Neo Liberalism and Neo Fascism Cover

Neo-Liberalism and Neo-Fascism

প্রভাত পটনায়েক

আমার আলোচনার বিষয়বস্তু নয়াউদারবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদ। সারা পৃথিবী জুড়েই একটা ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সম্পন্ন আন্দোলনের উত্থান ঘটেছে। নিজের বক্তৃতায় কমরেড সীতারাম সঠিকভাবেই প্রসঙ্গটির উল্লেখ করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে তাদেরকেই বিশেষ সম্ভবনাময় বলে মনে করা যায়। এধরণের আন্দোলনগুলিকে উদারবাদীরা কিছুতেই ফ্যাসিস্ট বলেন না, তাঁরা একে জাতীয়তাবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, পপ্যুলিস্ট, দক্ষিণপন্থী পপ্যুলিস্ট ইত্যাদি সব বলেন – কিন্তু কখনোই ফ্যাসিস্ট বলেন না, এবং সবসময় রাজনৈতিক কারণেই এর উত্থান বলে ধরে নেওয়া হয়, এমনটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও সত্যি। মোদীর উত্থানের কারণ বলে মনে করা হয় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে, বিজেপির উত্থানের মূল রাজনৈতিক কারণ হিসাবে আদবানীর রথযাত্রাকে মনে করা হয় – ইত্যাদি আরো নানাবিধ কারণ।এগুলি অসত্য নয়।

কিন্তু সারা বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার সৃষ্টি হওয়ার কারণ হিসাবে শুধু এটুকুই বলা চলে না।

ইতালিতে মেলোনি, যিনি ফ্যাসিবাদী উত্তরাধিকার বহন করছেন, তিনি বাস্তবেই সরকার গঠন করে ফেলেছেন। জার্মানীতে এএফডি, অল্টারনেটিভস্ ফর জার্মানি দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তিশালী দল। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প আবার জনসমর্থন জোগাড় করছেন, একবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও তিনি আবার ক্ষমতা দখলের জন্যে নেমেছেন। তুরস্কের কথাও বলা চলে। যেখানে এর্দোয়ানে মসনদে বসে আছেন।সারা বিশ্বেই এটা ঘটছে,‌ভারত কোনো ব্যতিক্রম নয়।

যদি এসবকিছু নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ আন্দোলনই হয়ে থাকে, তাহলে তা কখনো একটি দেশের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, কিন্তু সেটা বাস্তব নয়। যদিও সেই বিশেষ পরিস্থিতি এটাও বুঝিয়ে দেয়, যে কতদূর এই আন্দোলনের বিস্তার- আবার সমস্ত বিশ্বের ক্ষেত্রে একই- এমন কোনো সাধারণ বিষয়ও কারণ হিসাবে কাজ করতে পারে।

এগুলির কোনোটিকেই ফ্যাসিস্ট বলা হয় না, সেটা একটা অসাধারণ বিষয়, ফ্যাসিবাদের প্রায় প্রতিটি বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও, যে সকল প্রবনতা ১৯৩০-র দশকে লক্ষ্য করা যায়- সেসব এখনো আছে, নানানভাবে। বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি? কোনো একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা, মুসলিম, উদ্বাস্তু কিংবা চামড়ার রং – যে কোনো একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় – তাদের ঘৃণার বস্তুতে পরিণত করা। এদের আক্রমণ করা হবে এবং এদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ ঐক্যবদ্ধ হবে। এটা ফ্যাসিবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয়ত, এটা দমনমূলক স্বৈরতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, যদিও দমনের স্বার্থে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতাকে এঁরা ব্যবহার করতে চান না, বরং রাস্তায় সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করার জন্য ফ্যাসিবাদী রাস্তা দখলকারী অসামাজিক কর্মীবাহিনীকে ব্যবহার করতে চান। উদাহরণ হিসাবে বলা চলে শিক্ষকদের ওপর হামলা চলছে, এভিবিপি’র গুন্ডারা সরাসরি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছে যাতে চরম হেনস্থা করা যায়। রাস্তার মোড়ে জটলা পাকিয়ে থাকা গুন্ডাবাহিনী এবং দমনমূলক রাষ্ট্রক্ষমতার একটি সংমিশ্রণ ফ্যাসিবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। এছাড়া একচেটিয়া পুঁজির সাথে ফ্যাসিবাদের যোগাযোগও এই বন্দোবস্তের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। শেষ পর্যন্ত, অতন্দ্র ক্ষমতাশালী একজন ব্যক্তির উত্থান ঘটে, এগুলির সবকটাই আমরা নিজেদের দেশেও দেখছি‌‌।

