24 April 2020
পৃথিবীর পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। যে ভাইরাস এখনো পর্যন্ত ১.৮৫ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছে, তা নিরাময়ের ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনও নেই। হয়ত অচিরেই প্রকাশিত হবে।
যা বোঝা গেছে ভাইরাল সংক্রমণ ঠেকানোর চিরাচরিত সাধারণ পদ্ধতিই আপাতত কার্যকর – অর্থাৎ সংক্রমণ যেহেতু মানুষ থেকে মানুষের শরীরে যাচ্ছে, তাই নিজেদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার এবং একে আটকে রাখার কোনও বিকল্প আপাতত নেই।
শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা মানে কি, সেটা এতদিনে আমরা সবাই হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি। ভীড়, জমায়েত, একে অন্যের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা বিপজ্জনক। বাজার-হাট, যানবাহন বন্ধ। এমনকি মন্দির মসজিদ সহ সব ধর্মস্থানও বন্ধ।
অনেকে বুঝছেন, আবার অনেকে বুঝছেন না। কিন্তু এই শারীরিক দূরত্ব বজায় তো রাখতেই হবে। তাহলে এটা কার্যকর ও বাধ্যতামূলক করার উপায় কি?
আইন করতে হবে অথবা যে আইন যে দেশে আছে তার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া ১৩৩ কোটিকে বাগ মানানো যাবে কি ভাবে!
আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমলে একটা আইন তৈরী হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। সেই সময়ে বোম্বে তথা অধুনা মুম্বাইয়ে সাংঘাতিক প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল এবং এটা আমাদের সবারই জানা এই রোগ সাংঘাতিক ছোঁয়াচে। এই রোগের মোকাবিলা করার জন্যই নাকি এই আইন প্রণয়ন করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।
১২৩ বছর আগের এই আইনকে হাতিয়ার করেই আপাতত কোভিড ১৯ মোকাবিলা করার চেষ্টা চলছে।
সাধারণ স্বাভাবিক অবস্থায় রাষ্ট্র কারুর যাতায়াত এর জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহনের চলাচল, মেলামেশা, বাজার হাট-দোকান পাট খোলা সহ অন্যান্য নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু এই আইন বলবৎ করে রাষ্ট্র এইরকম অনেকগুলো ব্যক্তি স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতার পরিসরে ঢুকে পড়তে পারে।
এই আইন কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলোর হাতে অতিরিক্ত বেশকিছু ক্ষমতা প্রদান করে, যার মাধ্যমে অনেকগুলো বিধিনিষেধ জারি করতে পারে এই দুই সরকারই।
রাজ্য সরকারগুলো যদি মনে করে অন্যান্য সাধারণ আইন দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাচ্ছে না, তাহলে এই আইন ব্যবহার করতে পারে। এই আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালে তৈরী হওয়া ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৮ নং ধারা অনুযায়ী ২০০ টাকা জরিমানা অথবা ১ মাসের জেল অথবা দুটো শাস্তিই প্রযোজ্য হতে পারে। এবার যদি সরকার বাহাদুর মনে করে কারোর আচরণ খুবই বিপজ্জনক সংক্রমণ ছাড়ানোর ক্ষেত্রে অথবা সংক্রমণের চরিত্র খুব খারাপ, তাহলে এই জেল/জরিমানা অথবা দুটোই ৬ মাস এবং ১০০০টাকা হতে পারে। কোভিট ১৯ এর সংক্রমণের চরিত্র অনুযায়ী দ্বিতীয় শাস্তিই প্রযোজ্য, যেহেতু এই সংক্রমণের চরিত্র খুবই ক্ষতিকর।
তবে অনেক আইন বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু সাধারণ FIR করলেই হবে না, CrPC ১৯৫ নং ধারা অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের না করলে এই অভিযোগ আদালতে প্রামাণ্যতা নাও পেতে পারে।
আমি আইনজ্ঞ নই, এবং আইন সম্পর্কে ধ্যান ধারণাও খুবই দুর্বল। তবে যেটুকু দেখছি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৮ ছাড়াও ২৬৯/২৭০/২৭১ ধারাতেও মামলা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি(২৭০)ধারায় দোষী প্রমাণিত হলে ২ বছর সাজা ও জরিমানা হতে পারে। অর্থাৎ সরকারের হাতে ১২৩ বছর আগে তৈরী আইন প্রভূত ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য।
বিনা কাজে অনেকে বেরোচ্ছেন। মজা দেখা, তাস খেলা, পার্কে-রাস্তায় হাওয়া খাওয়া, পাড়ার মাচায় আড্ডা দেওয়ার সময় এটা নয়। সামনের লোকের ঘাড়ের উপর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে মাছের কানকো উল্টে দরদাম করা লোকদের বিরুদ্ধে অনুরোধে -উপরোধে কাজ না হলে, আইন প্রয়োগ করতেই পারে এবং উচিতও বটে।
কিন্তু অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে পুলিশের পোশাক না পড়ে একদল বেধড়ক মারধরের রাস্তায় হাঁটাকেই একমাত্র রাস্তা হিসাবে বেছে নিয়েছে। কোন আইন রাষ্ট্রকে এই অধিকার দিয়েছে? অনেকে বলছেন, বেশ করেছে। মারবে না তো কি করবে? বেরিয়েছে কেন?
