রুশ বিপ্লব ও নারীমুক্তি – মালিনী ভট্টাচার্য…

৭ নভেম্বের ২০২১ , রবিবার


১৯১৭র রুশ বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই ইউরোপের সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে নারীমুক্তির সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন। ১৯০৭ সাল বা তারও আগে থেকে বলশেভিক নেত্রীরা নিবিড়ভাবে চেষ্টা শুরু করেন রাশিয়াতে শ্রমজীবী মেয়েদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলতে এবং বিপ্লবী চেতনায় তাদের উদবুদ্ধ করতে। লেনিন নিজে বলেছিলেন, নারীশ্রমিকেরা অক্টোবর বিপ্লবে যে আগুয়ান ভূমিকা নিয়েছিলেন তাকে বাদ দিয়ে আমরা জয়ী হতে পারতাম না। অনেকের মতে, ১৯১৭র ২৩ ফেব্রুয়ারি ( অন্যহিসাবে ৮ মার্চ) পেত্রোগ্রাদের শ্রমজীবী মেয়েরা রুটি, যুদ্ধ বন্ধ এবং জারতন্ত্রের অবসানের দাবি নিয়ে যে দলে দলে রাস্তায় নেমেছিলেন সেখান থেকেই জ্বলে ওঠে রুশবিপ্লবের প্রথম স্ফুলিঙ্গ।


মনে রাখতে হবে ইউরোপের কোনো কোনো অংশে বিশেষত ভোটাধিকারের দাবি নিয়ে মেয়েদের নিজস্ব কিছু সংগঠন এসময়ে গড়ে উঠেছিল। নারীসাম্যের কিছু কিছু বিষয় ইউরোপীয় বুর্জোয়াসমাজে কিঞ্চিৎ পরিসর আদায় করতে সক্ষম হচ্ছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা খুব স্পষ্টভাবেই বুঝেছিলেন যে এই সাফ্রাজেট সংগঠনগুলি নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের বাইরে যেতে আগ্রহী নয়, সমাজের বৃহদংশের শ্রমজীবী মেয়েদের মুক্তিসন্ধানে সেখানে সহযোগিতার খোঁজ করে লাভ নেই। আর্থ-সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রেখে যারা শুধু ওপর থেকে কিছু সংশোধন চায় তাদের পথে নয়, যেতে হবে সমাজের আমূল পরিবর্তনে ব্রতীদের কঠিন রাস্তায়। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে শ্রেণীসমাজের আশিরনখর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে নারীমুক্তির কথা বলা আছে, এঙ্গেলস বা বেবেল ব্যক্তি-সম্পত্তির বিনাশে পারিবারিক-সামাজিক কর্তৃত্ববাদের যে অবসানের আশা দেখান, লেনিন অন্ধ, অধঃপতিত, অবিরাম গৃহশ্রমের নিগড় থেকে সামাজিক উৎপাদনের সম-অধিকারের জগতে যে মুক্তির বার্তা আনেন, সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা সাব্যস্ত করলেন সেদিকেই নারীমুক্তির প্রকৃত পথ।


নভেম্বর বিপ্লবের পরে রাশিয়াতে শিশু শ্রমিকরাষ্ট্র যে প্রথম যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলি নিয়েছিল তার মধ্যে বেশকিছু শ্রমজীবী মেয়েদের স্বার্থকে মাথায় রেখে সরাসরি রুশসমাজের লিঙ্গ-অসাম্যকে আঘাত করে। যেমন, জমিসংক্রান্ত অধ্যাদেশে সমস্ত জমিকে রাষ্ট্রের আওতায় এনে নারীপুরুষনির্বিশেষে সব কৃষককে বিনাকরে তা চাষ করার অধিকার দেওয়া হল। কাজের সময় আটঘন্টা বেঁধে সমকাজে সমমজুরির আইন চালু হল। মেয়েরা পেল মাতৃত্বকালীন সুবিধা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অসুস্থতায় সমান বিমার সুবিধা। ১৯১৮ সালের সংবিধানে শ্রমজীবীশ্রেণীর অংশহিসাবে তাদের মিলল পূর্ণ ভোটাধিকার এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পূর্ণ সুযোগ। আগে যাদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৭% সার্বজনীন শিক্ষানীতিতে বলীয়ান হয়ে তারা ২০ বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ মুক্ত হল নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে এবং সমস্ত দক্ষ উৎপাদনমূলক কাজে যোগ দিতে পারল। খোদ লেনিন আহ্বান জানালেন রাষ্ট্রের উদ্যোগে পর্যাপ্ত ক্রেশ এবং ক্যান্টিন গড়ে তোলার জন্য যাতে মেয়েরা গার্হস্থ্যের কারাগারে আটকা না থাকে।