ভারতীয় ফ্যাসিবাদের ভিতর সমস্ত ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ব্যাপকভাবে আছে, হিটলার বাস্তবিকভাবে বলতেন ১০০০ বছর রাইখের ক্ষমতার কথা, এখন মোদী বলেছেন ১০০০ বছর হিন্দু রাজের কথা। ১৯৩০ থেকেই ফ্যাসিবাদকে কেবল একচেটিয়া পুঁজি নয়, তার একটি বিশেষ অংশের সাথে লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে,‌জার্মানীতে ফ্যাসিবাদ ক্রুপস, আর্মামেন্ট, স্টিল ইত্যাদির সঙ্গে নিবিড় নৈকট্য বজায় রাখত। একচেটিয়া পুঁজি কিন্তু টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতেও বিশেষ ক্ষমতাধর ছিল, তারা সাহায্যও পেত কিন্তু তাদের যোগাযোগ এতটা নৈকট্যের ছিল না। জাপানে জ্যইবাৎসু একচেটিয়া পুঁজির সাথে ফ্যাসিবাদের যোগাযোগ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে একটি বিশেষ অংশের একচেটিয়া পুঁজি, যাকে শিঙ্কোজ্যইবাৎসু বলা হত,যেমন নিসান, তার সাথে মিলিটারি ফ্যাসিবাদের উত্থানের একটি ব্যাপক যোগাযোগ ছিল। একইভাবে, ভারতেও, একচেটিয়া পুঁজির পুরানো উপাদানগুলোর চাইতে, নতুন উপাদানগুলোর সাথে মোদী শাসনের যোগাযোগ বেশি, সকলেই তা নিয়ে আলোচনা করছেন।

তবুও, প্রশ্নটা হল, সারা বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদী উত্থানের কারণ কী? ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সমস্ত আধুনিক সমাজে আছে, আবার মুক্তচিন্তার প্রবণতাও আছে। ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় আসে যখন জনসমর্থন, মিডিয়ার সমর্থন, একচেটিয়া পুঁজির নতুন অংশটির সমর্থন মেলে। কেন একচেটিয়া পুঁজি এই বৈকল্য পূর্ণ নিকৃষ্ট রাজনৈতিক অংশটিকে ক্ষমতায় আনতে চায়? এটা তখনই হয় যখন পুঁজিবাদ, এবং একচেটিয়া পুঁজি একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৩০ এমন একটি সময় ছিল, গ্রেট ইকোনমিক ডিপ্রেশন, এবং তার পরবর্তীতে ব্যাপক এবং অনিয়ন্ত্রিত কর্মী ছাঁটাই, বেকারত্বের পরিস্থিতি – এবং সেই পরিস্থিতিতে একচেটিয়া পুঁজি নিজের আধিপত্যের বিপক্ষে ওঠা প্রশ্নগুলো প্রশমনের জন্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতা গুলোর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।

পোলিশ অর্থনীতিবিদ, মার্ক্সবাদী, মিখাইল কালেস্কি, ১৯৩০ এর ফ্যাসিবাদী উত্থানকে বড় ব্যবসা ও ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকেন্দ্র গুলোর মধ্যেকার সম্বন্ধ হিসাবে দেখেছেন। আজকের পৃথিবীতেও অনেকটা একইরকম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংকটের জন্যই নয়া ফ্যাসিবাদী উত্থান সম্ভব হচ্ছে। কেন আমি নয়া ফ্যাসিবাদী বলছি তার ব্যাখ্যায় আমি পরে আসব।

