সংস্কৃতিতে এলিট মহলের স্বেচ্ছাচারিতার অবসান – জয়দীপ মুখার্জী

৭ নভেম্বর ২০২১ (রবিবার)

শিল্পীর চোখে নভেম্বর বিপ্লব


মে, ১৯২৪ রাশিয়ার কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে দেশের নতুন পরিস্থিতিতে শিল্প-কলা, সাহিত্য, চলচ্চিত্রসহ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সোভিয়েত সরকার এবং পার্টির ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়েছিল।


‘নতুন পরিস্থিতি’ মানে, ১৯১৭ -এর সফল বিপ্লব, বিশ্বে প্রথম রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনৈতিক দায়িত্বে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণি বাহিনী কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টি। ফেব্রুয়ারিতে স্বৈরাচারি রাজতন্ত্রের অবসান। অতঃপর নভেম্বরের ৭ থেকে ১৭, বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে দুনিয়া কাঁপানো বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান, চরম দক্ষিণপন্থী অ্যালেকজান্ডার কেরেনেস্কি সরকারের পতন। দেশের অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। উৎপাদনের উপকরনের মালিকানা সরাসরি রাষ্ট্রের অধীন, সম্পদের সুষম বন্টন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষার সংস্থান, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা। স্বাভাবিকভাবে রাশিয়াসহ গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদী শিবিরের কাছেই সেটা ছিল চরম হতাশাব্যাঞ্জক ঘটনা। শৈশবেই সমাজতন্ত্রকে বিনাশ করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকার মতো সামরিক শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। গৃহযুদ্ধের নামে সেও এক ভয়ঙ্কর প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র। ১৯১৮ -এর জানুয়ারি থেকে ১৯২২ -এর অক্টোবর, রাশিয়া জুড়ে টানা চার বছর ক্ষমতাচ্যুত জারের শ্বেত সৈন্য বাহিনী এবং তাদের সহায়তাকারী সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন-ব্রিটিশ-ফরাসি-জার্মান সম্মিলিত ২ লক্ষ বহির্দেশীয় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লাল ফৌজ ও বলশেভিক পার্টির রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বিজয়ের পথেই জন্ম নিয়েছিল সেই নতুন পরিস্থিতি, এক নতুন যুগের সূচনা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই পুঁজিবাদী শিবিরের সেই প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্র মোকাবিলার পর গোটা রাশিয়া তখন রণক্লান্ত, বিধ্বস্ত। দেশজুড়ে চরম খাদ্য সংকট। রোমানভ সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট (জার) নিকোলাস (২) -এর চরম দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারি শাসনে আভ্যন্তরীন উৎপাদন তলানিতে। কল-কারখানার রুগ্ন দশা, মজুরির নিশ্চয়তা নেই, অযুত হাতে কোনো কাজ নেই। আইন শৃঙ্খলা ভগ্নপ্রায়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থবির, একেবারে অচলাবস্থা। জবরদস্তি জারের সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখানো লক্ষ শ্রমিক-কৃষক যুদ্ধের জের -এ পঙ্গুত্বের শিকার। তার ওপর দেশজুড়ে মারাত্মক সংক্রামক রোগের প্রকোপ, ভয়ানক টাইফাস মহামারি। এক চূড়ান্ত অরাজক অবস্থার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার কাজ শুরু করতে হয়েছিল বলশেভিক পার্টিকে। সঙ্কটে দীর্ণ, অভূক্ত রাশিয়ার বিভ্রান্ত মানুষকে সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রাণিত করার দুরূহ দায়িত্বে দেশের সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোকে গড়ে তোলার দিশা দিয়েছিল ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেস। গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল চলচ্চিত্র শিল্পের বিস্তার ঘটানোর ওপর। এই শিল্পের মাধ্যমে দেশের জণগনের বৃহত্তর অংশকে সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রাণিত করতে সোভিয়েত সরকার ও পার্টিকে যুথবদ্ধ ভুমিকা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্নাতীত ভাবেই দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে এই সংগঠিত আন্দোলনমুখী উদ্যোগের বাস্তবতা তৈরি করে দিয়েছিল নভেম্বর বিপ্লব।


