November and Rabindranath’s Pilgrimage -Subhoprasad Nandi Majumdar

৮ নভেম্বর ২০২৩ ,বুধবার

সমাজ বদল হয়েছে আগেও, যুগে যুগেই। এক ধরনের সমাজ এসে আরেক ধরনের সমাজকে উৎখাত করেছে। প্রকৃতির বুকে মুক্ত স্বাধীন মানুষ একদিন সমাজবদ্ধ হয়েছিল শোষণভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার পত্তনের মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে যতবার সমাজ বদলে সমাজ এগিয়েছে ঠিকই, শুধু শোষকেরই বদল হয়েছে। শোষণের ধরনের বদল হয়েছে। শোষণের অবসান হয় নি। পৃথিবীর বুকে নভেম্বরই নিয়ে আসে সেই সমাজ পরিবর্তন যার মধ্য দিয়ে শাসনভার আসে যুগ যুগ ধরে শোষিত লাঞ্ছিত শ্রমজীবী মানুষের হাতে। এর আগে প্যারিসে শ্রমিকরা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু সেটা ছিল ক্ষণস্থায়ী। সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরোনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর, নতুন ক্যালেন্ডোরের ৭ নভেম্বর রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে। এই নতুন শিশুকেও টুঁটি টিপে হত্যা করতে দেশ বিদেশের শোষক শ্রেণি জোট বেঁধে আক্রমণ হেনেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বুকে। এই টালমাটাল সময় পেরিয়ে জাতিসমূহের স্বেচ্ছামূলক ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন নিজেকে থিতু করছে, ওই সময়ে নভেম্বর বিপ্লবের ১৩ বছর পর ১৫ দিনের সফরে সোভিয়েত দেশে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন পশ্চিমের দেশগুলি জুড়ে শাসকশ্রেণি নিরন্তর অপপ্রচার চালাচ্ছে বিপ্লবোত্তর রাশিয়া সম্পর্কে। সর্বনাশের নাকি শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে রাশিয়া। রক্তের বন্যায় নাকি সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সভ্যতা বিরোধী এক দানবতন্ত্র।

পৃথিবীময় এই অপপ্রচারের মধ্যেও নভেম্বর বিপ্লব কৌতুহলী করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তিনি নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলেন রাশিয়ার বুকে ঘটে চলা ঐতিহাসিক রূপান্তরকে। নবগঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তাঁকে বারবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সোভিয়েত ভূমি ভ্রমণের। তাঁর আগ্রহের পাশাপাশি তিনি যাতে কিছুতেই সোভিয়েত রাশিয়ায় না যান তার জন্যে পশ্চিমী দুনিয়া থেকে নানা অজুহাতে বাদ সাধা হয়েছে তাঁর ‘শুভানুধ্যায়ীরা’। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন, “আবার অনেকে আমাকে ভয় দেখিয়েছে- কিন্তু প্রধান ভয়ের বিষয় আরামের অভাব, বলেছে আহারাদি সমস্ত কিছুই এমন মোটারকম যে আমি তা সহ্য করতে পারব না। তাছাড়া এমন কথাও অনেকে বলেছে, আমাকে যা দেখাবে তার অধিকাংশই বানানো”। যে সময়গুলিতে বারবার তাঁর কাছে আমন্ত্রণ আসছিল, তখন বাস্তবিকই রবীন্দ্রনাথের শরীর ও স্বাস্থ্য অনুকূল ছিল না। শারীরিক অসুস্থতাই তাঁর যাওয়ার পথ মূলত আটকেছিল। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন প্রথমে জেনেভা থাকাকালীন ও পরে জাপানে থাকাকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া সম্পর্কে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ডাক্তারদের আপত্তি জানানোর মধ্যে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত কারণটিই একমাত্র ছিল না। যেন এক ধরনের বাড়তি উৎসাহ ছিল ডাক্তারদের কবিকে নিরুৎসাহিত করার। রবীন্দ্রনাথকে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা যতই হোক না কেন, বিপ্লবোত্তর রাশিয়া নিজের চোখে দেখার আগ্রহ রবীন্দ্রনাথের ছিল অনেক বেশি। ১৯২৫ সালে স্টকহোমে থাকাকালীন সুইডেনে সোভিয়েত সরকারের দূত প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কবিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের আমন্ত্রণ জানাতে এলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আপনাদের দেশ তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, তুর্গেনেভ, চেখব ও গোর্কির মাধ্যমে যা জেনেছিলাম, তা আর নেই। আপনাদের নতুন জীবনের নতুন সাহিত্য কবে আমাদের দরজায় উপস্থিত হবে তাও জানা নেই।’ ১৯২৬ সালে বার্লিনে থাকাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আবার তারবার্তা আসে। রবীন্দ্রনাথ সেটার উত্তরও পাঠিয়েছিলেন। পরে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “এই যাত্রায় খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়া যাব, দেখতে চাই তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, সলোভিয়েভের দেশ। তারপর মরলে আফশোষ নেই। খুবই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি। আর আমার বেশি দিন নেই।….তাড়াতাড়ি রাশিয়া দেখে নিতে হবে।…মহান রুশ জাতি অন্তরের যে সম্পদ গড়ে তুলেছে তা বিশ্বসভ্যতার রত্নভাণ্ডারকে সমৃদ্ধতর করেছে।

