ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
রুশ বিপ্লব পরবর্তী সময়কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে সারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম হলেন আন্তোনিও গ্রামশি। ১৮৯১ সালের ২২শে জানুয়ারি আন্তোনিও গ্রামশীর জন্ম হয়, ইতালির দক্ষিণ অংশে অবস্থিত এক ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ – সার্দিনিয়ায়।
গ্রামশি পদবীটি এসেছে “গ্রামস” শব্দ থেকে যার সাহায্যে আলবেনিয়ার মধ্য-পূর্ব অঞ্চলের এক ছোট শহরকে বোঝানো হয়। অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে বহু পথ ঘুরে গ্রামশি পরিবার সার্দিনিয়ায় এসে বসবাস করতে শুরু করে। পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার সংকট মোকাবিলায় ১৯০৪ সালে তাকে পড়াশোনা ছেড়ে নানা কাজে যুক্ত হতে হয়েছিল। ছোটবেলার সেইসব কঠিন জীবনযাত্রা তার শরীরে যন্ত্রণার স্থায়ী চিহ্ন গেঁথে দেয়। শিরদাঁড়াতে টিউবারকিউলিসিসের সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় পিঠে একটা আস্ত কূঁজ নিয়েই সারা জীবন তাকে চলাফেরা করতে হয়েছে, স্বাস্থ্য এমনই যাকে রুগ্ন বলাই সঠিক।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শেষ করে মেধাবী ছাত্র হিসাবে ১৯১১ সালে স্কলারশিপ পেয়ে তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের এক অনন্য ছাত্র হয়েও দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে গভীর চর্চা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই। পুঁজিবাদী সমাজ সম্পর্কে নিজস্ব স্বকীয়তায় মার্কসবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করলেন গ্রামশি। ১৯১৩ সালে যুক্ত হলেন ইতালির সমাজতান্ত্রিক (সোশ্যালিস্ট) দলে। পার্টির মধ্যে মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক কর্তব্যের বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্কে নেতৃত্ব দিলেন, প্রতিষ্ঠিত হলেন সর্বহারা বিপ্লবের নেতা হিসাবে। একইসাথে শ্রমিকদের কাউন্সিল গড়ে তুলে ১৯১৯-১৯২০ সালে বিরাট ধর্মঘট সংগঠিত করলেন যার প্রভাবে ইতালির সর্বত্র শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার দেখা দিল।
পরবর্তীকালে যদিও ফ্যাক্টরি কাউন্সিল আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এই ব্যার্থতা থেকে গ্রামশিকে রাষ্ট্র বিপ্লবে লেনিনীয় রণকৌশলের যথার্থতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। ১৯২২ সালে তিনি ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে রাশিয়ায় গেছিলেন। সেখানেই বেহালা বাদিকা জুলিয়া স্ক্যুল্ট-এর সাথে তার পরিচয় হয়, তারা একে অন্যকে ভালোবেসে বিবাহ করেন। ১৯২৪ সালে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন এবং ল্যুনিতা (ঐক্য) নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করলেন।
১৯২৬ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারের সর্বাধিনায়ক বেনিতো মুসোলিনির উপরে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ হয়েছে, এই অজুহাতে ইতালির সরকার কমিউনিস্ট পার্টির উপর ভয়ঙ্কর নিপীড়ন নামিয়ে আনে। ফ্যাসিস্ট পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার পরে বিচারের সময়ে গ্রামশি’র শাস্তি দাবী করতে গিয়ে করে সরকারি উকিল বলেছিলেন “আগামী ২০ বছরের জন্য এই মস্তিস্কটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে হবে”। কয়েক মিনিটের বিচারে ফ্যাসিস্ত আদালত যাকে কুড়ি বছরের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করে। শাস্তি ঘোষণার এগারো বছর পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সাতদিনের মধ্যেই ছেচল্লিশ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