গোটা উদারনৈতিক বক্তব্য আসলে নিও লিবারালিজম‌‌ ও নিও ফ্যাসিজমের মধ্যেকার সম্পর্কটা বুঝতে দিতে চায় না, তারা এটাকে একটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ হিসাবেই চিন্হিত করে। এটাই তাঁরা বলতে চান যে নয়া উদারবাদ খুবই ভাল ব্যবস্থা, খারাপ হল কেবল ফ্যাসিবাদ। তাই, আমার তর্কটি হল, যা অবশ্যই দিমিত্রভের সপ্তম কমিন্টার্নের তর্কের অনুষঙ্গেই, আমি বলব যে নির্দিষ্ট সংকটের সময়েই ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়। ফ্যাসিবাদকে দিমিত্রভ বলেছিলেন: সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির খোলামেলা সন্ত্রাসী একনায়কতন্ত্র। নয়াউদারবাদ যে সংকটাপন্ন তা অবশ্যই জানা কথা। যদি মার্কিন হাউসিং বুমের পতনের পরবর্তী সময়টাকে খেয়াল করা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশের সূচক যদি দশক অনুযায়ী খেয়াল করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সবচেয়ে কম লাভজনক দশক ছিল ২০১৯ পর্যন্ত। খুবই স্পষ্ট হয়ে যায় এতে যে বেকারত্বের বর্ধিত হার এবং বৃদ্ধিহারের মন্দগতি এসময় পাশাপাশি চলেছে।

এটা বিস্ময়কর নয় যে নয়া উদারবাদের ক্ষমতায় থাকার সময়ের যে ব্যাপক বৈষম্য এবং মজুরির স্থিতাবস্থার ভিতর নয়া ফ্যাসিবাদের বিপদ লুকিয়ে আছে। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও যার ব্যতিক্রম হয়নি, স্বভাবতই, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তার অবস্থা আরোই খারাপ কারণ এখানে ব্যাপক সংখ্যায় বেকার শ্রমশক্তি আছে, উন্নত দেশগুলোতেও এখন মজুরির সূচক করা হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের ভিত্তিতে- ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন আক্রান্ত হয়েছে – আমেরিকার ট্রেড ইউনিয়ন গুলোকে বলা হয় যে আপনারা রাস্তায় নামবেন? আমরা কারখানাগুলোকে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠিয়ে দেব! পুঁজির অবাধ যাতায়াত আসলে একটি দেশের শ্রমিকশ্রেণিকে অপর দেশের শ্রমিকদের দেখিয়ে নিরস্ত্র করে রাখতে পুঁজিবাদের সহায়ক হয়। ফলতঃ তৃতীয় বিশ্বের অগুন্তি শ্রমিকের সুলভতাকে দেখিয়ে বছরের পর বছর মজুরি উন্নত দেশগুলোতেও একই জায়গায় রেখে দেওয়া যায়। জোসেফ স্টিগলিৎস যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তিনি একটা হিসেব কষেছিলেন যে ২০১১ সালের একজন পুরুষ আমেরিকান কর্মীর আসল মজুরি ১৯৬৮ সালের তুলনায় বেশি ছিল না, বরং সামান্য কম ছিল। এতে বোঝা যায় মজুরির স্থিতাবস্থার বাস্তবিক দিকটা। যদিও সর্বত্রই উৎপাদন বাড়ছে, শ্রমিকের কর্মদক্ষতাও – যা তিনি তৈরি করছেন সেটা বাড়লেও বাড়ছেনা মজুরি। উদ্বৃত্ত পুঁজি প্রতিটি দেশে ও গোটা দুনিয়ায় বাড়ছে, এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন মজুরি ও উদ্বৃত্তের মধ্যে সঙ্গতি থাকেনা তার মানে গড় চাহিদার হ্রাস, গোটা শ্রমিক শ্রেণির মজুরিটাই প্রায় উদ্বৃত্তের ঝুলিতে জমা পড়ছে, আর একটি ছোট্ট অংশকে সঞ্চয় বলা হচ্ছে।