রাজা-উজির-শিল্পমালিক-ধনীকশ্রেনির পরিবর্তে দেশের নীতি নির্ধারনের গুরুভার একেবারে চাষাভুষো-মজুরশ্রেণীর আমজনতার ওপর এবং সম্পদের ওপর গরিবেরও ন্যায্য অধিকার, আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল কবিতা, উপন্যাস, বইয়ের পাতায়, নাটক-থিয়েটারের মঞ্চে, সিনেমার পর্দায়। সাংস্কৃতিক চর্চা এবং বিনোদনের অধিকার যে শুধুমাত্র সমাজের উচ্চমার্গে অধিষ্ঠিত ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের একান্ত, অনন্তকালের এই স্বেচ্ছাচার ভাঙতে শুরু করলো। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সিনেমার নায়ক-নায়িকা হয়ে উঠলেন ধুলো-ময়লা-ঘামে ভেজা শরীরে মেহনতি মানুষজন, আমজনতার ঘরের লোক। গল্পের ভাষ্যে উঠে এলো দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটে জীবন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। সুন্দর সুবেশিত অভিজাত চেহেরার নায়ক-নায়িকার একক ক্ষমতাবলে বলীয়ান সদর্প নায়কোচিত উপস্থিতির বদলে ভিড়ে মিশে থাকা চেতনাসম্পন্ন, সৎ, সাহসী কোনো অখ্যাত মানুষের সমষ্টিগত প্রয়াস প্রধান চরিত্রের জায়গা করে নিল। শুধু সোভিয়েত রাশিয়ার জন্যই নয়, বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা হলো। সংস্কৃতির জগতে নিয়ে এলো এক গুণগত পরিবর্তন। ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির কবিতায়, ম্যাক্সিম গোর্কির গল্প-উপন্যাসে তার ছাপ পড়লো। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি, বরিস পলেভয়’দের লেখায় সমাজতন্ত্রকে রক্ষার মরনপণ সংগ্রামের বিজয়গাথা। লাজার লিসটজস্কি, কাজিমির ম্যালেভিচ, তাতলিনের তুলিতে বাঙময় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মৃত্যুঞ্জয়ী লড়াই।

লুনাচারস্কি
মায়াকোভস্কি

পুদভকিন


সাংস্কৃতিক জগতে এই গুণগত পরিবর্তনের ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ ছিল রাষ্ট্রনেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের। সিনেমা, সাহিত্য মানেই রাজা-রানি, রাজকন্যা-রাজপুত্র অথবা অভিজাত-ধনী পরিবারের প্রেম বিরহের গন্ডী পেরিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার লড়াইয়ে উন্নীত হওয়ার ঝোঁক তাঁকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। বস্তুত কিশোর বয়স থেকেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনাবিল আকর্ষণ ছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তলস্তয়, পুসকিন, দস্তয়ভস্কি, নিকোলাই গোগল’দের গল্প উপন্যাস ছিল তাঁর প্রিয় পাঠ্য। নিয়মিত লাইব্রেরিতে যেতেন তিনি। সেখানে সেক্সপিয়ের, ভন গ্যেটে’র সাহিত্যকর্মও ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। এমন কি, নিজের নাম উলিয়ানভ থেকে ছদ্মনাম লেনিন -এ পরিচিতি প্রাপ্তির অন্যতম একটি কারণ ছিল তাঁর এই সাহিত্য প্রীতি। জার শাসনে তাঁর ঐ ধরণের বই খোঁজাখুজির কারনে গুপ্তচর বাহিনীর নজরদাড়িতে পড়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেই থেকেই তাঁর ছদ্মনাম ব্যবহার শুরু। লেনিনের উপলব্ধি ছিল ভবিষ্যত কালে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠবে চলচ্চিত্র শিল্প। বিপ্লবোত্তর প্রথম বলশেভিক সরকারের শিক্ষা বিষয়ক কমিশার আনাতলি লুনাচারেস্কি’কে তিনি বলেছিলেন, শিল্প-কলার সবক’টি আঙ্গিকের মধ্যে চলচ্চিত্রই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্রকে শুধুমাত্র বিনোদনের উপকরণ হিসেবে দেখলে চলবে না। সুদীর্ঘ রাজতন্ত্রের অবসান ও চরম দক্ষিণপন্থী কেরেনেস্কি সরকারের পতনের পর বলশেভিক সরকার এবং পার্টির কাছে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার জনগণকে একাধারে সাক্ষর ও সচেতন করে তোলা। তাঁরা জানতেন প্রাথমিক এই কাজটি সম্পন্ন না করা গেলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয়। অতএব লেনিনের পরামর্শ ছিল, রাশিয়ার জনগণের উন্নত চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সংস্কৃতির অঙ্গনে চলচ্চিত্র শিল্পের পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে।

