সমানাধিকার আজ বিপন্ন।
আরেকটা দিক রয়েছে, সেটাও যথেষ্ট উদ্বেগের। বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো আজ বিপন্ন। এমন একটা স্বৈরতন্ত্র নামিয়ে আনা হয়েছে যা বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন কোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট,সৈন্য বাহিনী,আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ও স্বাতন্ত্রকে অবদমিত করছে। এদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে কেন্দ্রের শাসকদের ইচ্ছায় কাজ করতে অথবা এমন ব্যক্তিবর্গকে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে ঢোকানো হচ্ছে বা যোগসাজোশ করা হচ্ছে যারা শাসকদলের হয়ে কাজ করবে। বর্তমানে এদের লক্ষ্য হল সুপ্রীম কোর্ট।
আমলাতন্ত্রকে নিজেদের বশীভূত করা, ভারতের নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের বশীভূত করা, ইডি-সিবিআই এর মত কেন্দ্রীয় এজেন্সীগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার এর সবটাই এরা করেছে। এখন এদের প্রয়াস হল বিচারব্যবস্থার অখন্ডতা ও স্বাতন্ত্রকে বশীভূত করা। এখন যা ঘটছে সেটা হল আরএসএস-এর পরিকল্পনা অনুসারে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির দিকে এগোনো। এই হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা সংবিধান বিরোধী এবং সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী।
আজকের দিনে সবথেকে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সংবিধানের অস্তিত্ব বা সংবিধানের প্রজাতান্ত্রিক ধারণার অস্তিত্ব। স্বৈরাচারী হিন্দুত্ব সংবিধানকে নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য পুনর্নির্মাণ ও পরিবর্তন করতে চাইছে। এর অর্থ, যে প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান ভারতের গণপরিষদের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল এবং যা গত সাত দশক ধরে কার্যকর ভূমিকা পালন করে গেছে আজ ভয়াবহ আক্রমণের মুখে পরেছে। আজকের দিনে ভারতের সমস্ত নাগরিক, ভারতের সকল গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষের প্রধান কর্তব্য হল সংবিধানের ওপর এই আক্রমণ নামিয়ে আনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। গণতন্ত্রকে রক্ষা করা, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করা ও সংবিধানকে রক্ষা করা এইগুলোই আগামী দিনগুলোতে আমাদের মুখ্য দায়িত্ব হওয়া উচিত।
ভাষান্তরঃ সরিৎ মজুমদার