Pradosh Bagchi Cover

November Revolution: Four Decades

প্রদোষকুমার বাগচী

নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা ও বিকাশ। একশো বছর ধরে সেই আন্দোলন পরিচালিত হয়ে চলেছে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে। আন্দোলনের শক্তি ও প্রভাব যখন যেমন থাকুক না কেন, পরাধীন ও স্বাধীন ভারতের দুই ভিন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কখনও ছোট কখনও বড় আকারে, কখনও দেশব্যাপী বিশাল বিশাল সংগ্রাম আন্দোলনের তরঙ্গ তুলে অগণিত সাফল্য অর্জন করেছে ভারতের সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষ। তবুও একশো বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই বিপ্লবের সব শিক্ষা আয়ত্ত্ব হয়নি আজও। কেবল নভেম্বর বিপ্লব বা লেনিনের নামোচ্চারণ যথেষ্ট নয়। শিখতে হবে ইতিহাস থেকেও।

রুশ বিপ্লব ঘুরিয়ে দিয়েছিল সংগ্রামী জনতার চিন্তার মোড়। ইতিহাসের ধারায় ধনতন্ত্র কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়, শ্রেণী সংগ্রামের নিয়মে তার রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী—মাকর্সের যুগান্তকারী চিন্তার এই ছিল মূল কথা। রুশ দেশে সেই চিন্তা বাস্তবায়িত হয়েছে লেনিনের নেতৃত্বে, খবর পৌঁছানো মাত্রই সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সাথে সাথে, বাঙালি বিপ্লবীরাও তাকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বাগত জানিয়েছিল। আকর্ষিত হয়েছিল মার্কসবাদে।

হেগেলের ফিলোসফি অব রাইট’ সংক্রান্ত সমালোচনায় মাকর্সের একটা অভিমত ছিল। এই, ‘যে মুহূর্তে কোনো মতবাদ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে সেই মুহূর্তে ওই মতবাদ বস্তুগত শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।’ ইতিহাসে মাকর্সই সর্বপ্রথম ব্যক্ত করেন, সমাজের অপরিহার্য চালিকাশক্তি হলো শক্তিরূপী গণমানুষ। এখানে ব্যক্তির ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু সেটা ঐতিহাসিক শক্তির অংশ হিসাবে, সমগ্র হিসাবে নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শ্রেণিসংগ্রামের উপর নির্ভরশীল এই ধারণাটি বারে বারে বিরোধী ভাবধারা দ্বারা প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সেই সূত্রে বস্তুগত শক্তি হিসাবে তার আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনাও বারে বারে বিনষ্ট হয়েছে। ফলে প্রবাসী বিপ্লবী যাঁরা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে অল্পবিস্তর পরিচিত হয়েছিলেন, মার্কসের কথাও হয়তো কিছু জানতেন, তাঁরাও অনেকে ধরে নিয়েছিলেন মতাদর্শ হিসাবে মার্কসবাদের সেটাই স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে হঠাৎ পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেল।

প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন

১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের খবর শোনামাত্র পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে, প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের একাংশ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। বাংলার বুদ্ধিজীবী ও তরুণ বিপ্লবীদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। অনেকে লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অবশেষে ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর দেশের বাইরে তাশখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’র প্রতিষ্ঠা। এর পিছনে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এখান থেকেই তরুণ ভারতীয় বিপ্লবীদের কাছে কমিউনিজমের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা নানাভাবে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা হতো। বস্তুত ১৯২০-র সমগ্র দশক জুড়েই মতাদর্শগত চর্চার জগতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল তাশখন্দে গঠিত ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন বইটি সে সময়ে ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি ও মতাদর্শের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। পরে নতুন নতুন ব্যাখ্যায় ও বিশ্লেষণে রজনীপাম দত্তের ইন্ডিয়া টুডে গ্রন্থে আরও আলোকিত হয়ে উঠেছিল ভারত-ইতিহাসের চেহারা। ১৯৪১-এ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিও মার্কসবাদীর দৃষ্টিতে ভারত- ইতিহাসের কাঠামো শীর্ষক ৩১ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বলেছিল—