রাষ্ট্র ও তার পুলিশের লাঠি- বন্দুককে আইন বহির্ভূত ক্ষমতা দিলে কি হয়, জানেন না? তাহলে বিনা বিচারে শাস্তির বিরোধিতা করেন কেন? আমরা সবাই কি জানি – কে কেন বেরিয়েছে? জানেন কি এই পুলিশের পোশাক না পরা ডান্ডাধারীদের বড় একটা অংশই শাসকদলের হয়ে ভাড়া খাটা করা সিভিক পুলিশ? কোন গায়ের জ্বালা কে কিভাবে মেটাচ্ছে তা টিভি পর্দায় দেখে সবটা কি বুঝতে পারা যায়?
এর চাইতেও বড় দুটো বিপজ্জনক ঝোঁক দেখা দিচ্ছে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া এই আইনের অপব্যবহারের।
প্রথমত, এই আইন অনুযায়ী সরকারের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করতে পারা যাবে না। সরকার বা সরকারি দল যদি রেশনের টাকা লুঠ করে, আপনি কিছু বলতে পারবেন না। না খেতে পাওয়া গরীব মানুষ ফেসবুক -হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবাদ জানায় না। জানিয়ে লাভও নেই। টিভি র পর্দায় দিনে ১০ বার মুখ্যমন্ত্রীর বিজ্ঞাপনী ভাষনে শুনছে রেশনে ৫কেজি চাল পাওয়া যাচ্ছে। ভোরে উঠে লাইন দিয়ে, মাঝ আকাশের গনগনে সূর্য মাথায় ঘেমে নেয়ে একপেট খিদে নিয়ে যখন দোকানের মুখে গিয়ে শোনে, তার জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৫০০গ্রাম বা ১ কিলো চাল, তখন সে কি করবে? বাড়িতে ৪/৫ টা পেট-পিঠ এক হয়ে যাওয়া মানুষ চাল আসার আশায় প্রহর গুনছে। মাথা ঠান্ডা থাকবে – যদি দেখে বা শোনে শাসকদলের প্রধান কি অন্য কোনও মাতব্বর তার মালের অর্ধেক তুলে নিয়ে চলে গেছে? তখন কি করবে সে? মাথা ঠান্ডা রেখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবে – ফিলিং অ্যাঙ্গরি বা হাঙ্গরি?
রাস্তার বসবে না তো কি করবে? রাষ্ট্র খাবার না পাঠিয়ে, উল্টে লাঠিপেটা করে তুলে দেবে সেজন্য? চালচোরদের স্যালুট দিয়ে, গন্ডায় গন্ডায় ক্ষুধার্ত লোকদের ধরে জেলে পুরে দেবে সরকার? জয়নগরের জাঙ্গালিয়া, মগরাহাটের কলস বা বসিরহাটের বাদুরিয়া – ভুখা মানুষ চাল পেল না, দিদির ভাইয়েরা চাল নিয়ে গেল। খাবারের দাবীতে মানুষ রাস্তায় বসলে বা চালচোরদের ঘিরে ধরলেই পুলিশ নামিয়ে দিচ্ছে সরকার। লাঠি-মামলা-জেল আর ১২৩ বছর আগে তৈরী আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার।
গরীব মানুষের কাছে দুটো পছন্দ – হয় করোনায় মরো, নয়তো না খেতে পেয়ে।
সরকার তথ্যগোপন করবে, রেশনে খাবার নিয়ে দুর্নীতি দলবাজি করবে- কিন্তু আপনি প্রতিবাদ করতে পারবেন না! মানুষ ত্রাণ তহবিলে দান করছেন, আর তাই দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিজ্ঞাপন হচ্ছে – কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারবেন না! লকডাউন বিধি মেনে প্রতিবাদ করলেও গ্রেপ্তার! চলবে এটাই? ১২৩ বছর আগের আইনকে এইজন্য লাগু করেছেন?
