অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
বিংশ শতকের তিরিশের দশকের সূচনালগ্ন। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সারা ভারতের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে ১৯১৭-এর নভেম্বরে পেট্রোগ্রাদে যে আদর্শের অগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছিল, তার উপাসকরা ভারতেও রয়েছেন এবং সরকারী বয়ান অনুসারেই কিং-এম্পেরারকে গদিচ্যুত করতে তাঁরা সক্রিয়। ভীত সন্ত্রস্ত ব্রিটিশ প্রশাসন তখন চতুর্দিকে দেখছে সাম্যবাদের ভূত। যদিও মিরাট মামলার পর ভারতের সাম্যবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ প্রথম শ্রেণীর নেতাই কারাগারে, গোয়েন্দা বিভাগ ভালোই জানে কিং-এম্প্রেরারকে ভারত থেকে ঝাড়ু মেরে তাড়াতে উৎসাহী লাল-ঝান্ডাওয়ালারা হলো রক্তবীজের মতো। একজনও জেলের বাইরে থাকলে সে অচিরেই সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠবে। তাঁদের এই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। ঠিক এই সময়েই দক্ষিণ ভারতে সক্রিয় ছিল লাল-ঝান্ডাওয়ালাদের এক প্রবাদপ্রতিম বিপ্লবী নেতা। শ্রমিক আন্দোলনে তার হাতেখড়ি হয়েছিল জাহাজের মাল্লা হিসেবে, উপন্যাসের মতো রোমাঞ্চকর অশান্ত জীবন তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মাতৃভূমি পাঞ্জাব থেকে দেশ-দেশান্তরে, সাম্যবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর তিনি মার্কিন দেশের আরামের জীবন ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন সোভিয়েত দেশে। সেখানে রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের কাছে পেয়েছেন অস্ত্র চালানো এবং গোপন বিপ্লবী সংগঠন পরিচালনার শিক্ষা, তারপর মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদীদের পদতল থেকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরেছেন স্বদেশে। তিনি বিপ্লবী আমির হায়দার খান।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি, আমির হায়দার খান তখন দক্ষিণ ভারতে কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে তুলতে সক্রিয়। তিনি ‘শংকর’ নামক এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতের পরিচয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ক্রমশঃ তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে দক্ষিণ ভারতে সাম্যবাদীদের একটি চক্র। হায়দার খান সবসময়েই চাইতেন সমাজের সর্বাপেক্ষা প্রতিভাশালী এবং প্রগতিশীল মানুষেরা যেন এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই মনোভাবের কথা মাথায় রেখেই তাঁর সঙ্গী জয়রাম মামলম খবর আনেন এক যুবকের। এই যুবক লবণ সত্যাগ্রহের সময় আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খেটেছেন, কয়েদিদের অধিকারের জন্য অনশন করেছেন, সহ্য করেছেন অকথ্য অত্যাচার। সাম্যবাদের প্রতি ইতিমধ্যেই সহানুভূতিশীল এই ছেলে যদি কমিউনিস্ট আন্দোলনে সরাসরি যোগদান করে, তাহলে সংগঠন এক অসাধারণ কর্মী লাভ করবে – এই মত জয়রামের। তবে সমস্যাও রয়েছে। যুবকের খ্যাতি আছে প্রবল আদর্শবাদী এবং একগুঁয়ে বলে। সে পাকা গান্ধীবাদী, সর্বদা খাদির কাপড় গায়ে থাকে, চরকা চালায় নিয়ম করে। গ্রামসেবা, মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন, হরিজন আন্দোলন – সবেই তাকে থাকতে দেখা গেছে সবার আগে। এমন একজনকে প্রত্যক্ষ ভাবে সাম্যবাদী সংগঠনে যোগ দিতে রাজি করানো মোটেই সহজ হবে না। তবে হায়দার নিজে যদি কথা বলেন, তাহলে কাজ হতে পারে।
কিছুটা কৌতূহলে, কিছুটা এক নতুন সদস্য পাওয়ার আশায় হায়দার খান এই যুবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হাজির হলেন ব্যাঙ্গালোরে। যুবকের গায়ে খাদির জামা, পায়ে সস্তা চটি, খালি মাথা আর তাতে শুধু একটা টিকি। দেখা করতে তিনি জানালেন বাড়িতে না – আগামীকাল রবিবার সকাল দশটায় স্থানীয় পার্কে তিনি আলোচনার জন্য সময় দিতে পারেন। পরের দিন যথাসময়ে বসল আলোচনা। হায়দার অহিংস আন্দোলনের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন, বোঝালেন কংগ্রেসী আন্দোলন দেশে কখনই পূর্ণ স্বাধীনতা আনতে পারবে না, যুবককে আহ্বান করলেন তাঁদের সংগঠনে যোগদান করার। এইরকম আলোচনা আরও দুই দিন চলল। তবুও যুবককে তাঁর গান্ধীপন্থী ধারা থেকে একচুল নড়ানো গেল না। তিনি সাম্যবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু সরাসরি দলে যোগ দিতে অক্ষম – এই অবস্থানেই যুবক অনড় দেখে মরিয়া হয়ে হায়দার খান ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। জয়রাম তাঁকে আগেই বলেছিলেন – ‘হায়দার, এ ডোবার স্থির জল – ছোটোখাটো ঢিল ফেলে কিছু হবে না। প্রকান্ড একটা পাথর ফেললে তবে ঢেউ-টেউ উঠতে পারে।‘ তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন, সেই উপদেশ। এখন আর অগ্রাহ্য করার উপায় ছিল না। তিনি যুবককে মনে করিয়ে দিলেন, তিনি যে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকেন, সেখানে বিবাহ উপলক্ষেও ব্রিটিশ পতাকা তোলা হয় এবং তিনি নিজেও তাতে উপস্থিত থাকেন। এ তাঁর দোষ নয়, কংগ্রেস রাজনীতিই এই প্রকার দ্বিচারিতা সমর্থন করে, যেখানে গায়ে খদ্দর দিয়েও উকিল, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আর জজদের কংগ্রেস সমর্থক আত্মীয়রা কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে আগত সাহেবদের সঙ্গে ইউনিয়ন জ্যাকের ছায়াতলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারেন। এইভাবে কোন পূর্ণ স্বাধীনতা কবে কোন দেশে এসেছে ? এই আক্রমণ হায়দার বিনয়ের সঙ্গেই করেছিলেন – কিন্তু এর আবেদন ছিল যুক্তির থেকেও আবেগের দিকে, যুবকের প্রবল জাতীয়তাবাদী অস্মিতার দিকে। তবে এই আবেদনে আপাত ভাবে কিন্তু কোনও কাজ হল না। যুবক রইলেন আগের মতোই অনড়। হতাশ হায়দার ফিরে এলেন খালি হাতেই। এর কিছু পরে তিনি খবর পেয়েছিলেন যে ইউনিয়ন জ্যাক উত্তোলন নিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া করে ওই যুবক পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখেই ব্যাঙ্গালোর ছেড়েছেন। তবে আর কোনও খবর পাওয়ার আগেই আমির হায়দার খান পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। কয়েক বছর জেল খেটে যখন তিনি মুক্তি পেলেন, তাঁর জন্য চমক অপেক্ষা করছিল। যে সকল কমরেডরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সহাস্যমুখে ছিলেন এই যুবক। করমর্দন করে সেইদিন সে জানিয়েছিল যে হায়দারের পুকুরে পাথর ছোঁড়ায় সত্যিই কাজ হয়েছে, তিনি আর হায়দার এখন একই পথের পথিক এবং খুব তাড়াতাড়ি হায়দারের সঙ্গে মাদ্রাজে তিনি দেখা করবেন। এই যুবকের নাম – পুচ্চলপল্লী সুন্দরাইয়া।