‘….এই পুস্তিকাতে আমরা সর্বপ্রথম ভারত-ইতিহাসের মার্কসীয় ব্যাখ্যা পাচ্ছি। সে হিসাবে এই প্রবন্ধটি সমস্ত মার্কসবাদীর কাছে মূল্যবান এবং ভারতীয় মার্কসবাদীদের জ্ঞান ভাণ্ডারে একটি নূতন দান । …’

অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না সাহিত্য, রাজনীতি, মতাদর্শ ও ইতিহাস চিন্তার জগতেও নভেম্বর বিপ্লব এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছিল। প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। কাজ তাশখন্দেই আটকে থাকেনি, জার্মানীতেও প্রসারিত হয়েছিল। জার্মানী থেকেই ১৯২২ সালের ১৫ই মে তারিখে পার্টির প্রথম পাক্ষিক পত্রিকা দি ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স (‘ভারতীয় স্বাধীনতার অগ্রসেনা’) প্রকাশিত হয়েছিল। পরে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে মুজফ্ফর আহমদের পরামর্শে সেই পত্রিকার নতুন নাম হয়েছিল এডভান্স গার্ড (‘অগ্রসর সেনা’)। আর কি আশ্চর্য, সেই কাগজ কলকাতাতেও আসতো!

তাশখণ্ডে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ গড়ে ওঠার সাথে সাথে দেশের অভ্যন্তরে একই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজ সম্ভব হয়নি। ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে সে কাজ শুরু হতে একটু সময় লেগেছিল। তাছাড়া রক্ষণশীল সনাতনী ভাবধারায় রুশ বিপ্লবের মতাদর্শ একটা বিরাট আঘাত হেনেছিল। অনেকেই রুশ বিপ্লবের নামে আঁতকে উঠছিলেন। অনেকেরই প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটতে সময় লেগেছিল। এই প্রেক্ষাপটে সারা ভারতে এগিয়ে আসেন যে গুটিকয় যুবক, মুজফ্ফর আহমদ তার অন্যতম। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় গঠিত ভারতের প্রথম সাম্যবাদী সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান সোস্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে উঠেছিল তারই উদ্যোগে।

‘ইন্ডিয়ান সোস্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’

সাম্যবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রথম সর্বভারতীয় মঞ্চ হিসাবে ইন্ডিয়ান সোস্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠা। গড়ে উঠেছিল ১৯২১ সালের শেষভাগ ও ১৯২২ সালের গোড়ার দিকে। ৩/৪সি তালতলা লেন ছেড়ে দিয়ে মুজফ্ফর আহমদ তখন উঠে এসেছেন ১০/১ ব্রাইট স্কিটে। এটাই ছিল ইন্ডিয়ান সোস্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ এর ঠিকানা, যার বাংলা নাম ছিল ‘ভারত সাম্যতন্ত্র সমিতি’। সম্পাদক মুজফ্ফর আহমদ। এই বাড়িতে বসেই তিনি ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’কে একটি চিঠিতে বলেছিলেন ভারতে সমাজতন্ত্রের প্রসারের উদ্দেশ্যেই এই সমিতির আয়োজন। সম্ভবত এই চিঠিটিই ছিল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে লেখা মুজফ্ফর আমদের প্রথম চিঠি। পরে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের তরফে নলিনী গুপ্তের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হলে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে মুজফ্ফর আহমদেরও সংযোগ স্থাপিত হয়ে যায়।

দেশের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রয়াস

১৯২১ থেকে ১৯৩০–এই সময়কালটাকে দেশের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম পর্ব বলা চলে। ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে অবনী মুখার্জি ও মানবেন্দ্রনাথ রায় স্বাক্ষরিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ইস্তেহার বিতরণ করা হয়। অধিবেশনে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল সেই ইস্তেহার। ইত্যবসরে ১৯২২ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ঘটে গেলো মুজফ্ফর আহমদের। সেই সূত্রে দেশের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ভাবনা শুরু। মুজফ্ফর আহমদের কথায়-

