ইতিহাস কি?
ইতিহাস লেখার মূল আকর কোনগুলো?
ঐতিহাসিকের দায়িত্বই বা কি?
এই সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হল পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের ১২ থেকে ১৪ই মার্চ তিনদিনব্যাপী কর্মশালায়। পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের যুগ্ম উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মশালার শিরোনাম ছিল ‘ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান গবেষণায় মহাফেজখানা ও লেখ্যাগারের ভূমিকা’।
অধুনা প্রচলিত হাজারো সেমিনার ও ওয়েবিনারের ভিড়ে নিঃসন্দেহে এটি ছিল এক অভিনব ও বড় উদ্যোগ একথা বলাই যায়। কর্মশালার সূচনা করেন ঠিক ততোধিক বড় মাপের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক অধ্যাপক অমিয় কুমার বাগচী। আয়োজকেরা নিজস্ব ছক-ভাঙা রীতিতে প্রদীপ প্রজ্বলনের বদলে পরিবেশের কথা মাথায় রেখে গাছের চারায় জলদানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন।
নিজের উদ্বোধনি ভাষণে অধ্যাপক বাগচী প্রাচীন ভারতের সামন্ততন্ত্র ও বর্তমান ভারতের আধা-ধনতন্ত্র, আধা-সামন্ততন্ত্রের প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করেন। ধনতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রের কেবলমাত্র একটাই রূপ হয় – একথা ভাবলে ভূল; স্থান ও কালভেদে তার রকমফের লক্ষ্য করা যায়। এর সত্যতা উপলব্ধির জন্য বিশেষ দূরদৃষ্টির প্রয়োজন নেই; আধুনিক কালেই বিভিন্ন বড় বড় শিল্পপতি ও কর্পোরেট সংস্থার মালিকেরা যে আর্থিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন তাকে তিনি ‘বণিক সামন্ততন্ত্র’ বলে আখ্যা দেন। আলোচ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেই তিনি বর্তমান সময়ে ইতিহাস রচনায় আর্কাইভের সঠিক ব্যবহারের উপর জোর দেন। পাশাপাশি বর্তমান সরকার কিভাবে আর্কাইভের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে বিকৃত ইতিহাস লেখার প্রবনতা তৈরী করেছে আগামী দিনের গবেষকদের সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেন।
অধ্যাপক বাগচীর বেঁধে দেওয়া মুখবন্ধের সূত্র ধরেই পরবর্তী দুই আলোচক ছিলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডকুমেন্টেশন উপদেষ্টা রমেশ ইউ এবং ন্যাশনাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সহকারি পরিচালক জয়া রবিন্দ্রন। তারা যথাক্রমে দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষনে আর্কাইভের ভূমিকা এবং এই নথিগুলি দেখার ক্ষেত্রে আধুনিক গবেষকেরা কি কি আসুবিধার সম্মুখীন হন ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেন। আর্কাইভ যে আমাদের অতীত ঐতিহ্যেরই একটা অংশ এবং সেগুলির সংরক্ষণের দায়িত্ব সম্পর্কে আগামীর ছাত্র ও গবেষকদের অবহিত করার প্রসঙ্গটি উভয় বক্তার কথাতেই উঠে আসে।
পরবর্তী বক্তা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া আর্কাইভের প্রাক্তন আর্কির্ভিস্ট আর. এল. সাহু ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া আর্কাইভের ভূমিকার বিষয়ে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। সম্ভবত উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে এদিন সবচেয়ে বেশি আগ্রহের সৃষ্টি করেছিলো বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যাপক শেখর ভৌমিকের উপস্থাপনাটি। দেশের বিভিন্ন মন্দিরের পাণ্ডাদের খাতায় থাকা কুলপঞ্জি ও অন্যান্য সূত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি মূলত অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের বাঙালিদের সামাজিক ও ভৌগলিক সচলতার এক অজানা ইতিহাসকে তুলে ধরেন।
