On Friedrich Engels: V I Lenin

ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস প্রসঙ্গে ভি আই লেনিন             

            নিভে গেল মনীষার কিবা দীপশিখা,

          আহা, কী হৃদয়ে রুদ্ধ হলো রে স্পন্দন। *

নতুন পঞ্জিকা অনুসারে ১৮৯৫ সালের ৫ আগস্ট (২৪ জুলাই) লন্ডনে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর বন্ধু কার্ল মার্কসের পর (১৮৮৩ সালে প্রয়াত) এঙ্গেলসই ছিলেন গোটা সভ্য দুনিয়ায় আধুনিক প্রলেতারিয়েতের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মনীষী ও নেতা। কার্ল মার্কসের সঙ্গে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের পরিচয়ের পর থেকে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস কী করেছেন সেটা বুঝতে হলে আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশে মার্কসের মতবাদ ও ক্রিয়াকলাপের তাৎপর্য পরিস্কার হৃদয়ঙ্গম করা দরকার। মার্কস ও এঙ্গেলস সর্বপ্রথম দেখান যে, শ্রমিকশ্রেণী ও তার দাবিদাওয়া হল বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আবশ্যিক সৃষ্টি, এ-ব্যবস্থা ও তার বুর্জোয়ারা অনিবার্যভাবেই প্রলেতারিয়েতেকে সৃষ্ট ও সংগঠিত করে। তাঁরা দেখান, মানবজাতি বর্তমানে যে দুর্দশায় নিপীড়িত তা থেকে তার পরিত্রাণ ঘটায় বিভিন্ন সহৃদয় ব্যক্তিবিশেষের শুভ প্রচেষ্টা নয়, সংগঠিত প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী-সংগ্রাম। মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের বৈজ্ঞানিক রচনায় প্রথম ব্যাখ্যা করেন যে সমাজতন্ত্র স্বপ্নদ্রষ্টার কল্পনা নয়, বর্তমান সমাজের উৎপাদনী শক্তিগুলির বিকাশের চরম লক্ষ্য ও অপরিহার্য পরিণাম মাত্র। এ যাবৎকার সমস্ত লিখিত ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস, কতকগুলি সামাজিক শ্রেণীর উপর অন্য কতকগুলি শ্রেণীর প্রভুত্ব ও বিজয়ের পালাবদলের ইতিহাস। এবং তা চলতে থাকবে যতদিন না লোপ পাচ্ছে শ্রেণী-সংগ্রাম ও শ্রেণী-প্রভুত্বের ভিত্তি, অর্থাৎ ব্যক্তিগত মালিকানা ও বিশৃঙ্খল সামাজিক উৎপাদন। প্রলেতারীয় স্বার্থের দাবি হল এই সব ভিত্তির বিলোপ, তাই সংগঠিত শ্রমিকদের সচেতন শ্রেণী-সংগ্রাম চালিত হওয়া চাই এদের বিরুদ্ধে। আর প্রতিটা শ্রেণী-সংগ্রামই হল রাজনৈতিক সংগ্রাম।