আগে পরে চার জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার চেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল। উদ্যোক্তারা একত্র মিলিত হয়ে আলোচনা করে যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা নয়। প্রত্যেক জায়গায় পৃথক পৃথকভাবে প্রথম উদ্যোক্তারা কাজ শুরু করেছিলেন, তাঁদের একজনের সঙ্গে আর একজনের পরিচয়ও ছিল না। ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। প্রথম চারটি জায়গায়—— কলকাতা, বোম্বে, লাহোর ও মাদ্রাজের এক জায়গা হতে অন্য জায়গার দূরত্ব এক হাজার মাইলেরও অনেক বেশি। এত দূরে দূরে থেকেও আমরা সারা ভারতের পার্টি গড়ার কাজে নেমেছিলেম। কারণ কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক। আমাদের সকলের মধ্যবিন্দু ছিল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। তার কেন্দ্র (হেড কোয়ার্টাস) ছিল বহু হাজার মাইল দূরে, মস্কোতে।

বিপ্লবকে রাজশক্তি যে প্রবল ভয় করতো তা বোঝা গেল কানপুর ও পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলায় কমিউনিস্টদের শেষ করে দেবার চেষ্টায়।

পেশোয়ার ও কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা

শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনীতিকে অঙ্কুরেই শেষ করে নিতে পেশোয়ার ষড়যন্ত্রের প্রথম মামলা শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত পর পর চারটি মামলা হয়েছিল। গওহর রহমান, মুহম্মদ আকবর শাহ, আবদুল মজিদ, ফিরোজুদ্দিন মনসুর, আবদুল কাদের, মুজফ্ফর আহমদ প্রমুখ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

পরে ১৯২৪ সালে শুরু হওয়া কানপুর ষড়যন্ত্র মামলাতেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মুজফ্ফর আহমদ। এই মামলার সূত্রেই লোকে প্রথম জানতে পারে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি বলে একটি পার্টির কথা। বিপ্লবের জন্য তাঁরা নতুন পথে নেমেছেন। তাঁদের আদর্শ মার্কসবাদ। মজুর কৃষককে সঙ্গে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সাথে সাথে দেশের স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পথেও পা বাড়াতে চান তাঁরা। আবার অর্থনৈতিক সংগ্রামের তাৎপর্য তুলে ধরে সর্বহারাদেরও ঐক্য গড়তে চান। বলতে গেলে এদেশের আধুনিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন কমিউনিস্টদেরই অবদান।

‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ থেকে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’

কমিউনিস্ট ভাবধারা ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্য সামনে রেখে ১৯২৫ সালের ১লা নভেম্বর গঠিত হয়েছিল ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’। এর মুখপত্র ছিল লাঙল। পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই পত্রিকাতেই কমিউনিস্টদের কানপুর সম্মেলনের সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। কানপুর সম্মেলনই ছিল কমিউনিস্টদের প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন। সত্য ভক্তের উদ্যোগে সমস্ত কমিউনিস্ট গ্রুপকে একত্রিত করে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করার উদ্দেশ্যে আহৃত হয়েছিল। এই সম্মেলন। সম্মেলন থেকে বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে মুজফ্ফর আহমদ কলকাতায় ফেরেন। এবং লেবার স্বরাজ পার্টিতে যোগ দিয়ে গ্রহণ করেন লাঙল সম্পাদনার ভার। পরে সংগ্রামী কৃষক ও শ্রমিকের জঙ্গি অংশকে একটি পার্টিতে সমবেত করার লক্ষ্যে ১৯২৬ সালে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ পরিণত হয় ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’-তে। সেই সুত্রে লাঙলও পরিণত হয় গণবাণী-তে। গণবাণী- কে কেন্দ্র করে চাষী মজুরের আন্দোলন তখন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। নতুন ধরনের যুবসংগঠনও গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তুলছে গণবাণী। এই প্রেক্ষাপটে ১৯২৮ সালে বাংলার রাজনীতিতে সক্রিয় যুবসংগঠন হিসাবে গড়ে ওঠে ‘ইয়ং কমরেডস লীগ’। প্রথম সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন যথাক্রমে ধরণী গোস্বামী ও ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ফিলিপ স্প্রাট। এই পর্বে চেঙ্গাইল, বাউড়িয়া, ব্যারাকপুর, হাওড়া সহ মেটিয়াবুরুজের সুতাকল ও চটকল শ্রমিক লিলুয়ার রেল শ্রমিক বিক্ষোভ, ধাঙড় বা মেথর শ্রমিকদের বিরাট বিরাট ধর্মঘট আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। সারা দেশে মজুর শ্রেণীর আন্দোলন সংগ্রামের জঙ্গি চেহারা দেখে ব্রিটিশ শাসক তীব্র দমন পীড়ন নামিয়ে আনে। ফলে দেশে ও দেশের বাইরে পার্টি কমিটিগুলি আইনি পথে কাজ করতে পারেনি।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা

ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার অভিযোগে ১৯২৯-এর ২০শে মার্চ ২/১ ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন মুজফ্ফর আহমদ, ফিলিপ স্প্রাট, অযোধ্যা প্রসাদ ও শামসুল হুদা। সারা ভারত থেকে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। এইভাবে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ধরপাকড়ের ফলে শ্রমিক-কৃষক দল ও কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করার যে সামর্থ্য ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল তা তছনছ হয়ে গেলো। তদসত্ত্বেও কমিউনিস্টরা বন্দীশালার কাঠগড়াকে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রচারমঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে সারা দেশে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হলেন। বস্তুত সেদিনের আদালত কক্ষ কমিউনিস্টদের কাছে হয়ে উঠেছিল মার্কসবাদের এজিট প্রপের একটি মঞ্চ। ঘটনাচক্রে এই সময়টাতেই কমিন্টার্ন থেকে বহিষ্কৃত হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। পরে ১৯৩৯-এ গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র মানবেন্দ্রনাথ রায়কে নিয়ে ৮০ পাতার একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ছিল দ্য রাশিয়ান রেভোলিউশন : হাউ এম এন রায় মিসইন্টারপ্রেটস টু ইয়াং ইনটেলেকচুয়ালস অব ইন্ডিয়া। চন্দননগরের সমবায় পাবলিশিং থেকে বেরিয়েছিল বইটি।

ইতিমধ্যে মীরাট মামলায় সাজা খেটে ১৯৩৬ সালের জুন মাসের শেষের দিকে কলকাতায় ফিরে এলেন মুজফ্ফর আহমদ।

কলকাতা কমিটি থেকে বাংলা কমিটি

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় সারা দেশের কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হয়ে গেলে ১৯৩১ সালে আবদুল হালিমকে সম্পাদক করে ৭ মৌলবী লেনে গড়ে ওঠে কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কমিটি। ছোটো ছোটো গোষ্ঠী গঠনের মধ্য দিয়ে চক্রস্তরে পার্টির কার্যকলাপের স্তর পেরিয়ে ‘কলকাতা কমিটি’-র উত্তরণ ঘটলো পার্টি স্তরে। চক্রস্তর থেকে পার্টি স্তরে উত্তরণের মধ্য দিয়ে প্রসারিত হলো ‘কলকাতা কমিটি’-র কাজ। তৈরি হলো একটি সাংগঠনিক কাঠামো। গুণগত এইসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কমিটি ‘বাংলা কমিটি’-তে রূপান্তরিত হয়। যার সদর দপ্তর ছিল ৪১ জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের ২৫ নম্বর ঘর। আবদুল হালিমের কথায়—

‘কমিউনিস্ট তত্ত্ব, মার্কসবাদ ও রাজনৈতিক প্রচার এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে সুসংহত করবার কাজে ৪১ নম্বর জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটস্থ কেন্দ্র যে ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল তাহা চিরস্মরণীয় থাকিবে’।

