ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
একটা বিরাট বোমা। চার হাজার চারশো কিলোগ্রাম তার ওজন। ছোটদের পটকায় ব্যবহৃত সোরা-গন্ধকের বদলে চৌষট্টি কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হলে কি হতে পারে? ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট সেটাই প্রত্যক্ষ করেছিল জাপানের হিরোশিমা শহর।
এই ঘটনার বছর ছয়েক আগের কথা – আমেরিকার সরকার সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রযুক্তির খোঁজ চালাচ্ছে। ‘নিউক্লিয়ার ফিশন’ তখন সদ্য আবিষ্কৃত এক প্রযুক্তি। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে ‘নিউক্লিয়ার ফিশন’ এর সামরিক প্রয়োগ বিষয়ে পারমানবিক বিশেষজ্ঞ এনরিকো ফার্মির সঙ্গে আমেরিকার নৌবাহিনীর যৌথ সেমিনার আয়োজন হয়। ইতিমধ্যে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুসভেল্ট এর কাছে ‘নিউক্লিয়ার ফিশন’ এর সামরিক ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতেও রাজি হয়ে যান। ১৯৪০ সালের ফব্রুয়ারী মাসে আমেরিকার সরকার তৎপর হয় এই বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর জন্য। ৬০০০ মার্কিন ডলার ধার্য করে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় ন্যাশনাল ব্যুরো অফ স্ট্যান্ডার্ড এর প্রধান এল জে ব্রিগ্স এর হাতে। কাজে গতি বৃদ্ধি করতে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে দায়ভার দেওয়া হয় সায়েন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর প্রধান প্রযুক্তিবিদ ভ্যানেভার বুশকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা অংশগ্রহণ করলে ক্রমেই শক্তিশালী ও অধিক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহার তাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ১৯৪২ সালে বেশি বেশি সংখ্যায় পরীক্ষাগার বানাতে ও নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে মার্কিন সেনাকে সরাসরি যুক্ত করা হয়। সেনার ইঞ্জিনিয়াররাও সেই প্রকল্পে হাত লাগায়। সেনার তরফে প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে নিয়োগ করা হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লেস্লি আর গ্রোভ্সকে। সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে বেড়ে চলা মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী সেই প্রকল্পের নামকরণ করা হয় “ম্যানহাটান প্রোজেক্ট”।
অতি দ্রুত প্রকল্পের কাজ তরান্বিত করতে একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষার দল তৈরি হয় আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু তাতেও নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি করার মত অবস্থায় কিছুতেই পৌঁছানো যাচ্ছিল না। পরমাণু বোমা তৈরির প্রধান উপাদান ইউরেনিয়ামের পরমাণুগুলিকে একে অপরের থেকে আলাদা করা যাচ্ছিল না কিছুতেই। অবশেষে ১৯৪৩ সালে বিজ্ঞানী জে রবার্ট ওপেনহাইমার নিউ মেক্সিকোর লস আলামোস পরীক্ষাগারে নিউক্লিয়ার অস্ত্রের উপযুক্ত প্রযুক্তিতে পৌঁছতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে প্রকল্পের খরচ ৬০০০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ততদিনে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়ে যায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রথম নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার সফল হয় ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই ভোর সাড়ে পাঁচটায় নিউ মেক্সিকোর আল্বুকার্কি অঞ্চলে।
বিজ্ঞানীরা এই প্রয়োগের পরেই অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হন। সেদিন নিউ মেক্সিকোতে চল্লিশ হাজার বর্গফুটের হাল্কা গোলাপি মাশরুম আকারের যে আগুনের গোলা তারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা তাদের মনে ভিতি ধরাতে বাধ্য করেছিলো। আল্বুকার্কির উপত্যকা জুড়ে যে বজ্রনির্ঘোষ ছড়িয়ে পড়েছিল তা আসলে ছিল অপ্রাকৃতিক ও মানুষের দ্বারা সৃষ্ট। তবে মার্কিন সরকারের কাছে অস্ত্রের সাফল্যই ছিল শেষ কথা। মানবসভত্যাকে কবরে পাঠানোর সেই সাফল্য বিজ্ঞানের চরমতম অপপ্রয়োগ হিসাবে চিহ্নিত হয়েই ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে।
১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট জাপানের হন্শু প্রদেশের হিরোশিমা শহরের আকাশে মার্কিন বিমানের টহলদারি শুরু হয়। জ্বালানীর অভাবে জাপানী যুদ্ধবিমান তখন মাটিতে। প্রতিরক্ষা শূন্য বললেই চলে। মার্কিন টহলদারি বিমান থেকে খবর যায় আবহাওয়া পরিষ্কার। ‘এলোনা গে’ নামের বি –২৯ বোমারু যুদ্ধবিমানে তখন ‘লিট্ল বয়’ নামের মার্কিন নিউক্লিয়ার অস্ত্র অপেক্ষা করছে হিরোশিমার মাটি ছোঁওয়ার জন্য। বিশ্বযুদ্ধের পরিবেশে সারাক্ষণই তটস্থ হয়ে থাকা জাপানের মানুষ মার্কিন বিমানের শব্দে তখন আরও বেশী ভীত-সন্ত্রস্ত। নিউক্লিয়ার অস্ত্র সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা হয় বিমানের পাইলট ও অন্যান্য বিমানকর্মীদের। সকাল ৮ টা বেজে ১৫ মিনিটে বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে হিরোশিমার বুকে আছড়ে পড়তে ‘লিট্ল বয়’ এর সময় লেগেছিল ৪৩ সেকেন্ড। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা দেখে ‘এনোলা গে’ এর সহপাইলট ক্যাপ্টেন রবার্ট লুইস প্রবল আশঙ্কায় তার লগ বুক এ লেখেন “My God! What we have done?”
সেইদিন হিরোশিমার আকাশে-বাতাসে মারণ বিষের মাত্রা নিয়ে কারোরই মাথা ব্যথা ছিল না, পৃথিবীর ওজোন স্তর কমলো না বাড়ল তাও কেউ পরখ করতে চায় নি। ঠিক কতজন সেদিন হিরোশিমা শহরে মারা গেছিল সেই সংখ্যা বলতে গেলে আজও ‘আনুমানিক’ শব্দটা ব্যবহার করতে হয়, কারণ সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরার মত সেদিন আর কেউ হিরোশিমায় উপযুক্ত ছিল না। ছিল জ্বলন্ত সূর্য পৃথিবীতে নেমে আসা, আগুনের হলকা, নদীতে ভাসমান মৃতদেহের সারি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দলা পাকানো মাংসপিণ্ড, অর্ধদগ্ধ মানুষের চিৎকার-কান্না, ঝলসে যাওয়া গাছ, কালো হয়ে যাওয়া কংক্রিটের দেওয়াল আর সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী বিষদাঁতের ক্ষত। সেদিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যার মেধা ব্যবহার করে সারা পৃথিবীর সামনে বীভৎসার নতুন নজির প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই জে রবার্ট ওপেনহাইমার নিজের আবিষ্কার দেখে প্রবল অনুতাপে বলেছিলেন- “Now I am become Death, the destroyer of worlds.”
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ কৃষ্ণায়ন ঘোষ