কাকাবাবু, কঠিন দিনগুলি ও ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
ঠিক কোন বছর এখন মনে পড়ে না। বিগত শতাব্দীর আশির দশকের কোন একটা বছর ৫ই আগস্ট মহাজাতি সদনে কাকাবাবুর জন্মদিন পালিত হচ্ছে।
মঞ্চে কাকাবাবুর বিশালাকৃতির সাদাকালো ফটোটি।
উদ্বোধনী সঙ্গীত শুরু করলেন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়।
প্রথম গান: তুমি কি কেবলই ছবি? স্মৃতিপটে লেখা… উপস্থিত শ্রোতারা মুহূর্তে মন্ত্রমুগ্ধ।
দ্বিতীয় গান: কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো….।
তাঁর সঙ্গে তবলা খোল বেহালা কিছুই ছিল না। শুধু হারমোনিয়াম নিয়ে কিছুটা ঢিমেতালে গানটা গাইলেন।…..
আজও সে গান কানে ভাসছে।
সেই থেকে কাকাবাবুর প্রসঙ্গ এলেই ওই গানটির কথা আমার মনে পড়ে।
আজ অনেক গবেষক বিস্তর পরিশ্রম করে খোঁজার চেষ্টা করছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন কিভাবে অবিভক্ত ভারতের পূর্ব প্রান্তে নোয়াখালী জেলার এক অখ্যাত দ্বীপ সন্দ্বীপে অর্থ উপার্জনে অক্ষম এক মুসলিম দরিদ্র আইনজীবীর সন্তান কি করে কমিউনিজমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেন এবং কি করেই বা সেই মানুষটি উথালপাথাল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় অতিক্রম করে আদর্শে অবিচল রইলেন।
ঐতিহাসিকরা, গবেষকরা পারেন তাঁর সমকালীন ইতিহাস কে তন্ন তন্ন করেখুঁজে বের করতে, যা থেকে আন্দাজ করা যায় কোন কার্যকারণ পরিস্থিতি, কোন ঘটনাক্রম এই ধরনের বিপ্লবীর জন্ম দেয়।
চেষ্টাও করছেন অনেকে।
কিন্তু সেই মানুষটির মনোজগতে পরিবর্তনের রহস্য খুঁজে বার করা খুবই কঠিন।
কাকাবাবু কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ অবশ্য নিজের জীবনের গোড়ার কাহিনী লিখে গেছেন। রয়েছে অন্যের লেখা আরো কিছু প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণ।
তাই দিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করব কিছুটা।। আমাদের আজকের আলোচ্য কমরেড মুজফফর মুজফ্ফর আহ্মদ ও ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
ন্যাশনাল বুক এজেন্সি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৩৯ সালের ২৬ জুন।
কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার পিছনে কমরেড মুজফফর আহমদ এর অবদান বুঝতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
এদেশে কমিউনিজমের আদর্শ প্রচার করতে হলে, কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হলে, কমিউনিস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হলে সর্বাগ্রে যে মার্কসবাদী বইপত্র, পত্রপত্রিকার প্রকাশ ও প্রচার প্রয়োজন এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন লেনিনের থেকে। বিপ্লবী লেনিনেরও কর্মময় জীবনের শুরু হয়েছিল আদর্শে বলীয়ান পত্রিকা ও বইপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু মুজফ্ফর আহ্মদ যখন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে মার্কসবাদী চিন্তা ধারার পরিচয় হয়নি।
এই প্রসঙ্গে কাকাবাবুর নিজের লেখা থেকে উদ্ধৃতি না দিলে চলবে না।
তিনি লিখছেন: “এখন আমাদের কমরেডরা কমিউনিস্ট পার্টি র সর্বসময়ের কর্মী হন। তাঁরা শুনে আজ আশ্চর্য হবেন যে ১৯১৮ সালের শেষাশেষিতে আমি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র সবসময়ের কর্মী হয়েছিলেম। পুরো ১৯১৯ সাল এবং ১৯২০ সালের মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত সমিতির সব-সময়ের কর্মী আমি ছিলেম। তারপরে “নবযুগ” কাগজ পরিচালনা করার সময় আমি সর্বসময়ের কর্মীর মতোই কাজ করেছি, যদিও কোনো রাজনীতিক পার্টি সভ্য আমি তখন ছিলেমনা। ১৯১৮ সালের শেষাশেষিতে আমার যে সবসময়ের কর্মীর জীবন আরম্ভ হয়েছিল সেই জীবন আমার আজও অর্থাৎ ১৯৬৭ সালেএই কয়েক ছত্র লেখার সময়ও, চলেছে।
