অক্টোবর বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পোস্টমর্টেম আজও চলছে গোটা দুনিয়া জুড়ে। সমাজতন্ত্রের অসারতা, অপ্রাসঙ্গিকতা প্রমানে লক্ষ লক্ষ টন কাগজ আর হাজার হাজার লিটার কালি খরচ হচ্ছে ফি বছর। সেলুলয়ডের যুগ পার করে ডিজিটাল দুনিয়ায় কোটি কোটি জিবি ডিজিটাল ডেটায় জমা হচ্ছে সোভিয়েত নিন্দা ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার। যদি সত্যিই সমাজতন্ত্র অপ্রাসঙ্গিক হতো তাহলে বিশ্বব্যাপী ধনবাদী দুনিয়াকে এতো শ্রম, মেধা, ডলার খরচ করতে হতো কি! মূল ধারার সংবাদমাধ্যম থেকে হালফিলের ইন্টারনেট নির্ভর যাবতীয় মিডিয়া প্রতি অক্টোবরেই সেজেগুজে সোভিয়েতের ভুত তাড়াতে নেমে পড়ে। ১৯১৭-র পর থেকে অক্টোবর বিপ্লবের উদযাপন যেমন চলে তার চেয়েও বেশি চলে ভুত তাড়ানোর ওঝাগিরি। ইতিহাসে বহু সাম্রাজ্য এসছে, গেছে তার কোনোটাকেই কবর থেকে তুলে প্রতিনিয়ত কাটাছেঁড়া করার দরকার তো পৃথিবীর হয় না। আজ সেই সোভিয়েত দেশটাই নেই। আজকের রাশিয়া পূঁজিবাদী নয়া উদারবাদী পথেই চলছে। কমিউনিস্ট পার্টিও সেখানে দুর্বল। তবু বিশেষ করে এই মাস জুড়ে দৈনিক সংবাদপত্র থেকে জার্নাল, পোর্টাল, টেলিভিশন, সোশাল মাধ্যমে সেই এক বিষোদগার চলছেই। সঙ্কটাপন্ন পূঁজিবাদী ব্যবস্থা আজও সমাজতন্ত্রের ভুত দেখেই চলছে।
সোভিয়েতহীন বিশ্বে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির জয়ধ্বনি করলেন বিশিষ্ট পূঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ, দার্শনিকরা। তারপর গ্লোবালাইজেশন ও নয়া উদারবাদের বিশ্বময়তার বয়স বাড়তে থাকলো। দেশে দেশে পুরোনো আইন বদলের হিড়িক উঠলো, সংস্কারের মোহময় প্রতিশ্রুতির স্বপ্নে। এমন এক ধারণার জন্ম হলো যেন, সমাজতন্ত্রের আপদ বিদেয়ের পর বিশ্বময় গ্লোবালাইজেশনের ছন্দময় দ্যোতনা এনে দেবে এক আশ্চর্য দুনিয়া! যা সদম্ভে ঘোষণা করবে পূঁজিবাদের শ্রেষ্ঠত্ব। অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক, ভয়াল ফাইটার প্লেন, মিসাইল থেকে যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন তাদের ফ্যাশন শো করা শুরু করলো বাধাহীন বিশ্বের আকাশ, মাটি, জলে। উল্লাস এক নতুন বিশ্ব অর্থনীতির। সাম্রাজ্যবাদী আস্ফালন, তাদের সৃষ্ট বাণিজ্য নীতি নির্দ্ধারক আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এবং সর্বোপরি সম্প্রসারিত ন্যাটোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব পূঁজিবাদী অর্থনীতি। যার শীর্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের সমর কৌশল, বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক লগ্নি পূঁজির অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বিশ্বায়ন ক্রনি ক্যাপিটালিজমের যুগে প্রবেশ করে, বিপুল পূঁজি কেন্দ্রীভবনের লক্ষ্যে, বেপরোয়া লুটতরাজের পথে।
বিশ্বময় পূঁজিবাদী অর্থনীতির এই নতুন পর্যায়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পৃথিবীকে বহুধা বিভক্ত করলো। উত্তরের সঙ্ঘে দক্ষিণ, উন্নত ও অনুন্নত দেশের সঙ্গে দেশ, আর দেশের মধ্যে ধনী ও দরিদ্রের ফারাক সাংঘাতিক ভাবে বেড়ে গেলো। সব নীতি প্রণয়ন হলো ধনীদের স্বার্থে। বিশ্বায়িত অর্থনীতির নয়া উদারবাদী নীতিতে দেশে সরকারের দায়িত্ব গেলো কমে আর করপোরেটের সাম্রাজ্য, মুনাফা বেড়ে গেলো পাহাড় প্রমান। বিলিওনিয়ারের জন্ম হতে থাকলো একদিকে অন্যপ্রান্তে কোটি কোটি মানুষ সব মহাদেশেই তলিয়ে যেতে থাকলো ক্ষুধা, বেকারির, উপার্জনহীন এক বিপন্নতার গহ্বরে। দারিদ্রের বহর এতটাই চওড়া হলো যে, ক্ষুধার