কলকাতা কমিটি গঠনের পূর্বে ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি খসড়া কর্মসূচির ভিত্তিতে সারা দেশে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট গ্রুপগুলির একটি ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক মঞ্চ গড়ার প্রয়োজন দেখা দিলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কমিউনিস্ট গ্রুপগুলিকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মীরাট মামলা-পরবর্তী বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে পার্টিকে ফিরিয়ে আনতে এই উদ্যোগ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিমধ্যে মূলত কমিন্টার্নের নির্দেশ অনুযায়ীই ১৯৩২ সালে গঠিত হয় একটি নতুন সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন ‘ওয়ার্কার্স পার্টি অব ইন্ডিয়া’। উদ্যোক্তা আবদুল হালিম। এক বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণীর প্রকাশ্য পার্টি হিসাবে সারা ভারতে এই পার্টি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অফিস ছিল বেলেঘাটার ৩/১ কালভার্ট রোডে।

অবশেষে ১৯৩৩-এর ডিসেম্বরে কলকাতার জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটস্থ আমজাদিয়া হোটেলের দোতলায় একটি গোপন সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় পার্টির একটি কেন্দ্রীয় কমিটি। ডক্টর গঙ্গাধর অধিকারী পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বস্তুত বিশের দশকের তাশখণ্ড কমিটি, কানপুর কমিটি এবং ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি অব ইন্ডিয়া’-র দেশব্যাপী সংগঠনই ছিল কেন্দ্রীয় কমিটি গড়ে তোলার ভিত্তি। পার্টির নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা ‘গণশক্তি পাবলিশিং হাউস’-এর আত্মপ্রকাশও এই সময়ে। এই সময়ে পার্টিরও শক্তি বৃদ্ধি হয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে।

কমিউনিস্ট পার্টি অবৈধ ঘোষিত

ব্রিটিশ সরকার যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রসারে ভীত হয়ে পড়েছিল পার্টিকে অবৈধ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে তাদের সেই মনোভাবটাই প্রকাশ্যে চলে এল। ১৯৩৪ সালের ২৩শে জুলাই ভারতের সর্বত্র নিষিদ্ধ হলো কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু কংগ্রেসের গায়ে কোনো আঁচড় পড়েনি। ১৯৩৪-এর আগেও কমিউনিস্ট পার্টিকে কার্যত বেআইনী করে রাখা হয়েছিল। এতে পার্টির নেতা ও কর্মীরা মোটেও দমে যায়নি। মানুষের মনে পুঞ্জীভূত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তারা সংগ্রামী মানুষের বৃহত্তর ঐক্য গঠনের কথা ভেবেছে। সেসময়েই ১৯৩৫ সালে, খবর এলো, ভারতসহ ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানাচ্ছে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেস।

দত্ত-ব্রাডলে থিসিস

ভারতের মাটিতে যুক্তফ্রন্টের নীতির প্রয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আলোচনায় অগ্রসর হয়েছিল। সেই সময়েই গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রজনীপাম দত্ত এবং বেন ব্রাডলের কাছ থেকে ভারতের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যুক্তফ্রন্টের নীতি প্রয়োগের ব্যাপারে বেশ কিছু পরামর্শ পাওয়া গেল। এটাই পরবর্তীকালে ‘দত্ত-ব্রাডলে’ থিসিস হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই থিসিসের ভিত্তিতেই ভারতের কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের মঞ্চকে একটি ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মঞ্চে পরিণত করতে সচেষ্ট হন। কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থেকেই কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই থিসিস অনুযায়ী হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও নৃপেন চক্রবর্তী কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে, হরিপুরা কংগ্রেসে বঙ্কিম মুখার্জি, মুজফ্ফর আহমদ, সোমনাথ লাহিড়ি, পাঁচুগোপাল ভাদুড়ী, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার এ আই সি সি-র সদস্য নির্বাচিত হন। রণকৌশলগত এই নীতি অনুসরণ করার ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্টরা কংগ্রেস এবং কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠেন এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে তৎপর হন।