আইনগুলো যে কেবলমাত্র পুঁথির পাতায় আবদ্ধ ছিল না, তাকে কার্যকরী করার পরিকাঠামো চারিদিকের আক্রমণ ও গৃহযুদ্ধের মধ্যেই অতিদ্রুত তৈরি হয়েছিল এবং শিশুরাষ্ট্রের সুরক্ষা ও বিকাশে দীর্ঘ বঞ্চনার অন্ধকারে পড়ে-থাকা লক্ষ লক্ষ মেয়ের সজীব অংশগ্রহণকে সম্ভব করেছিল, তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বিপ্লবী রাষ্ট্রে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। লেনিন বলেছিলেন, এই লম্বা লড়াই যতদিন না আমরা জিতব ততদিন সমাজতন্ত্রের লড়াইও বিলম্বিত হবে। গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের ওপর ধর্মের প্রভাব কাটাতে হলে কতখানি সংবেদনশীলতার প্রয়োজন তার উল্লেখ করেছিলেন। ক্লারা জেটকিনের সঙ্গে কথোপকথনে মন্তব্য করেছিলেন, অনেক কমরেডের সম্বন্ধেই একথা বলা যায় যে ওপর থেকে নখের আঁচড় দিলেই তার ভিতরের সংকীর্ণতা বেরিয়ে আসবে। লঘু আলাপচারিতা নয়, এ ছিল সতর্কবাণী।


প্রকৃতপক্ষে বলশেভিক বিপ্লবের ঠিক পরের বছরগুলিতে নারীমুক্তির অভিমুখে রাষ্ট্র ও সমাজের যে তীব্র গতিবেগ লক্ষ্য করা যায় তা যে আগাগোড়াই অব্যাহত ছিল এমন দাবি করা যাবে না। সোভিয়েট রাশিয়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই গতিবেগে আগুপিছু ছিল, ছিল বদ্ধতায় পর্যবসিত হবার ইঙ্গিত। বিগত ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের আগুয়ান উপস্থিতি অনেক বেড়েছে তখনই প্রথম পারিবারিক আইনগুলিতে কিছুটা রক্ষণশীলতা ফিরিয়ে আনা হয়, শ্রমিক-রাষ্ট্রের স্বার্থে তাদের মাতৃত্বের ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয় বেশি, মেয়েদের বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় সম-অংশভাগী করে তোলার প্রকল্পটির খানিকটা থমকে-যাওয়া সূচিত হয় তার মধ্যে।

১৯৫৫র পরে রক্ষণশীল সংশোধনীগুলি তুলে নেওয়া হলেও, পরে ১৯৭৭এর সংবিধানে মেয়েদের সমানাধিকারের কথা নতুন করে ঘোষিত হলেও এবং রাষ্ট্র থেকে প্রাপ্য সুযোগসুবিধা একই রকম থাকলেও নতুন মানুষ গড়তে পারিবারিক ও পিতৃতান্ত্রিক আদলের বিরুদ্ধে প্রথম পর্যায়ের তুমুল সামাজিক আন্দোলনকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। সোভিয়েট রাশিয়ার পতনের পরে একথাও শোনা গিয়েছিল যে রুশ মেয়েরা সাম্য চায় না, চায় গৃহের আশ্রয়ে ফিরতে। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয় যে সমাজতন্ত্রের আদলে নারীমুক্তির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শ্রেণী-প্রতিপক্ষ, এমনকী সমাজতন্ত্রী নারীবাদীরাও যেসব প্রশ্ন সময়ে সময়ে তোলেন তা এড়ানোর নয়।