হটস্পটের জন্ম হতে থাকলো আফ্রিকা থেকে এশিয়া, লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে। এক অনুদার, ভয়ংকর বৈষম্যমূলক আর্থিক নীতির প্রচার সর্বস্বতা হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকলেন মানুষ। বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সুফল পাবে জনগণ, পণ্য বা পরিষেবার গুনমান আকর্ষণীয় হবে ও দাম কমবে। এসবই মিথ্যা প্রবচন ছাড়া কিছু নয়, ক্রমশ প্রকাশ্য হলো। আসলে ক্রমশ একচেটিয়া পূঁজির বিশ্বায়ন ঘটতে থাকলো। লেনিন, সাম্রাজ্যবাদী যুগে, পূঁজিবাদের এই প্রবণতার কথা আগেই বলেছিলেন। নয়া উদারবাদের আমলে করপোরেট হলো সর্বত্রগামী। রাষ্ট্রায়ত্ত সব সম্পদের মালিকানা, আর রাষ্ট্র, সরকার, জনগনের থাকলো না, তা করপোরেটের প্রভূত মুনাফা অর্জনের খনি হয়ে উঠলো। শিল্প থেকে কৃষি, খনি থেকে রেল, ব্যাঙ্ক-বীমা থেকে সড়ক, শিক্ষা বা চিকিৎসা এমনকি বিদ্যুৎ থেকে পানীয় জল যা মানুষের বেঁচে থাকার শর্ত ও অধিকার তা সবই করপোরেটের হয়ে গেলো।
বিশ্বায়ন, নয়া উদারবাদ বাধাহীন প্রাঙ্গণ পেলেও তা কিছুকালের মধ্যেই আবার সঙ্কটে পড়লো। মন্দায় আক্রান্ত হলো পূঁজিবাদী বিশ্ব। বিশ্বায়নের ধাক্কায় একটা দুটো দেশের মধ্যে সেই মন্দা সীমাবদ্ধ থাকলো না, গোটা বিশ্ব জুড়েই দেখা দিলো অর্থনৈতিক মন্দা। খোদ মার্কিন মুলুক, ইউরোপের দেশে দেশে বন্ধ হলো ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানি, বন্ধ হলো ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি। পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত প্রভাব পড়লো। ব্যাপক বেকারি, কর্মচ্যুতির সাক্ষী থাকলো প্রতিটি দেশ। জিডিপি বিপজ্জনক ভাবে নিম্নমুখী হলো। পূঁজিবাদী সঙ্কটে বিপদাপন্ন করপোরেটকে বাঁচাতে সরকারি ত্রান যথেচ্ছ বিলি হলেও দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া গরীব, মধ্যবিত্ত মানুষের অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে উঠলো। এই মন্দা থেকে বেরোনোর পথ সন্ধান করলেও দীর্ঘস্থায়ী মন্দা থেকে বেরোনোর পথ পূঁজিবাদের জানা নেই। এর মধ্যে সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতি পূঁজিবাদের রিক্ততাকে আবারো বে-আব্রু করে দিলো। এক ভয়াবহ, অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হলেন মানুষ। কিন্তু সেইসময়েও মুনাফা কমেনি করপোরেটের বরং তা বিস্ময়কর ভাবে বেড়ে যায়। কাজ হারানো মানুষের স্রোত তৈরি হয় সর্বত্র। কোভিডের আগেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছিলো আর বাজার অগ্নিমূল্য হচ্ছিলো কোভিড পরিস্থিতি যেন আগুনে ঘি ঢাললো। করপোরেট প্রীতি, মুনাফা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার বোঝা চাপলো আবার জনগণের ওপর। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমছিলো তা আরো বহুগুন কমে গেলো। বিশ্বজোড়া পূঁজিবাদী সঙ্কটের দিনে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের হাতেও উঠলো মার্কস। তাঁরা সন্ধান করতে শুরু করলেন ক্যাপিটালিজমের বাঁচার পথ। কিন্তু মার্কস তো ক্যাপিটালিজমের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, তার অন্তর্নিহিত সঙ্কট ও তার মধ্যেকার আত্মধ্বংসকারী বিশৃঙ্খলা দেখিয়ে পূঁজিবাদের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়েছিলেন। পুঁজিবাদের বিশ্বায়িত প্রক্রিয়াকে তাঁরা বর্ণনা করেছিলেন,
‘নিজেদের প্রস্তুত পণ্যের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, সর্বত্র স্থাপন করতে হয় যোগসূত্র।’