পি. সুন্দরাইয়ার নাম শোনেননি, ভারতের সাম্যবাদী রাজনীতিতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। বিশেষ করে নিজামশাহীর বিরুদ্ধে হায়দ্রাবাদের কৃষকমুক্তি সংগ্রামে অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য তাঁর নাম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও এই প্রবাদপ্রতিম নেতা ভারতের সাম্যবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) প্রতিষ্ঠা হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি। তাঁর জীবনের এই সকল অধ্যায় সম্পর্কে অনেকেই জানেন। তাই সেগুলি নিয়ে পুনরাবৃত্তির জন্য এই নিবন্ধ নয়। বরং আমির হায়দার খানের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক বৈঠকের বিবরণ প্রবন্ধের প্রথমেই প্রদান করা হয়েছে তার পূর্বে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনের নানা অজানা কথা তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য। তাই সুন্দরাইয়ার স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে তাঁর অধিকাংশ কমরেডই যেরকম করেছেন, সেই ১৯৪১ বা ১৯৩৭ থেকে নয়, আমরা আমাদের কাহিনী শুরু করব তার অনেকটা আগে থেকে।
পুচ্চলপল্লী সুন্দরাইয়া জন্মগ্রহণ করেন অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোর জেলার অলকানিপড়ু গ্রামে। ১৯১৩ সালে ১-লা মে, মে দিবসে তাঁর জন্ম। পিতা ভেঙ্কটস্বামী রেড্ডি ছিলেন বর্ধিষ্ণু কৃষক। তাঁর ছিল প্রায় দেড়শো বিঘা উর্বর জমি যার অধিকাংশই চাষ করত ভাগচাষি আর কৃষি শ্রমিকরা। তবে অন্যান্য অনেক ধনী কৃষকের মতো ভেঙ্কটস্বামী পায়ের উপর পা তুলে জমিদারী করতেন না। তিনি মাঠে ঘাটে কাদা মেখে প্রত্যক্ষ ভাবে চাষবাসের কাজে অংশ নিতেন। জমি আর ফসল সম্পর্কে অগাধ পান্ডিত্যের জন্য স্থানীয় কৃষকরা তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর মা শেশমা ছিলেন স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। পরিবারের সব সদস্যের দিকে তাঁর সবসময় নজর থাকত। দয়াশীলা বলে পরিচিতি থাকলেও তিনি জাত-পাত, আচার-বিচার খুব কোঠর ভাবে মেনে চলতেন, যা পরবর্তীকালে ছেলেদের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের কারণো হয়েছিল। সুন্দরাইয়া ছিলেন সাত ভাই-বোনের মধ্যে ষষ্ঠ। সন্তান লাভের জন্য ভেঙ্কটস্বামী ভেঙ্কেটেশ্বরের কাছে মানত করেছিলেন, তাই সন্তানদের নামের সঙ্গে ‘ভেঙ্কট’ বাধ্যতামূলক ভাবে জুড়ে দিতে হত। সেই অনুসারে জন্মের সময় সুন্দরাইয়ার নাম রাখা হয় পুচ্চলপল্লী ভেঙ্কট সুন্দরারামী রেড্ডি।
এই খটমট নাম থেকে সুন্দরাইয়া এলো কি করে ? সুন্দরাইয়া আদতে ছিল তাঁর ডাক নাম। রাজনৈতিক চেতনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরাইয়া প্রথমে নাম থেকে ভেঙ্কট আর রামকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন আর অন্তিমে জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ত্যাগ করেছিলেন ‘রেড্ডি’ উপাধিকে। সে অবশ্য অনেক পরের কথা। সুন্দরাইয়া সব সময় সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করতেন। তাই নিজের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়েও ‘ছোটোবেলা থেকেই আমি প্রগতিশীল’ এই ধরণের অবস্তাব কথা বলে নিজের গৌরববৃদ্ধি করতে চাননি। সেই সময়ে অন্ধ্রের একটি বর্ধিষ্ণু কৃষক উচ্চজাতির পরিবারের ছেলের যেমন হওয়ার কথা, সুন্দরাইয়া তার থেকে একেবারেই আলাদা ছিলেন না। নিজের বয়ানেই দুরন্ত ও চঞ্চল হিসেবে তাঁর কুখ্যাতি ছিল। ছয় বছর বয়সে সুন্দরাইয়া পিতৃহারা হন। কিন্তু তাঁর মা কোনও অভাব বুঝতে দেননি। ছেলেকে প্রথমে তিনি পঞ্চেয়েতের স্কুলে ভর্তি করেন। গ্রামের অস্পৃশ্য জাতিসমূহকে যে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হত সচেতন ভাবে, তা বালক সুন্দরাইয়ার নজর এড়ায়নি। কিন্তু এই মহা অন্যায়কে তলিয়ে বোঝার মত তাঁর তখনও বোধ ছিল না। দুরন্ত হলেও সুন্দরাইয়া মেধাবী ছিলেন। তেলেগু অক্ষর তিনি শিখে নিয়েছিলেন খুব দ্রুত, অঙ্কে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। কবিতা পড়তেও তিনি খুব পছন্দ করতেন।
সুন্দরাইয়ার গ্রামে রেড্ডিদেরই প্রাধান্য ছিল। ক্ষমতায়, বৈভবে ও প্রতিপত্তিতে পাদ্মাসালিরা ছিলেন তাঁদের একমাত্র প্রতিপক্ষ। মালা এবং মাদিগা – এই দুই নিম্নবর্গের জাতি ছিল সংখ্যাগুরু। কিন্তু সবদিক থেকেই তাঁরা ছিলেন পশ্চাৎপদ। তাঁদের শিক্ষার কোনও অধিকার ছিল না, এক কুয়ো থেকে তাঁদের জল পান করতে দেওয়া হত না। সুন্দরাইয়ার মনে এই অনাচারগুলি ছাপ ফেলেছিল। তিনি মাঝে মাঝে মা-কে অনুনয় করতেন এই জাতির তৃষ্ণার্ত কাউকে জল দিতে অথবা আলাদা ভাবে খাবার না দিয়ে একসাথে খাবার বানাতে। তাঁর এই আবেদন কখনই সফল হয়নি, সুন্দরাইয়াও সাময়িক ভাবে এটাই স্বাভাবিক ভেবে এই নিয়ে সদ্য বিধবা মায়ের সঙ্গে সংঘাতে যাননি।