তাই, পুঁজিবাদী সময়ে সমস্ত বৈষম্যের বৃদ্ধি আসলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদনকে নির্দেশ করে। এই নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করা যায়,‌ নানান অ্যাসেট প্রাইস বুমসের মাধ্যমে, যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে। ডট কম বুদবুদের মাধ্যমে ডটকম কোম্পানী গুলোর একুইটি, দাম ইত্যাদি বেড়েছে – যার ভিতর দিয়ে মানুষ তুলনায় বড়লোক হয়ে গেছেন এমন বোধের সৃষ্টি করা হয়েছে। যেই মাত্র তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ কিনতে শুরু করেছেন ডট কম বুদবুদ ফেটে যাচ্ছে। অ্যালেন গ্রিনস্প্লান, যিনি আমেরিকার ফেডারাল রিজার্ভের মাথায় ছিলেন তিনি আরেকটা বুদবুদ তৈরি করেন – হাউজিং বুদবুদ, যার কারণে আমেরিকায় ও বিশ্বে অর্থনীতি কিছুদিনের জন্য চলছিল। যা এই বুদবুদ গুলো করে তা হল কৃত্রিঙভাবে দাম বাড়িয়ে দেখায়, তাই যারা অ্যাসেটগুলো কিনেছেন তারা বড়লোক হিসেবে নিজেদের মনে করেন এবং আরো কিনতে থাকেন।

হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট সংক্রান্ত আর্থিক উন্নয়নের বুদবুদ ফেটে যাবার পর আর কোনো বুদবুদ নিয়ে আসা অবশ্য হয়নি। যদিও এও সত্যি কথা যে আমেরিকায় সুদের হার, কমসময় ও বড় সময়ের ধারের ক্ষেত্রে, কার্যত শূন্য। কারণ মানুষ আসলে বুঝতে পারছেন, তারা ভেবেছিলেন যে তারা বড়লোক – কিন্তু বুদবুদ ফেটে গিয়ে তাদের ভ্রান্তি কেটে যাচ্ছে। তাই তারা আরো আন্দাজ করার ক্ষেত্রে আরো সচেতন হয়ে যাচ্ছেন।

বুদবুদ আসল নয়। পৃথিবীর অর্থনীতিকে সমতায় আনার বদলে তা স্থিতাবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। এই স্থিতাবস্থা অবশ্যই বিশ্বের লগ্নী পুঁজির আধিপত্যের কাছে একটা ভয়ের কারণ। কারণ এতে করে মানুষ বলতে পারেন – এত বেকারত্ব কারণ কল্যাণকামী রাষ্ট্র নেই – বরং কল্যাণকামী রাষ্ট্র ফিরিয়ে আনা হোক। বরং কাজের জন্ম দেওয়া হোক গড় চাহিদার বৃদ্ধি ঘটিয়ে, রাষ্ট্রীয় খরচে। এই পরিস্থিতিটা একচেটিয়া পুঁজি এড়াতে চায়, তারা চায় না নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতি বা লগ্নি পুঁজির বিশ্বজোড়া আধিপত্যের প্রতি কোনো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হোক। এটা এক্ষুনি কোনো সমাজতান্ত্রিক ভয়ের কারণ না হলেও এমন পরিস্থিতি জন্ম দেয় যা এই বন্দোবস্তের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করে। কেউ বলতে পারে যে ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ছিল, সমাজতান্ত্রিক ভয়ের একটা বাস্তবতা ছিল, এখন এতই স্বল্পসংখ্যক সমাজতান্ত্রিক দেশ আছে, পুঁজিবাদ একেবারেই প্রশ্নাতীত অবস্থানে, এখন কেন ফ্যাসিবাদী ঝোঁক উৎপন্ন হচ্ছে?

ভয়টা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া থেকে না এলেও মানুষের বাড়তে থাকা বাস্তবিক চাহিদা আসলেই নীতির বদলে চাপ সৃষ্টি করছে। যা কিছুতেই নয়া উদারবাদী কাঠামোর মধ্যে দিয়ে সমাধান করা যায় না। সেজন্যই নয়া উদারবাদ ও লগ্নি পুঁজির আধিপত্যের বিকল্প খোঁজা চলছে। এটাই তাদের চিন্তার বিষয়।