আজকের পূঁজিবাদ কি একে অস্বীকার করতে পারে! শোষণ মূলক পূঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে অসাম্যের যন্ত্রনা, সীমাহীন বঞ্চনা, অমানবিকতা ছাড়া কিইবা দিতে পারে! পুঁজিবাদের গতিশীলতা, উদ্বৃত্ত মূল্য, পুঁজি ও সম্পদের পুঞ্জীভবন, ক্রমবর্ধমান অসাম্য, অতি উৎপাদনের সংকট পর্যায়ক্রমে নিয়ে আসে সংকটকে। তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে নৈরাজ্য, যার ফলে আসে অতি উৎপাদনের সংকট। বেরোনোর জন্য সে চরম অবৈজ্ঞানিক ভাবে উৎপাদিকা শক্তি আংশিক ভাবে ধ্বংস করে, অন্য বাজার দখলের জন্য যুদ্ধ, দখলদারি চালায়। বেকারিতে ছেয়ে যায় জব মার্কেট। শ্রমের মূল্য কমে যায় ফলে তার উৎপাদিত পণ্যের বাজার থাকে না। বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকা চাষীর মতো সে বাজারের দিকে চেয়ে থাকে, তাদের অদ্ভুত বিশ্বাস সর্বশক্তিমান পূঁজিবাদী বাজার সব নিরাময় করবে। কিন্তু তা হয় না, মার্কসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী পূঁজিবাদ ফিরেফিরে সঙ্কটে পড়ে। তাই সংকট পুঁজিবাদের নিত্যসঙ্গী। পুঁজিবাদের এই সংকট অনিবার্য। কারণ, এই ব্যবস্থার জঠরেই রয়েছে এর বীজ। এই ব্যবস্থাই সংকটের উৎস। কারণ, শোষণই পুঁজিবাদের অস্তিত্বের ভিত্তি।
মার্কস যে ঠিক, তা সোভিয়েতহীন বিশ্বে পূঁজিবাদের বহু ঢক্কানিনাদে প্রচারিত বিশ্বায়ন, নয়া উদারবাদী নীতির ফলস্বরূপ ২০০৮ সাল থেকে চলা দীর্ঘস্থায়ী মন্দা আবারো প্রমান করলো। নিজে নিজে এই ব্যবস্থা ধ্বংস হবে না। তার সঙ্কটের বোঝা সে জনগনের ওপর চাপিয়ে বাঁচবার, আপাত সামলানোর চেষ্টা করলেও তা আবারো সঙ্কট আনবে। তাকে ভেঙে ফেলার আহ্বানই জানিয়েছিলেন মার্কস-এঙ্গেলশ, কমিউনিস্ট ইশতেহারে। শ্রমিক শ্রেণীর তাই চাই নিজস্ব সংগঠন। অনেক বক্রোক্তি সত্ত্বেও সর্বাহারা বিপ্লব সম্পাদিত হয়ে এক নতুন বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো প্রথমবার সোভিয়েতে। সমাজতান্ত্রিক বিকল্প ব্যবস্থায় মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলির নিরসন, অসাধারণ সাফল্যের ইতিহাস পূঁজিবাদের ভয়ের কারণ। প্রয়োগের ভুলে আপাত বিপর্যয় এলেও বিজ্ঞান বাতিল হয়ে যায় না। পূঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রবীনত্ব সত্ত্বেও তা যদি বারে বারে মুমূর্ষু হয়ে পড়ে, তবে বয়সের দিক থেকে অনেক কম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও কিছু ঘার প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হতেই পারে।এ কথা পূঁজিবাদ যথেষ্ট বোঝে বলেই ‘কমিউনিজমের ভুত’ তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় আজও। সোভিয়েত সেই বিকল্পের জনক, পূঁজিবাদের নিশ্চিন্ত ঘুম কেড়ে নেওয়া গত শতাব্দীর সব থেকে তোলপাড় করা ঘটনা, যা সময়, দেশ, কালের গন্ডী ছাড়িয়ে আজও উজ্জ্বল।
আর্থিক মন্দা ও তদ্জনিত ভয়ংকর বৈষম্য ও তীব্র শোষণ, বেকারি ও অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধিতে যন্ত্রণা ক্লিষ্ট শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক, কৃষকরা আজ দেশে দেশে লড়াইয়ে সামিল। শ্রমিকদের ধর্মঘট, কাজের দাবিতে তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষের বহি:প্রকাশ ঘটেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ধনীশ্রেষ্ঠ ১ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ বাকি ৯৯ শতাংশ জনতার সম্পদের চেয়ে বেশি। আজকের পুঁজিবাদ সম্পর্কে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোশেফ স্টিগলিৎজ বলেছেন, ‘অব দি ওয়ান পার্সেন্ট, বাই