সুন্দরাইয়ার বড়দির বিয়ে হয়েছিল বীরস্বামী রেড্ডি নামের এক ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে। তিরুবল্লারে তিনি বদলি হয়ে আসার পর স্ত্রী-এর দুই ছোটো ভাইকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন। জামাইবাবুর সঙ্গে সুন্দরাইয়া এবং তাঁর ভাই রামের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, যদিও কখনও কখনও বিবাদও যে হতো না এমন নয়। তবে দিনের শেষে বীরস্বামী স্ত্রী-র মেধাবী এই দুই ভাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষীই ছিলেন। ওয়েসলি হাই স্কুলে দুজনকেই তিনি ভর্তি করে দেন। এখানে পড়ানোর মূল মাধ্যম ছিল তামিল, এদিকে সুন্দরাইয়া তেলুগু ছাড়া কোনও ভাষাই জানতেন না। ইংরেজি তাই চটপট শিখে ফেললেও তামিল ভাষায় যে বিষয়গুলো পড়ানো হত, তাতে সুন্দরাইয়া আশানরূপ নম্বর পেতেন না। অঙ্কে তার পূর্বের দক্ষতা বজায় ছিল, যদিও স্টেপ জাম্প করার বদঅভ্যাসের জন্য শিক্ষকরা হরদম নম্বর কাটতেন। সুন্দরাইয়ার যুক্তি দিতেন, উত্তর যখন ঠিক, কিভাবে করেছি তা দিয়ে কি যায় আসে ? স্বভাবতঃই তা গ্রাহ্য হত না।
বই পড়ার নেশা এই সময়েই সুন্দরাইয়াকে গ্রাস করে। জামাইবাবুর লাইব্রেরির প্রায় সব বই-ই তাঁর নখদর্পণে ছিল। ‘মোল্লা রামায়নম’-এর মতো ধ্রুপদী সাহিত্যে স্কুল বয়স থেকেই তাঁর রুচি ছিল। ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস প্রচুর পড়তেন। ভোগরাজু নারায়ণ মূর্তির ‘বিমলা’ খুব প্রিয় ছিল। এছাড়াও পড়তেন ‘রায়চুর যুদ্ধম’, ‘বিজয়নগর সাম্রাজ্যম’ প্রভৃতি বই। রাজসিংহ, রাণা প্রতাপ বালক সুন্দরাইয়ার কাছে নায়ক হিসেবে ধরা দিতেন। এই সকল গল্প উপন্যাস তাঁকে প্রথম জাতীয়তাবাদী চিন্তার দিকে নিয়ে যায়। তাঁর এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ দেখে মা এবং তাঁর জামাইবাবু দুজনেই খুব চিন্তিত ছিলেন দেশে যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের বন্যায় সুন্দরাইয়া না যোগ দিয়ে দেন।
জামাইবাবুর বদলির সঙ্গে সঙ্গে দুই ভাইকেও ঘরতে হত। রাজামুন্দ্রিতে বদলি হয়ে গেলেন বীরস্বামী। দুই ভাই স্কুল পাল্টে এখানে এক স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হলেন। রাজামুন্দ্রি সেই সময় দক্ষিণ ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। ই. রামচন্দ্র রেড্ডি, পি. মল্লিকার্জুন রাও প্রমুখ তরুণ জাতীয়তাবাদীর সংস্পর্শে আসলেন সুন্দরাইয়া। এতকাল শুধু সাহিত্য আর পুরাণ-মহাকাব্যের মধ্যেই সুন্দরাইয়ার জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল। এঁরা সুন্দরাইয়াকে সন্ধান দিলেন ইতিহাস ও রাজনীতির বইয়ের এক নতুন জগতের। এই জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস কর্মীদের কাছ থেকেই সুন্দরাইয়া একবার ভীষণ তিরস্কৃত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নাম না জানার জন্য। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, এই অজ্ঞানতা দূর করতেই হবে। সমস্ত সংবাদপত্র সুন্দরাইয়া খুঁটিয়ে পড়া শুরু করেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সব খবর থাকত তাঁর নখদর্পনে। জাতীয়তাবাদী ‘অন্ধ্র পত্রিকা’-র তিনি নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। কংগ্রেসের জালিয়নওয়ালাবাগ সংক্রান্ত রিপোর্ট তিনি এখানেই পাঠ করেন। এই রিপোর্ট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁর ঘৃণাকে আরও সুতীব্র করেছিল।
গান্ধীর জীবনীও এর মধ্যে সুন্দরাইয়া পড়ে ফেলেছিলেন আর গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গান্ধীবাদী জীবনকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছা তাঁর মনে বাসা বাঁধে। কিন্তু অন্যদিকে বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রাম ও নির্ভীক আদর্শবোধ, তাঁর বয়সী অন্যান্য কিশোরের মতোই সুন্দরাইয়ার ভালো লাগত। গান্ধীর সশস্ত্র বিপ্লববাদের সমালোচনা তিনি ঠিক মেনে নিতে পারতেন না। এই নিয়ে এই সময়ে তাঁর মনে টানাপোড়েন নেহাত কম হয়নি। কংগ্রেসের মধ্যে তখনও বিপ্লববাদীরা সক্রিয় ছিলেন। ও. পার্বতীসাম এবং এ. সুব্বা রাও, যাঁরা সুন্দরাইয়ার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, এইসময় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে বিপ্লবী সংগঠন গড়ার দিকে চলেছিলেন। তরুণ সুন্দরাইয়াকে এই সংগঠনে যোগ দিক এমন ইচ্ছা তাঁদের মনে মনে ছিল। তাঁরা সুন্দরাইয়াকে আর এক বছর পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিয়ে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাব নিয়ে সুন্দরাইয়ার মনে সম্ভবতঃ কিছু সংশয় ছিল। গান্ধীবাদী ভাবনা তখন তাঁর হৃদয়ে গভীর ভাবেই প্রবেশ করেছে। তবুও এক বছর অধ্যয়নে তিনি রাজি হয়ে যান। এই সময়েই তিনি সংস্কৃত শেখেন ও বয় স্কাউটস সংগঠনে অংশগ্রহণ করে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সংগ্রামী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা শিক্ষা অধিগত করতে সচেষ্ট হন।
এই সময় নানা বিষয় নিয়ে জামাইবাবুর সঙ্গে সুন্দরাইয়া এবং তাঁর ভাই, রামের বিরোধ চরমে ওঠে। যদিও বীরস্বামী স্ত্রীর দুই ভাইকে স্নেহই করতেন এবং সুন্দরাইয়া ও রাম তাঁদের ভগ্নীপতিকে ভালোবাসতেন, তবুও সংঘাত চরম অবস্থায় পৌঁছলে দুজনেই অভিমানে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন মাদ্রাজে। আত্মীয় বীরা রেড্ডি তাঁদের সেখানে আশ্রয় দেন। সুন্দরাইয়ার বয়স তখন ১৩। এখানে তিনি হিন্দু হাই স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। তিন বছর চলে তাঁর এই স্কুলের পড়াশোনা। গান্ধীর সব লেখাপত্র সুন্দরাইয়া এর মধ্যে পড়ে ফেলেছেন, ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-রও তিনি নিয়মিত পাঠক। ধর্ম ও দর্শনের প্রতি তাঁর বিশেষ রুচি হয়েছে। পড়ে নিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী রামতীর্থ এবং স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সব বইপত্রও। পড়ে নিয়েছেন বাল গঙ্গাধর তিলকের ‘গীতা রহস্য’-ও। সাম্প্রদায়িক ভাবনা সুন্দরাইয়ার মনে কখনও স্থান পায়নি, তবে হিন্দু পুনরুত্থানবাদের সংস্কারমুখী প্রবণতার প্রতি এই পর্বে গভীর ভাবে তিনি আকর্ষিত হন। বিশেষ করে গীতার নিষ্কাম কর্মের ভাবনা ও বিবেকানন্দ প্রচারিত শ্রী রামকৃষ্ণের জীবজ্ঞানে শিবসেবার আদর্শ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই সময় সংস্কারমূলক যুক্তিবাদ মিশ্রিত আধ্যাত্মিকতা ছিল সুন্দরাইয়ার মননের মূল উপাদান। সমাজতন্ত্র-এর ধারণা তখনও সেখানে প্রবেশ করেনি।