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস

মার্কস ও এঙ্গেলসের এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানে আত্মমুক্তির জন্য সংগ্রামরত সমস্ত প্রলেতারিয়েত আয়ত্ত করেছে, কিন্তু উনিশ শতকের ৪০-এর দশকে যখন দুই বন্ধু তৎকালের সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য ও সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলেন তখন এ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেবারেই অভিনব। গুণী ও গুণহীন, সৎ ও অসৎ এমন বহু লোক তখন ছিলেন যাঁরা রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামে, রাজা, পুলিশ ও যাজকদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আচ্ছন্ন হয়ে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের স্বার্থবিরোধ দেখতেন না। শ্রমিকেরা স্বাধীন সামাজিক শক্তি হিসেবে অবতীর্ণ হবে এ ভাবনাটাকেই আমল দিতেন না তাঁরা। অন্যদিকে ছিলেন বহু স্বপ্নদর্শীও (কখনও কখনও আবার প্রতিভাবান), তাঁরা ভাবতেন যে সমসাময়িক সমাজ-ব্যবস্থার অন্যায় বিষয়ে সরকার ও শাসকশ্রেণীর প্রত্যয় জাগালেই পৃথিবীতে শান্তি ও সর্বজনীন কল্যাণ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। বিনা সংগ্রামে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা। পরিশেষে, তদানীন্তন সমাজতন্ত্রীদের প্রায় সবাই এবং সাধারণভাবে শ্রমিকশ্রেণীর বন্ধুরা প্রলেতারিয়েতকে ভাবতেন একটা দৃষ্টিক্ষত হিসেবে এবং শিল্পবৃদ্ধির সঙ্গে সে দৃষ্টিক্ষত কিভাবে বাড়ছে তা দেখে আতঙ্ক হত তাঁদের। সেইজন্যেই এরা ভাবতেন কিভাবে শিল্প ও প্রলেতারিয়েতের বৃদ্ধি রোধ করা যায়, থামানো যায় ‘ইতিহাসের চাকা’। প্রলেতারিয়েতের বৃদ্ধিতে এই সাধারণ ভীতির বিপরীতে মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের সমস্ত ভরসাই রাখলেন প্রলেতারিয়েতের অবিরাম বৃদ্ধির উপর। যত বেশি হবে প্রলেতারিয়েত, বিপ্লবী শ্রেণী হিসেবে ততই তার বাড়বে শক্তি, ততই নিকটতর ও সম্ভবপর হয়ে উঠবে সমাজতন্ত্র। শ্রমিকশ্রেণীর জন্য মার্কস ও এঙ্গেলসের যা অবদান সেটা অল্প কথায় এইভাবে বলা যায়, শ্রমিকশ্রেণীকে তাঁরা আত্মজ্ঞান ও আত্মচেতনার শিক্ষা দেন এবং স্বপ্নদর্শনের স্থানে স্থাপন করেন বিজ্ঞান।

এই জন্যই এঙ্গেলসের নাম ও জীবনের কথা প্রতিটা শ্রমিককে জানতে হবে। এ কারণে আমাদের সমস্ত প্রকাশনার মতো এই সংকলটিরও উদ্দেশ্য হলো রুশ শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণীগত আত্মচেতনা জাগিয়ে তোলা, এবং তাতে আধুনিক প্রলেতারিয়েতের দুই মহাশিক্ষকের অন্যতম ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের জীবন ও ক্রিয়াকলাপের একটা রূপরেখা দেওয়া।