দি ওয়ান পার্সেন্ট, ফর দি ওয়ান পার্সেন্ট’, এক শতাংশের, এক শতাংশের দ্বারা, এক শতাংশের জন্য। লড়াই এই ১ শতাংশের বিরুদ্ধে বাকি ৯৯ শতাংশের। আমেরিকা দেখেছে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট মুভমেন্ট। অনেক দেশেই শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আছড়ে পড়ছে, অচল করে দিচ্ছে। আমাদের দেশের চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ দেশের শ্রমিক, কর্মচারী সহ শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবী মানুষের লড়াই ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে নয়া উদারবাদের মারাত্মক প্রভাবের বিরুদ্ধে, বেঁচে থাকার জন্যে। পূঁজিবাদ এই সংগ্রাম দমন করতে মরীয়া হবেই। তার আঁচ পড়ছে সর্বত্র। সরকার সক্রিয় হয়েছে সবধরনের প্রতিবাদ, সংগ্রামকে ধূলিসাৎ করতে। শাসকের অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, বাড়ছে স্বৈরাচারী, আধিপত্যকামী চরম দক্ষিণপন্থার আক্রমণ।
এই সঙ্কটের আবহে বিশ্ব রাজনীতিতে এইসময়, উত্থান ঘটেছে চরম দক্ষিণপন্থার। আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুরস্কের এরদোগান, ইজরায়েলের নেতানিয়াহু, ভারতের নরেন্দ্র মোদির ওপর পড়লো হিটলার, মুসোলিনির ছায়া। ইউরোপের অনেক দেশেই নিও নাজি তৎপরতা বাড়তে থেকেছে। কেউ কেউ ক্ষমতায় এসেছে। চরম দক্ষিণপন্থাতেও নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির নির্মম প্রয়োগ চলছে সঙ্গে ভয়ংকর দমনপীড়ন। গরীব মানুষকে তার শ্রেণী পরিচিতি ও শ্রেণী অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে, পরিকল্পিত ভাবেই এইসব দেশে বিভাজন ও ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ধর্ম, জাতি বিদ্বেষের কদর্য হানাহানি, পারস্পরিক অনাস্থা, বিদ্বেষে ভর করে এইসব শাসকেরা ক্ষমতায় থাকতে চায়। ট্রাম্প হেরে গেলেও বাকিরা আছে। আবার ট্রাম্প হারলেও আমেরিকার রাজনীতি বা যুদ্ধনীতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পূঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট থেকেই জন্ম হয়েছে চরম দক্ষিণপন্থার। অনেকেই যাকে তুলনা করছেন ১৯২০-৩০ দশকের মহামন্দা ও তৎকালীন বিশ্বরাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার উন্মেষের সঙ্গে। সেইসময়ের সঙ্গে আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেশ কিছু সাদৃশ্য আছে। গণতন্ত্রের পরিসর, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা উধাও হয়ে গেছে। দানবীয় আইন গ্রহণ করেছে সরকার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ দমন করতে।
যে পন্ডিতেরা সমাজতন্ত্রের অসারতা প্রচারে সদা ব্যস্ত তারা পূঁজিবাদের অন্ত:সারশূন্যতা ও অমানবিক, নির্মম, কুৎসিত রূপটি দেখতেই পাচ্ছেন না। আসলে বুঝছেন বলেই একদিকে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন, বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ছে, অন্যদিকে সুকৌশলে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসার, ধর্ম-জাতি বিদ্বেষ, বিভাজনের পথ ধরেছে চরম দক্ষিণপন্থী শাসকেরা। ভয় তাদের তাড়া করছে বলেই জনতার মুখ বন্ধ করার জন্য এতো সুবিশাল, নৃশংস আয়োজন চলছে।