ম্যাজিকের মতো কাজ হলো লেনিনের বার্তায়। রাশিয়ার চলচ্চিত্র জগতের দুই পথিকৃৎ ভ্লাদিমির গার্ডিন এবং লেভ কুলেশভের তত্ত্বাবধানে ১৯১৯ -এ চালু হলো, স্টেট স্কুল অব সিনেমাটোগ্রাফি। সুপ্রাচীন বাজারমুখী অভিজাত ঘরানার সমান্তরালে শুরু হলো একেবারে অন্য ঘরানার বাস্তবমুখী চলচ্চিত্র নির্মানের প্রতিষ্ঠান। প্রখ্যাত অভিনেতা ও বাস্তবমুখী সিনেমা পরিচালক গ্রিগরি কোজিনৎসেভ, লিওনেড ট্রাউবার্গ, সের্গেই ইউৎকেভিচ’রা সকলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনি। একে একে সামনের সারিতে চলে এলেন বিশ্ববরেণ্য সের্গেই আইজেনস্টাইন, ভেসভলভ পুদোভকিন, বরিস বার্ণেট, মিখাইল রোমের মতো পরিচালকরা। তাঁদের সৃজনশীল ভাবনা এবং উদ্ভাবনী শক্তির মিশেলে কালোত্তীর্ন হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত রাশিয়ার চলচ্চিত্র শিল্প। কুলেশভ তৈরি করলেন, মিঃ ওয়েস্ট ইন দ্য ল্যান্ড অফ দ্য বলশেভিকস অফ ১৯২৪, বাই দ্য ল অফ ১৯২৬, দ্য কনসোলার অফ ১৯৩৩ এবং অন দ্য রেড ফ্রন্ট (১৯২০) -এর মতো অবিস্মরণীয় সমস্ত ছবি।

আইজেন্সটাইন


১৯০৫ -এর ব্যর্থ অভ্যুত্থান থেকে ১৯১৭ -এর সফল বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে আইজেনস্টাইনের ট্রিলজি স্ট্রাইক, ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন এবং অক্টোবর সারা বিশ্বেই আলোড়ন তৈরি করেছিল। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেই প্রথম কারখানার মজদুর, জাহাজের খালাসি, বলশেভিক বিপ্লবীরা নায়কের আসনে। তাঁদের সাজসজ্জায় রং-চঙ্গের কোনো আতিশয্য নেই, ধুসরিত ভঙ্গুর চেহারা, একেবারে বাস্তবোচিত। সোভিয়েত রাশিয়াসহ দুনিয়ার মেহনতি মানুষ নিজেদের খুঁজে পেলেন সিনেমার পর্দায়। পরাজয়ের গ্লানিতে নয়, বিজয়ের সরনিতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এই ছবিগুলিকে। চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলীতেও নতুনত্বের জনক ছিলেন আইজেনস্টাইন। ভিন্ন মুহুর্তের অনেক ছোটো দৃশ্যকে কেটে জুড়ে রূপক-দৃশ্যের সম্পাদনায় আরেকটি মুহুর্ত সৃষ্টি, চলচ্চিত্রের পরিভাষায় মন্তাজ তাঁরই অবদান। আলো আঁধারির বিপরীতধর্মী দৃশ্যের বিন্যাসে যুক্তির বৈপরিত্য তুলে ধরা এবং সমাধান খুঁজে বের করার তাত্ত্বিক কৌশলও তাঁর মৌলিক সৃষ্টি। এ যেন কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতিফলন, যুক্তি পালটা-যুক্তি থেকে সংশ্লেষে উত্তরন। তাঁর লেখা দ্য ফোর্থ ডায়মেনশন অফ সিনেমা গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাছেই বিশেষ ভাবে সমাদৃত। পরবর্তী যুগে বিলি ওয়াইল্ডার, চার্লি চ্যাপলিন, অ্যালফ্রেড হিচকক, দ্য সিকা, রোজেলিনি, ভিসকন্তি, ফেদরিকো ফেলিনি প্রমুখ অসংখ্য চিত্র পরিচালকদের ছবিতে আইজেনস্টাইনের নির্মাণশৈলীর ছাপ পড়েছে। ভারতের ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিত রায়, মৃনাল সেন’রাও সেই প্রভাবে আলোকিত হয়েছিলেন।