প্রাশিয়া রাজ্যের রাইন প্রদেশের বার্মেন শহরে ১৮২০ সালে এঙ্গেলস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কারখানা-মালিক। ১৮৩৮ সালে সাংসারিক কারণে এঙ্গেলস উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করেই ব্রেমেনের এক সওদাগরী সংস্থায় কর্মচারী হিসেবে ঢুকতে বাধ্য হন। ব্যবসায়িক কাজের মধ্যেও নিজের বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার কাজ চালিয়ে যেতে এঙ্গেলসের বাধা হয়নি। ছাত্র-অবস্থাতেই তিনি স্বৈরাচার ও আমলাদের স্বেচ্ছাচারিতাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। দর্শনের চর্চা মারফত তিনি আরো অগ্রসর হন। সেসময় জার্মান দর্শনের ক্ষেত্রে ছিল হেগেলীয় মতবাদের প্রাধান্য, এঙ্গেলস তার অনুগামী হয়ে ওঠেন। হেগেল স্বয়ং ছিলেন স্বৈরাচারী প্রাশিয়ান সরকারের পক্ষপাতী, বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরূপে তিনি তখন তার চাকরিতে বহাল, তাহলেও হেগেলের শিক্ষা ছিল বৈপ্লবিক। মানবিক যুক্তি ও মানবিক অধিকারের উপর হেগেলের বিশ্বাস ও বিশ্বে পরিবর্তন ও বিকাশের চিরন্তন প্রক্রিয়া চলছে এই মর্মে তাঁর দর্শনের যে মুল প্রতিপাদ্য তার ফলে বার্লিনের এই দার্শনিকের যেসব শিষ্য চলতি অবস্থা মেনে নিতে চাইছিলেন না তাঁরা এই চিন্তায় উপনীত হন যে চলতি অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, চলতি অন্যায় ও প্রভুত্বকারী অমঙ্গলের বিরূদ্ধে সংগ্রামের মুল নিহিত রয়েছে চিরন্তন বিকাশের বিশ্বজনীন নিয়মে। সবই যদি বিকশিত হয়ে উঠতে থাকে, যদি একটা প্রতিষ্ঠানের স্থান নেয় অন্য প্রতিষ্ঠান, তবে প্রাশিয়ান রাজা বা রুশ জারের স্বৈরাচারই_বা কেন চিরকাল চলবে, কেন চলবে বিপুল অধিকাংশের ঘাড় ভেঙে নগণ্য অল্পসংখ্যকের ধনবৃদ্ধি, জনগণের উপর বুর্জোয়ার প্রভুত্ব? হেগেলের দর্শনে বলা হয়েছিল আত্মার ও ভাবের বিকাশের কথা, এটা ভাববাদী তত্ত্ব। আত্মার বিকাশ থেকে এই দর্শন পৌঁছত প্রকৃতি, মানুষ এবং লৌকিক, সামাজিক সম্পর্কের বিকাশে। বিকাশের চিরন্তন প্রক্রিয়া বিষয়ে হেগেলের ভাবনা অব্যাহত রেখে**  মার্কস ও এঙ্গেলস আগে থেকেই ধরে নেওয়া ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি বর্জন করেন, জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়ে তারা দেখলেন যে আত্মার বিকাশ দিয়ে প্রকৃতির বিকাশ ব্যাখ্যা তো হয়ই না বরং উল্টো, প্রকৃতি দিয়ে পদার্থ দিয়েই ব্যাখ্যা করা উচিত আত্মার…. হেগেল ও অন্যান্য হেগেলপন্থীদের বিপরীতে মার্কস ও এঙ্গেলস ছিলেন বস্তুবাদী। বিশ্ব ও মানবসমাজের উপর বস্তুবাদী দৃষ্টিপাত করে তাঁরা দেখলেন যে প্রকৃতির সমস্ত ঘটনার পিছনে যেমন আছে স্তুপে কারণ, মানব-সমাজের বিকাশও তেমনি বস্তুগত, উৎপাদনী শক্তির বিকাশের শর্তাধীন। মানবিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনে লোকে পরস্পরের সঙ্গে যে-সম্পর্ক স্থাপন করে তা নির্ভর করে উৎপাদনী শক্তির বিকাশের উপর। আর এই সম্পর্ক দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় সামাজিক জীবনের সমস্ত ঘটনার, মানবিক প্রচেষ্টা, ভাবনা ধারণা ও আইনের। উৎপাদনী শক্তির বিকাশ থেকে সৃষ্ট হয় ব্যক্তি মালিকানার ভিত্তিতে স্থাপিত সামাজিক সম্পর্ক, কিন্তু আবার দেখা যাবে যে উৎপাদনী শক্তির ওই বিকাশেই ফের অধিকাংশের সম্পত্তি লোপ পায় আর তা কেন্দ্রীভূত হয় নগণ্য সংখ্যাল্পের হাতে। বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থার যা ভিত্তি সেই মালিকানাই লুপ্ত হয় তাতে, তার বিকাশ হয় সেই লক্ষ্যের দিকে যা গ্রহণ করছে সমাজতন্ত্রীরা। সমাজতন্ত্রীদের শুধু এইটুকু বুঝতে হবে কোন সামাজিক শক্তি বর্তমান সমাজে তার স্বকীয় অবস্থানের কারণেই সমাজতন্ত্র স্থাপনে আগ্রহী, এবং আপন স্বার্থ ও ঐতিহাসিক কর্তব্যের চেতনা সেই শক্তিতে সঞ্চারিত করতে হবে। এই শক্তি হলো প্রলেতারিয়েত। এ শক্তির সঙ্গে এঙ্গেলসের পরিচয় হয় ইংলন্ডে, ব্রিটিশ শিল্পের কেন্দ্র ম্যাঞ্চেষ্টারে, ১৮৪২ সালে। তিনি এখানে এসে একটা সওদাগরী সংস্থায় চাকরি নেন, তাঁর বাবা ছিলেন এ সংস্থার অন্যতম অংশীদার। এঙ্গেলস এখানে কেবল কারখানার অফিসে বসে থাকেননি, শ্রমিকেরা যেখানে গাদাগাদি করে থাকতেন সেই সব নোংরা বস্তির মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন তিনি, নিজের চোখে দেখতেন তাদের নিঃস্বতা ও দারিদ্র্য। শুধু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে তৃপ্ত না হয়ে তিনি ইংরেজ শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা সম্পর্কে যা কিছু প্রকাশিত হয়েছিল সব পাঠ করেন, সাধ্যায়ত সমস্ত সরকারী দলিল তিনি খুঁটিয়ে অধ্যয়ণ করেন। এই অধ্যয়ণ ও পর্যবেক্ষণের ফল হলো ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’। ‘ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’ বইটির লেখক হিসেবে এঙ্গেলসের প্রধান কীর্তি কী তা আমরা আগেই বলেছি। এঙ্গেলসের আগে অনেকেই প্রলেতারিয়েতের দুই ক্লেশ বর্ণনা করে তাদের সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছেন। এঙ্গেলসই প্রথম বলেন যে, প্রলেতারিয়েত শুধু একটা ক্লেশভোগী শ্রেণী নয়; যে-লজ্জাকর অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সে রয়েছে, সেই অবস্থাই তাকে অপ্রতিরোধ্যরূপে সামনে ঠেলে দিচ্ছে ও নিজের চরম মুক্তির জন্য সংগ্রামে বাধ্য করছে। আর সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত নিজেই সাহায্য করবে নিজেকে। শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন অনিবার্যভাবেই শ্রমিকদের এই চেতনায় উপনীত করাবে যে সমাজতন্ত্র ছাড়া তাঁদের গত্যন্তর নেই। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হবে যখন তা হয়ে উঠবে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য। ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা সম্পর্কে এঙ্গেলসের বইখানির এই হল মুল কথা। চিন্তাশীল ও সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত এই ভাবনা আজ আত্মস্থ করে নিলেও সে-সময়ে এটা ছিল নতুন। এ ভাবনা পেশ করা হয়েছিল যে-বইখানায় সেটির রচনাশৈলী মুগ্ধ করার মতো, ইংরেজ প্রলেতারিয়েতের দুর্দশার অতি প্রামাণ্য ও রোমহর্ষক চিত্রে তা পরিপূর্ণ। এই বই হল পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর অভিযোগপত্র। এর প্রভাবও হয়ে ওঠে দুরপ্রসারী। আধুনিক প্রলেতারিয়েতের অবস্থার সেরা ছবি হিসেবে সর্বত্রই এঙ্গেলসের বইটির উল্লেখ শুরু হয়। এবং বাস্তবিকই, শ্রমিকশ্রেণীর দুর্দশার এমন জ্বলজ্বলে ও সত্য বর্ণনা ১৮৪৫ সালের আগে বা পরে আর দেখা যায়নি।