বিকল্পের সন্ধান শোষিত মানুষ করবেই। অতীতেও যেমন করেছে, আজও তেমনই করছে। পুতি গন্ধময় পূঁজিবাদের হাতে সভ্যতার সঙ্কট নিরাময়ের কোনো পথ্য নেই। হয় তাকে মানুষের সব কষ্ট, যন্ত্রণা, অসহায়তা অস্বীকার করে কল্পনার ফানুস ওড়াতে হবে, নইলে তীব্র দমন-পীড়নের পথে যেতে হবে। আমাদের দেশেই যেমন আমরা দেখেছি, ‘ফিল গুড’, ‘আচ্ছে দিন’ ইত্যাদি স্লোগান, শ্রম কোডের আড়ালে শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া, ন্যায় সংহিতার মতো ঔপনিবেশিক আইনের ভয়াবহতা ইত্যাদি। অথবা দার্শনিকেরা মানুষের দু:খ, কষ্টের বর্ণনা দেবেন আর সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় বলে উপাসনালয়ের দ্বারস্থ হওয়ার উপদেশ দেবেন। একবিংশ শতকের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেড়ে চলেছে নানান ধর্মীয়, সম্প্রদায়গত অনুষ্ঠান, উৎসব, পালা-পার্বন। এর সঙ্গেই মিশে থাকছে অন্য ধর্ম, জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ। তীব্র হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ। এসবের মিশেল নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আক্রমণ থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দিচ্ছে। শ্রেণী ভিত্তিক রাজনৈতিক বিন্যাস ভেঙেচুরে দেওয়াটা শাসকের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবু শোষিত, নিপীড়িত মানুষ বিকল্পের সন্ধান করবে।
কার্ল মার্কসের মৃত্যু হয়েছে ১৮৮৩ সালে। ১৯৯৯ সালে বিবিসি নিউজ অনলাইন নির্বাচনে শতাব্দির শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ নির্বাচিত হচ্ছেন উনবিংশ শতকের প্রকেতারিয় বিপ্লবী মতাদর্শের জনক কার্ল মার্কস। বিবিসি কোনো সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত সংস্থা নয়। অথচ তার নির্বাচন থেকেই মার্কসের প্রাসঙ্গিকতার পরিচয় বিশ্ব পূঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ পেলো। মার্কস প্রাসঙ্গিক থাকার অর্থ তাঁর মতবাদের প্রাসঙ্গিক থাকা। মার্কসবাদ হলো শোষিত মানুষের মতবাদ। সাধারণ মানুষের মতবাদ। মানব মুক্তির মতবাদ। একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক মতবাদ। সমাজকে শুধু ব্যাখ্যা করকে হবে না, মার্কসের কথায়, “দার্শনিকরা নানাভাবে এই জগৎটাকে ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তন করা”। এই পরিবর্তনেরই সূচনা ঘটেছিলো রাশিয়ায়। দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনের মধ্যে দিয়ে জন্ম নিয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই হলো মহান নভেম্বর বিপ্লব। তত্ত্বের সত্যতা ও প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই মার্কস আজও জীবন্ত আর সেই কারণেই সেই অমোঘ তত্ত্বের প্রয়োগে ঘটা ঐতিহাসিক রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও বিলীন হয়ে যায়নি। বিকল্পের প্রয়োজন আজকের দিনে আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। পূঁজিবাদ ভীত সেই অমোঘ বিকল্পের কারণে। তারাও জানে সোভিয়েত না থাকলেও বিশ্ব সমাজতন্ত্র বিবর্জিত নয়।
পৃথিবীতে কত পরিবর্তনই তো ঘটেছে এযাবতকাল, কিন্তু সেসব মনে রাখার দায় শতাব্দী পেরিয়ে কে বা নিয়েছে! কেনইবা নেবে! তাহলে নভেম্বর বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের কথা কেন ঘুরেফিরে দৈনন্দিন রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের আলোচনায় বারেবারে আসে! এ থেকে বোঝা যায়, রুশ বিপ্লবের মধ্যে এমন মৌলিক ও শাশ্বত উপাদান ছিলো যা তাকে আজও পূঁজিবাদের চক্ষুশূল করে রেখেছে। রুশ বিপ্লব ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম বিপ্লব যেখানে শোষিত শ্রেণীগুলি, শোষণমূলক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল যা আর শোষক শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সেটাই