সমাজতন্ত্র না থাকলেও একপ্রকার সমতার ভাব তাঁর মনে ছিল। তিনি সমাজের দলিত শ্রেণীর সঙ্গে এই সময়ই জাতপাতের তোয়াক্কা না করে মিশতে থাকেন। আবাল্য লালিত সংস্কার ত্যাগ করে তাঁদের প্রদান করতে শুরু করেন যথাযথ সমাজিক সম্মান। এই বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যেতেও আর তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। যখনই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সুন্দরাইয়া গ্রামের বাড়ি ফিরতেন, চলে যেতেন মাঠে খেত-মজুরদের মধ্যে। বোঝার চেষ্টা করতেন তাঁদের দুঃখ দুর্দশার কথা, গ্রামের অর্থনীতির মার-প্যাঁচ আর জাতি এবং শ্রেণীর যোগসূত্র। এই বোঝার চেষ্টা সচেতন ছিল, এমন নয়। যে তথ্যগুলো সুন্দরাইয়া পেতেন, তাকে ব্যাখ্যা করার জাদুকাঠি, মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা তখনও তাঁর হাতে আসেনি। কিন্তু হিন্দু দর্শনের আধুনিক সংস্কারবাদী পুনঃব্যাখ্যা তাঁর মধ্যে যে মানবতাবাদী চেতনার সঞ্চার করেছিল, তার ভিত্তিতেই ইয়ান্নাদি নামক ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’-দের উপর জাতভিত্তিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সুন্দরাইয়া রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এই বয়সেই। গান্ধী, বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ – এই তিনজন ছিলেন তাঁর প্রধান পথ প্রদর্শক।
সুন্দরাইয়ার রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ যোগদানের সুযোগ এল ১৯২৮ সালে। সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনে ভারত তখন উত্তাল। চতুর্দিকে শোনা যাচ্ছে ‘সাইমন গো ব্যাক’-এর ধ্বনি। সুন্দরাইয়ার নেতৃত্বে স্কুলের তাঁর ক্লাসের সহপাঠীরা সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করে ক্লাস বয়কট করে একদিনের জন্য। তবে অধিকাংশ ছাত্ররই এই জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা খুব দ্রুত শীতল হয়ে যায়। তাই পরের দিন হেডমাস্টার সকল ছাত্রর স্কুলে অনুপস্থিতির কৈফিয়ৎ দাবি করলে কেউ শরীর খারাপের কথা বলে, কেউ বা পরিবারের অনুষ্ঠানের। একমাত্র সুন্দরাইয়া প্রশ্নের উত্তরে চোখে চোখ রেখে জবাব দিয়েছিলেন – ‘আমি আসিনি, কারণ কাল সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে সারা দেশে বয়কট দিবস পালনের ডাক দেওয়া হয়েছিল।‘ হতচকিত হেডমাস্টার – ‘কার অনুমতিতে কামাই করেছ ?’ প্রশ্ন করতেই উত্তর উড়ে এসেছিল – ‘জাতীয় আহ্বান করা হয়েছে, এতে আবার কার অনুমতি লাগবে ?’ এই ঘটনার পর সুন্দরাইয়ার নাম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে যথেষ্ট ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব এই মেধাবী এবং সাহসী ছেলেটিকে নিজেদের দিকে টেনে নিতে উৎসাহী হন। তাঁদের অবশ্য বিশেষ পরিশ্রম করার প্রয়োজন ছিল না। কংগ্রেস সম্পর্কে সুন্দরাইয়ার তখনো অনেক প্রশ্ন থাকলেও তিনি গান্ধীর প্রায় অন্ধ ভক্ত। মাদ্রাজে গান্ধীর আগমন হলেই মাইলের পর মাইল হেঁটে তিনি মহাত্মার সভা শুনতে যেতেন। গান্ধীর সভায় স্কাউট পোশাক পরে যেতে মানা করা হলে, তিনি তাঁর অত্যন্ত পছন্দের স্কাউট সংগঠনই ছেড়ে দেন।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে লয়োলা কলেজে ভর্তি হলেন সুন্দরাইয়া। বিজ্ঞানের ছাত্র তিনি। অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন তাঁর মূল পড়ার বিষয়। কিন্তু ওর পাশাপাশি সারাক্ষণ চলল ইতিহাস আর অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা। জিগ সান্ডার্স-এর ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’, ট্যাসিকের ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’, ল্যাস্কির ‘গ্রামার অফ পলিটিক্স’ এবং আরও আরও অনেক বই। সমাজতন্ত্র নিয়ে এই প্রথম বই পড়ার সুযোগ হল। গান্ধী, নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ পড়তেন সুযোগ পেলেই। সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কেও এইখানেই দুই একটা বই পেলেন। যদিও তা পড়ে খুব স্পষ্ট ধারণা লাভ করা কঠিন ছিল। গান্ধী তখনও সুন্দরাইয়ার নায়ক। তাঁর সাধারণ জীবন, সমাজসংস্কারের প্রশ্নে তাঁর আন্তরিকতা, বিশেষ করে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর মনোভাব সুন্দরাইয়াকে ভীষণ প্রভাবিত করে। তবে গান্ধীর সংগ্রামের পন্থায় অহিংসার সম্পূর্ণ বর্জন নিয়ে সুন্দরাইয়ার মনে সংশয় তৈরি হয়েছিল। এমন নয়, তিনি সশস্ত্র সংগ্রাম চাইছিলেন। কিন্তু অহিংস আন্দোলনে আক্রমণ নেমে এলে প্রতিরোধ করার মধ্যে অন্যায় কোথায়, তা তাঁর বোধগম্য হত না। তাও এই প্রশ্ন ব্যতীত আন্দোলনের পদ্ধতি, সংগ্রামের পদ্ধতি ও মূল রাজনীতির বিষয়ে তিনি গান্ধীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত ছিলেন। গান্ধীর সঙ্গে, কংগ্রেসের সঙ্গে নয়। এখানে এই পার্থক্যটি আলাদা ভাবে তুলে ধরা জরুরি। সুন্দরাইয়া গান্ধীবাদের প্রতি অনুগত ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব সম্পর্কে তাঁর মনে সেই সময় থেকেই প্রবল সংশয় ছিল। তাঁদের কাজকর্ম, আচার ব্যবহার তিনি অ-গান্ধীসুলভ মনে করতেন ও গান্ধীবাদী নীতির ভিত্তিতেই কংগ্রেসের প্রতিবাদ করতেন। তবুও জাতীয় আন্দোলনের প্রধান মঞ্চ হিসেবে প্রত্যক্ষ ভাবে কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করারও তিনি পক্ষপাতি ছিলেন না। স্থানীয় কংগ্রেস নেতারও এই রগচটা, গান্ধীভক্ত তরুণকে বিশেষ চটাতো না, কারণ তার মতো ভালো সংগঠক ছিল দুর্লভ।
