চিরহরিৎ নভেম্বর
সৃজন ভট্টাচার্য্য
মন কি আজো লেনিন চায়? মনকে বলো – হ্যাঁ,
মনকে বলো – হ্যাঁ, তবু হ্যাঁ
জয়দেবের কবিতা ছাড়া শুরু করা যেত না। যেতই না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন, ব্রেখট কি সেই সৈনিকের গল্পটা খারাপ লিখিয়াছিলেন? বা, ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা, যা থেকে বিষ্ণু দে’র অনুবাদ ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান – ‘রুশ দেশের কমরেড লেনিন’, তাই বা কম কীসে? কথাটা তা নয়। খুঁজতে বসলে সোভিয়েত আর লেনিন নিয়ে হাজারো মণিমুক্তো বেরিয়ে আসবে দুনিয়ার সব প্রান্তরে। তবুও, জয়দেব বসুতে ফেরা, কারণ ওই যে প্রশ্নটা, ওটা ভীষণ জরুরি। জরুরি, ও প্রাসঙ্গিক। উত্তরটা জয়দেব দিয়েছেন নিজের স্টাইলে – “মনকে বলো, হ্যাঁ।”
আমরাও কি কবির রাস্তাই ধরব?
দুনিয়ার বড় অংশ কিন্তু মুখের উপর “না” বলে দিয়েছিল পত্রপাঠ! সোভিয়েত ও সোভিয়েতের মৃত্যু – দুইই বড্ড মহাকাব্যিক, বিরাট তার অভিঘাত ও ব্যাপ্তি। শিস দিতে দিতে স্করপিয়নস যখন গাইছে ‘উইন্ডস অফ চেঞ্জ’, ফুকুয়ামা যখন ইতিহাসের মৃত্যুঘন্টা বাজাচ্ছেন, ম্যাগি থ্যাচার যখন প্রত্যয়ী গলায় জানাচ্ছেন, পুঁজিবাদের কোনো বিকল্প নেই – উল্টো শিবিরের আকাশ তখন কালো, দিশাহীন স্তব্ধ নির্বাক। একের পর এক দেশে কমিউনিস্ট পার্টি উঠে গেল, রাতারাতি সাইনবোর্ড লেগে গেল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের। আমরা, দুনিয়ার বিষণ্ণ বিপন্ন কমিউনিস্টরা, তখন কি জানতাম – ক্রেমলিনের চূড়া থেকে লালপতাকা নেমে যাওয়ার ১০ বছরের মাথায় আফগানিস্তান-ইরাক যুদ্ধ দেখে দুনিয়া উপলব্ধি করবে আমেরিকার হাতে বিশ্বকে একা ছেড়ে দেওয়ার বিপদ, ২০ বছরের মাথায় ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলন শুরু হলে খোদ পোপ দাস ক্যাপিটাল কিনতে চাইবেন, আর ৩০ বছরের মাথায় করোনার পৃথিবীর অসুখ গভীর হয়ে উঠলে ফাইনান্সিয়াল টাইমস লিখবে – ফিরে চলো সমাজতন্ত্রে?