গত কয়েক বছরের রক্তাপ্লুত ঘটনা সত্ত্বেও এখন তারা মহা ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়েছে।” নভেম্বর বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে কোন নতুন যুগের সূচণা করেছিল, তাও সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সারা জীবন ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রাচ্যের সমাজকে দেখেছেন, দেখেছেন পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। নিঃসম্পর্কের দূরত্ব থেকে শুধুমাত্র পর্যটকের  দৃষ্টিতে দেখেন নি কোনো দেশকেই। ধনতান্ত্রিক পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা তাঁর হাত দিয়ে ‘রক্তকরবী’, ‘অচলায়তন’-এর মত নাটকের জন্ম দিয়েছে যেখানে হৃদয়হীন যন্ত্রসভ্যতার সীমাহীন লোভের আবর্তে মানুষের সহজাত প্রাকৃতিক সত্তার শ্বাসরোধকারী অভিজ্ঞতার কথা, পাষাণপ্রতিম ব্যবহার হাতে মুক্ত মানুষের বন্দীত্বের কথা বলঅ হয়েছে। ১৫ দিনের সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ ছিল তাঁর কাছে এনেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। সভ্যতার এক নতুন অভিজ্ঞান রচিত হয়েছে তাঁর জীবনে ১৫ দিনের সংক্ষিপ্ত সফরের পর। তাঁর অভিজ্ঞতা তিনি ধারাবাহিকভাবে চিঠিপত্রের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকাকালীন পর্বেই লিখে গেছেন। ফিরে এসেও নানা জনকে লেখা চিঠিপত্রে, বক্তৃতায় বারবার উল্লেখ করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা। প্রথম চিঠি শুরুই হচ্ছে এই পংক্তিগুলি দিয়ে, “রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।

চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদের সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব চেয়ে কম খেয়ে, কম প’রে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালার লাথিঝাঁটা খেয়ে মরে- জীবনযাত্রার জন্য যত-কিছু সুযোগ সুবিধে সব-কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে- উপরের সবাই অঅলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।” শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণিগত শোষণবঞ্চনার ইতিহাসের এমন নিখুঁত চিত্রায়ন এবং নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যদিয়ে ঘটা শ্রেণিগত শোষণের ব্যবস্থার আমূল উৎপাটনের এমন সঠিক মূ্ল্যায়ন, রবীন্দ্রনাথের সমসময়ে দুর্লভ। এই ভ্রমণের গভীর পরিতৃপ্তির কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,“কিন্তু পৃথিবীতে যেখানে সবচেয়ে বড়ো ঐতিহাসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান সেখানে নিমন্ত্রণ পেয়েও না আসা আমার জন্যে অমার্জনীয় হত।” রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া যাত্রায় বাদ সাধতে যেমন তৎপরতা ছিল, ঠিক তেমনি সক্রিয়তা দেখা গেছে রাশিয়া থেকে ফেরার পর। রাশিয়া থেকে ফেরার পর কবির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করার কথা ছিল, কিন্তু তাঁর অসুস্থতা নিয়ে এমনমাত্রায় প্রচার তোলা হয় যে বক্তৃতা বাতিল হয়ে যায়। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “..আমাদের মতে কবি যাহাতে বক্তৃতাদি না করিতে পারেন সেইরূপ চাতুর্যপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হইল।…আমেরিকানদের ভয় রবীন্দ্রনাথ পাছে গান্ধীবাদ সমর্থন করেন।…রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রবাদের যে পরীক্ষা শুরু হইয়াছে তাহা তো আমেরিকান ধনতন্ত্র ধুরন্ধরদের স্বর্থের চরম পরিপন্থী আন্দোলন-রবীন্দ্রনাথ সদ্য সফর করিয়া ফিরিয়াছেন-যদি তিনি প্রশংসামান কথা বলেন”।