কলেজে পড়ার সময়েই সুন্দরাইয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় বোম্বে থেকে আগত এইচ.ডি. রাজার। রাজা কমিউনিস্ট ছিলেন না, কিন্তু বোম্বের শ্রমিক আন্দোলন, যাতে সেই সময়ে কমিউনিস্টদের প্রভাব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তার সঙ্গে তাঁর ভালোই পরিচিতি ছিল। রাজার মাধ্যমেই সুন্দরাইয়া প্রথম কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ার সুযোগ পান। এই ইস্তেহার সুন্দরাইয়ার কাছে অদ্ভুত ভাবে ধরা দিয়েছিল। তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন গীতা, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ আর গান্ধীর মধ্যে তিনি এতকাল কিছু হাতড়ে বেড়িয়েছেন। কি চাইছেন, তা নিয়ে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কমিউনিস্ট ইস্তেহার-এ তিনি যা চাইছিলেন, পেয়ে গেলেন, হঠাৎ করে তাঁর সামনে থেকে যেন পর্দা সরে গেল, দৃষ্টি হয়ে গেল স্বচ্ছ। সুন্দরাইয়া পরে লিখেছেন, এমন নয়, একটা বই পড়েই তাঁর চরিত্র পুরো বদলে গেছিল। ইস্তেহার থেকে তিনি নতুন কোনও কথা পেয়েছিলেন এমন নয়। আদতে যে বিশ্বাসগুলি তিনি ইতিমধ্যেই লালন করছিলেন, জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শ্রেণীর যে বাস্তবতাকে তিনি প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করছিলেন – ম্যানিফেস্টো তাঁকে সেগুলিকে সুস্পষ্ট ভাবে বোঝার এক বিশ্ববীক্ষার চাবিকাঠি ধরিয়ে দিয়েছিল মাত্র, তাঁর মনের কথাগুলিকেই তুলে ধরেছিল সাজিয়ে গুছিয়ে। ম্যানিফেস্টো পাঠ যেমন নতুন পথের সন্ধান দিন, তেমনই সুন্দরাইয়ার মনের মধ্যে এক প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব-এরও সৃষ্টি করেছিল। তিনি এতকালের রাজনৈতিক শিক্ষা উপড়ে ফেলতেও পারছিলেন না, আবার সাম্যবাদী মতাদর্শকে বর্জন করতেও পারছিলেন না। তাই এই সময় থেকে আমির হায়দার খানের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে অবধি তিনি মার্কসের সঙ্গে বিবেকানন্দ আর গান্ধীকে মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। হায়দারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল সেই দ্বিতীয় অনুঘটক যা সুন্দরাইয়ার গান্ধী থেকে মার্কসের যাত্রাপথের অন্তিম পর্বের সূচনা করেছিল। যাই হোক, সে পরের কাহিনী। ইস্তেহার সুন্দরাইয়ার চিন্তার দিক বদলে দিল বটে, কিন্তু তার জন্য রাতারাতি তিনি খাদি ছেড়ে লাল ঝান্ডা ধরলেন না। সেরকম অস্থিরমতি তাঁর চরিত্র ছিলও না।
আমাদের কাহিনী এসে পড়েছে ১৯২৯ সালে। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার খবর, অল্প স্বল্প হলেও সুন্দরাইয়া পাচ্ছেন। এইচ.ডি. রাজা মারফত বোম্বে থেকে প্যামফ্লেট আনিয়ে পড়ছেন। ভগৎ সিং-এর আইনসভায় বধিরকে শোনানোর উদ্দেশ্যে বোমা নিক্ষেপ, যতীন দাসের অনশন ও শহীদত্ব বরণের খবর তাঁকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। মিরাট মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্টদের প্রতি আর হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশনের বিপ্লবীদের প্রতি সুন্দরাইয়ার পূর্ণ সহানুভূতি ছিল, কিন্তু তখনও অবধি সমালোচনা সত্ত্বেও একমাত্র কংগ্রেসের রাজনীতিতেই তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিতেন। পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব কংগ্রেসের অধিবেশনে গৃহীত হওয়ার পর ১৯৩০ সালের ২৬-শে জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। সেদিন লয়োলা কলেজের প্রায় তিনশো ছাত্র নিয়ে চরকাখচিত তেরঙ্গা হাতে মিছিলের নেতৃত্ব দেন সুন্দরাইয়া। কলেজ কর্তৃপক্ষ এই মিছিলের নিন্দা করলে এবং গান্ধী টুপি পরার বিপক্ষে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ ও আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। এই কলেজ ভিত্তিক আন্দোলন থেকে যে নেতৃত্ব উঠে আসে, তারা কিন্তু অচিরেই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ চিরাচরিত ভাবে অনুমোদিত গান্ধীবাদী আন্দোলন কৌশলের বাইরে যেতে নারাজ ছিল। অন্য অংশ, যার নেতৃত্বে ছিলেন সুন্দরাইয়া এবং ভি.কে. নরসিংহন, তাঁরা গান্ধীবাদী আদর্শকে সমাজতন্ত্রের লাল কাঁচের নিচে রেখে ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী ছিলেন। এই দ্বিতীয় অংশটি চেয়েছিল আন্দোলনকে আরও বৈপ্লবিক দিকে চালনা করতে। এখানে বৈপ্লবিক দিক বলতে অবশ্যই কমিউনিস্ট অর্থে বৈপ্লবিক এমনকি সশস্ত্র বিপ্লবী অর্থে বৈপ্লবিক বলা হচ্ছে না। ছাত্রনেতাদের এই অংশের ব্যাখ্যা ছিল, গান্ধীবাদী আদর্শ যে স্বাধীনতার কথা বলে তা নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়। গ্রামে গিয়ে গ্রাম সেবা করা, সমাজ সংস্কারে মন দেওয়া, সমাজের দলিত শ্রেণীর উন্নতি সাধন, অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন করা গান্ধীবাদী আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই গ্রামে গিয়ে কৃষক স্বার্থে কাজ করতে বা জাতপাত বিরোধী আন্দোলন করতে খুব কম ছাত্রেরই উৎসাহ ছিল। তাই সুন্দরাইয়ারা ছিলেন সংখ্যালঘু। এই বস্তবতা অবশ্য তাঁকে বিশেষ হতাশ করেনি। রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যে তিনি পড়ে ফেলেছেন। অনুমান করাই যায়, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ তিনি পড়েছিলেন।
১৯৩০-এর মার্চ মাসে পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষা না করেই সুন্দরাইয়া গ্রামে ফিরে যান। লক্ষ্য গ্রাম সেবা আর গান্ধীর অস্পৃশ্যতা বিরোধী হরিজন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নিজের গ্রামে দলিত সামাজিক অধিকার রক্ষায় তিনি গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করেন। স্থানীয় উচ্চজাতির ভূস্বামীরা এই প্রচেষ্টা স্বাভাবিক ভাবেই ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। পরিবারের তরফ থেকেও সুন্দরাইয়া নানা প্রতিরোধের মুখে পড়েন। একত্রে খাওয়া দাওয়া করার মাধ্যমে জাতিভেদের সামাজিক প্রাচীর ভাঙার জন্য সুন্দরাইয়ার সত্যাগ্রহ শুরু করেন। এই সত্যাগ্রহ গ্রামের নিম্নবর্গের জনতার ব্যাপক সহানুভূতি অর্জন করে। গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহী নেতা হিসেবে সুন্দরাইয়া গোদাবরী অঞ্চলে খুব দ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পশ্চিম গোদাবরী জেলার ‘সোধারা সমিতি’ তাঁকে এই