১৯৩৬-৩৯: পার্টির দ্রুত বৃদ্ধি

এই সময়কালে পার্টির গণকর্মসূচীর ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে। গঠিত হয় সারা ভারত কিষাণ সভা। ওই বছরেই গঠিত হয় সারা ভারত ছাত্র ফেডারেশন। ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজ্যে সরকার গঠিত হওয়ায় বড় বড় বিক্ষোভ সংগ্রাম ধর্মঘট পরিচালিত হয়। ১৯৩৭-৩৮ সালে সারা দেশে ৩৭৯টি ধর্মঘট সংগঠিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’-এর প্রকাশ ঘটে। পার্টির প্রকাশনালয় হিসাবে ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’রও প্রতিষ্ঠা এই সময়ে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সমস্ত কাজ থমকে যায়। একসময় “ন্যাশনাল ফ্রন্টও বন্ধ হয়ে গেলো। নতুন পরিস্থিতিতে পার্টির প্রায় সমস্ত কাজই মুখ থুবড়ে পড়ে। তবুও বাংলায় মুজফ্ফর আহমদ, বঙ্কিম মুখার্জি, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, আবদুল হালিমের চেষ্টায় নতুন ধরনের নতুন সাপ্তাহিক’ বেরোল ‘আগে চলো’। প্রথম সংখ্যার প্রথম পাতার লিড নিউজ ছিল— ‘সারা ভারতে সুতাকল কর্মীদের সম্মেলন চাই’।

জনযুদ্ধের কাল

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি একে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসাবে অভিহিত করেছিল। পরে ১৯৪১ সালে ২২শে জুন নাৎসীবাহিনী সোভিয়েত আক্রমণ করলে এই যুদ্ধ আর কেবল সাম্রাজ্যবাদী রইলো না। এর ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে ফ্যাসিস্ত শক্তির আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরি হয়, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এই যুদ্ধকে রুখতে ‘জনযুদ্ধ’-এর স্লোগান দেওয়া হয়। বিশ্বযুদ্ধের অভিমুখ ও চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্নও ওঠে পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি তুলে ধরা হয়েছিল পার্টির পলিটব্যুরোতে। ছয়টি ভাগে সাজানো সবক’টি প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছিল সেই পলিটব্যুরো। এই সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র ছিল পিপলস ওয়ার। বঙ্গদেশেও ওই সময়ে পার্টির মুখপত্র ছিল সাপ্তাহিক জনযুদ্ধ। সম্পাদক ছিলেন বঙ্কিম মুখার্জি। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে পার্টির স্বাধীন কাজকর্মের বিকাশ ঘটে। ঠিক হয় পার্টি বৈধ হওয়ার ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে হবে।

২৪৯ বহুবাজার স্ট্রিট

বহুবাজার স্ট্রিটের ২৪১ নম্বর বাড়িতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’-র প্রথম প্রকাশ্য দপ্তর গঠিত হয়। এই বাড়িতেই মুজফ্ফর আহমদের নির্দেশে প্রকাশ্যে পার্টির সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন রণেন সেন, বিশ্বনাথ মুখার্জি ও বঙ্কিম মুখার্জি। এই প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে লাল পতাকা উড়িয়েছিল। মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন—

‘মনে রাখতে হবে যে পার্টির নামে কোনো লাল পতাকা ১৯৩৭ সালের আগে কিংবা পরে আমরা ওড়াতে পারিনি। তখন গণ-সংগঠনের মঞ্চ থেকেই আমরা লাল পতাকা ওড়াতাম। পার্টির নামে আমরা লাল পতাকা ওড়াতে আরম্ভ করেছিলাম ১৯৪২ সালে পার্টি বৈধ ঘোষিত হওয়ার পর থেকে’।

