লাগাতার সরকারের ভ্রুকূটি অমান্য করে করোনা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য তুলে ধরছে গণশক্তি । সত্য উন্মোচনের ‘অপরাধে’ বুধবার নবান্নের সাংবাদিক সম্মেলেনে সরাসরি রাজ্য সরকারের প্রধানের কাছ থেকে এসেছে ‘আইনি ব্যবস্থার’ হুমকি। সেই প্রেক্ষিতেই সংবাদপত্রের দায়বদ্ধতা নিয়ে কলম ধরলেন ‘গণশক্তি’ র সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী ।
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বিশ্বজনীন দুর্যোগ। এই সঙ্কট মোকাবিলায় এখনও মানবসমাজ পূর্ণ সাফল্য অর্জন করেনি। তথাকথিত উন্নত দেশগুলিতেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে সংক্রমণের হার পাহাড় ছুঁয়েছে, মৃতের সংখ্যা বিপুল। ভারতেও সংক্রমণ বাড়ছে, লকডাউন সত্ত্বেও পুরো নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এসবই সাদা চোখে দেখতে পাওয়া তথ্য।
এই সঙ্কট মোকাবিলায় কয়েকটি পূর্বশর্ত রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বিশেষজ্ঞরা সেই পূর্বশর্তগুলির কথা বলছেন। হয় সে-সব মানতে হবে, অন্যথায় আজ না হোক কাল বিপদে পড়তেই হবে। পূর্বশর্তের অন্যতম হলো তথ্য প্রকাশ করা। অন্যভাবে বললে তথ্য গোপন না করা। তথ্য গোপন করলে জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, সংক্রমণের গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হয়। তা থেকে একদিকে সমাজে সতকর্তার ঘাটতি তৈরি হয় অন্যদিকে নীতি নির্ধারণে এমনকি সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণেও ভুলের অবকাশ তৈরি হয়। কোনও কোনও শাসক সাময়িকভাবে মনে করতে পারেন সংক্রমণের সংখ্যা বা মৃতের সংখ্যা কম করে দেখিয়ে কৃতিত্ব নেওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে যাবে না। একদিন সেই বুদ্বুদ ফেটে যাবে, তখন বর্ধিত বিপদের মধ্যে অরক্ষিত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
একথা উল্লেখ করতে হলো কেন না সঠিক তথ্য প্রকাশের দায়ে গণশক্তিকে হুমকি শুনতে হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে এই হুমকি আসছে। পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণের সংবাদ প্রকাশ করাই সংবাদমাধ্যমের কাজ। প্রকৃত চিত্র কী, কতজন সংক্রমিত হচ্ছেন, কতজন কোয়ারান্টিনে যাচ্ছেন, মৃতের সংখ্যা কত, কতজন রোগমুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন, হাসপাতাল কেমন চলছে, চিকিৎসকরা কীভাবে লড়াই করছেন— করোনা মহামারীর সময়ে এই খবরই যদি না ছাপা হবে তাহলে আর ‘সংবাদপত্র’ প্রকাশ করা হবে কেন? ভুয়ো খবর প্রকাশ অন্যায়। আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য যদি ভুয়ো খবর প্রকাশ হয় তা অন্যায়। সরকারি সূত্রে যদি ভুয়ো খবর প্রচার হয়, তা-ও কি ন্যায্য? গণশক্তি ভুয়ো খবরের সংক্রমণ ছড়ানোর পত্রিকা না।
ধরা যাক, রাজ্যে মৃতের সংখ্যা। রাজ্য সরকার একটি সংখ্যা প্রকাশ করছে। গণশক্তিতে তা জানানোও হচ্ছে। কিন্তু ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের একটি নির্দেশিকা রয়েছে— কোভিড-১৯’এ মৃত্যু বলতে কী বোঝানো হবে। সেই মাপকাঠি অনুসরণ করা হচ্ছে কি? এই প্রশ্ন তোলা কি অন্যায়? গণশক্তি কিন্তু সেই মাপকাঠি মেনেই চলেছে। মনপসন্দের বিষয় নয়, বিজ্ঞানের বিষয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের নির্দেশ। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নির্দেশ। আমরা দেখেছি একজন রোগীর মৃত্যুর পরে তাঁর পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ এসেছে। লিখব না? একজন রোগীর মৃত্যুর কারণে এক হাসপাতালের ৪৯ জন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারান্টিনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো সরকারই। অথচ সেই রোগীর করোনা হয়েছিল বলা যাবে না? তাহলে কোয়ারান্টিনে পাঠালেন কেন? বেশ কয়েকজন রোগীর ক্ষেত্রে শেষকৃত্য করা হয়েছে করোনা রোগীদের জন্য প্রযোজ্য নিয়ম মেনেই। করোনায় মৃত্যু না হলে তা করা হলো কেন? এই সংবাদ লেখা যাবে না?
ধরা যাক, পরীক্ষার ক্ষেত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, পরীক্ষা পরীক্ষা পরীক্ষা। করোনা মোকাবিলার আরেকটি পূর্বশর্ত। ভারতেই পরীক্ষা হচ্ছে খুব কম। বিশ্বের নিরিখে একেবারে তলার দিকে। পশ্চিমবঙ্গ আবার দেশের নিরিখে একেবারে নিচের দিকে। লেখা যাবে না? তর্কের খাতিরে না হয় লিখলামই না। তাহলে বিপদ কোথায়? বিপদ সুপ্ত সংক্রমণের। যা একবার দ্রুত ছড়াতে শুরু করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। ক্ষতি কার? রাজ্যের, রাজ্যের জনগণের। এই সংবাদ লেখা সামাজিক কর্তব্য।
শুধু সরকারি ভাষ্যের জন্য সরকারের বুলেটিন রয়েছে। সরকারের পদক্ষেপও তো খবর। সরকারের পদক্ষেপ থেকেও জানা যাচ্ছে কোথায় কী অবস্থা। কোথায় ভালো, কোথায় তত ভালো নয়। সেই খবর প্রকাশ করা যাবে না? কেন? দেশে কি সেন্সরশিপ রয়েছে?
গণশক্তি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ। করোনা মোকাবিলার সময়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে গায়ে পড়ে অসহযোগিতার বা সংঘাতের কোনও উদ্দেশ্য গণশক্তির নেই। এই মহামারী মোকাবিলা জনগণের, পুরো সমাজের ঐক্যবদ্ধ দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সম্পর্কে গণশক্তি সচেতন। এই দায়িত্ববোধ থেকেই রাজ্যের জনগণের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়ে গণশক্তি সচেতন থাকছে, থাকবেও। যে পদক্ষেপে জনগণের ক্ষতি হতে পারে, তা লিখবে। যে পদক্ষেপে জনগণের সংক্রমণের বিপদ কমবে, তা বারংবার লিখবে। গণশক্তির পাঠকরা জানেন এই দুই কাজই যথাসাধ্য নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছি আমরা। এক কথায় একেই বলে সৎ সাংবাদিকতা।
জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন প্রয়োগ, জেলে পোরার হুমকি দিয়ে গণশক্তিকে চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, করোনাকে জেলে পোরা যাবে না।