প্রথমবার, সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের একটি সুনির্দিষ্ট বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই যুগ থেকে আজও তা বিশ্ব ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় হিসেবেই বহাল আছে। মার্কস-এঙ্গেলশের সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব, মানব সভ্যতার বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর পরীক্ষিত। জীবন জুড়ে মার্কসের পূঁজিবাদকে গভীর নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ যে ভুল তা পূঁজিবাদ কখনও প্রমান করতে পারেনি তো বটেই বরং মার্কসের বিশ্লেষণ যে সঠিক তার প্রমান প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
নভেম্বর বিপ্লব শুধু স্বৈরাচারী জার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ঘটা কোনো জাতীয় বিপ্লবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এটা ছিলো একটি নতুন ধরনের বিপ্লব, যা ছিলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, পুঁজিবাদবিরোধী এবং চরিত্রগতভাবে সমাজতান্ত্রিক। এই বিপ্লবের একটা সার্বজনীন তাৎপর্য ছিল। লেনিন এবং বলশেভিকরা রাশিয়ার বিপ্লবকে শুধু “জাতীয়” দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেননি বরং তাকে দেখেছেন বিশ্বের অন্যত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রদূত হিসেবে। মার্কস-এঙ্গেলশের তত্ত্বের সফল প্রয়োগ ও প্রথম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পত্তনের সফল বিপ্লবের কান্ডারী লেনিন-ও তাই আজও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাননি। সোভিয়েতহীন বিশ্বেও সাম্রাজ্যবাদ, পূঁজিবাদ তাই আজও সোভিয়েত বিপ্লব, লেনিন-কে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। পূঁজিবাদের দু:স্বপ্নের কারণ হয়েই নভেম্বরের লাল পতাকা উড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই।
সাম্রাজ্যবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নভেম্বর বিপ্লবকে বোঝা যায় না। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে বিশ্ব পূঁজিবাদ সঙ্কটাপন্ন হয়। মহামন্দা বলা হয় তাকে। পূঁজিবাদ জানতো না উত্তরণের পথ ও উপায়। অবস্থা ফেরাতে তারা গেলো যুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পথে। এ যুদ্ধ সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য ছিলো না বরং এক দেশের গরীব মানুষের কাঁধে রাইফেল তুলে দেওয়া হয়েছিলো অন্য দেশের একইরকম গরীব সেনাকে মারার জন্য। সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের প্রকট রূপকে বলশেভিকরা ব্যবহার করলো সফল ভাবে, লেনিনের নেতৃত্বে। দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এই যুদ্ধকে চিহ্নিত করেছিলো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসেবে। অন্য দেশ দখল ও লুন্ঠনের জন্য এই যুদ্ধ। এখানে মেহনতী মানুষের কোনো স্বার্থ নেই। এই যুদ্ধকে বিপ্লবী সংগ্রামে পরিণত করার আহ্বানের বাস্তবায়ন হয়েছিলো রাশিয়ায়। লেনিনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে মার্কসবাদী ধারণার বিকাশ এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বকে বিপ্লবী কৌশলের অংশে পরিণত করা। মার্কস যখন পুঁজিবাদকে একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা হিসাবে বিকাশের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, তখন তাঁর মৃত্যুর পরে পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিবাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। লেনিনের মার্কসবাদ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি তাঁকে দেখতে সক্ষম করেছিল যে কীভাবে একচেটিয়া পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত প্রয়োজনের কারণে সাম্রাজ্যবাদ একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা হিসাবে বিকশিত হয়েছিল এবং তিনি এটিকে বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট রণনীতি এবং কৌশলের সাথে যুক্ত করেছিলেন।