হিটলার বলেছিল – ক্যাচ দেম ইয়ং! পুঁজির মাথারা বোঝে, তরুণ প্রজন্মের মাথা না খেতে পারলে নিজেদের অস্তিত্বসঙ্কট অবশ্যম্ভাবী। কমিউনিজম ও সোভিয়েত সম্বন্ধে তাত্ত্বিক বিতর্ক শুধু নয়, রীতিমতো নিয়ম করে কুৎসা ও খিস্তিখেউড় চালিয়ে যেতে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা খরচ করে ওরা। ওইজন্যেই একসময় র্যাম্বো যেত ভিয়েতনামে, আর এখন ফিদেল কাস্ত্রোকে খুন করতে হবে, এই লক্ষ্য সামনে রেখে মোবাইল গেম তৈরি হয়। ওইজন্যেই জ্যোতি বসু মারা যাওয়ার পরদিন মমতা আর মহাগুরু ‘মানুবাবু’কে দিয়ে জঘন্য অবিচুয়ারি লেখায় আনন্দবাজার, ওইজন্যেই মোদিজির আদরের বিগ ব্রাদার ‘ডোলান্ড’ ট্রাম্পকে ২০২০ সালের ভোটে হারার ভয়ে বলতে হয়, ডেমোক্র্যাটরা ছুপা সোশ্যালিস্ট, ওরা জিতলে চীনের হাতে তুলে দেবে গোটা দেশকে! এ চক্রান্তের জাল সিনেমা সিরিয়াল নাটক মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি সর্বত্রব্যাপী। কিছুতেই বামপন্থার প্রতি, সমাজতন্ত্রের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আস্থা জোগানো যাবে না। ওদের শিখিয়ে যেতে হবে, বিপ্লব হলে কমিউনিস্টরা তোমার জমি বাড়ি সমস্ত কিছু গরিবগুর্বোদের হাতে দিয়ে দেবে, ও পথে হেঁটোনা তাই কোনোমতেই!
আমরা যদি পালটা প্রশ্ন করি?
এই যে আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগেপরে জন্মেছি, পুঁজিবাদ আমাদের যা যা প্রমিস করেছিল, একটাও দিতে পেরেছে? সোভিয়েতে গণতন্ত্র নেই, ওদিকপানে চেও না, আমরা গণতন্ত্র দেব, আমাদের কাছে এসো, বলেছিল ওরা। ওদের বানানো পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের উদাহরণ? জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ! এহসান জাফরি! র্যাচেল কোরি! কত নাম বলব? আচ্ছা, আপনি কি কি পছন্দ করেন, তা আগেভাগে জেনে গিয়ে “pages you may like” বলে ফেসবুক আপনাকে বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে দেয় কি করে? জর্জ অরওয়েল সোভিয়েতকে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ। সোভিয়েত নেই। সোভিয়েতে গণতন্ত্রের চেহারা কী ছিল, কতটা গ্রহণীয় কতটা বর্জনীয় তা নিয়ে চর্চা এখনো বিদ্যমান। তবে, বিগ ব্রাদার কিন্তু দিব্যি রয়ে গেছে। আকারে অবয়বে বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর।
ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ফ্রিডম অফ থট জাতীয় কথাগুলি বুর্জোয়াদের খুব প্রিয়। আদতে এ কথাগুলি মহাগুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে বড়লোকদের হাতে পড়ে এসব ধারণার পিণ্ডি চটকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওদের অন্তঃসারশূন্য প্রচার আসলে বিকল্পের প্রভাবকে প্রতিহত করতে। ওরা এমনিতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দু’চারটে মিটিং মিছিল মেনে নিলেও নিতে পারে, তবে সমাজতন্ত্রের বিকল্পকে খুব ভয় পায়। সোভিয়েত সমাজকে দেখিয়েছিল, বিকল্পের টেক্কা কাকে বলে। বলশয় থিয়েটার থেকে আন্দ্রেই তারকোভস্কি, লেভ ইয়াসিন থেকে ভিক্টর চুখারিন, ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা – দুনিয়ার এমন কোনো ক্ষেত্র ছিল না যেখানে সবে জন্ম নেওয়া দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন হাজির করেনি বিকল্পের মডেল। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ – সমাজতান্ত্রিক মানুষ ছিল অন্যরকম, ভবিষ্যতের দিশারী। প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে উঠে ইউরি গ্যাগারিনের ছোট্ট কথাটা – “আমি এখানে কোনো ভগবান দেখতে পাচ্ছি না” – আদতে দর্শনের জগতে মার্কসবাদের বিশাল জয়! কী এমন ওরা করেছে, যা সোভিয়েত পারেনি? আজ ভাবলে অবাক লাগে, হিটলার তখন দুনিয়ার সর্বশক্তিমান মিলিটারির নেতা, তার বিরুদ্ধে লড়াইতে সমগ্র মানবসভ্যতাকে বাঁচানোর লক্ষ্য নিয়ে কী দুর্দম উদ্যমে নেমেছিল সোভিয়েতের সাধারণ মানুষ। একটা যুদ্ধে আড়াই কোটি শহীদের দেশ, প্রতি ঘরে খাবার টেবিলে একটা ফাঁকা চেয়ার রাখা থাকত, সে পরিবারের শহীদকে স্মরণ করে। দেশের প্রধান স্তালিনকে যখন এসে বলা হলো, আপনার ছেলে জার্মানদের হাতে বন্দি, তিনি বললেন, এত মায়ের কোল খালি হচ্ছে, আমি কেন আমার ছেলেকে কোনো জঘন্য নাৎসির বিনিময়ে ফেরত নেব? এমন দেশনেতার দৃষ্টান্ত, আছে ইতিহাসে আর কোনো?