রবীন্দ্রনাথ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে যান তখন তাঁর স্বদেশ ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনের এক নতুন পর্বে প্রবেশ করছে। কংগ্রেস সর্বপ্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাবকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে। এর আগের দশকের শেষ পর্বে সাইমন কমিশন ভারতে এসেছে। কুড়ির দশক নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা আন্দোলনে জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাত্রা ব্যাপকতা পেয়েছে। অন্যদিকে খিলাফৎ আন্দোলনের পরের পর্বে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তুলছে। আবার জনগনও বেশি বেশি করে সংগ্রামমুখী হচ্ছে। স্বদেশের এমন একটি পরিস্থিতি থেকে সোভিয়েত রাশিয়ায় পৌঁছে বারবারই রবীন্দ্রনাথের মনে পড়েছে ঔপনিবেশিক শাসনে দুর্দশাগ্রস্ত ভারতের কথা। তিনি লিখেছেন,“রাশিয়ার সমস্ত দেশ-প্রদেশকে জাতি-উপজাাতিকে সক্ষম ও শিক্ষিত করে তোলবার জন্য এত বড়ো সর্বব্যাপী অসামান্য অক্লান্ত উদ্যোগ আমাদের মতো ব্রিটিশ সাবজেক্টের সুদূর কল্পনার অতীত।

..চোখে দেখলুম-এও দেখতে পেলুম এদের রাষ্ট্রে জাতিবর্ণবিচার একটুও নেই। সোভিয়েট শাসনের অন্তর্গত বর্বরপ্রায় প্রজার মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্যে এরা যে প্রকৃষ্ট প্রণালীর ব্যবস্থা করেছে ভারতবর্ষের জনসাধারণের পক্ষে তা দুর্লভ। অথচ এই অশিক্ষার অনিবার্য ফলে আমাদের বুদ্ধিতে চরিত্রে যে দুর্বলতা, ব্যবহারে যে মূঢ়তা, দেশবিদেশের কাছে তার রটনা চলছে।”

রাশিয়া থেকে ফিরে আমেরিকার যাওয়ার পথে যখন তিনি গোটা সফরের স্মৃতিচারণ করে চিঠি লেখেন প্রিয়জনদের সেখানে সোভিয়েত ব্যবস্থার আরো গভীর ও বিস্তৃত মূল্যায়ন উঠে আসে। সেখানে তিনি বারবারই তুলনা করেছেন পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক দেশগুলির ব্যবস্থার সাথে। কখনো তুলনা করেছেন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা স্বদেশের সাথে। আমেরিকা যাওয়ার পথে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আট বছরের মধ্যে শিক্ষার জোরে সমস্ত দেশের লোকের মনের চেহারা বদলে দিয়েছে। যারা মূক ছিল তারা ভাষা পেয়েছে, যারা মূঢ় ছিল তাদের চিত্তের আবরণ উদ্ঘাটিত, …..আজ তারা সমাজের অন্ধকুটুরী থেকে বেরিয়ে এসে সবার সঙ্গে সমান আসন পাবার অধিকারী। এত প্রভূত লোকের যে এত দ্রুত এমন ভাবান্তর ঘটতে পারে তা কল্পনা করা কঠিন। …. এরা তিনটে জিনিস নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত আছে। শিক্ষা, কৃষি এবং যন্ত্র। এই তিন পথ দিয়ে এরা সমস্ত জাতি মিলে চিত্ত, অন্ন এবং কর্মশক্তিকে সম্পূর্ণতা দেবার সাধনা করছে।

১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে এখানে যে বিপ্লব হয়ে গেল তার আগে এ-দেশে শতকরা নিরানব্বই জন চাষী আধুনিক হলযন্ত্র চক্ষেও দেখে নি। তারা সেদিন আমাদেরই চাষীদের মতো সম্পূর্ণ দুর্বলরাম ছিল, নিরন্ন নিঃসহায় নির্বাক। আজ দেখতে দেখতে এদের খেতে হাজার হাজার হলযন্ত্র নেমেছে।..কিন্তু শুধু যন্ত্রে কোনো কাজ হয় না যন্ত্রী যদি মানুষ না হয়ে ওঠে। এদের খেতের কৃষি মনের কৃষির সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে।”

