‘ভুলি নাই’ – ঐতিহাসিক নৌ-বিদ্রোহ স্মরণে : অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত…

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ( শুক্রবার )

প্রথম পর্ব

হিংস্র বাঘের মত পদচারণা করছিলেন বোম্বের রয়্যাল ইন্ডিয়া নেভির ‘তলোয়ার’ জাহাজের কম্যান্ডিং অফিসার ফ্রেডরিক কিং। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর ক্রোধের নিমিত্ত, এক ভারতীয় নাবিক। পায়চারি থামিয়ে কিং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ‘তোমার কার্যকলাপের পরিণতি কি, তা কি তুমি জান ?’ তৎক্ষণাৎ নির্ভীক উত্তর এল – ‘আমি ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ‘। এর পরেই নৌসেনার যাবতীয় শতাব্দী প্রাচীন নিয়ম ও শৃঙ্খলাকে নস্যাৎ করে চেয়ার টেনে কম্যান্ডিং অফিসারের সামনে বসে পড়লেন ঐ তরুণ ভারতীয় নাবিক। হতভম্ব হয়ে গেলেন কিং। দীর্ঘকাল তিনি রাজকীয় নৌবহরে রয়েছেন, কিন্তু এর পূর্বে এমন ঘটনার তিনি কোনোদিন মুখোমুখি হননি। এ কোন সব উলটে দেওয়া নতুন ক্রান্তির হাওয়া বইছে আরব সাগরে, যে সামান্য সিগনালম্যান জাহাজের কম্যান্ডিং অফিসারের সামনে এই ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে ?


আরব সাগরে ভাসমান ‘তলোয়ার’ জাহাজ। এই জাহাজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজ করেছে সিগন্যাল রেটিংদের শিক্ষাকেন্দ্র রূপে। হাজার হাজার রেটিং এখানে প্রশিক্ষণ লাভ করেছে, কোনোদিন শৃঙ্খলায় কোনো চিড় ধরেনি। ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর মতো, রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীও চূড়ান্ত অরাজনৈতিক। প্রায় তিন দশক ধরে চলা জাতীয় আন্দোলনের উত্থান ও পতনের ঢেউ তাকে স্পর্শও করেনি। ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ‘সেডিশন’ আর যেখানেই মাথা তুলুক, নৌ-সেনা তার থেকে নিরাপদ। তার উপর ‘তলোয়ার’-এর মতো জাহাজে, যেখানে ফ্রেডরিক কিং-এর মতো দুঁদে কম্যান্ডিং অফিসার আছে সেখানে তো তা অসম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর থেকেই একটির পর একটি ঘটনা এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে লাগল।

৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কলার ধরে ঝাঁকিয়েছিল স্বাধীন দেশের স্বপ্ন

প্রথম অশনি সংকেত দেখা গেল ১৯৪৫ সালের ১-লা ডিসেম্বর। অসামরিক জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য সেইদিন জাহাজ উন্মুক্ত করার কথা। রাত অবধি সেই মর্মেই প্রস্তুতি চলেছে। কিন্তু সকাল হতেই হতবাক অফিসাররা, দেখলেন বিক্ষিপ্ত পোড়া পতাকা আর কাপড়ের জঞ্জালের মাঝখানে কারা যেন একফুট উঁচু অক্ষরে লিখে গেছে কতগুলো আগুন ঝরানো স্লোগান – ‘ভারত ছাড়ো’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘এখনই বিদ্রোহ কর’, ‘গোরাদের হত্যা কর’। কোনো রকমে অসামরিক লোকদের জন্য ফাটক খুলে দেওয়ার আগে লেখা পরিষ্কার করা গেলেও, রেটিং দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল দারুণ উত্তেজনা।


সেই শুরু। এর পর ঘটে যেতে লাগল একের পর এক একই রকম ঘটনা। কম্যান্ডিং অফিসারের সামনে মাথার টুপি ছুঁড়ে ফেলে তাতে লাথি মেরে কারাবরণ করলেন আর. কে সিং। ১৯৪৬ সালের ২ রা ফেব্রুয়ারি কম্যান্ডার ইন চিফের জাহাজ পরিদর্শন করতে আসার দিন যে বেদির উপর দাঁড়িয়ে তিনি অভিনন্দন গ্রহণ করবেন সেখানে দেখা গেল বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে ‘জয় হিন্দ’ আর ‘ভারত ছাড়ো’। অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। যে করেই হোক ধরতেই হবে রেটিং-দের মধ্যে থেকে চক্রান্তকারীদের। শীঘ্রই তাঁদের এই প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া গেল। জনৈক ভারতীয় অফিসারই ধরিয়ে দিল এতদিন ধরে কর্তৃপক্ষকে অপদস্ত করার প্রচেষ্টার অন্যতম মাথাকে। ধরা পড়লেন সিগনালম্যান বলাই চন্দ্র দত্ত। তিনি গ্রেপ্তার হলেন বটে, কিন্তু তারপর নৌ-বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সামনেও তাঁর দৃপ্ত আচরণ, যা নিবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে, নাবিকদের প্রবল ভাবে অনুপ্রাণিত করল।