পুনশ্চ, যেহেতু গণতন্ত্রের কথা উঠলই, সোভিয়েত রাশিয়াতেই কিন্তু সবার জন্য ভোটের অধিকার লাগু হওয়া প্রথম।
নভেম্বর বিপ্লব আসলে দেশের উৎপাদনের সাথে জনগণের বিছিন্নতাটা কাটাতে পেরেছিল। মানুষ একটা সময় অবধি আক্ষরিক অর্থেই ভাবত, এই সরকারটা আমার সরকার। ফলতঃ, দেশগঠনের কাজে উদ্দীপনাও ছিল উল্লেখযোগ্য। সোভিয়েত ভ্রমণ করেই রবীন্দ্রনাথের সেই অমর উক্তি, এদেশে না এলে এজন্মের তীর্থদর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য – সমস্ত নাগরিকের জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর প্রশ্নে সোভিয়েত অদ্বিতীয়, পুরো পৃথিবীর কাছে পথপ্রদর্শক। এমনকী চরম মুনাফালোভীদেরও সোভিয়েতের আতঙ্কে পড়ে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে লাগু করতে হয়েছিল কল্যাণকর রাষ্ট্রের নীতি। আজ যখন ভারতবর্ষের তরুণ প্রজন্মের সামনে সবথেকে বড় সঙ্কট হলো বেকারী – সে যদি ইতিহাস ঘেঁটে দেখে যে দুনিয়ায় এমন একটা দেশ ছিল যারা জন্মের ১৯ বছরের মধ্যে ১৯৩৬ সালে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল, সে দেশের প্রতি অনুরক্ত হওয়া থেকে কে আটকাবে তাকে? সকলের জন্য রেশন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রশ্নকে রাষ্ট্রের সরাসরি দায়িত্বকর্তব্যের মধ্যে নিয়ে আসা, দুনিয়াকে প্রথম পথ দেখিয়েছিল সোভিয়েত। আমাদের মত বিশাল মানবসম্পদের দেশে, যেখানে জনসংখ্যার ৬৫% হলো ৩৫ বছরের নীচে, সরকার যদি দায়িত্ব নিত সকল নাগরিককে পেট ভরে খাইয়ে, ফ্রি’তে লেখাপড়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তার হাতে সে যা করতে পারে তার ভিত্তিতে একটি নিশ্চিত কাজের যোগান দেওয়ার – ভারতবর্ষ তবে এগোত বহুদূর। সমাজতন্ত্র কী পারে, হাতের কাছে তার উদাহরণ হলো চীন। চীনের স্বাধীনতা আমাদের দু’বছর পর ১৯৪৯ সালে৷ অথচ আজ তারা কোথায় পৌঁছে গেছে, আর ভারতবর্ষের মন্ত্রী-সান্ত্রীরা এখনো বলে চলেছে, গোমূত্র খেলে করোনা সেরে যাবে!