এঙ্গেলস সোস্যালিস্ট হয়ে ওঠেন কেবল ইংলন্ডেই। ম্যাঞ্চেষ্টারে তিনি তদানীন্তন ইংরেজ শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও ইংরেজদের সমাজতন্ত্রী প্রকাশণাগুলিতে লিখতে শুরু করেন। ১৮৪৪ সালে জার্মানিতে ফেরার পথে প্যারিসে মার্কসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়, চিঠিপত্রের যোগাযোগ আগেই ঘটেছিল। মার্কসও প্যারিসে ফরাসী সমাজতন্ত্রীদের ও ফরাসী জীবনের প্রভাবে সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন। দুই বন্ধু এখানে একত্রে লেখেন ‘পবিত্র পরিবার, অথবা সমালোচনামূলক সমালোচনীর সমালোচনার’। বইটি প্রকাশিত হয় ‘ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’ প্রকাশের একবছর আগে, এবং তার বেশিরভাগটাই ছিল মার্কসের লেখা; বৈপ্লবিক বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রের প্রধান যেসব কথা আগে বলেছি, তারই বুনিয়াদ পেশ করা হয় এই বইয়ে। দার্শনিক বাউয়ের ভ্রাতাদের ও তাঁদের অনুগামীদের ব্যঙ্গ করে বলা হত ‘পবিত্র পরিবার’ অথবা সমালোচনামূলক সমালোচনীর সমালোচনা। এই ভদ্রলোকেরা এমন সমালচনার প্রতচার করতেন যার সবকিছু বাস্তবতার ঊর্ধ্বে, পার্টি ও রাজনীতির ঊর্দ্ধে থেকে, সমস্ত সাংসারিক ক্রিয়াকলাপ  বর্জন করে পারিপার্শ্বের জগৎ ও তার ঘটনাবলী নিয়ে কেবল ‘সমালোচনামূলক’ অনুধাবনে ব্যাপৃত থাকত। সমালোচনায় অসমর্থ জনতা ( uncritical mass) হিসেবে গণ্য করে প্রলেতারিয়েতের প্রতি উন্নাসিক ভাব দেখাতেন। এই কাণ্ডজ্ঞানহীন ও ক্ষতিকর ধারার বিরুদ্ধে মার্কস ও এঙ্গেলস দৃঢ়চিত্তে উঠে দাঁড়ান। শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্র কর্তৃক দলিত শ্রমিক, এই বাস্তব একটি মানবিক ব্যক্তিসত্তার নামে তারা দাবি করেন অনুমান নয়, উন্নত সমাজ গঠনের জন্যে সংগ্রাম। সেরূপ সংগ্রাম চালাতে সমর্থ ও তাতে স্বার্থসম্পন্ন যে শক্তি, সেটা তাঁরা অবশ্যই দেখেন প্রলেতারিয়েতের মধ্যে। ‘পবিত্র পরিবারের’ আগেই মার্কস ও রুগের Deutsch-Französische Jarbücher পত্রিকায় এঙ্গেলসের ‘রাজনীতি সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে’ ছাপা হয়, তাতে সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মুল ঘটনাগুলিকে দেখা হয় ব্যক্তি মালিকানার প্রভুত্বের অনিবার্য পরিণাম হিসেবে। মার্কসের রচনায় যে বিজ্ঞানে পুরো একটা বিপ্লব ঘটে যায় সেই রাজনীতি- সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্রের চর্চা করার জন্য মার্কস যে সিদ্ধান্ত নেন, তার পিছনে এঙ্গেলসের সঙ্গে যোগাযোগের ঘটনাটা নিঃসন্দেহে কাজ করেছে।