Historic November Revolution: Legacy and Contemporary Relevance

নভেম্বর বিপ্লব শুধু শিক্ষা স্বাস্থ্য কৃষি ও জাতিগত মুক্তিই নিয়ে আসে নি, তার অপরিহার্য সঙ্গী হিসেবে শিল্পকলা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এনেছিল যুগান্তর। রাশিয়ার নাট্যশালা, চিত্রবীথি, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত সমস্ত স্তরেই এসেছিল নতুন ভাষা নতুন আবেগ নতুন সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে এসেছিল সেই যুগান্তর। বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় সংস্কৃতির এই পরিসরগুলি ছিল রাজতন্ত্র লালিত অভিজাতবর্গের একচেটিয়া বিচরণস্থল, সেখানে মজুর শ্রেণির লোকের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। রাশিয়ার শ্রমিক কৃষক যখন রুটি ও শান্তির দাবিতে বিপ্লবের দিকে এগাচ্ছে তখন রাশিয়ার নাট্যশালা জুড়ে চলছিল ধনীদের বিনোদনের অঢেল আয়োজন। বিপ্লবোত্তর রাশিয়া দরিদ্র শ্রমিক কৃষক খেপেখাওয়া মানুষের জন্যে অর্গলমুক্ত করেছিল ওই সংস্কৃতির বিস্তৃত অঙ্গনকে।  রবীন্দ্রনাথ সে সম্পর্কেও বলেছেন সবিস্তারে। “হঠাৎ মনে হতে পারে, এরা বুঝি কেবলই কাজের দিকে ঝোঁক দিয়েছে গোঁয়ারের মতো ললিতকলাকে অবজ্ঞা ক’রে। একেবারেই তা নয়। সম্রাটের আমলের তৈরি বড়ো বড়ো রঙ্গশালায় উচ্চ অঙ্গের নাটক ও অপেরার অভিনয়ে বিলম্বে টিকিট পাওয়াই শক্ত হয়। নাট্যাভিনয়কলায় এদের মতো ওস্তাদ জগতে অল্পই আছে, পূর্বতন কালে আমীর-ওমরাওরাই সে-সমস্ত ভোগ করে এসেছেন- তখনকার দিনে যাদের পায়ে ছিল না জুতো, গায়ে ছিল ময়লা ছেঁড়া কাপড়, আহার ছিল আধ-পেটা, দেবতা মানুষ সবাইকেই অহোরাত্র ভয় করে করে বেড়িয়েছে, পরিত্রাণের জন্যে পুরুত-পাণ্ডাকে দিয়েছে ঘুষ, আর মনিবের কাছে ধুলোয় মাথা লুটিয়ে আত্মাবমাননা করেছে, তাদেরই ভিড়ে থিয়েটারে জায়গা পাওয়া যায় না। আমি যেদিন অভিনয় দেখতে গিয়েছিলুম সেদিন হচ্ছিল টলস্টয়ের ‘রিসারেকশন’। জিনিসটা জনসাধারণের পক্ষে সহজে উপভোগ্য বলে মনে করা যায় না। কিন্তু শ্রোতারা গভীর মনোযোগের সঙ্গে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে শুনছিল।”

বিপ্লব চিত্রকলার জগতকেও অর্গলমুক্ত করে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল সমাজের মজুর কৃষক শ্রেণিকে। এ কথাও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে। যুগ যুগ ধরে উচ্চস্তরের ললিতকলার পৃথিবীতে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত প্রান্তিকজনকে কীভাবে সেই জগতের রসের শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়াস হয়েছিল তাও লক্ষ্য করেছেন কবি। তিনি লিখেছেন,“১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে সোভিয়েট-শাসন প্রবর্তিত হবার পূর্বে যে-সব দর্শক এই রকম গ্যালারীতে আসত তারা ধনী মানী জ্ঞানী দলের লোক এবং তারা, যাদের এরা বলে bourgeoisie অর্থাৎ পরশ্রমজীবী। এখন আসে স্বশ্রমজীবীর দল, যথা রাজমিস্ত্রি, লোহার, মুদি, দরজি ইত্যাদি। আর আসে সোভিয়েত সৈনিক, সেনানায়ক, ছাত্র এবং চাষী সম্প্রদায়।

