ওয়েব ডেস্ক প্রতিবেদন
লকডাউন, আনলক নানা কারিকুরির মধ্যেও করোনা সংক্রমণ কমার কোন লক্ষণ নেই।আমআদমির পকেট-এ এখনো লকডাউন। জুনে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৬.০৯%। যা দেশের প্রথম সারির ব্যাঙ্কগুলি এখন জমার উপরে যতটা সুদ দিচ্ছে (কমবেশি ৫.৫%), তার তুলনায় অনেকটা বেশি। অর্থাৎ, ব্যাঙ্কে টাকা রেখে কর মেটানোর পরে হাতে যে সুদ আসছে, তার প্রায় পুরোটাই চলে যাচ্ছে জিনিসের দাম মেটাতে। ঝুলি ভরছে না সঞ্চয়ের।
মানুষকে বিশেষত ভাবাচ্ছে খাদ্যপণ্যের দাম। যা বেড়েছে ৭.৮৭%। এর মধ্যে ডালের দাম বেড়েছে ১৬.৬৮%, মাছ-মাংসের ১৬.২২%, ভোজ্য তেল ১২.২৭% এবং মশলার ১১.৭৪%। তবে বাজারে গেলে মনে হবে, আসলে খাদ্যপণ্য সরকারি হিসেবের চেয়েও অনেকটা দামি। তার উপরে রয়েছে পেট্রল ও ডিজেলের নাগাড়ে বেড়ে চলা দর। যা ঠেলে তুলতে শুরু করেছে জিনিসের দামকে। এই পরিস্থিতিতে আমানতে সুদের হারের পতন নিয়ে চিন্তায় আমজনতা। বিশেষ করে কপালে ভাঁজ গভীর হচ্ছে করোনার ধাক্কায় কাজ হারানো বা বেতন ছাঁটাই হওয়া মানুষের। প্রবীণরা অন্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি সুদ পাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু শুধুমাত্র তাঁদের জন্য আনা বিভিন্ন প্রকল্পেও সুদ কমেছে লকডাউনের মধ্যে। ফলে খুব একটা স্বস্তিতে নেই তাঁরাও।
সাধারণ মানুষের কোন উপকারে না আসুক,ব্যাঙ্কগুলো এখন মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে উঠেছে। ইন্দিরা গান্ধির ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ৫১-তম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ব্যাঙ্কের কর্মীরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। তাঁদের উদ্বেগের কারণ ছিল, সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে অনাদায়ী ঋণের বোঝা। রবিবার এই তথ্যকে হাতিয়ার করেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানালেন সীতারাম ইয়েচুরি সহ বিরোধি নেতৃত্ব। এক ট্যুইট বার্তায় ইয়েচুরি বলেন – এটা ব্যাংকগুলোতে জমা হওয়া মানুষের আজীবনের সঞ্চয় লুট।ঋণ খেলাপিদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে মানুষের অর্থ ফেরত দিতে হবে।মোদির ঘনিষ্ঠদের এই লুটপাট রুখতেই হবে, এদের গ্রেফতার করতে হবে।
রবিবার ছিল ইন্দিরার ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের বর্ষপূর্তি। শনিবারই ব্যাঙ্ক কর্মীদের সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন’ ২,৪২৬টি সংস্থার তালিকা প্রকাশ করে। এই সংস্থাগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ১,৪৭,৩৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে শোধ করেনি। অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের তালিকা অনুযায়ী, ২,৪২৬টি সংস্থার মধ্যে ৩৩টি সংস্থার বকেয়া ঋণের পরিমাণ মাথা পিছু ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এই ৩৩টি সংস্থার কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৩২,৭৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেহুল চোকসির গীতাঞ্জলি জেমস (৪,৬৪৪ কোটি টাকা), গিলি ইন্ডিয়া (১,৪৭৭ কোটি টাকা), উইনসাম ডায়মন্ডস (২,৯১৮ কোটি টাকা), এবিজি শিপইয়ার্ড(১,৮৭৫ কোটি টাকা), রুচি সোয়া ইন্ডাস্ট্রিস (১,৬১৮ কোটি টাকা), নক্ষত্র ব্র্যান্ডস (১,১০৯ কোটি টাকা) , কিংফিশার এয়ারলাইন্স(৫৮৬ কোটি টাকা) রয়েছে। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ সবথেকে বেশি, ৪৩,৮৮৭ কোটি টাকা রয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের খাতায়।
সারা ভারত ব্যাঙ্ক কর্মচারি এ্যাসোসিয়েশানের সাধারণ সম্পাদক সি এইচ বেঙ্কটাচালাম জানান যে এই গোটা হিসাবটা Central Repository of Information on Large Credits (CRILC) এর ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবধির হিসাব। তাঁর মতে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে বকেয়া আদায় করার একমাত্র উপায় অধ্যাদেশ জারি করা। দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে উদ্ধার করতে হবে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অধিকাংশই নামজাদা সংস্থা। তাদের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও তারা ঋণ শোধ করছে না। তার জন্য ব্যাঙ্ক কেন খেসারত দেবে! অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কোনও সংস্থা একটি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করছে না। কিন্তু অন্য ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাচ্ছে। এই সংস্থাগুলোর সামর্থ্য আছে তাই এদের কোনভাবােই এনসিএলটি(ন্যাশনাল কোম্পানি ল্য ট্রাইব্যুনাল) বা আইবিসি(ইনসলভেন্সি এ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোড)এর আওতায় কোন ধরণের ছাড় দেওয়া চলবে না।
বেঙ্কটাচালাম আরো বলেন যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো দেশের আর্থিক অগ্রগতি ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রের ইঞ্জিনের ভূমিকা পালন করে এসেছে, আত্মনির্ভর ভারত গড়তে গেলে তাদের আরো শক্তশালী করা প্রয়োজন।এই ব্যাঙ্কগুলোর সামনে সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা হল এই বেসরকারি সংস্থা ও কর্পোরেটদের অনাদায়ী ঋণ। অবিলম্বে এই ঋণের বকেয়া আদায় করতে পারলে দেশ গঠনে ব্যাঙ্কগুলোর ভূমিকা আরো বৃদ্ধি পাবে।
২০ লক্ষ কোটি টাকার যে অর্থনৈতিক প্যাকেজের কথা ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের সরকার ঘোষণা করেছে তার একটা বড় অংশই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর মাধ্যমে শিল্প ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের। অর্থনীতিবিদদের একাংশের আশঙ্কা যে এমএসএমই ক্ষেত্রের জন্য প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা সহ প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকার যে আর্থিক ঋণ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে এবং যে ঋণের সুদ দেওয়ার প্রয়োজন চলতি অর্থবর্ষে পড়বে না, তার ফলে অনাদায়ী ঋণের বোঝা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর ওপরে আরো বাড়বে যার কুফল সামনের অ্রর্থবর্ষে বোঝা যাবে। ব্যাঙ্কসংগঠনগুলোর তাই দাবি দেশের আর্থিক মেরুদন্ডকে শক্তিশালী করতে অবিলম্বে বড় মাপের ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে আইনী প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।