পাটির বৈধ হওয়ার ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ১লা আগস্ট ১৯৪২ কলকাতা টাউ হলে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেছিলে রাহুল সাংকৃত্যায়ন। সেদিন টাউন হলে তিল ধারনের স্থান ছিল না। এই সময়েই পার্টি যেমন বিভিন্ন গণআন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল, তেমনি কংগ্রেসে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক ধরপাকড় ও দমনপীড়ন শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানালো। তাদের মুক্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলনও করেছিল। আজ হয়তো অনেকে ভুলে গেছেন আগস্ট আন্দোলনের ঘাঁটি আমেদাবাদে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়ে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন কমিউনিস্ট কর্মী উমাভাই ফাদিয়া। কলকাতায় যেদিন পুলিশের লাঠি চলেছিল, সে লাঠিও সকলের আগে পড়েছিল কমিউনিস্ট ছাত্রদের মাথায়। জনগণের মধ্যে ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে পার্টি সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৩ সালে বোম্বেতে পার্টির প্রথম কংগ্রেসের সময়ে পার্টি সদস্য ছিল ১৫,৫৬৩।

শেষ আঘাত হানার সংগ্রাম ও ভারতের স্বাধীনতা

যুদ্ধের শেষে ফ্যাসিবাদের পরাজয় এবং তার কিছুদিনের মধ্যে আকাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জিত হলে সি পি আই-এর ‘জনযুদ্ধ’-এর নীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও তার যথার্থতারও প্রমাণ পেলেন দেশবাসী। যুদ্ধের পর গণঅভ্যুত্থানের যে জোয়ার শুরু হয়েছিল তাতে কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দী সৈনিকদের প্রতি সংহতি জ্ঞাপনে, নৌবিদ্রোহের প্রতি সমর্থনে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণসংগ্রামে, তেভাগা আন্দোলনে, তেলঙ্গানা গণসংগ্রামে, কেরলের পুন্নাপ্রা-ভায়লার আন্দোলনে – সবেতেই নেতৃত্বের প্রথম সারিতে ছিল কমিউনিস্টরা। শত শত শহীদের আত্মদানে দৃপ্ত এইসব গণসংগ্রাম কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে পরিচালিত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামকে আরও শাণিত করে। বাংলার তদানীন্তন গভর্নর রিচার্ড কেসি তার রিপোর্টে লিখলেন – “সমস্ত বিক্ষোভের পিছনে সবচেয়ে বিপজ্জনক সংগঠন হচ্ছে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’।” কমিউনিস্টদের তরফে শেষ আঘাত হানার এমন ব্যাপক চেহারা দেখে দেশে ফিরে গিয়ে ব্রিটিশ সংসদীয় নেতা ফ্ল্যাঙ্ক রিচার্ডস প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলিকে সতর্ক করলেন এই বলে, ‘আমাদের চটপট ভারত ছেড়ে চলে আসা উচিত, নইলে ভারতবাসীরা আমাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে।’ (অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৩। ২। ৪৬)

একথা ঠিক সেসময়ে কমিউনিস্টরা বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী ভূমিকা পালন করলেও জঙ্গী গণআন্দোলনকে দেশব্যাপী অভ্যুত্থানে পরিণত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি কমিউনিস্টদের ছিল না। এরই সুযোগ নিয়েছিল বুর্জোয়ারা। তাই দেখা গেলো কংগ্রেস। নেতারা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাইবামাত্র ব্রিটিশ শাসক তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারা কংগ্রেসের উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম লীগের ভারত ভাগের স্লোগানকে কার্যকরী করে তুললো। এইভাবে ১৯৪৭ সালে ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনা একই সঙ্গে কংগ্রেসের কাছে যেমন জয়ের, তেমনি পরাজয়েরও। কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের একাংশ এই স্বাধীনতাকে স্বাগত জানায়। অন্য অংশ সমগ্র ঘটনাকে বুর্জোয়া নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মসমর্পণ হিসাবে চিহ্নিত করে।

দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ ও বামপন্থী হঠকারিতা

ঘটনাপরম্পরা যদিও দেখিয়ে দিচ্ছে তিরিশের দশক থেকে পার্টির বিরাট অগ্রগতি ঘটে চলেছিল, কিন্তু সেই সময় থেকেই পার্টি নেতৃত্ব হয় সুবিধাবাদ, নয় সংকীর্ণতাবাদের শিকার হয়েছিল। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের শিকার হয়েছিল পার্টি। ১৯৪৮ সালে পার্টির কলকাতা কংগ্রেসে সেই ত্রুটি দূর করা হয়, কিন্তু তা করতে গিয়ে পার্টি নেতৃত্ব বামপন্থী সংকীর্ণতাবাদের শিকারে পরিণত হয়, যার পরিণতি হয়েছিল ভয়ঙ্কর।