এটাই কিন্তু নয়া ফ্যাসিবাদী প্রবণতার দিকে ঝুঁকতে থাকার কারণ, যার মাধ্যমে নিও লিবারাল ডিসকোর্সকে বদলে দিয়ে – মানুষের জীবনের সাথে জুড়ে থাকা সমস্যা – বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতির হার, বা আরো নানাবিধ বস্তুগত অবস্থা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে ইহুদি বিদ্বেষ, মুসলিম বিদ্বেষ, উদ্বাস্তু বিদ্বেষ বা কালো মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণায় মানুষকে নিয়োজিত করতে চায়। অবশ্যই, প্রতিটি ঘৃণার ঘটনা শ্রমিকদের বিভাজিত করে, বাড়তে থাকা প্রশ্নমালাকে দুর্বল করে।

আবার, ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদ এবং নিও ফ্যাসিজমের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় এসে বেকারত্ব কমায় ও চাকরি দেয়। সত্যিই জাপানে মিলিটারি ফ্যাসিবাদ গ্রেট ডিপ্রেশনের সমস্যা অনেকটা কমিয়ে এনেছিল। জাপানে সমস্ত মানুষের প্রায় চাকরি হয়ে গিয়েছিল। জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর সকলের চাকরি হয়, এবং একাজ করা হয়েছিল মিলিটারির ব্যয় বাড়িয়ে এবং সরকারের ঋণ বাড়িয়ে। একটি ফ্যাসিবাদী সরকার যদি সমস্ত টাকার বেশিটাই মিলিটারি খাতে দেয়, তবেই এটা হতে পারে, যদিও তার অর্থ হল যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেই ফ্যাসিবাদ কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যার একটি বিশেষ ধরণের সমাধানের চেষ্টা করছিল, সামরিকীকরণের মাধ্যমে। আরেকটা পদ্ধতি রুজভেল্ট আমেরিকায় প্রয়োগ করেছিলেন, সরকারি ব্যয় বাড়ানো, মিলিটারির ব্যয় না, সাধারণভাবে রাস্তাঘাট তৈরি, উন্নয়নকামী উদ্দেশ্যে ব্যয়।

কিন্তু এই নয়া চুক্তি বা ডিল আমেরিকার একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের পক্ষ থেকে বিরোধ করা হয় এবং সাথে সাথে তা প্রত্যাহৃত হয়। তাই ১৯৩৭ এ আরেকটি সংকট যুক্তরাষ্ট্রে দানা বাঁধে এবং উদারবাদী পক্ষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এ থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তা পায়নি। তাই, কথাটা হল যে ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের সুবিধা হল এই যে কোনো একটি অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরোনোর রাস্তা তাদের জানা। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ এর মধ্যে হিটলারের জনসমর্থন তাই ক্রমান্বয়ে বেড়েছিল, কারণ তারা গ্রেট ডিপ্রেশনের থেকে বেরোনোর একটা রাস্তা দেখাতে পেরেছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক ফ্যাসিবাদ, যাকে আমরা নয়া ফ্যাসিবাদ বলছি, তারা কিন্তু সেই অবস্থায় নেই। কারণ হল, সরকার যদি চান গড় চাহিদা বাড়াতে পারেন, তারা খরচগুলো নিজেরা দিয়ে দিতে পারেন – এটা হতে পারে রাজস্ব ঘাটতির মাধ্যমে – যার মানে যদি ১০০ টাকা খরচ হয় এবং কারো উপর কর চাপানো না হয়, অর্থাৎ যদি সাধারণ মানুষের আয় ও ব্যয় অপরিবর্তিত থাকে। অন্যথায়, যদি বড়লোকদের উপর কর চাপানো হয়, যদি বড়লোকদের থেকে ১০০ টাকা নেওয়া হয় যার থেকে উদাহরণ হিসাবে বলা চলে, ৫০ টাকা সরকার ব্যয় করল, তাহলেও গড় চাহিদার একটা বৃদ্ধি দেখা যাবে। কিন্তু যদি শ্রমজীবীর উপর কর চাপে – তাহলে যেহেতু তাদের আয়ের বৃদ্ধি নেই, তাই গড় চাহিদার বৃদ্ধি হতে পারবে না। এতে শুধু শ্রমজীবীর চাহিদা হ্রাস ও রাষ্ট্রের চাহিদা বৃদ্ধি হতে পারে মাত্র। নেট বৃদ্ধি হবে না।