বিচারে শেষে কারাবাস শুরু হয়, সাথে চলে ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। দুর্বল স্বাস্থ্য ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকে। জেলে থাকতে গ্রামসি ৩০ টি নোটবুকে মোট ২৪৪৮ পাতার কারাবাসের দিনলিপি লেখেন। জেলখানার সেন্সরশিপ এড়াতে গ্রামশি’কে মার্কসবাদী দর্শনের অভিধানে নতুন শব্দ যোগ করতে হয়েছিল। ফ্যাসিস্ত আদালত তার মস্তিষ্ককে নিষ্ক্রিয় রাখতে চেয়েছিল, বহু নির্যাতনে তার শরীর ভেঙ্গে পড়লেও মস্তিষ্কটি সচল ছিল বলেই এহেন কঠিন কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। তার রচনায় ব্যবহৃত নতুন শব্দগুলি আজকের পৃথিবীতে মার্কসবাদীদের গবেষণার বিষয়, চর্চার বিষয়।
গ্রামশির শ্রমিক-কৃষক জোটের তত্ত্বটিই ইতিহাসে লিঁও থিসিস নামে খ্যাত, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে প্রকাশিত গ্রামশীর শেষ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘সাউদার্ন কোয়েশ্চেন’ (ইতালির অনুন্নত দক্ষিনপ্রান্তের মানুষকে সংগ্রামে যুক্ত করার সমস্যা)। অনেক পরে এই প্রবন্ধটি উদ্ধার করে পুনরায় প্রকাশ করা হয়। ইতালিতে মেহনতি জনগণের সব অংশের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যস্থাপনে ‘রিসর্জিমেন্তো’ নামক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠায় একের পরে এক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, পন্ডিতেরা দেওয়ালে মাথা ঠুকতেই শুধু বাকি রেখেছিলেন – কিছুতেই কেউ কোন সমাধান দিতে পারেন নি, গ্রামশি সেই সমস্যারই সমাধানসুত্র দিয়ে গেলেন। শ্রমিক-কৃষকদের সংগ্রামী ঐক্যই হল সেই রাস্তা। ইতালির নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ–লেনিনবাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগেরই নাম গ্রামশীর লিঁও থিসিস।
ইতালিতে সর্বহারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রতিবিপ্লবী ফ্যাসিস্ত শক্তির কাছে পরাজিত হয় ঠিকই কিন্তু একইসাথে প্রমানিত হয় গ্রামশির বিকল্প কর্মসূচিই সঠিক ছিল। গ্রামশির আগে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমেদেও বর্দিগা, তার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবাদের বিপদকে ছোট করে দেখে (তখনও বেনিতো মুসোলিনি ক্ষমতা দখল করেন নি, এদিক ওদিক নিজের গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে আতংক প্রচারের কাজ করছেন) – একে একটি সাময়িক রাজনৈতিক উত্তেজনার ফলশ্রুতি হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়, সেই অনুযায়ী অপর্যাপ্ত প্রতিরোধ কর্মসূচী গ্রহন করা হয়। সোজা কথায় নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিস্ট বিশ্লেষণে ব্যর্থ হয় বর্দিগার কর্মসূচী – ফ্যাসিবাদ জিতে যায়। আজকের পৃথিবীতে মুক্তচিন্তার মালা জপে বাম রাজনীতির ঐক্যে আঘাত করতে চান এমন বিশিষ্টদের লেখায় একটা প্রবনতা থাকে যেন গ্রামশি’র বামপন্থা এবং লেনিনের কমিউনিস্ট কর্মসূচী আলাদা। প্রকৃত সত্য এর একশো আশি ডিগ্রি বিপরীত। গ্রামশি লেনিনের শিক্ষাকেই আরও গভীর অর্থে সম্প্রসারিত করেছেন, গ্রেপাত্র হওয়ার আগে অবধি ইতালির নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করেছেন।