আমার জীবনের পেশা কি হবে, সাহিত্য না রাজনীতি এই নিয়ে আমি পুরো ১৯১৯ সাল ভেবেছি। সত্য কথা বলতে, আমার মনের ভিতরে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলছিল। কবি আমি ছিলেম না। গল্প লেখক বা উপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন আমি কোনদিন দেখিনি। সেই ভাষা কোনদিন আমার আয়ত্তে ছিলনা। আমার প্রবল বাসনা ছিল যে আমি একজন প্রবন্ধকার হব। আমার পরবর্তী জীবনেও, অর্থাৎ রাজনৈতিক জীবনে তা হবার পথে কোন প্রতিবন্ধক ছিল বলে আমার মনে হয় না। তবু আমি প্রবন্ধকারও হতে পারিনি, যদিও আমি খবরের কাগজ চালিয়েছি।
আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলছিল তাতে শেষ পর্যন্ত জয় হল রাজনীতির। একটা কিছুতেই যে নিজেকে বিলিয়ে দেব সে তো আগেই স্থির করেছিলেম। সেই জন্যই তো আমি” বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র সবসময়ের কর্মী হতে পেরেছিলেম। ১৯২০ সালের শুরুতে আমি স্থির করে ফেললাম যে রাজনীতি হবে আমার জীবনের পেশা। আমি রাজনৈতিক সভা সমিতি ও মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করেছিলেম ১৯১৬ সাল হতে।”(আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। মুজফ্ফর আহ্মদ। পৃষ্ঠা ৩৯। এনবিএ ত্রয়োদশ মুদ্রণ।)
বই সম্পর্কে কাকাবাবুর মনোভাব কি রকম ছিল তা আন্দাজ করা যায় যখন দেখি ১৯৬৭ সালে৭৮ বছর বয়সেও তিনি মনে করে লিখছেন,”আমি ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসের কথা বলছি। তখনকার দিনে পুস্তকের দাম খুব সস্তা ছিল। ১০ টাকার ভিতরে আমি কয়েকটা পুস্তক কিনেছিলাম।”
প্রসঙ্গত এগুলি ছিল মার্কস লেনিনের লেখা বই, অথবা প্রবন্ধ সংকলন। ছিল ক্যাপিটাল গ্রন্থের একটি সহজবোধ্য সংস্করণ।
সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কথা অনুযায়ী”দেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে ও রুশ বিপ্লব তাঁকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। লেনিনের কথামত তিনি প্রথম থেকেই মার্কসবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন প্রচার ও প্রকাশ এর উপর জোর দিতে থাকেন। শ্রমিক ও কৃষকের শোষণ সম্পর্কে পত্র পত্রিকায় লেখা তিনি শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে চলে শ্রমিক কৃষক আন্দোলন সংগঠনে যোগ দেওয়া। দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে মধ্যে টেনে আনতে হবে এই সবে তার দৃষ্টি ছিল বেশি। কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সম্পর্কে চিন্তা করে আদর্শগত জ্ঞানার্জনের জন্য গোপনে মার্কসবাদী সাহিত্য সংগ্রহ করতে থাকেন। তাঁর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা “নবযুগ” দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের যোগদান ,এসব কিছুই এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আসে।
পরবর্তী যুগে লাঙ্গল গণবাণী প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশে ও ছোট ছোট পুস্তক প্রকাশের জন্য তিনি প্রয়াস চালান।” (ন্যাশনাল বুক এজেন্সির ৫০ বছর পূর্তি।সরোজ মুখোপাধ্যায়। এন বিএ প্রকাশনা, ১৯৮৯)
ইতিহাসের ঠিক এই অধ্যায়টি সম্পর্কে কাকাবাবুর বন্ধু সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ থেকে উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছিনা। তিনি লিখছেন:
“একদা কলকাতায় তিনটে সাপ্তাহিক প্রায় একই কালেই বেরিয়েছিল। মুজফফরের গণবাণী (অথবা লাঙ্গল) নজরুলের ধুমকেতু আর আমার নবপর্যায় যুগান্তর।… নজরুলের ধুমকেতু ছিল নিছক বিপ্লববাদের জয়দ্ধজা, বিদ্রোহী আন্দোলনের ইন্ধন জোগানো, আর মুজফফরের পত্রিকাটা সোজাসুজি কৃষক মজদুর দের মুখপাত্র, কমিউনিজমের তত্ত্ব বোঝাবার হাতিয়ার আর আমারটা যে কী না!”