স্থূল অপপ্রচারের মাত্রা বাদ দিলেও যেপ্রশ্নগুলির ঠাণ্ডামাথা বিচার দরকার সেগুলি হলঃ

১) পারিবারিক নিষ্পেষণ ও ধর্মীয় সংস্কারের নিগড় থেকে মেয়েদের মুক্তি দেয় সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষা, কিন্তু রাষ্ট্রের উন্নয়নের স্বার্থের কথা বলে এক নতুন রক্ষণশীলতায় বিপ্লবের সঙ্গীহিসাবে তার আত্মবিকাশকে সীমিত করা যায়কি? বিপ্লবের গতি নিছক অর্থনৈতিক উপযোগিতাবাদের দিকে গেলে নতুন মানুষ গড়ার বৃহত্তর গণতান্ত্রিক সক্রিয়তায় ঘাটতি হয়ে যেতেই পারে।

২) শ্রেণীনিরপেক্ষ কোনো নারীমুক্তির আন্দোলন যেমন আজকের পরিস্থিতিতেও হয় না, বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীমুক্তির সামগ্রিক আন্দোলন যেমন কখনো করা যায় না, তেমনি অন্যদিকে সর্বহারা শ্রমজীবী কিছুটা ক্ষমতার অধিকারী হলেই নারীসাম্যের পক্ষ স্বাভাবিকভাবেই অবলম্বন করবে এমনটা নয়। তার চেতনারও বিকাশ চাই।

৩) আগের প্রশ্নের সূত্র ধরেই বলা যায়, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি বা সংগঠনকেও অভ্যন্তরীণ শ্রেণীসাম্য ও লিঙ্গসাম্যের পাঠ অহরহ নিতে হয়। নইলে অতিকেন্দ্রিকতা সমাজতন্ত্রের চেতনা জাগানোর বদলে কর্মীদের সংগঠনের অভ্যন্তরীণ পিতৃতন্ত্রেরই বশংবদ সৈনিক বানিয়ে ফেলতে পারে।


সমাজতন্ত্রের সৈনিকরা রুশ বিপ্লব থেকে এই শিক্ষাই নিতে পারেন যে বিপ্লবী নীতি এবং সামাজিক পশ্চাৎপদতা/রক্ষণশীলতার মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়না। একটি কিংবা অন্যটিকে অপসৃত হতেই হয়। বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চলাকালীনও সমাজের মধ্যে এই দুটি শক্তিই কাজ করতে থাকে। এবং দুইয়ের মধ্যে বিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর আকার নেয়। বলশেভিকরা বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সামাজিক রক্ষণশীলতাকে জোর ধাক্কা দিতে পেরেছিলেন। মানুষের চেতনাকে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন। এই উদ্যোগ পরে অব্যাহত থাকেনি। যাঁরা সমাজ-পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ তাঁরা রক্ষণশীলতাকে প্রাণপণ আক্রমণ না করে তার সঙ্গে সহাবস্থানে ভারসাম্য রক্ষা করে চলবেন এই ভ্রান্তিতে যদি ভোগেন তাহলে একসময় তাঁদেরই পিছিয়ে পড়তে হবে। পুঁজিবাদ সারাবিশ্বে লিঙ্গসাম্যের সমস্যাকে মেটাতে পারেনি। এবিষয়ে রুশ বিপ্লবের শিক্ষাকে নতুন করে হৃদয়ঙ্গম করা ছাড়া আমাদের উপায় কোথায়?

Spread the word

Leave a Reply