জনপ্রিয়তার ভিত্তিতেই লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হলে তার নেতৃত্ব দিতে ডেকে নেন। এই সত্যাগ্রহে সংগঠক ও নেতা হিসেবে সুন্দরাইয়া তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। ‘জলের মধ্যে মাছের মতো’ গ্রাম থেকে গ্রামে তিনি কৃষকদের মধ্যে ঘুরতে থাকেন ও সংগঠিত করেন লবণ সত্যাগ্রহ পালনে, মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনে এবং জাতপাত বিরোধী আন্দোলনে। এই সময়েই তাঁর কানে আসে, ‘রেড্ডি’ নেতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে। জাতি পরিচিতির মধ্যে আটকে যাওয়া তাঁর একেবারেই অপছন্দ ছিল, এইসময় থেকেই তিনি জাতিসূচক উপাধি ‘রেড্ডি’ ত্যাগ করেন। সর্বত্র নিজের পরিচয় দিতে শুরু করেন ডাকনাম সুন্দরাইয়া ব্যবহার করেই। পুলিশের মধ্যে এই সময় তাঁর কুখ্যাতি বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। কুমুদাভাল্লি গ্রামে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে আসে। সুন্দরাইয়া ততদিনে অন্ধ্রের গ্রামাঞ্চলের গলিখুঁজি হাতের তালুর মতো চেনেন। যদি পালাতে চাইতেন, সহজেই পারতেন। কিন্তু গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের আদর্শ তখনও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাঁকে গ্রেফতার করতে পুলিশ এসেছে শুনে তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন। বিচারে দুই বছরের কারাদন্ড হল সুন্দরাইয়ার। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল তাঞ্জোরের ব্রষ্টেল জেলে।
ব্রষ্টেল কারাগারের জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন। কারাগারের অব্যবস্থা ছিল তুঙ্গে। খাবারের মান ছিল ভীষণ খারাপ। রাজনৈতিক বন্দি আর দাগী আসামীদের কোনও বিভাজন করা হতো না, আর পুলিশের মদতে খুনী, ডাকাত, চোরের সত্যাগ্রহীদের উপর অত্যাচার চালাত। রাজনৈতিক বন্দীদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে কারাগারের মধ্যে সুন্দরাইয়া বন্দিদের সংগঠিত করেন এবং বন্দীদের অধিকারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যান। এই আন্দোলন শেষে পরিণত হয় অনশনে। অনশন ভঙ্গ করার জন্য পুলিশ, সুন্দরাইয়া, যিনি তখনও আইনের চোখে নাবালক, তার উপর যে অকথ্য অত্যাচার করে, তার বিবরণ পড়লে শিউরে উঠতে হয়। সাধারণ নাক দিয়ে দুধ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা তো ছিলই, তা বিফল হলে জেলার আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেন। সুন্দরাইয়াকে চিত করে শোয়ানো হত, ছয়জন ওয়ার্ড বয়ের দুজন পায়ের উপর বসত আর দুইজন হাত চেপে ধরত। আরেকজন মুখের মধ্যে স্ক্রু-ড্রাইভারের মতো একটা যন্ত্র ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে দাঁত ফাঁক করে তাতে ফানেল ঢোকাত। এই ফানেল দিয়ে ভরে দেওয়া হত আধা-তরল খাদ্য। বন্দী গিলছে না, মনে করলে আবার জোর করে মুখ হাঁ করে একটা চামচ দিয়ে সেটা খাদ্যনালিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হত ধস্তাধস্তি করে। এইরূপ নারকীয় প্রক্রিয়া খুব স্বাভাবিক ভাবে অধিকাংশ বন্দিই সহ্য করতে পারেননি। সুন্দরাইয়াই একমাত্র বন্দী যিনি এই অকথ্য অত্যাচারের পরেও অনশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই অন্য সত্যাগ্রহীদের দিয়ে পুলিশ তার কাছে আবেদন করায়। তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ যে বজ্রকঠিন পি.এস. নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি হয়তো ধমক দিয়ে সহযোদ্ধাদের আবার লড়াইয়ে ফেরাতেন। কিন্তু আঠেরো বছরের সুন্দরাইয়া, খাতায় কলমে নেতা হলেও সহযোদ্ধাদের অনশন প্রত্যাহার করার আবেদন ফেরাতে পারেননি। সুন্দরাইয়া অনশন প্রত্যাহার করলেন বটে কিন্তু ব্রষ্টেল জেল এই বেয়াড়া বন্দির দায়িত্ব নিতে আর রাজি ছিল না। তাঁকে পাঠানো হল তিরুচিনাপল্লীর কারাগারে। এই জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্তও অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। পড়াশোনারও বন্দোবস্ত ছিল। সুন্দরাইয়া এই সময়েই হিন্দি আর উর্দু শিখে ফেলেন, প্রচুর উপন্যাস আর রাজনীতির বই পড়তে থাকেন। তাঁর বড়দা এই সময় হাই কোর্টে রিভিউ-এর মাধ্যমে তিনি নাবালক এই যুক্তিতে সুন্দরাইয়াকে রাজামুন্দ্রি সেন্ট্রাল জেলে সরিয়ে নিয়ে আসেন। সুন্দরাইয়া এতে প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছিলেন, এই প্রকার কোর্টে রিভিউ করে ছাড়া পাওয়ার প্রচেষ্টা সত্যাগ্রহী হিসেবে তাঁর সম্মানে কলঙ্কলেপন করবে বলে তাঁর মনে হয়েছিল। দাদা তাঁকে এই পদক্ষেপ নেওয়ার আগে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি ও জলের মতো টাকা খরচ করেছেন, এও ছিল তাঁর বিরক্তির অন্যতম কারণ। কিন্তু কিছু করারও ছিল না। অবশ্য একদিক থেকে এই জেলখানায় আসা তাঁর পক্ষে শাপে বর হয়েছিল। এই জেলেই তখন কারারুদ্ধ ছিলেন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত শিব ভার্মা, বিজয় কুমার সিনহার মতো বিপ্লবী। এনারা ভগৎ সিং-কে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন এবং হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান সংগঠনের নীতি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতেন। ভার্মার সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যে সুন্দরাইয়ার খুবই সখ্যতা তৈরি হয়ে গেল। বিপ্লবীদের সুন্দরাইয়া সব সময়ই শ্রদ্ধা করতেন। শিব ভার্মার থেকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতেন, তাঁদের আদর্শ কি, কর্মপদ্ধতি কি আর অন্যদিকে শিব ভার্মা গান্ধীবাদী রাজনীতির নিন্দা করলে প্রতিবাদও করতেন। ভার্মা বলতেন, তুমি যাই বলো, সমাজতন্ত্রই সঠিক পথ, গান্ধী নন। সুন্দরাইয়া সমাজতন্ত্র সঠিক পথ একথা মানতেন, কিন্তু সেই পথে হাঁটতে গেলে গান্ধীকে পরিত্যাগ করতে হবে, এই বক্তব্য তিনি তখনই মেনে নিতে পারেননি।