১৮৪৫ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত সময়টা এঙ্গেলস ব্রাসেলস ও প্যারিসে কাটান, এবং তাঁর বৈজ্ঞানিক চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাসেলস ও প্যারিসে জার্মান শ্রমিকদের মধ্যে হাতে কলমের কাজকে মিলিয়ে নেন। এইখানেই গুপ্ত জার্মান সমিতি ‘কমিউনিস্ট লীগ’-এর সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের যোগাযোগ হয়, এই সঙ্ঘ তাদের উপর ভার দেয় তাঁদের রচিত সমাজতন্ত্রের মুলনীতি বর্ণনা করার জন্যে। এইভাবেই জন্ম নেয় ১৮৪৮ সালে ছাপা মার্কস ও এঙ্গেলসের সুবিখ্যাত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ ছোট্ট এই পুস্তিকাখানি বহু বৃহৎ গ্রন্থের মতোই মুল্যবান: সভ্য জগতের সমস্ত সংগঠিত ও সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত আজও তার প্রেরণায় সজীব ও সচল।

১৮৪৮ সালের যে-বিপ্লব প্রথমে ফ্রান্সে শুরু হয়ে পরে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত হয়, তার পরিণতিতে মার্কস ও এঙ্গেলস দেশে ফেরেন। সেখানে, প্রাশিয়ার রাইন অঞ্চলে তাঁরা কলোন থেকে প্রকাশিত গণতান্ত্রিক Neue Rheinische Zeitung পত্রিকার প্রধান হয়ে উঠেন। প্রাশিয়ার রাইন প্রদেশর সমস্ত বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠেন দুই বন্ধু। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কবল থেকে জনগণের স্বার্থ ও স্বাধীনতা রক্ষা করে যান শেষ মাত্রা পর্যন্ত। সবাই জানেন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জয়লাভ করে। Neue Rheinische Zeitung নিষিদ্ধ হয়; দেশান্তরী হয়ে জীবনযাপনের সময়েই মার্কস প্রাশিয়ান নাগরিকত্ব হারিয়েছিলেন, এবার তাঁকে নির্বাসিত করা হয়; আর এঙ্গেলস সশস্ত্র গণবিদ্রোহে অংশ নেন, তিনটি সংঘর্ষে লড়াই করেন মুক্তির জন্য, এবং বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পর সুইজারল্যান্ড হয়ে লন্ডন পালান।