নভেম্বর বিপ্লব দুনিয়াকে প্রথম দেখিয়েছিল, “যারা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল” – তারাও দেশ চালাতে পারে। নভেম্বর বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষ সহ দুনিয়ার ১০০’টারও বেশি দেশে জন্ম নিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। লেনিন ও তাঁর বাহিনীর কৃতিত্ব অপরিসীম, কারণ তাঁরাই বিশ্বকে হতবাক করে দেখালেন প্রথম, মার্কস-এঙ্গেলসের লেখাগুলো সত্যি হতে পারে! সোভিয়েত যদি মহাকাব্য হয়, নভেম্বর বিপ্লব তবে সে মহাকাব্যের আদিপর্ব, দুনিয়া কাঁপানো দশটা দিন। নভেম্বর বিপ্লব প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে একটাই বার্তা নিয়ে পৌঁছলো – সমাজতন্ত্র, অলীক কল্পনা নয়! নভেম্বর বিপ্লব স্বপ্ন দেখার ভিত তৈরি করল পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য। এ সম্মিলিত স্বপ্নের ভার, নেহাত কম নয়।
করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে আরো ঘনীভূত হয়েছে বড়লোকের আদিম লুটের চক্রান্ত। গরিব আরো গরিব হয়েছে, তেলা মাথায় তেল পড়েছে আরো বেশি। পণ্ডিতের ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মেরে বলতে শুরু করেছেন, পুঁজিবাদ চলবে না। করোনার আগেই, খোদ ফুকুয়ামা চারপাশ দেখে ঢোক গিলে বলেছেন, ইতিহাসের অবসানের থিওরি’টা ভুল ছিল, সমাজতন্ত্র আসতেই পারে। বিকল্পের খোঁজ, বিকল্পের খোঁজ। চারিদিকে রব একটাই, প্যান্ডেমিক বুঝিয়ে দিয়েছে যে ক্যাপিটালিজমের চেনা ছকে সভ্যতার উন্নতি হওয়া মুশকিল। তাহলে এখন করণীয় কী – এ প্রশ্নটা সবথেকে জরুরি হয়ে উঠছে তরুণ প্রজন্মের সামনে, কারণ তারাই নূতন যৌবনের দূত, ভবিষ্যতের ভার তাদেরই হাতে। এবং এখানেই, এখানেই আমাদের ফিরতে হবে নভেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়ার কাছে। রোমানভ সাম্রাজ্যের দালালরা আজো দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে। ফাঁকেতালে ফেঁপে ওঠা কেরেনস্কির দলবলও চারপাশে কম নয়। নীরবে তাই প্রস্তুতি চাই অরোরা যুদ্ধজাহাজের সৈনিকদের। একদিন আগেও নয়, একদিন পরেও নয় – ঘা মারতে হবে ঠিক তখনই, যখন ঘা মারলে এই পচাগলা সিস্টেমটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে সময় লাগবে না বিন্দুমাত্র।
একথাও আমরা জানি, বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখা যায়নি, ৭৪ বছর পর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ইউএসএসআর। যান্ত্রিকতা ও মার্কসবাদ যে একে অপরের বিরোধী দুটি শব্দ, সে শিক্ষা দিয়েই চলে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের শিক্ষা থেকেই শুরু হয়েছে আগামীর লড়াই, তা অন্য কোনো লেখার বিষয়বস্তু। কিন্তু যা অপরিবর্তিত, যা অমলিন, যা চিরবাঙ্ময় – তা হলো নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব। চরম সঙ্কটের মুহূর্তে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায় নভেম্বর। তীব্র জনবিদ্বেষ, হানাহানি, লুটপাটের মধ্যে হাতে হাত ধরে সামনে এগোতে শেখায় নভেম্বর। শুধু বিশ শতক নয়, আগামী বহু শতকের জন্য – সভ্যতার লাইটপোস্টের নাম, নভেম্বর বিপ্লব!
ফলতঃ, মনকে বলো, হ্যাঁ, তবু, হ্যাঁ।