১৯৩১ সালের মার্চ মাসে গান্ধী-আরউইন চুক্তির প্রেক্ষিতে সত্যাগ্রহীদের মুক্তি দেওয়া শুরু হয়। সুন্দরাইয়াও এই সময় জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মায়ের কাছে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কলেজ শিক্ষায় যে ছেদ পড়েছে, তা আবার শুরু করবেন, পড়াশোনায় মন দেবেন। তবে এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে শিক্ষা শেষ করে রাজনীতি করার অনুমতিও তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন। পড়াশোনার জন্য তিনি ব্যাঙ্গালোরে ভগ্নিপতির নিকট চলে যান। ঠিক এই সময়েই তার সঙ্গে আমির হায়দার খানের সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার, যার বর্ণনা এই নিবন্ধের সূচনাতেই দেওয়া হয়েছে, তা অনুষ্ঠিত হয়। যে কাজ শিব ভার্মা পারেননি, সেই কাজ হায়দার খান পারলেন। খদ্দর পরিহিত, চরকা চালানো সুন্দরাইয়ার মনে আন্দোলনের পথ নিয়ে যে সংশয় দানা বাঁধছিল, কংগ্রেসের আপোষের রাজনীতি নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হচ্ছিল, ইউনিয়ন জ্যাক নিয়ে হায়দার খানের উদাহরণের পর তা প্রবল হয়ে ওঠে। বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্যই সুন্দরাইয়া ভগ্নিপতির বাড়ি ত্যাগ করেন। তিনি ঠিক করেন, গ্রামে গিয়ে আগে যেমন কাজ করছিলেন, আবারও সেইরকম কাজ করবেন। কিন্তু এবার নিছক সত্যাগ্রহী হিসেবে নয়, একজন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে।
গ্রামে ফিরেই সুন্দরাইয়া খবর পান আমির হায়দার খান গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি ঠিক করেছিলেন মাদ্রাজে গিয়ে হায়দার খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পার্টির সদস্যপদ তখনই নিয়ে নেবেন। তা আর হওয়ার ছিল না। দক্ষিণ ভারতে কমিউনিস্ট সংগঠন তখন ছত্রভঙ্গ। তাহলে করণীয় কি ? ১৯৩২ সালের মে মাসে সুন্দরাইয়া প্রথমে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ধন্যবাদ জানান। এই অবাধ্য ভাইটিকে পড়াতে আর বড়ো করতে দাদা কম টাকা ঢালেননি, তারপরেও বাড়ির দায়িত্ব না নিয়ে দেশের কাজেই সময় দিলে একবারও তিরস্কার করেননি, বরং জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য জলের মতো অর্থ ব্যয় করেছে। রাজনৈতিক কাজে সুন্দরাইয়া বড়ো ভাইয়ের কাছে যখন যা চেয়েছেন, তাই পেয়েছেন। এই ঋণ কিছু শোধ না করে আবার রাজনীতিতে নামা ছিল সুন্দরাইয়ার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তিনি নিজের ভাগের সম্পত্তি সব দাদাকে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। দাদা ভাইয়ের থেকে বিনামূল্যে সমস্ত সম্পত্তি নিতে অস্বীকৃতি হলে সুন্দরাইয়া খুব সামান্য জমি নিজের জন্য রেখে বাকি জমি নামমাত্র মূল্যে দাদাকে কিনে নিতে রাজি করান। এই কাজের জন্য পরে অনেকেই সুন্দরাইয়ার বিষয়বুদ্ধি কম বলে তিরস্কার করেছিল। কিন্তু এই কাজ না করে সুন্দরাইয়া নিজের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকতে পারতেন না। যাই হোক, সম্পত্তি বিষয়ে সব পিছুটান চুকিয়ে তিনি গ্রামের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দাদার থেকে নিজের ভাগের জমির যে টাকা তিনি পেয়েছিলেন, তা তিনি প্রথমেই খরচ করলেন একটি পাঠাগার, একটি সমবায় ন্যায্যমূল্যের দোকান আর একটি স্বল্পমূল্যের চিকিৎসালয় নির্মাণে। খেত মজুরদের শিশুদের তিনি অক্ষর শিক্ষা প্রদান শুরু করলেন। বিশেষ নজর দিলেন অস্পৃশ্য জাতিগুলির শিশুদের প্রতি, কারণ তাদের পাঠশালায় পড়ার কোনও অধিকার ছিল না। খেত মজুরদের মধ্যে জাতিভেদের ব্যবধান ঘুচিয়ে তাদের মধ্যে শ্রেণীচেতনা জাগরণ করতে ও শক্তিশালী করতে সুন্দরাইয়া সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। তিনি খেতমজুরদের সঙ্গে একত্রে থাকতেন, খাওয়া দাওয়া করতেন, মাঠের কাজে হাত লাগাতেন। পঁচিশ কেজির বস্তা তুলতে বা ঘন্টার পর ঘন্টা মাঠের কাজ করতে অনভ্যাসের ফলে সুন্দরাইয়ার ভীষণ কষ্ট হত। তবে জেলের অভিজ্ঞতা তাঁকে কষ্টসহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল করেছিল। অচিরেই তিনি খেতমজুর শ্রেণীর সহনশীলতা অর্জন করেন। তাঁরাও এই ‘পাগলা রেড্ডি’ (কারণ এক বর্ধিষ্ণু রেড্ডি চাষি পরিবারের ছেলের দলিত খেতমজুরদের সঙ্গে কাজ করা, গল্প করা আর খাওয়াদাওয়া করা পাগলামি ছাড়া আর কি ?)-কে অচিরেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। সুন্দরাইয়ার সঙ্গে বিনা সংকোচে ভাগ করে নিতেন সুখ দুঃখের নানা কাহিনী। গ্রামেরই ছেলে সুন্দরাইয়া, কিন্তু এমন এক নতুন গ্রাম সমাজের খুঁটিনাটি এই কালপর্বে তাঁর কাছে উন্মুক্ত হচ্ছিল, যা এতদিন তাঁর কাছে অজানাই ছিল। পরিচিত দৃশ্যও নতুন ভাবে দেখতে ও ব্যাখ্যা করতে শিখেছিলেন তিনি। এই সময়েই সুন্দরাইয়া পড়ে ফেলেন লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, ‘কি করিতে হইবে’ ইত্যাদি লেখাপত্র। তেলুগু ভাষায় তিনি ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’এবং সর্বোপরি ‘পুঁজি’ অনুবাদের কাজেও হাত দেন। নিজের মতো করে যা বুঝতেন, তিনি বুঝিয়ে দিতেন তাঁর নতুন খেতমজুর বন্ধুদেরও।
ক্রমে কভুর ও নেল্লোর তালুকে সুন্দরাইয়ার নাম ছড়িয়ে পড়ল। সুন্দরাইয়া, যার যাপন গান্ধীবাদী, কিন্তু রাজনীতি সাম্যবাদী। এই যাপন ও রাজনীতির এই সমন্বয় ছিল অপ্রতিরোধ্য। গ্রামের জমিদাররা স্বভাবতঃই প্রমাদ গোনেন। সুন্দরাইয়ার বিরুদ্ধে শুরু হয় ব্যাপক প্রচার শুরু। ভাগচাষিদের দেয় ফসলের পরিমাণ হ্রাস আর কৃষি শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সুন্দরাইয়া আন্দোলন শুরু করলে জমিদাররা বলেন, আজ এ বেতন বাড়ানোর আন্দোলন করছে, এই দাবী মেনে নিলে কাল খেত মজুরদের নিয়ে জমির দখল নেবে। সুন্দরাইয়া এই বক্তব্য শুনে জমিদার শ্রেণীর শ্রেণী চেতনার প্রচুর প্রশংসা করেন, কারণ সঠিক ভাবেই তারা বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। শ্রেণী অধিকার ও স্বার্থ এবং সেই স্বার্থ রক্ষার একই চেতনা যাতে ভাগচাষি, খেতমজুরদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে তাতে তিনি যত্নবান হন। জাতিপ্রথা বিরোধী আন্দোলনকেও তিনি এই জমির আন্দোলনের সঙ্গে রেখেছিলেন, আলাদা করেননি বা উপেক্ষা করেননি। বিশেষ করে গুরুত্ব দেন গ্রামের কুয়োর জল দলিত জাতিগুলির ব্যবহার করার অধিকারের উপর। প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে হলেও বহু গ্রামেই সুন্দরাইয়া সাফল্য পান। কারণ শ্রেণী প্রশ্ন ও জাতিভেদের প্রশ্ন সম্পর্কে তাঁর এত সূক্ষ্ম বোঝাপড়া ছিল, যে তিনি খুব কম কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি জাতিভেদের প্রশ্নকে বৃহত্তর শ্রেণী রাজনীতির প্রতিকূল শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে না দিয়ে সহজেই অনুকূল শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হতেন এবং অর্থনীতির লড়াই আর সামাজিক মর্যাদার লড়াইকে জুড়ে দিতে পারতেন।