অল্প কথায় নিজস্ব ভঙ্গিতে সেদিনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল শিবরাম বর্ণনা করেছেন এইভাবে,
“আমাদের তিনটি পত্রিকার প্রকাশ পর্বটাও ছিল এক বিশেষ কালীন। চারিধার থেকে নানারকম সম্ভাবনার আসন্ন তা তখন দেখা দিয়েছে। সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মিটে ছিল।এদেশে গান্ধিজির সহিংস অসহযোগের অভ্যুদয় উদ্যম। ও দেশে ঘোরতর সহিংস সংগ্রামে রাশিয়াকে বে- জার করে সেইসঙ্গে জারের বন্ধু পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রদেরও বেজায় রকমের ব্যাজার করে বলশেভিকদের অভ্যুত্থান, এদিকে ইহলোককে সশরীরে লোকোত্তর দানের সাধনায় নিমগ্ন পন্ডিচেরির সাধক বৃন্দ ,তার উপরে কংগ্রেসের রাজনীতির মঞ্চে দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র, জহরলাল এর আবির্ভাব—— সব মিলিয়ে এক ধুম ধারাক্কা!” (ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর। শিবরাম চক্রবর্তী। পৃষ্ঠা ১৫১। নবপত্র প্রকাশন। প্রথম সংস্করণ)
কাকাবাবুর লেখার যে বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে স্মৃতিনির্ভর লেখাগুলি যে বিরাট ছড়ানো তা নয়, কিন্তু যা লিখেছেন এত খুঁটিনাটি তথ্য সমৃদ্ধ, যে সেখানে দাঁত ফোটানোর উপায় নেই।
সরোজ মুখোপাধ্যায় বা ন্যাশনাল বুক এজেন্সির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুরেন দত্তের স্মৃতিচারণায় ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায়। আগ্রহী পাঠক সেগুলি দেখতে পারেন। কিন্তু সেই গোড়ার দিনগুলির কথা খুব স্পষ্ট ভাষায় মুজফ্ফর আহ্মদ লিখে গেছেন:
“উনিশশো ত্রিশের দশক ও শেষ হতে চলেছিল। মার্কসীয় সাহিত্যের চাহিদাও বেড়েছিল। তবুও আমরা কলকাতায় কোন পুস্তক বিক্রয় ও প্রকাশন ভবন স্থাপন করতে পারলাম না। কলকাতা ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বড় পুস্তকের বাজার। এই বাজারে খুব ছোট একটা দোকান খুলতে হলেও কমপক্ষে দু চার হাজার টাকার দরকার। সেই টাকা পাওয়ার কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না”।
কমরেড রেবতী মোহন বর্মন একজন স্কলার ছিলেন এবং সন্ত্রাসবাদি দলের একজন নেতাও ছিলেন তিনি। বিনা বিচারে বন্দি করার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করার আগে হতেই তিনি মার্কসীয় সাহিত্যের পড়াশুনা আরম্ভ করেছিলেন। বন্দী শিবিরে গিয়ে পড়াশুনা তিনি আরো বাড়িয়ে দিলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি যখন মুক্তি পেলেন তখন তিনি একজন পাকা কমিউনিস্ট। বাইরে এসেও নানারকম সাংগঠনিক কাজের ভিতর দিয়ে অন্য অনেকের সঙ্গে তিনিও ভারতের অবৈধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ অর্জন করে নিলেন। মার্কসীয় সাহিত্য পরিবেশন করার উদ্দেশ্যে একটি দোকান খোলা হোক এটা তিনিও একান্তভাবে চাইছিলেন। কিন্তু টাকা কোথায়? তখনকার দিনে সন্ত্রাসবাদীর দল হতে যারা অবৈধ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতেন তাঁরা কমরেড মুজফফর আহমদ এর সঙ্গে সংযোগ রাখতেন। তিনি চিহ্নিত ব্যক্তি ছিলেন। দোকান স্থাপনের ব্যাপার নিয়ে কমরেড রেবতী বর্মনের কমরেড মুজফফর আহমেদ এর সঙ্গে দিনের-পর-দিন আলোচনা হল। শেষে স্থির হল যে কমিউনিস্ট পার্টির শুভেচ্ছাকে মূলধন করেই একটি ছোট দোকান খুলে দেওয়া হোক। শ্রী গোপাল ঘোষ কমরেড রেবতী বর্মনের পুরনো পার্টির সভ্য ছিলেন এবং কমরেড বর্মন কে খুব ভালোও বাসতেন তিনি। আমরা যে সময়ের কথা বলছি (১৯৩৯) সেই সময় শ্রী ঘোষ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর নিকট হতে কমরেড বর্মন ২০০ টাকা নিলেন।
এই সময়ে আরও দুটি সুযোগ এসে গেল। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য কমরেড সুরেন্দ্রনাথ দত্ত এমসি সরকার এন্ড সন্স এর দোকানে চাকরি করতেন। সরকাররা দোকানের কর্মী কমাছিলেন। এই সূত্রে ১৯৩৯ সালের পয়লা জুন তারিখে কমরেড সুরেন দত্তের ছাঁটাই হলেন,। ছাঁটাই হওয়াটা ভালো কথা নয়। কিন্তু কমরেড সুরেন দত্তের ছাঁটাই তে আমরা সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেম। কারণ আমরা নিজেদের দোকান খুলতে যাচ্ছিলেম।৭২ নম্বর হ্যারিসন রোড এর (কলেজ স্কোয়ার এর দিকে) একটি কবরের জায়গা হতে সামান্য বড় একখানা ঘরে শ্রী ব্রজবিহারী বর্মনের “বর্মন পাবলিশিং হাউস” ছিল। তিনি এই ঘরখানা ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে লাগা অপেক্ষাকৃত বড় ঘরে উঠে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাঁর খালি করে দেওয়া ঘরখানা নিয়ে নিলাম। সামান্য ভাড়া ছিল ——- দৈনিক ছয় আনা কিংবা আট আনা। সামান্য কিছু ফার্নিচারও জোগাড় করা হলো।
১৯৩৯ সালের ২৬ শে জুন তারিখে আমরা দোকান খুলে দিলাম। শুধু বাংলাদেশের নয়, সমস্ত ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম পুস্তক এর দোকান।
আমাদের মূলধন ছিল: কমিউনিস্ট পার্টির শুভেচ্ছা; কমরেড সুরেন্দ্র নাথ দত্তের শ্রম; কমরেড রেবতী মোহন বর্মন এর জোগাড় করা দুইশত টাকা।
দোকানের নাম দেওয়া হলো ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। সারা ভারতের মার্কসীয় ও প্রগতির সাহিত্যের পরিবেশক হওয়ার স্বপ্ন সেদিন আমরা দেখেছিলেম। ওই অর্থেই আমাদের নামের গোড়ায় ন্যাশনাল কথাটা বসেছিল। কেউ কেউ ভুল ধারণা করেন অন্তত অতীতে করেছেন যে আমরা ন্যাশনালিস্ট সাহিত্যের প্রকাশক ও পরিবেশক। ন্যাশনালিস্ট সাহিত্য আমাদের নিকটে পরিত্যাজ্য নয় ,কিন্তু তার জন্য অনেক দোকান আছে। তাই আমাদের ভবিষ্যতে যাতে কোনো বিচ্যুতি ঘটতে না পারে সে কথা মনে রেখে ১৯৪৩ সালে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে রেজিস্ট্রি করার সময় আমরা তার মেমোরেন্ডাম অব এসোসিয়েশন এর নির্ধারণ করে দিয়েছি যে আমাদের কোম্পানি শুধু মার্কসীয় ও প্রগতি সাহিত্যের প্রকাশক ও পরিবেশক । মেমোরেন্ডাম এর কোনো পরিবর্তন হয় না।