মার্কসও সেখানে বসতি পাতেন। এঙ্গেলস অচিরে ফের কেরানির কাজ নেন ৪০-এর দশকের ম্যাঞ্চেস্টারের সেই সওদাগরী সংস্থায়, এবং পরে তার অংশীদার হন। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত তিনি থাকেন ম্যাঞ্চেস্টারে ও মার্কস লন্ডনে, এতে তাঁদের জীবন্ত মানসিক যোগাযোগে বাদামি হয়নি; প্রায় দৈনিক চিঠির আদান-প্রদান চলত তাঁদের। এই সব পত্রালাপের মধ্যে দিয়ে তাঁরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণার বিনিময় করেন এবং একযোগে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যান। ১৮৭০ সালে এঙ্গেলস লন্ডনে ফেরেন, এবং ১৮৮৩ সালে মার্কসের মৃত্যু পর্যন্ত চলে তাঁদের কর্মচঞ্চল মিলিত মানসিক জীবন। এর ফল হলো- মার্কসের দিক থেকে – ‘পুঁজি’, আমাদের যুগের মহত্তম রাজনীতি সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্রীয় রচনা, আর এঙ্গেলসের দিক থেকে- ছোট-বড়ো একসারি বই। পুঁজিবাদী অর্থনীতির জটিল ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করেন মার্কস। আর অতি সহজ ভাষায়, প্রায়ই বিতর্কমূলক রচনায় সাধারণ বৈজ্ঞানিক সমস্যা এবং অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে ইতিহাসের বস্তুবাদী বোধ ও মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী লেখেন এঙ্গেলস। এঙ্গেলসের এই সব রচনার মধ্যে উল্লেখ করব; ড্যুরিং-এর বিরুদ্ধে বিতর্কমূলক রচনা জার সরকারের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় রুশ বিপ্লবীর বীরোচিত সংগ্রাম অভিজ্ঞ এই বিপ্লবীদের হৃদয়ে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল সাড়া জাগায়। অন্যদিকে মেকি অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের অতি প্রত্যক্ষ ও জরুরী কর্তব্য থেকে রুশ সমাজতন্ত্রীদের সরে আসার হীন চেষ্টাটা তাঁদের চোখে স্বভাবতই সন্দেহজনক ঠেকেছিল এবং এমনকি সামাজিক বিপ্লবের মহাদর্শের প্রতি সরাসরি বেইমানি বলেই তাঁরা গণ্য করেছিলেন। ‘ প্রলেতারিয়েতের মুক্তি হওয়া চাই তাদের নিজেদের কাজ’-অবিরাম এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন মার্কস ও এঙ্গেলস। আর নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে হলে কিছুটা রাজনৈতিক অধিকারও প্রলেতারিয়েতের জয় করা দরকার। তাছাড়া, মার্কস ও এঙ্গেলস পরিস্কার দেখেছিলেন যে পশ্চিম ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষেও রাশিয়ায় রাজনৈতিক বিপ্লবের তাৎপর্য হবে বিপুল। স্বৈরতন্ত্রী রাশিয়া চিরকালই ছিল ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়ার দুর্গপ্রকার। ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে দীর্ঘকালের মতো বিরোধ বপন করে ১৮৭০ সালের যুদ্ধ রাশিয়াকে যে অসাধারণ অনুকুল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে স্থাপন করে তাতে অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে স্বৈরতন্ত্রী রাশিয়ার তাৎপর্যটাই বেড়েছে। পোলিশ, ফিনিশ, জার্মান, আর্মেনিয়ান ও অন্যান্য ছোট-ছোট জাতিকে যার পীড়ন করার দরকার নেই, দরকার নেই অবিরাম ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জার্মানিকে লাগানোর, তেমন এক স্বাধীন রাশিয়া থাকলেই কেবল বর্তমান ইউরোপ তার সামরিক চাপ থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। ইউরোপের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান দুর্বল হয়ে যাবে, এবং ইউরোপীয় শ্রমিকশ্রেণীর শক্তি বেড়ে উঠবে। তাই পশ্চিমে শ্রমিক আন্দোলনের সাফল্যের জন্যই এঙ্গেলস রাশিয়ায় রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন সাগ্রহে। তাঁর প্রয়াণে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারালো রুশ বিপ্লবীরা।

প্রলেতারিয়েতের মহা যোদ্ধা ও শিক্ষক ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের স্মৃতি অক্ষয় হোক!

*নিকোলাই আলেক্সেয়েভিচ নেক্রাসভের লেখা ‘দব্রলিউউবভ স্মরণে’ শীর্ষক কবিতাটি থেকে।

**মার্কস ও এঙ্গেলস একাধিক বার দেখিয়েছেন যে তাঁদের মানসিক বিকাশ বহু দিক থেকে মহান জার্মান দার্শনিকদের, বিশেষ করে হেগেলের নিকট ঋণী। এঙ্গেলস বলেছেন, ‘জার্মান দর্শন না থাকলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রও সম্ভব হত না’। (লেনিনের টীকা)

Spread the word

Leave a Reply