Patkathir Sepoy

The Struggle: A Report

শ্রদ্ধা ঘোষ চক্রবর্তী

‘উত্তরবঙ্গ’-প্রত্যেক বাঙ্গালীর স্বপ্নমাখা আবেগের অপর নাম। সেখানে পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থান জলপাইগুড়ি জেলার। মূলত গ্রাম ভিত্তিক এই জেলার কিছু গ্রামের রোজনামচা তুলে ধরতেই এই প্রয়াস।

চিত্রটা ঠিক এমন, পাটকাঠি দিয়ে বানানো দেওয়াল মাথায় টিনের ছাউনী মাটির মেঝেতে প্লাস্টিক পেতে চলছে তাদের দৈনন্দিন জীবন। বরাদ্দ ত্রিপল জোটেনি এই বর্ষায়। তাদের ঘরে একটিমাত্র টিমটিমে বাল্ব জ্বলে। পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই তাদের। কারণ ফরেস্ট বস্তঞি হওয়ার সুবাদে A.D.C এর প্রকল্প অনুযায়ী কোন ঘর বা সুবিধা তারা পায়নি। এমনকি আবাস যোজনার বরাদ্দ ঘর বা সুযোগ সুবিধা নেতাদের  দয়ায় জোটেনি কিন্তু অনেকাংশে প্রভাবশালী পরিবারকে পাইয়ে দেওয়ার প্রয়াসও জারি আছে। কুয়ো নির্মাণের বরাদ্দ অর্থ তারা পায় না।কাজেই এই বর্ষায় এক হাঁটু কাদাজল পেড়িয়ে, মাথায় আকাশ ভাঙা বৃষ্টি নিয়ে, প্রায় অর্ধেক কিলোমিটার গেলে তবেই মিলবে খাবার জল। অথবা চাতকের মত চেয়ে থাকতে হয় আশেপাশের বাড়ির সাহায্যের আশায়। ঘরের পাঁচ বছরের ছেলেটির অক্ষর পরিচয় হয়নি এখনো। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বৈকি। কোনো একসময় সেখানে চতুর্থ শ্রেণী পযর্ন্ত পড়াশোনা হত। শিক্ষক ছিলেন। সহকারীও ছিলেন। ষাট সত্তরের মতো পড়ুয়ারাও নিয়মিত পড়ত সেখানে। এখন একটি মাত্র ঘরে স্থান হয়েছে তাদের। বাকি স্কুল বাড়ির মাঠ আর বারান্দা রেশনের দ্রব্য বিলির জন্য ব্যবহার করা হয়। বতর্মানে পড়ুয়ার সংখ্যা পনেরো কুড়ি জন। একজন শিক্ষক তাদের পড়ান। আবার তিনিই মিড্ ডে মিলের তদারকের দায়িত্বে আছেন। পুষ্টিকর খাদ্য বন্টনের যে উদ্দেশ্যে এই মিড্ ডে মিল প্রকল্প তার বাস্তবায়নেও বিস্তর ফাঁক। ভাত আর ডাল একসাথে একটি পাত্রে দিয়ে বাচ্চাদের হাতে ধরানো হয় কাঁচা ডিম।

এই প্রহসনের ঘেরাটোপের বাইরে যারা ইংরাজী মাধ্যম স্কুলগুলিতে ভর্তি করিয়েছিলেন তাদের বাচ্চাদের তারাও অনেকে অস্বাভাবিক বেতনের ভারে জর্জরিত হয়ে স্কুল ছাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ছেলেমেয়েরা গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। এদের জন্য সর্বশিক্ষা অভিযান নেহাতই একটা কথার কথা মাত্র।

পরের বাড়ি। সেখানে আছেন এক প্রসূতি আর তার পরিবার। রাত্রে হাতির হানা নিত্যদিনের সঙ্গী। সরকার পক্ষ থেকে বানানো হয়েছিল একটি টয়লেট, বিনামুল্যে শৌচাগার প্রকল্প। পরে সরকার পক্ষের কর্মীরা সেই পরিবারের থেকে ৯০০ টাকা দাবী করে শৌচাগারের দরজার খরচ বাবদ। পরিবারটি টাকা দিতে অস্বীকার করে। ফল স্বরূপ শৌচাগারের দরজা খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঝড়বাদলের রাতে যেখানে লোডশেডিং সহজ ঘটনা, প্রসূতি মহিলা, বাড়ির বয়স্ক মানুষ, বাচ্চা সকলকেই সাপ বিছে হাতির ভয় অগ্রাহ্য বাইরের জঙ্গলে যেতে হয়।