আর্টের বোধ ক্রমে ক্রমে এদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। এদের মতো আনাড়িদের পক্ষে চিত্রকলার রহস্য প্রথম দৃষ্টিতে ঠিকমতো বোঝা অসাধ্য। দেয়ালে দেয়ালে ছবি দেখে দেখে এরা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, বুদ্ধি যায় পথ হারিয়ে। এই কারণে প্রায় সব ম্যুজিয়মেই উপযুক্ত পরিচায়ক রেখে দেওয়া হয়েছে।….যারা দেখতে আসে তাদের সঙ্গে এদের দেনাপাওনার কোনো কারবার থাকে না। ছবিতে যে-বিষয়টা প্রকাশ করছে সেইটে দেখলেই যে ছবি দেখা হয়, দর্শকেরা যাতে সেই ভুল না করে পরিদর্শয়িতার সেটা জানা চাই।”

শিল্পকলার যে ক্ষেত্রটিতে সর্ব অর্থেই বিপ্লব এনেছিল নভেম্বর ১৯১৭-এর পটপরিবর্তন সেটা হল চলচ্চিত্র। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন দেশের অভ্যন্তরে চলছে গৃহযুদ্ধ ও অর্থকষ্ট তখন সম্পূর্ণ এক চিত্রভাষার জন্ম দেয় বিপ্লবোত্তর সোভিয়েতের চলচ্চিত্র। সেই ভাষার নাম মন্তাজ। মূলত অর্থনৈতিক সংকটের চাপে যখন ফিল্মের রাশ কেনা সুকঠিন হয়ে পড়ছিল তখন সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন পরস্পর আপাতসম্পর্কহীন দৃশ্যের চলচ্ছবি জুড়ে দিয়ে মন্তাজ নামের নতুন ভাষার জন্ম দেন চলচ্চিত্রকার ও গবেষক লেভ কুলেশভ। বিশ্ব চলচ্চিত্রের যুগান্তরের পুরোহিত, বিশিষ্ট সোভিয়েত চলচ্চিত্রকার আইজেনস্টাইনের সমকালীন অন্য বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার  পুডোভকিন ছিলেন কুলেশভের ছাত্র। কুলেশভের আগে চলচ্চিত্র সম্পাদনা ছিল একরৈখিক। মন্তাজের আবিষ্কার একে বহুমাত্রিকতা প্রদান করে। মন্তাজের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার হয় আইজেনস্টাইনের যুগান্তকারী ফিল্ম ব্যাটলশিপ পটেমকিন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করে ব্যাটলশিপ পটেমকিন দেখতে গিয়েছিলেন। আইজেনস্টাইন তখন দেশের বাইরে থাকায় রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা হয় নি। তবে তাঁর স্ত্রী উপস্থিত থেকে দোভাষীর কাজ করেছিলেন। শোনা যায় ছবিটি দেখতে দেখতে কবি মাঝেমাঝেই অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। নাবিকদের বিদ্রোহের দৃশ্য দেখতে দেখতে বারবার তিনি মুঠো বন্ধ করছিলেন ও খুলছিলেন।

Rabindranath Tagore in Moscow

বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “…আপাতত রাশিয়ায় এসেছি- না এলে এজন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।”

তাঁর মুগ্ধতার কথা পুত্র রথীন্দ্রনাথকে বলতে গিয়ে লিখেছেন,“তোরা রাশিয়ায় যদি আসতিস তবে বুঝতে পারতিস কাজ করবার ঢের আছে। টাকা কম হলেও চলে যদি বুদ্ধি থাকে ও উদ্যম থাকে, যদি নিজের উপরে ভরসা থাকে।”

পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এই ক’টি বাক্যতে বোঝা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লবী সরকারে প্রধান জোরে জায়গাটি রবীন্দ্রনাথ সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। অর্থাভাব ও বহির্শত্রুর ও দেশীয় পরাজিত শক্তির চক্রব্যূহকে ভেদ করে স্বল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা স্বাস্থ্য শিল্প ও জাতিসমূহের সুষম বিকাশের যে অত্যাশ্চর্য অগ্রগতি ঘটেছিল এবং যে অগ্রগতিকে ভিত্তি করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েও একার শক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কীভাবে বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিল্প ও সামরিক শক্তিতে বিশ্বের মহাশক্তিতে পরিণত হয় তার মূল উৎস রথীন্দ্রনাথকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে ইঙ্গিত রয়েছে।

একটি দেশে রাত এলে যেমন যেমন সূর্যের আলো নিভে যাওয়া বোঝায় না, তেমনি নয়ের দশকের বিপর্যয় নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে নিষ্প্রভ করতে পারে নি।

Spread the word

Leave a Reply