পাণ্ডাদের খাতা ও অন্যান্য সূত্রে ছড়িয়ে থাকা তথ্যগুলিকে সংগ্রহ করা যতটা কষ্টের, ঠিক ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ এক অন্য ইতিহাস গঠনের ক্ষেত্রে। ভৌগলিক সচলতারই একটা দিক হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজশেখর বসু ফিজি ও ভারতের বিভিন্ন মহাফেজখানার ভিত্তিতে উপস্থাপন করেন অভিবাসনকারী ভারতীয়দের জীবনচর্যার বিভিন্ন দিক। বাধ্য হয়ে অথবা সেচ্ছায় কর্মসূত্রে এক নতুন অঞ্চলে এসে তাদের দুঃখ বেদনা, বদলে যাওয়া সামাজিক চিত্র ও জাতপাতের কাঠামোর প্রসঙ্গটি অধ্যাপক বসু ব্যাখ্যা করেন।
পশ্চিমবঙ্গ লেখ্যাগারের প্রাক্তন সহকারী পরিচালক ড. আনন্দ ভট্টাচার্য নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আর্কাইভে গবেষণার খুঁটিনাটি আলোচনা করেন। প্রসঙ্গক্রমে ১৯৪৭-এর পর দেশ বা রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও সরকারি দীর্ঘসূত্রিতা যে পদে পদে প্রতিবন্ধতার সৃষ্টি করে চলেছে সে প্রসঙ্গটিও উঠে আসে।
কর্মশালার দ্বিতীয় দিনে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার স্টেট ব্যাঙ্কের গড়ে ওঠার ইতিহাস ও তার আর্কাইভের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। ভারতে ব্যাঙ্কিং কার্যকলাপের উল্লেখ প্রাচীন ইতিহাসে থাকলেও ব্রিটিশ শাসনকালে কিভাবে প্রথমে প্রেসিডেন্সী ব্যাঙ্ক থেকে প্রথমে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক ও স্বাধীনতার পরে স্টেট ব্যাঙ্কের জন্ম হয় – এটিই ছিল আলোচনার মূল উপজীব্য।
অন্যদিকে ন্যাশানাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়ার দুই প্রাক্তন সহকারী পরিচালক রাজমানি শ্রীবাস্তব ও সুতপা চক্রবর্তী ইতিহাস গবেষণায় আর্কাইভের ভূমিকা ও তার সঠিক ব্যাবহার পদ্ধতিকে তুলে ধরেন। আর্কাইভে ইতিহাসের সূত্র অন্বেষণের জন্য প্রয়োজন গবেষকের কঠোর অধ্যবসায় এবং সেখানে যে তাড়াহুড়োর কোনও স্থান নেই তা দ্বিতীয় বক্তার কথায় বিশেষভাবে উঠে আসে। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক কুনাল চক্রবর্তী প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে পৌরাণিক সাক্ষ্যের ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করেন। সাধারনত এমনটা মনে হতে পারে যে প্রাচীন ভারতের কোনও আর্কাইভ নেই বা সেই সময়কার তথ্যগুলি কোনও নির্দিষ্ট চার দেওয়ালে আবদ্ধ নয়। প্রাচীন ইতিহাসের সূত্র পাওয়া যেতে পারে প্রত্নবস্তুর পাশাপাশি বেদ, পুরান, উপনিষদে। তবে এক্ষেত্রে তিনি পুরানের অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কানাগলি থেকে ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকদের সচেতন থাকার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
মধ্যযুগ বিশেষ করে মুঘলযুগের ইতিহাস চর্চায় আর্কাইভে সংরক্ষিত মূল ফার্সি নথি পাঠের প্রয়োজনীয়তা উদাহরন সহযোগে ব্যাখ্যা করেন আলিগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাঈদ আলী নাদিম রেজাভী। মূল নথি পাঠ না করে শুধুমাত্র তার ইংরেজি তর্জমার উপর নির্ভর করলে যে আমাদের কি ধরনের বিভ্রান্তির সম্মুখীন হতে হয় তা তিনি বিভিন্ন উদাহরন সহযোগে ব্যাখ্যা করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, এতদিন পর্যন্ত বাবরের পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভের অন্যতম কারন হিসাবে ভারতীয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম কামানের ব্যবহারের কথা বলা হতো। কিন্তু তিনি লোদি আমলের একটি চিত্রের সাহায্যে একথা প্রমান করে দেন যে ভারতের ইতিহাসে কামানের ব্যবহারের ইতিহাস আরও পুরনো। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সায়ন ভট্টাচার্য বলেন ইতিহাসের পুনর্গঠনে কলকাতাস্থিত সংগ্রহশালার জন্ম ও বিকাশের কথা। পাশাপাশি তিনি মিউজিয়াম কিভাবে তার সামাজিক দায়িত্বও পালন করে, সেটিরও সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেন।
