ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
তারিখঃ ১২ জুলাই, ২০২০ – রবিবার
ভারতে লকডাউন ঘোষণা করা হয় মার্চ মাসের ২৪ তারিখে। তারপর থেকেই মোদী সরকার সংসদে কোনোরকম আলোচনা না করেই একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কখনো অর্ডিন্যান্স জারী, কখনো একতরফা ঘোষণা করে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম এবং ছবি ব্যাবহার করে গঠন করা হয়েছে PM Cares Fund – ঘোষণা করা হয়েছে সারা দেশে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় এই তহবিল একটি সুরক্ষা কবচের মতো কাজ করবে। এই তহবিলে অনুদানের জন্য সরকারি কর্মচারীদের মাসিক বেতনের একটি অংশকে বাধ্যতামূলক হিসাবে কেটে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশি, বিদেশি কর্পোরেট সংস্থারা এই তহবিলে অনুদান দিয়েছে। ভারতের বহু স্বনামধন্য ব্যাক্তিত্ব এই তহবিলে নিজেদের অনুদান দিয়েছেন। এইসব কিছুই সম্ভব হয়েছে কারণ ভারত সরকারের জাতীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের ব্যাবহার করে পিএম কেয়ার্স তহবিলের চেয়ারপার্সন হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীকেই, অছি হিসাবে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রয়েছেন।
অথচ পিএম কেয়ার্স ‘র আয়-ব্যায় সংক্রান্ত হিসাবের প্রসঙ্গ এলে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে যে কোন সরকারি নিরীক্ষক সংস্থাই এই তহবিলের নিরীক্ষণ (Audit) করতে পারবে না কারণ এই তহবিল কোন সরকারি তহবিল নয়, নিছকই ব্যাক্তিগত! এমন অদ্ভুত যুক্তি সম্ভবত স্বাধীন ভারতে সরকারি অজুহাত হিসাবে একটিই! যে তহবিলের চেয়ারপার্সন দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে, যে তহবিলের প্রচারে দেশের জাতীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের ব্যাবহার করা হয় সেই তহবিল নাকি ব্যাক্তিগত ফান্ড। স্বাভাবিকভাবেই সব দিক থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই তহবিল ব্যাবহার করে যেভাবে ভেন্টিলেটর কেনার বরাত ঘোষণা করা হয়েছে তাতে সম্ভাব্য দুর্নীতির ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে।
এই তহবিলের নিরীক্ষণ সংক্রান্ত আর টি আই’র জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিল CAG ( The Comptroller and Auditor General of India ) কিংবা অন্যান্য সরকারি নিরীক্ষণ সংস্থা পিএম কেয়ার্স ‘র হিসাব পরীক্ষা করতে পারবে না, প্রয়োজনে তহবিল সংক্রান্ত বিষয়ে গঠিত ট্রাস্ট দ্বারা নির্বাচিত কোন বেসরকারি নিরীক্ষণ সংস্থা সেই কাজ করবে।
সম্প্রতি সংসদীয় কমিটিগুলীর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ PAC (Public Accounts Committee)’র সভা হয়েছে। PAC (Public Accounts Committee) হল সেই সংস্থা যারা অতীতে 2G Spectrum বণ্টন সংক্রান্ত আর্থিক তছরুপের ক্ষেত্রে CAG’র রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে স্ক্র্যুটিনির দায়িত্ব পালন করেছিল। এই সভায় পিএম কেয়ার্স ‘র হিসাব পরীক্ষা করার প্রসঙ্গ উঠলে বিজেপি’র পক্ষ থেকে কমিটি সদস্যরা বাধা দেন, তাদের বক্তব্য ঐ তহবিলের স্ক্র্যুটিনি করতে পারবেনা PAC (Public Accounts Committee)। PAC’র চেয়রাম্যান কংগ্রেস দলের সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী কমিটি সদস্যদের বলেন দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এই তহবিলের প্রসঙ্গে সবারই উচিত নিজেদের বিবেকের দ্বারা চালিত হয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে নিরীক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু সরকারী দলের প্রতিনিধিরা নিজেদের বক্তব্যে অনড় থাকেন, তারা এই তহবিলের হিসাবনিকাশ কোন সংসদীয় কমিটির সামনে প্রকাশ করতে রাজি নন। সভায় উপস্থিত বিজু জনতা দলের প্রতিনিধি ভারতুয়ারি মাথানি বিজেপি’র দাবিকে সমর্থন করেন। PAC দ্বারা পিএম কেয়ার্স ‘র হিসাব পরীক্ষা করার প্রসঙ্গে সমর্থন জানান ডিএমকে দলের প্রতিনিধি টি আর বালু।
এমনিতে বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাগুলিতে সরকারী প্রতিনিধি কিংবা সদস্যেরা সেভাবে উপস্থিত থাকেন না, কিন্তু এই সভায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিজেপি’র সকল সদস্যেরাই উপস্থিত ছিলেন। এতে বোঝাই যায় বিজেপি পিএম কেয়ার্স ‘র হিসাব পরীক্ষা করার প্রসঙ্গে বাধা দিতে বদ্ধপরিকর।
এই সভায় তহবিলের হিসাব নিরীক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় নি, অর্থাৎ PAC পিএম কেয়ার্স ‘র হিসাব পরীক্ষা কিংবা স্ক্র্যুটিনি করতে পারবে না। এমনটা হল একটাই কারনে, বিজেপি সাংসদেরা চান না সংসদীয় কমিটি নিজের কাজ করুক। যদিও ঐ সভা থেকেই পূর্ব লাদাখ সিমান্তে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া চীন-ভারত সংঘর্ষের পরে যে সড়ক বানানোর কাজ শুরু হয়েছে সেই বিষয়ে নিরীক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পিএম কেয়ার্স তহবিল সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের তরফে এই অদ্ভুত একগুঁয়ে মনোভাবই এই তহবিলের প্রসঙ্গে আরও বেশি সন্দেহ উদ্রেক করছে। একদিকে সরকার ঘোষণা করছে যে এই তহবিল দেশের সুরক্ষা কবচ অথচ তারাই এই তহবিলের হিসেব-নিকেশ নিয়ে কোন তথ্য দিতে রাজি নয়! এমন মনোভাব নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
PAC’র সভা প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন “প্রথমে CAG’কে হিসাব নিরীক্ষণ করতে দেওয়া হল না, তারপরে এই তহবিল সংক্রান্ত আর টি আই’কে নাকচ করা হল এখন বিজেপি সাংসদেরা সংসদীয় কমিটিকে কাজ করতে বাধা দিচ্ছেন। ভারতের জনগন জানতে চান কিভাবে, কোথায় দেশের টাকা খরচ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের সরকার এভাবে কি লুকোতে চাইছেন?”
পিএম কেয়ার্স নিয়ে দেশের সরকার যত বেশি লুকোছাপা করবেন এই তহবিল নিয়ে সবার সন্দেহ আরও বাড়বে। জাতীয় প্রতীক, দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম এবং ছবি ব্যাবহার করে তহবিল সংগ্রহ করার পরে যদি কেউ যুক্তি হাজির করে এই তহবিল আসলে ব্যাক্তিগত তবে লু স্যুন’র সেই বিখাত কথাটিই আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে – “সমস্ত প্রানীদের মধ্যে আমি মশাকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি কারণ সে রক্ত চুষে খাওয়ার পক্ষে যুক্তি হাজির করে”!