তাই, শুধু দুটো পথই আছে।‌ হয় রাজস্ব ঘাটতি করে সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে আথবা ধনী ও পুঁজিপতিদের ওপর কর চাপিয়ে। যা ইতিমধ্যেই আমরা উল্লেখ করেছি। এই দুটো পথই কিন্তু লগ্নি পুঁজি বিরোধ করে থাকে। এখন যেহেতু জাতিরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি উভয়ের অস্তিত্বই আছে, যে জাতিরাষ্ট্র লগ্নি পুঁজির সুবিধা দেখছে না, পুঁজি সেই‌ রাষ্ট্রকে পরিত্যাগ করতে পারে। তাই, যে দুই পথে নেট গড় চাহিদা বাড়ানো যেত, তা খারিজ হয়ে ।

তাই, উদার বুর্জোয়া দল দ্বারা পরিচালিত বা নয়া ফ্যাসিবাদী দল দ্বারা পরিচালিত সরকার – যাই থাকুক না কেন, এই সংকটকে মোকাবিলা করতে পারার সম্ভবনা খুবই কম। তাই, আগেকার ফ্যাসিবাদী সরকারের মত বর্তমান ফ্যাসিবাদ যুদ্ধ ও আত্মবিনাশের পথে নাও যেতে পারে, তাকে ভোট দিয়ে সরিয়ে দেওয়া যায়, যেমন ট্রাম্পকে সরানো হয়েছিল। কিন্তু সরালেও তার ক্ষমতায় ফিরে আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় না।

তাই, বর্তমান নয়া ফ্যাসিবাদ টিকে থাকে বেশি, তা কম অত্যাচারী হতে পারে ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের চাইতে, এবং যুদ্ধ করে নিজেকে ধ্বংস করার প্রবণতাও তার কম। আসলে বর্তমান ফ্যাসিবাদ নয়া উদারবাদের সংমিশ্রণেই সৃষ্ট। এবং এ হল নয়া উদারবাদের সর্বোচ্চ এবং শেষ অভিব্যক্তি। একে শেষ পর্যন্ত হারানো যায় নয়া উদারবাদের সংমিশ্রণকে হটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। ভোটে হারানোর মধ্যে ফিরে আসার সম্ভবনা থাকে, শেষ পর্যন্ত হারালে সেই সম্ভবনা থাকবে না। নয়া উদারবাদের সংমিশ্রনকে সরানোর কাজ এক্ষুনি হয়তো সমাজতন্ত্রের দাবি করে না হতে পারে, কিন্তু এক্ষুনি যা হতে পারে তা হল বর্তমান পরিস্থিতির অভিমুখ বিকল্প দিকে ঘোরানোর মাধ্যমে – বেকারত্ব, কল্যাণকামী খরচের দাবির মাধ্যমে। এর মানে, নয়া উদারবাদের হাত থেকে বেরোনো, পুঁজি, ব্যবসা ও রাষ্ট্রের চালনাশক্তি সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের হাতে রাখা – যার মধ্যে দিয়ে ক্রমান্বয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে এগোনো যায়। পুঁজিবাদ একরকম অচলাবস্থার স্তরে পৌঁছেছে, ফ্যাসিবাদ সেই অচলাবস্থারই অভিব্যক্তি, এই অচলাবস্থা শেষ পর্যন্ত হারানো যায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধতার মধ্যে দিয়ে, যে বিষয়ে এ সময় আমাদের সচেতন হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের জন্মদিবস উপলক্ষে থ্রিসুরে দুইদিন ব্যপি জাতীয় সেমিনার আয়োজিত হয়। অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক সেই সেমিনারেই ‘নয়া উদারবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদ’ প্রসঙ্গে বক্তৃতা দেন। এই প্রতিবেদনে সেই বক্তৃতারই বাংলা ভাষান্তর প্রকাশ করা হল।

ভাষান্তর করেছেন- শ্রীতমা সাউ ও নবারুণ চক্রবর্তী।   

Spread the word

Leave a Reply