পুনরায় অবৈধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি

কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় ১৯৪৮-এ। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসকরা চেয়েছিল অঙ্কুরেই কমিউনিস্ট পার্টিকে শেষ করে দিতে। আর স্বাধীন ভারতে কংগ্রেসের প্রথম কাজই হয়েছিল পার্টিকে বেআইনী ঘোষণা করে কমিউনিস্টদের শেষ করে দেওয়া। পার্টি তখন আসন্ন বিপ্লবের অভিলাষে বিভোর থেকে আন্দোলনকে আর তীব্র, আরও জঙ্গি করে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। ১৯৫০ সালে কমিনফর্মের মুখপত্রে বলা হলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যে সংকীর্ণতাবাদী রাস্তা নিয়েছে, তা পরিহার করতে হবে। সেই লাইন অনুসারে পার্টিকে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলা হলো। নেতৃত্বেও পরিবর্তন এলো। এর ফলে পার্টিকে বিপর্যয়ের মুখ থেকে খানিকটা রোধ করা গেল ঠিকই, কিন্তু বিপ্লবের প্রশে সুবিধাবাদী ও সংকীর্ণতাবাদী প্রবণতাগুলো থেকেই গেলো।

১৯৫১: পার্টির কর্মসূচী গৃহীত

বিতর্ক গুরুতর আকার নেওয়ায় বিরোধ মীমাংসার ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তা চাইলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিকেই দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরামর্শদাতা মান্য করা হতো। স্বয়ং স্তালিন ভারতের প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন, আপনাদের পার্টি সার্বভৌম পার্টি। আমরা সাধ্যমত পরামর্শ দিয়েছি। আপনাদের দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ভিত্তিতেই আপনাদের এগোতে হবে। নিজেদের অভিজ্ঞতায় যদি বোঝেন কোথাও কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে, তাহলে পরামর্শগুলি সংশোধন করবেন, প্রয়োজনে বাতিলও করবেন। ভারতীয় প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজেশ্বর রাও, বাসবপুন্নাইয়া, অজয় ঘোষ এবং এস এ ডাঙ্গে। স্তালিনের পরামর্শমতো ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় এক গোপন পার্টি সম্মেলনে ‘পার্টি কর্মসূচী’ গ্রহণের মাধ্যমে পার্টি ফিরে আসে গণআন্দোলনের সঠিক পথে। মতাদর্শগত বিতর্কও খানিকটা স্তিমিত হয়ে আসে।

১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসাবে আবির্ভূত হয় কমিউনিস্ট পার্টি। এই নির্বাচনই প্রমাণ করে দেয় কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়ো’ ও মুসলিম লীগের ‘দ্বিজাতির তত্ত্ব’-এর বিরোধিতা করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জঙ্গি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে বিকল্প শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। গণআন্দোলন ও গণসংগঠনগুলিও ক্রমশ শক্তিশালী হতে শুরু করে এই সময় থেকে। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পার্টির অভ্যন্তরে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই দশকটিকে গণআন্দোলনের জোয়ারের দশক হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। অঙ্গরাজ্যে সরকার গঠন ও পরিচালনার অভিজ্ঞতাও এই সময়ে বাস্তব রূপ পায়।

পরে মতাদর্শগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিও বিভাজিত হয় একাধিকবার। অবশ্য সেই প্রসঙ্গ ভিন্ন। ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবের ফলে বিশ্ব পরিস্থিতির চেহারাও পাল্টে গিয়েছিল। তার প্রভাব ভারতেও পড়েছিল। ১৯২০ সালে যে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাশখন্দে, সেই থেকে চারদশক বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল শ্রমজীবী মানুষের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে সেই পার্টিই পালন করে গেছে গৌরবময় ভূমিকা।

২০১৭ সালে কোরক সাহিত্য পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত

Spread the word

Leave a Reply