অনেক বাড়িরই সামনে পিছনে কোনও রাস্তা নেই, জমির ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। রাত বা দিন সেই জলা জমিই একমাএ পথ। এমনকি মেন রাস্তা তৈরির আশ্বাস দিয়েও বারবার সেই টাকা পঞ্চায়েতের অফিস থেকেই উবে গিয়েছে নেতাদের পকেটে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ গুলো যাদের টোটোই রুজিরুটির জোগান দেয় সেই টোটোর টায়ার পাংচার হচ্ছে প্রায়ই। বসে যাচ্ছে তাদের রোজগার।

মরেও শান্তি নেই – চলতি এই কথাটির সার্থক উদাহরণ আছে এই গ্রামে। বার চারেক টাকা এসেছিল শ্মশান নির্মাণের জন‍্য। অথচ তার সবটুকু দিয়ে স্থানীয় নেতা কেবিল টিভির ব্যবসা চালু করেছে। আর মৃতর পরিবার মরদেহ সৎকার করে নালার মত এক হাজা মজা নদীর ধারে। আবার  নিজেদেরই কাঠ জোগাড় করে আনতে হয়। বর্ষার দিনে ভিজে কাঠ জ্বলতে চায় না অগত্যা আধ পোড়া মৃতদেহ ফেলেই চলে আসতে হয় আজও।

জঙ্গলবেষ্টিত গ্রাম। পদে পদে হাতির হানার ভয়। যানবাহন সন্ধ্যার পর বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রাতবিরেতে প্রসূতি মহিলা বা কোন বাচ্চা বা বৃদ্ধর চিকিৎসার দরকার পড়লে প্রতীক্ষা করতে হয় সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ওপর। সময় মতো আসার কোন নিশ্চয়তা নেই। আসবে কিনা তাও অনিশ্চিত।

এভাবেই চলছে এখানকার জনজীবন। মানুষ বড় কাঁদছে। পাহাড়ও হাসছে না জঙ্গলও হাসছে না। বরং জলে কুমির হয়ে বসে আছে মানুষের দারিদ্রতা আর ডাঙায় শাসকগোষ্ঠী দাঁড়িয়ে আছে শোষণের অবতার হয়ে। ন্যায্য অধিকার দাবী করলে বন্ধ হবে রেশন, বন্ধ হবে লক্ষীর ভান্ডারের পাঁচশ টাকা। পেটে না খেয়ে ওরা পিঠে সইবে কেমন করে! গলা টিপে রেখেছে ওদের, জয়গান গাইতেই হবে।

বামফ্রন্ট জমানায় এলাকার পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন প্রয়াত কমরেড মন্টু সাহা। সেই সময় যা হয়েছিল সেটাই এইসব গ্রামে শেষ উন্নয়নমূলক কাজ। জমির মালিকদের সাথে কথা বলে তিনি চওড়া আল কেটে পাথর ফেলে রাস্তা করেছিলেন একদম প্রত্যন্ত এলাকা অবধি। এখন তো জমি বিক্রির জিনিষ! আগেকার সেইসব আল বাঁধানো রাস্তাও বিক্রি হয়ে গেছে! চিহ্ন অবধি নেই।

উত্তরবঙ্গ হাসছে বলে সরকারের প্রধান প্রচার চালান- স্থানীয়রা জানতে চান ঐ হাসি আসলে কাদের?

এসবই হল পরিস্থিতি। কিন্তু এটাই শেষ কথা এমন না। মানুষের ক্ষোভ রয়েছে, সুযোগ পেলে তাদের সেই ক্ষোভ আগুনের চেহারা নেবে, নেবেই। আগামীকাল রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট, মানুষের মতামত জানানোর দিন- শাসকের অপকর্মের হিসাব নেওয়ার দিন। মানুষের ক্ষোভ চেপে রাখতে ওরা যেমন তৈরি হচ্ছে- লড়াই করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন মানুষও। তাদের অবস্থা, জীবন দেখেও লড়াই চালানোর কথাবার্তা পাটকাঠির স্পর্ধা বলে কারোর মনে হতে পারে, কিন্তু পাটকাঠির সেপাইরাও যে শেষ অবধিই লড়ে সেকথা ভুলতে নেই।

Spread the word

Leave a Reply