লেনিন প্রয়াত হয়েছেন ১৯২৪। মার্কসের কথানুযায়ী পূঁজিবাদ আবারো সঙ্কটে পড়ে ১৯৩০-র দশকে। লেনিন বলেছিলে সাম্রাজ্যবাদীরা আবারো যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এবং তাই ঘটেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতা বিপন্ন হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের দিকে পৃথিবীকে নিয়ে যেতে জন্ম হয়েছিলো ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদের। বিপন্ন হয়েছিলো সভ্যতা। সোভিয়েতের অবদান আজকের বিশ্বকেও বারংবার স্মরণ করতে হয়। প্রায় পৌনে ২ কোটি মানুষের আত্মত্যাগ, বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েতের কমিউনিস্ট পার্টি। মানব সভ্যতা রক্ষা পেয়েছিলো। তারপর শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশের পতন, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলির জয়। অনেক দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতন্ত্র। ইতিবাচক অভিমুখেই বিশ্ব রাজনীতি এগোতে থাকলে একসময় বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাসিন্দা হন। পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক মহামন্দা-প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং পরিশেষে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৩০-র মহামন্দা-ফ্যাসিবাদের উত্থান-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরিশেষে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ও দেশে দেশে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের বিজয়কেতন। ২০০৮ থেকে আবার সঙ্কট ঘটিয়েছে চরম দক্ষিণপন্থার উন্মেষ। সাম্রাজ্যবাদ আগের থেকেও শক্তিশালী হয়েছে যেমন সত্য তেমনই সত্য আগের চেয়েও বেশি অসাম্য, যন্ত্রণা ক্লিষ্ট জীবন। দুনিয়া জোড়া বিকল্পের সন্ধান ও ক্রমবর্ধমান সংগ্রামও সত্য।
মার্কিনী ডলারের তেজ কমছে। এক মেরু বিশ্ব আর নেই। সমাজতান্ত্রিক চিনের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার আমেরিকাকে টপকে গেছে। চিন, রাশিয়াকে ঘিরে দক্ষিণের দেশগুলি ক্রমশ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে মার্কিনী খবরদারির বাইরে আসছে। বাড়ছে দেশের সংখ্যা। কথা উঠছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারেন্সি হিসেবে ডলার বিসর্জনের। মার্কিনী আধিপত্য, দখলদারিতে তাই সম্প্রসারিত হচ্ছে ন্যাটো, যার পরিণতিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও ক্রমশ সাউথ ব্লকের কাছাকাছি আসছিলো। হামাসের হামলাকে কাজে লাগিয়ে ইজরায়েলের পাশে আমেরিকা ডলার ও অস্ত্র নিয়ে উপস্থিত। প্যালেস্তাইনকে নিশ্চিহ্ন করতে সব আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিশু, নারী সহ অসামরিক প্যালেস্তিনিয়দের লাশের পাহাড় বানাচ্ছে উগ্র জায়নবাদী চরম দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়ক নেতানিয়াহু। এই ভয়ংকর আগ্রাসন থামাতে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার কোনো দায় নেই বরং আমেরিকা চায় যুদ্ধ হোক। পরোক্ষে আমেরিকা-ইজরায়েলের সঙ্গী ভারতও তাই চায়। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনী দখল রাখতে ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে শক্তির এই ভয়াবহ আস্ফালন। মানুষের চাপ থাকলেও আরব দুনিয়া সক্রিয় কোনো ভূমিকা প্যালেস্তাইনের পক্ষে নেয়নি। চিন, রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে সদা সচেষ্ট আমেরিকা। লাতিন আমেরিকা থেকে এশিয়া, আফ্রিকা জুড়ে মার্কিনী আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় অন্তহীন যুদ্ধের হুমকি, নানান কৌশলে দখদারিত্বের চেষ্টা কখনোই ক্যাপিটালিজমের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে না। উগ্র জাতীয়তাবাদ, যুদ্ধ, মৃত্যু, ধ্বংস, ধর্ম-জাতি বিদ্বেষ, হানাহানি আর চরম দারিদ্র, বেকারি, ক্ষুধা, বঞ্চনা, শোষণ এবং স্বৈরাচার, দমনপীড়ন, গণতন্ত্রহীনতা, মানবিধাকার লঙ্ঘন – এই হলো আজকের পূঁজিবাদী ব্যবস্থা। ফলে বেঁচে থাকার জন্য, মৌলিক চাহিদা পূরণে, উন্নত জীবনের লক্ষ্যে বিকল্পের সন্ধান চলবেই।
পূঁজিবাদ মানুষকে তার শ্রেণী পরিচিতি ও অবস্থান ভোলাতে চায়। পূঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র শোষণ, আরো মুনাফার খিদেই যে কোটি কোটি মানুষের জীবনের অসীম সঙ্কটের জন্য দায়ী, তা আড়াল করে মানুষকে তার জৌলুশে আকৃষ্ট করতে চায়, মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে আর সামান্য সুবিধে প্রদানের ব্যাপক প্রচারে মানুষকে বোকা বানাতে চায়। তবু এইসব চাতুরি দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা মিটছে না। শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী মানুষ জোটবদ্ধ হচ্ছে, সংগ্রাম বিস্তৃত হচ্ছে। বিকল্প সমাজতন্ত্রের ভাবনাকে কবরে পাঠানো যাচ্ছে না।
সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পর ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটির প্রতি বহু মানুষের যে অনাগ্রহ, কিছুটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছিলো বর্তমান সময়ে তার পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। ২০১৯ সালে Axios জার্নালে প্রকাশিত নতুন হ্যারিস পোল-র তথ্য চমকে দেওয়ার মতো। আমেরিকার নানা প্রজন্মের মানুষের মতামতে উঠে এসেছে, জেনারেশন জি ও মিলেনিয়াম সমাজতন্ত্রকে পূঁজিবাদের চেয়ে বেশি পছন্দ করছে, যা তাদের আগের প্রজন্মের পছন্দের থেকে ভিন্ন। তারা সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সরকারি নীতি চায়, সরকারি ব্যবস্থায় সার্বজনীন হেলথকেয়ার চায়, অবৈতনিক শিক্ষা চায়, সরকারি বীমা চায়, সর্বোপরি তাদের ৫০ ভাগ সমাজতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হতে চায়। আমেরিকার মোট ভোটারের ৩৭% এই প্রজন্ম। এর আগে ২০১৫ সালে YouGov নামের এক মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি একটি সার্ভে করে দেখে, ১৮-৩৯ বছরের তরুণ প্রজন্মের ২৬% সমাজতন্ত্রের পক্ষে তাদের সমর্থন জানাচ্ছে, যখন ৬৫ উর্দ্ধ মানুষের মাত্র ১৫% সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন। গবেষকদের অনেকেই মনে করেন তরুণ প্রজন্ম, শুধু তারুণ্যের জন্য সমাজতন্ত্র অভিমুখী হচ্ছে তা নয়, আসলে পূঁজিবাদের ব্যর্থতাই তাদের সমাজতন্ত্রের বিকল্প ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট করছে।
নভেম্বর বিপ্লব ও তার আদর্শ অকেজো হয়ে যায়নি, বিস্মৃতির অতলে তলিয়েও যায়নি। তা আজও ভাস্বর, আজও পথ প্রদর্শক।