যদিও আমাদের দোকানে পুস্তকের সংখ্যা খুবই কম ছিল তবুও পুস্তক আসা মাত্রই তা বিক্রয় হয়ে যাচ্ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি প্রতিষ্ঠান প হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির ব্যক্তিরা যে দোকানে আসা-যাওয়া করতেন তা থেকে পার্টি সভ্যরা তো বটেই পার্টির বন্ধুরাও বুঝে নিয়েছিলেন যে দোকানটি কমিউনিস্ট পার্টির শুভেচ্ছায় পরিচালিত।
অশেষ সাহসে ভর করে ওই অবস্থায় আমরা যে সেদিন দোকানটি খুলেছিলাম অনেকে তাতে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়ে ছিলেন।এই আগ্রহ প্রকাশকারীদের মধ্যে কমরেড ধরণীকান্ত গোস্বামী ও কমরেড আব্দুল হালিমের নাম উল্লেখযোগ্য।”
যাত্রা শুরু হলেও ন্যাশনাল বুক এজেন্সি যাত্রাপথ মোটেই ফুল বিছানো ছিলনা।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এন বি এর দোকানে পুলিশি হামলা শুরু হল। কাকাবাবু সহ আরো অনেকে তখনই গ্রেফতার। এরপর ১৯৪৮ সালের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি আক্রান্ত হয়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ কে কেন্দ্র করে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়।কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনেরআঁচ পড়ে এন বি এর উপর। কাকাবাবুর জীবদ্দশাতে ও পরে হামলা আক্রমণ থেমে থাকেনি।
সে ইতিহাস বিভিন্ন নিবন্ধে লিপিবদ্ধ আছে।
এখানে যেটা বিশেষভাবে বলার, কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের কৃতিত্ব যে তিনি অসংখ্য গুণী মানুষকে ন্যাশনাল বুক এজেন্সির সঙ্গে সমবেত করতে পেরেছিলেন।
তাঁদের মধ্যে যেমন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক কবি প্রাবন্ধিক ছিলেন, তেমনি অনেক নতুন লেখকের এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ন্যাশনাল এর হাত ধরে।
এন বি এর পরিচালকমণ্ডলীতে বেশকিছু যোগ্য সংগঠকের সমাবেশ ঘটেছিল, আর ছিল অগণিত নিবেদিতপ্রাণ ন্যাশনাল এর কর্মী, এবং রাজ্য তথা দেশ তথা বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী।
এদের সকলের সামনে ছিলেন কাকাবাবু, এক আদর্শ। তাঁর জীবদ্দশায় ন্যাশনাল বুক এজেন্সির অনেক প্রসার ঘটেছিল।
চীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, গ্রেট ব্রিটেন থেকে বই আমদানির বন্দোবস্ত হয়।
এক্ষেত্রে যেটা বলার কেবলমাত্র আদর্শকে ভালোবাসা নয়, কেবলমাত্র একটা দোকান ঘর তৈরি করা নয়, বইকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন কাকাবাবু।
একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে কম্পোজ, প্রুফ দেখা, বইয়ের অঙ্গসজ্জা, প্রচ্ছদ, ছাপা, হরফের আয়তন, ছাপা, বাধাই ও বিক্রি এসব কিছুর বিষয়ে খুটিনাটি আগ্রহ ছিল কাকাবাবুর।
ভালো করে প্রুফ দেখতে না পারলে, যে বইয়ে অজস্র ভুল থেকে যায় সেজন্য তিনি চেয়েছিলেন সকল শিক্ষিত পার্টিকর্মী প্রুফ দেখা যেন আয়ত্ত করে নেন।
সে কারণে গণশক্তি প্রিন্টার্সের ডায়েরিতে কাকাবাবু প্রুফ দেখার পদ্ধতি- সম্বলিত একটি পৃষ্ঠা ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