তবে প্রশ্ন ওঠে আর্কাইভ কি শুধুই সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত ও সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান? সেই প্রশ্নেরই উত্তরদানের প্রয়াস পেয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুদেষ্ণা ব্যানার্জী। তিনি দেখিয়েছেন আর্কাইভের চেনা গণ্ডির বাইরেও ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের কত উপাদান; প্রয়োজন শুধু অন্য চোখ ও ভিন্ন মননে সেগুলির পাঠ গ্রহন। আর্কাইভে যে তথ্য পাই, সবসময়ই সেগুলিকে নির্বিচারে গ্রহন করা উচিৎ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখানে রাষ্ট্রশক্তির দৃষ্টিতে ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় নথিগুলিই সংরক্ষণ করা হয়। তাই এক্ষেত্রে সমালোচনার চশমা পরে লেখ্যাগারের নথিতে অতীতের পদচিহ্ন খোঁজা বিশেষ করে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
তৃতীয় তথা শেষদিনে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজের প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস নির্মাণে লেখ্যাগারের ভূমিকা ও কিছুক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি স্বীকার করে নেন যে প্রান্তিক মানুষের প্রশ্নে, বা দেশভাগ উত্তর সাধারন মানুষের জীবন যন্ত্রণার মতো বিষয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনির্মিত আর্কাইভগুলি খুব কম তথ্যই সরাবরাহ করে। আবার যেগুলি আছে, সেগুলিও সব এক জায়গায় পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন তাদের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে গবেষকের বাস্তব অভিজ্ঞতা।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র নিজের অভিজ্ঞতার রোমন্থনের ভিত্তিতে আর্কাইভে থাকা নথির একমুখীনতা ও তার পাঠের সমস্যার কথা আলোচনা করেন। এর পাশাপাশি ইতিহাস ও সাহিত্যিক চিন্তনের মধ্যেকার সম্পর্কের বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন সমাজের মনের ভিতরে থাকে সাহিত্য আর তার বহিরাবরণের খোঁজ দেয় ইতিহাস। এখানে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তিনি তোলেন, সেটি হ’ল দীর্ঘসময়ের প্রেক্ষিতে যদি ইতিহাসের আদিকল্পের পরিবর্তন হয়ে থাকে; তাহলে আমরা আর্কাইভের আদিকল্পের পরিবর্তন ঘটাবো না কেন? সম্ভবত এই আদিকল্প পরিবর্তনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরন হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন তরুন গবেষকের পরিবর্ত আর্কাইভ গঠনের উদ্যোগ।
বিগত বেশকিছু বছর ধরে তারা অক্লান্ত প্রচেস্তায় গড়ে তুলেছেন এই আর্কাইভ, বা বলা চলে স্মৃতিভাণ্ডার। যেখানে স্থান পেয়েছে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারনা, পুরনো চিঠিপত্র, ছবি-ইত্যাদি। তিনদিন ব্যাপী আলোচনায় বারবারই যে প্রসঙ্গটি ফিরে এসেছে তা হল বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস রচনায় আর্কাইভের ভূমিকা ও তার পাশাপাশি বিকল্প সূত্রের খোঁজ। পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের আয়োজিত এই কর্মশালার সার্থকতা উপলব্ধি করা যায় টানা তিনদিন ঘরভর্তি শ্রোতাদের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সংসদের সভাপতি অরুন বন্দ্যোপাধ্যায়, সহ-সভাপতি সুস্নাত দাশ, যুগ্ম সম্পাদক বিমান সমাদ্দারের নামও। অধ্যাপক আশীষ কুমার দাস তাঁর সম্পাদকের অবিভাষনে বর্তমানে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে নেমে আসা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, একমুখী, বিশেষ উদ্দেশ্যমণ্ডিত বিকৃত ইতিহাসব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং আগামীর গবেষকদের এই বিষয়ে দায়িত্বের কথাও স্মরন করিয়ে দেন।
অরূপ মিত্র, পি.এইচ.ডি গবেষক, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়