১৯৩৪ সাল অবধি সুন্দরাইয়া এই গ্রামীণ আন্দোলনেই নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি সাম্যবাদী আন্দোলন সম্পর্কে খবরাখবর রখতেন, বোম্বের পার্টির পরিচিত মাধ্যমে নিজের কাছে নথিপত্র আর বইপত্রও আনিয়ে নিতেন, কিন্তু সরাসরি সদস্যপদ পাননি। কংগ্রেস কোনও স্থানীয় আন্দোলন বা সমাবেশ করলে তাঁকে আহ্বান করলেই সাহায্য পেত। সুন্দরাইয়ার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর শৃঙ্খলা ও কর্মতৎপরতা ছিল দেখার মতো। তাঁর অনেক বিপ্লবী বন্ধু তাঁকে প্রত্যক্ষ ভাবে এইসময় বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দিতে আহ্বান জানান। সুন্দরাইয়া ওই পথে একেবারেই আস্থা রাখতেন না, তাই বারে বারেই সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। বিপ্লবীদের তিনি অবশ্য সবসময়ই সাহায্য করতেন। অর্থ সাহায্য তো বটেই, আত্মগোপন করতেও তিনি অনেকবার তাদের সাহায্য করেন। নেল্লোর-কভুর অঞ্চলে সুন্দরাইয়ার এতোই প্রভাব ছিল, তিনি যাকে একবার আশ্রয় দিতেন, পুলিশ গ্রামের পর গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার খোঁজ পেতো না।
১৯৩৪ সাল, মাদ্রাজ। জামবাজার এলাকায় কমিউনিস্টদের এক গোপন মিটিং বসেছে। সদ্য কারামুক্ত আমির হায়দার খান মিটিং-এর মধ্যমণি। একদা যে যুবককে পার্টিতে আনার জন্য তিনি ব্যাঙ্গালোর অবধি ছুটে গিয়েছিলেন, তার শীতল আচরণ হসিমুখে সহ্য করেছিলেন, আজ সে স্বেচ্ছায় এসেছে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সাদরে তাঁকে ডেকে নিলেন আমির হায়দার খান। সুদরাইয়া জানালেন যে প্রস্তাব আমির হায়দার খান দিয়ে এসেছিলেন, তার উত্তর দিতে তিনি এসেছেন। উত্তর হলো, হ্যাঁ। তিনি প্রস্তুত। গান্ধী একদিক দিয়ে তাঁর জীবনের অংশ চিরকালই থাকবেন। যে যাপনের পাঠ গান্ধীবাদী রাজনীতি তাঁকে শিখিয়েছে, তা এখন তাঁর চরিত্রের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু তার পাশাপশি, দীর্ঘ তাত্ত্বিক অধ্যয়ন ও বাস্তব রাজনীতি তাঁকে শিখিয়েছে শিব ভার্মা বহুকাল আগে কারাগারে যা বলেছিলেন সেই কথাই ঠিক। সমাজতন্ত্রেই এই দেশের মুক্তি আর সেই মুক্তির সূত্র পাওয়া যাবে গান্ধীজির পথে নয়, মার্কসের পথে, লেনিনবাদের প্রয়োগে। মনে মনে সুন্দরাইয়া মার্কসবাদী হয়ে গেছিলেন বহুদিনই, আজ তাতে শিলমোহর পড়ল। হায়দার খান সানন্দে তাঁকে সরকারী ভাবে পার্টির সদস্যপদ প্রদান করলেন। তাঁকে অচিরেই দক্ষিণ ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু তার জন্য তাঁর বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না। কারণ তিনি জানতেন, দক্ষিণ ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন নির্মাণের ভার সুন্দরাইয়ার মতো মানুষকে তিনি অর্পণ করে দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাঁর এই বিশ্বাস ভ্রান্ত ছিল না।
কমরেড পি. সুন্দরাইয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ও সাম্যবাদী আন্দোলনে যে অবদান, তা সম্পর্কে কমবেশি অনেক কথাই আমরা জানি। কিভাবে তিনি ই.এম.এস নাম্বুদিরিপাদ, এ.কে. গোপালন, পি. কৃষ্ণ. পিল্লাই-এর মতো পরবর্তীকালের প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতাকে সংগঠনে নিয়ে এলেন, কিভাবে তিনি কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির মধ্যে কমিউনিস্ট গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুলিশের নজর এড়িয়ে ছায়ার মতো তাঁর সর্বত্র যাতায়াত, বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর ঝাঁপিয়ে পড়ে ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ এবং সর্বোপরি তেলেঙ্গানা কৃষক সংগ্রামে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা যথেষ্ট আলোচিত হয়। অনালোচিত থেকে যায় দুটি প্রশ্ন। কোন আন্দোলন সংগ্রামের আগুনে পুড়ে পি.এস.-এর মতো একটি ইস্পাত সম মানুষ তৈরি হলো ? কোন প্রক্রিয়ায়, কোন রাজনৈতিক যাত্রাপথ ধরে স্বদেশের মুক্তির পথ খুঁজতে খুঁজতে তিনি গান্ধী থেকে মার্কসে এলেন ? সেই প্রশ্নে সামান্যতম আলোকপাতও যদি এই প্রবন্ধ করে থাকে, তবেই এই লেখা সার্থক মনে করব। আজ ৭৭-তম স্বাধীনতা দিবসে জাতীয়মুক্তির তপস্বী পি. সুন্দরাইয়ার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ‘স্বাধীনতা’ একটি একক ঘটনা নয়, এটি আদতে একটি দীর্ঘমেয়াদী আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে দিয়েই শেষ হয়ে যায় না। বরং তা এই প্রক্রিয়ার সূচনামাত্র। তাই স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যখন ১৯৪৭-এলো, তখন তিনি ‘কাজ শেষ’ বলে আত্মতুষ্ট হয়ে বসে পড়লেন না। বরং তেলেঙ্গানা কৃষক সংগ্রামের মাধ্যমে সচেষ্ট হলেন সেই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, পূর্ণতা প্রদান করার। তাঁর উদাহরণ আমাদের অনুপ্রাণিত করুক বহু আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে তাকে সার্থক করে তোলার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে, স্বাধীনতার প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই হবে পি.এস-এর স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।