দ্বিতীয়ত, এই বিশ্ব মহামারীর বিরুদ্ধে একা কেউ লড়তে পারবে? সরকার একা পারবে? মানুষকে দান করতে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তার তহবিল ছাড়া অন্য কোথাও দান করলেই ওনার গোঁসা। রক্তদান করলেও গ্রেপ্তার হতে হবে! শুধু ওনার দলের লোকই পারবে ওনার ছবি সেঁটে ত্রাণকর্তা সাজতে! ওনার ছবি না সাঁটলেই সেই ত্রাণ বেআইনি?
কলকাতার কর্পোরেশন পরিস্কার করছে না, পাড়ার লোক নিয়ে বামপন্থী কর্মীরা বস্তিতে ব্লিচিং ছড়াতে গেলেই পুলিশ আর বাইক বাহিনী চলে আসছে। উনি ঝাঁটা হাতে ফটোশুট করতে পারবেন, কিন্তু বামপন্থীরা ঝাঁটা ব্লিচিং নিয়ে বস্তি কি পাড়া পরিস্কার করবে – না সেটা হবে না। দেখছেন না, ভোটকুশলীর পরামর্শে বাকি ৪১ জন মন্ত্রীর ছবি বা খবর পর্যন্ত ছাপা হচ্ছে না! আর বিরোধী দল বিশেষ করে বামপন্থীরা নামবে – উঁহু, সেটি হবে না। বাজারী মিডিয়া বামপন্থীদের খবর করবে না, এটা না হয় বিজ্ঞাপনের অর্থ দিয়ে গ্যারান্টি করা গেছে। কিন্তু বস্তিবাসী যদি দেখে কাউন্সিলর পাড়ার বস্তিতে না গিয়ে মস্তি করছে আকালের বাজারে বোতল জুটিয়ে, তাহলে বিপদ! তাই নিজে যখন যাচ্ছি না, তখন আর কেউ যেতে পারবে না। তাই হামলা আর মামলা। এখন নতুন হাতিয়ার ১২৩ বছর আগের ঔপনিবেশিক আইন।
ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জেলে পুরতে এই আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার হতো, এমনই ছিল অভিযোগ।
ব্রিটিশ গেছে, কিন্তু সরকারের কর্তা-কত্রীরা একই আছে।
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বামপন্থীরা রক্ত দেয় প্রাণের তাগিদে, ঝাঁটা ব্লিচিং নিয়ে বস্তিতে-পাড়ায়-গাঁয়ে নামে সংক্রমণ ঠেকাতে। কোনো ভোটকুশলীর পরামর্শে নিজের বিজ্ঞাপন করার জন্য ঝাঁটা হাতে ফটোশুট করার জন্য রাস্তায় নামে না।
তাই, বন্ধু চয়ন, ভাই বাবু বা কলতান দুঃখ পেওনা। রবি ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে কমরেড জ্যোতি বসু বারবার বলতেন – মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।মানুষকে ভরসা করো, মানুষকেই ভিত্তি করো।
ব্রিটিশরাই চিরন্তন হতে পারলো না, এদের দৌড় আর কত?
পুনশ্চঃ দুটি কথাঃ- ১) শুনলাম ডঃ সুজন চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে নাকি সরকার FIR করেছে। ২) বাল গঙ্গাধর তিলককে এই আইনে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করেছিল ১৮৯৭ সালে ‘কেশরী’ পত্রিকায় প্লেগ সংক্রমণে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার জন্য।