উন্নত পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পুঁজিবাদকে একটি কর্তৃত্বকামী আধিপত্যবাদী ব্যবস্থা (Hegemony) হিসাবে তুলে ধরে তিনি প্রমান করলেন অর্থনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়াও পুঁজিবাদ নিজের স্বপক্ষে সমাজে কিছু নির্দিষ্ট ধারণা ও সেই অনুসারি নৈতিকতারও একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পুঁজিপতিদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার সাথে জনজীবনে এইসমস্ত ধারণা এবং নৈতিকতার অভ্যাসগুলি চাপিয়ে দিয়ে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা নিজেকে একটি স্বাভাবিক, ন্যায়সঙ্গত রূপ হিসাবে জনসাধারণের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে থাকা পুঁজিবাদকে চূড়ান্ত আঘাত করার আগে প্রথমে আঘাত হানতে হবে বুর্জোয়া ব্যবস্থার হয়ে ঢাক পেটানো বাহিনীর উপরে। পুঁজিবাদ নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে তার চারদিকে পেটোয়া বাহিনীর পরিখা খনন করে রাখে, প্রথমে পেরোতে হবে সেই বাধা। এটাই গ্রামশির চিন্তাধারার মূল কথা।
ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি বুঝতে পারে ব্যাপক নিপীড়ন নেমে আসতে চলেছে, গ্রামশি’কে মস্কো কিংবা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। তিনি নিজে সেই পরিকল্পনা খারিজ করে ইতালিতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সব জেনেও কেন এমন আত্মহনন বলে মনে হতে পারে – এই প্রশ্নের উত্তর আন্তোনিও গ্রামশি নিজেই দিয়ে গেছেন। জেলে বসে তার রচনাসমূহ গোপনে বাইরে আনেন তার শ্যালিকা তাতিয়ানা। সেইসব লেখা পরে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা, গ্রামশির খুব কাছের বন্ধু কমরেড তোগলিয়াত্তিকে দিয়েছিলেন তাতিয়ানাই।
……‘ডুবতে থাকা জাহাজের ক্যাপ্টেনের উচিত সকলের পরে জাহাজ ছেড়ে যাওয়া। যতক্ষণ না সকল যাত্রী নিরাপদে অন্যত্র স্থানান্তরিত হচ্ছেন ততক্ষন অবধি তাকে জাহাজে থাকতেই হবে। কেউ এমনও মনে করেন ডুবন্ত জাহাজের সাথেই ক্যাপ্টেনের সলিল সমাধি হওয়া উচিত। যতই উদ্ভট শোনাক এই কথা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নয়’
গ্রেপ্তারি এড়িয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে অস্বীকারের যুক্তি হিসাবে এই কথাগুলিই ছিল তার বার্তা।
গ্রামশি বুঝেছিলেন তিনি বেরিয়ে যেতে পারলেও ইতালির সর্বহারা – মেহনতি জনগণের কোথাও যাওয়ার নেই, যতক্ষণ না তার বুঝবেন তাদের নিজেদের দেশে গ্রামশির থাকা নিরাপদ নয় তার আগে চলে যাওয়ার অর্থ হবে জনগণের মনে ভয়ের উদ্রেক হতে সাহায্য করা। প্রকৃত বিপ্লবী ছিলেন বলেই নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও আশাবাদী ছিলেন – সিনেমার নায়কের মতো অ্যাডভেঞ্চার কমিউনিস্ট বিপ্লবীকে মানায় না। সিনেমার নায়ক সর্বদা জিতলেও জনগণের সংগ্রামের নায়ক কখনো কখনো ব্যর্থ হতে পারেন। তাহলেও শেষ অবধি তিনি জনগণের স্বার্থকেই নিজের স্বার্থ বলে মনে করেন, এখানেই গ্রামশির সংগ্রাম নতুন ইতিহাস রচনা করে, এখানেই নিহিত থাকে গ্রামশির উত্তরাধিকার।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