এরকম আশ্চর্য ব্যাপার আর কোথাও কেউ করেছেন বলে জানা নেই।
কাকাবাবুর হাতের লেখাও ছিল বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে। ওই রকম হাতের লেখাতেই পাণ্ডুলিপি জমা দিতেন। কম্পোজিটরের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে তাঁর সব সময় খেয়াল থাকত। লেখার উপরে নিচে মাঝে মার্জিন থাকতো, যাতে প্রয়োজনে মূল পান্ডুলিপির উপর সংশোধন করা যায়।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় আজকালকার অনেক পেশাদার লিখিয়েও এইসব গুণাবলী আয়ত্ত করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন।
কাকাবাবুর গদ্যে বাংলা বানানের বৈশিষ্ট্য কি তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে কাকাবাবুর সহজ-সরল মেদহীন গদ্য যে বাংলা সাহিত্যে তুলনাহীন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ নিয়ে শিবরাম চক্রবর্তীর মন্তব্য উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
তিনি লিখছেন:
“সোজা সবকথার সরল ঋজু গদ্য, সহজ ভাষার ভেতরে কোন ঘোরপ্যাঁচ নেই, যা বলবার সোজাসুজি বলা, যা নাকি তীর বেগে গিয়ে পাঠকের মর্মমূলে বিদ্ধ হয়। লেখার মর্ম আর পাঠকের মর্ম এক হয়ে লেখক এর বক্তব্য পাঠকের অন্তরে গাঁথা হয়ে যায়।…….. উনি যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বিরাট এক সংগঠক মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন সেসবের আমি বিশেষ কিছুই জানিনা, এদেশের কমিউনিজমের কেবল অগ্রদূত নন, তার অগ্রগতির মূলেও তাঁর অবদান যে সবিশেষ সে বিষয়ে আমি অজ্ঞ, রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা নিয়েও আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই, কিন্তু তিনি যে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিশিষ্ট গদ্য ভঙ্গির স্রষ্টা——সেই কথাটাই আমার কাছে মুখ্য।” (ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর। শিবরাম চক্রবর্তী। পৃষ্ঠা ১৫১। নবপত্র প্রকাশন। প্রথম সংস্করণ)
আসলে মনটা যখন গড়ে ওঠে, অর্থাৎ সেই কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দোড়গোড়ায়, তখনই মুজফফর আহমদ-এর মন রাঙিয়ে ছিল লেখালিখি ছাপাখানার জগত। তাই শুরু থেকেই এর জন্য মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন।
তারপর যখন বৃহত্তর রাজনীতির ডাক যখন এলো তখন তাঁর এই সাধনার ফসল তুলে দিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করতেই।
আজ পরিস্থিতি প্রতিকুল। প্রতিকূলতার চরিত্র বদলেছে। পত্রপত্রিকা বই প্রকাশনার জগতে অনেক পরিবর্তন আসছে ।আগামী দিনে আরো আসবে। নিত্য নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব মাথা ঘুরিয়ে দেবে।
কিন্তু যতই যাই করা হোক যিনি এইসব কাজে যুক্ত হবেন, যিনি এইসব কাজে নেতৃত্ব দেবেন, তাঁকে কাকাবাবুর জীবন থেকে শিক্ষা নিতেই হবে।
এই আদর্শবোধ, এই নিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।