১৯০৫ -এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ম্যাক্সিম গোর্কি’র বিখ্যাত উপন্যাস মাদার -কে চলচ্চিত্রের রূপ দিয়েছিলেন পুদোভকিন। তাঁর আরেকটি অবিস্মরণীয় ছবি দ্য এন্ড অফ সেন্ট পিটাসবার্গ মুক্তি পেয়েছিল ১৯২৮ -এ। কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসা এক কৃষক পরিবারের সন্তানের বিপ্লবী হয়ে ওঠার চিত্র। এই ছবিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্রের পাশাপাশি বলশেভিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং তার পরবর্তী গৃহযুদ্ধে বিপ্লবকে রক্ষা করার সংগ্রাম তিনি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর বাকি ছবিগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ভিক্টরি (১৯৩৮), মিনিন অ্যান্ড পোজারস্কি (১৯৩৯) এবং সুভরভ (১৯৪১)।

সোভিয়েত ইউনিয়নে রবীন্দ্রনাথ

কোনো সন্দেহ নেই সংস্কৃতি জগতে এই জাগরণের কেন্দ্রে ছিল নভেম্বর বিপ্লব। শ্রেণী বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার দীর্ঘায়ত সংগ্রাম। ১৯৩০ -এ রাশিয়া ভ্রমণে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেখানে পৌঁছে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কবি লিখলেন, “প্রত্যেক সমাজের নিজের ভিতরেও এই একই কথা। যে মানুষকে মানুষ সম্মান করতে পারে না সে মানুষকে মানুষ উপকার করতে অক্ষম। অন্তত যখনই নিজের স্বার্থে এসে ঠেকে তখনই মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়। রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা চলছে। তার শেষ ফলের কথা এখনো বিচার করবার সময় হয়নি, কিন্তু আপাতত যা চোখে পড়ছে তা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত – ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে সেই শিক্ষা কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়।” ঐ চিঠিতেই তিনি লিখছেন, “এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই–একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ।” দ্বিতীয় চিঠিতে কবির উপলব্ধি আরও স্পষ্ট। তিনি লিখছেন, “এখানে এসে যেটা সবচেয়ে আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে এই ধনগরিমার ইতরতার সম্পুর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহুর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভুষো সকলেই আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। এইটে দেখে আমি যেমন বিস্মিত তেমনই আনন্দিত হয়েছি। মানুষে মানুষে ব্যবহার কী আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে।”


নভেম্বর বিপ্লবের একশত চার বছর অতিক্রান্ত। সোভিয়েত সাবেক হয়ে গিয়েছে তাও তিন দশক পেরিয়ে। বিপ্লব রক্ষার সংগ্রাম কালের বিচারে সাময়িক হলেও হোঁচটগ্রস্ত। ১৯৩০ -এ রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা ছিল, “এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই, তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্য একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে-কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনও টেঁকে না-সজীব মনের তত্ত্বর সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে”। প্রয়োগ কৌশলের ত্রুটি ও মতাদর্শগত বিচ্যুতির পাশাপাশি, সমাজতন্ত্রকে বিনাশের আভ্যন্তরীন এবং বহির্দেশীয় বৃহৎ ধনতান্ত্রিক শিবিরের যুগপৎ ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা না করতে পারাও এর অন্যতম কারন। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির তৎপরতা, নয়া উদারনীতির ফলে ভোগবাদের বিস্তার, সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন, বিশ্বজুড়ে অতি দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারি শক্তির উত্থান ইত্যাদি মূল্যয়নে অসম্পূর্ণতা থেকে যাওয়ার মতো বহুবিধ কারনও ইতোমধ্যেই চিহ্নিত। তবু মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে বৃহত্তর অংশ বরাবর অখ্যাতর ভিড়ে মিশে থাকে, উচ্চবর্গের লাথি-ঝাঁটা অসম্মানের বোঝা বয়েও মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে-উপরতলার সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে, সেইসমস্ত মেহনতি মানুষের আশা-আকাঙ্খা, অধিকারবোধ, মুক্তির আশ্বাস বরাবরের জন্য প্রজ্জ্বলিত করেছে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধিকে পূর্ণ সম্মান জানিয়েই বলা যায়, ধনগরিমার ইতরতা অবসানে দীর্ঘ সংগ্রামের প্রথম আলো নভেম্বর বিপ্লব’ই।

Spread the word

Leave a Reply