শিল্পী চিত্তপ্রসাদের আঁকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিদেশ থেকে ফেরত রেটিংদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরেই একটি টানাপোড়েন তীব্র হচ্ছিল। সমগ্র যুদ্ধে তারা তাদের ব্রিটিশ সহকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, কিন্তু প্রাপ্য সম্মান তো পেলোই না, বরং পদে পদে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তারা শাসিত ও ব্রিটিশ বাহিনী শাসক। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে সেই বিভাজন বেড়েছে বৈ কমেনি। এরই মধ্যে তাঁদের কানে এসেছে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা।

আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের লালকেল্লায় বিচার উপলক্ষে সারা ভারত যে রাস্তায় নেমে এসেছে দল-মত নির্বিশেষে, সেই সম্পর্কেও তাঁরা অবগত ছিলেন। রেটিং-দের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের সেল সক্রিয় ছিল না, কিন্তু তাঁদের মধ্যে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিত ভাবে গড়ে উঠছিল একপ্রকার স্বতঃস্ফুর্ত রাজনৈতিক সচেতনতা। এই সচেতনতাই আর.কে সিং বা বলাই চন্দ্র দত্তের মতো নাবিকদের বিদ্রোহী করে তুলেছিল। খারাপ খাদ্য, বেতন বৈষম্য, ব্রিটিশ অফিসারদের বর্ণ বিদ্বেষী আচরণ এবং ডি-মোবিলাইজ করার দেরির মতো বিষয় নিয়ে যে ক্ষোভ আগে থেকেই ছিল, তাই ক্রমশ ব্রিটিশ শাসনের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিরোধিতার একটি আকার ধারণ করল।


বলাই চন্দ্র দত্তকে গ্রেপ্তার করার পরেও অবস্থার উন্নতি হল না। নাবিকরা গোপনে প্রতিরোধ চালিয়েই যেতে লাগলেন। অবশেষে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭-ই ফেব্রুয়ারি রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ধর্মঘট করার। গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহের অনুকরণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল প্রাথমিক ভাবে খারাপ খাদ্যের বিরোধিতার মাধ্যমেই ধর্মঘট শুরু করা হবে। সেই পরিকল্পনা অনুসারেই ১৮-ই ফেব্রুয়ারি সকালে তলোয়ার জাহাজ জুড়ে মুখরিত হল, ‘না খাবার, না কাজ !’-এর স্লোগান, কিন্তু বেলা গড়াতেই দেখা গেল ভালো খাবারের প্রতিশ্রুতি দিয়েও এমনকি স্বয়ং রিয়ার অ্যাডমিরালও পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না, তাঁর আপোষের প্রস্তাবের জবাব মারমুখী রেটিংরা দিচ্ছে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ ধ্বনির মাধ্যমে।

১৮ তারিখ বেলা চারটের পর ‘তলোয়ার’ জাহাজ আর ব্রিটিশদের হাতে থাকল না। ব্রিটিশ অফিসাররা আগেই জাহাজ ত্যাগ করেছিলেন, এবার তাঁদের সঙ্গী হলেন অধিকাংশ ভারতীয় অফিসার। মূলতঃ শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণী থেকে আগত রেটিংরাই বিদ্রোহের মশাল হাতে তুলে, তলোয়ার জাহাজের দখল নিল। সেই রাতেই দাবি সমূহ সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দিল তলোয়ারের নাবিকরা। তাতে যেমন ছিল উন্নত চাকরির ও খাদ্যের দাবি, তেমন ছিল আই.এন.এ-এর বন্দী সেনাদের মুক্তি, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনার অপসারণ, ব্রিটিশদের ভারত পরিত্যাগ করার মতো রাজনৈতিক দাবিও।

চলবে………

Spread the word

Leave a Reply