মুঘল সাম্রাজ্য – ভারতের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ- শুভ বসু

১১ এপ্রিল ২০২৩ (মঙ্গলবার)

মুঘল যুগের গুরুত্ব কোথায় ভারতের ইতিহাসে ? প্রকৃত পক্ষে মুঘল যুগের সূচনা ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে । মুঘল সাম্রাজ্য মূলত শক্তিশালী হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৮৯ সালে পর্যন্ত। ১৬৮৯ সালের থেকে মুঘলদের সঙ্গে ইংরেজ বণিকদের লড়াই সূচিত হয় এবং তার একপ্ৰকার সমাধান হয় ১৭৬৫ সালে সুবে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে প্রদানের মধ্যে দিয়ে। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে আগ্রা, দিল্লি এবং লাহোর কে কেন্দ্র করে যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তারই নাম মুঘল রাজপূত সাম্রাজ্য। মুঘল সম্রাটরা আকবর থেকে বাহাদুরশাহ দ্বিতীয় পর্যন্ত সবাই ভারতে জন্মেছিলেন এবং সম্রাট আকবরের পুত্র পৌত্র এবং তাঁদের সন্তান সন্ততিরা মুঘল পিতা এবং রাজপূত পিতামহীর সন্তান ছিলেন। রাজপূত সৈনিকরা মুঘল সাম্রাজ্যের অনুগত যোদ্ধা ছিলেন । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় সুবে বাংলা জয় করেছিলেন রাজা মান সিংহ। ঔরঙ্গজেবের হয়ে দাক্ষিণাত্যের শিবাজীকে পরাস্ত করেন মির্জা রাজা জয় সিংহ। মুঘল সাম্রাজ্যে মুসলমান ওমরাহদের মৃত্যু হলে তাদের সম্পত্তি বাদশাহের কাছে চলে যেত কিন্তু রাজপূত রাজারা তাদের সম্পত্তি তাঁদের উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের সন্তান সন্ততিদের দিয়ে যেতে পারতেন।


প্রকৃত পক্ষে ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দী ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মীয় হানাহানির যুগ। ইরানে , মধ্যপ্রাচ্যে এবং খ্রিস্টান ইউরোপে তখন ছিল শিয়া সুন্নি , ক্যাথলিক প্রটেস্টান্ট এবং ইহুদিদের মধ্যে লড়াইয়ের যুগ। কিন্তু ভারতে আকবর এবং জাহাঙ্গীর বাদশাহর সুলেহই কুল নীতির ফলে শিয়া সুন্নি , সনাতন ধর্ম , জৈন এবং ক্যাথলিক দের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ছিল। এবিষয়ে অরবিন্দ ঘোষ লিখেছিলেন – a great and magnificent construction and an immense amount অফ political genius and talent was employed in its creation and maintenance. It was as splendid, powerful and beneficent – and it may be added, in spite of Aurangazeb’s fanatical zeal – infinitely more liberal and tolerant in religion than any medieval contemporary European kingdom or empire. India under its rule stood high in militaryand political strength, economic opulence and the brilliance of its art and culture.


প্রকৃত পক্ষে ঔরঙ্গজেব বাদশাহর ভূমিকাও ইতিহাসে অদ্রে তুজকের গবেষণামূলক গ্রন্থের ফলে অনেকাংশে বদলে গেছে।মুঘল সাম্রাজ্য হলো ভারতের আধুনিকতার প্রথম যুগ। সেই যুগে মুঘলরা একটি কেন্দ্রীভূত সামরিক আমলাতন্ত্রের ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা প্রতিবর্ত্তন করেন যা মূলত কৃষি অর্থিনীতি থেকে রাজস্বের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত গ্রহণ করে নগরকেন্দ্রিক সমাজে ব্যবসার সঞ্চার করেন। মুঘল যুগে যে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে তার ফলে সুরাট থেকে ঢাকা পর্যন্ত এবং লাহোর থেকে তাঞ্জাভুর পর্যন্ত বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ব্রডেল যিনি ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার ইতিহাস লিখেছিলেন তিনি মনে করতেন সমকালীন ইউরোপের চেয়ে মুঘল ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভালো ছিল। সেই সময় কৃষিতে নতুন ফসলের উৎপাদন হয় , নতুন ধরণের ফলের বিশেষ বাগিচা তৈরী হয় , শিল্পে মসলিন , বারুদ , মশলা প্রভৃতির কারবারের ফলে ইউরোপ থেকে আসে সিলভার বুলিয়ন যা ইউরোপীয় বণিকরা নিয়ে আসতেন ল্যাটিন আমেরিকার পেরু থেকে লুঠ করে নিয়ে আসতেন। সেই কারণের ভারত সেই সময় বাণিজ্যের শীর্ষে উপনীত হয়েছিল। গুজরাটের বণিক আব্দুল গাফ্ফার সাহেবের একারই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমান সংখ্যক জাহাজ ছিল। ভারতের অর্থনীতি সেই সময় বিশ্বের অর্থনীতির প্রায় এ চতুর্থাংশ ছিল।


মুঘল যুগেই হিন্দুস্তানী সংস্কৃতির সূচনা হয়। সংগীতের জগতেই সেই সময় থেকে উত্থান হয় কালাবন্ত বিরাদরির। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই পশ্চিমা এশিয়ার সংগীত আর ভারতীয় সংগীতের সংমিশ্রণ হয়। সংস্কৃত ভাষায় লেখা সংগীত রত্নাকর এ তার সাক্ষর পাওয়া যায়। চতুর্দশ শতকে নক্সাবির কাহিনীতেও এই সাংস্কৃতিক সংমিশনের উল্লেখ রয়েছে। আবুল ফজলের বর্ণনা আকবরের দরবারের ৩৬ জন মূল সংগীতজ্ঞর মধ্যে ২১ জন ছিলেন হিন্দুস্তানের। এছাড়াও শিল্পীরা এসেছিলেন মাসাদ , খোরাসান হেরাত এবং ভোলগার তীরবর্তী কিপচাক থেকে। সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ধ্রুপদ খেয়াল এবং পরবর্তী কালে ঠুমরীর বিকাশ হয়।

প্রকৃত পক্ষে মুঘল যুগেই হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের ঘরানার বিকাশ হয় , কর্ণাট সংগীতের ধারার পাশাপাশি।
মুঘল চিত্রকলার বিকাশের ইতিহাস আরো গভীরে। আকবরের সময়ে দুই চিত্র শিল্পী মীর সাইদ আলী এবং আব্দুস সামাদ পারসিক চিত্রকলার ধারা নিয়ে আসেন আবার দাস্বান্থ , বাসায়ান এবং লাল নিয়ে আসেন ভারতীয় চিত্রকলার ধারা। দাস্বান্থ ছিলেন আব্দুস সামাদের ছাত্র। আবুল ফজলের বয়ান অনুযায়ী তিনি হয়ে ওঠেন শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তারপরে শিল্পী ভীম গুজরাটি , খেম করম , ধরম দাস ছিলেন পরবর্তী মুঘল শিল্পী। এরাই বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন আমির হামজার কাহিনী অলংকরণ করেন এবং নতুন চিত্র কলার জন্ম দেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবনীন্দ্রনাথ যখন বেঙ্গল ঘরানার জন্ম দেন তখন তিনিও মুঘল ঘরানার শিল্পীদের প্রভাবিত হন।


মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন উত্তর ভারতে তাজমহল , ইতমাদউদ্দৌলার সমাধি , আগ্রা দুর্গ এবং শাজাহানাবাদের লালাকেল্লার মতো স্থাপত্যে ছড়িয়ে আছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে লালকেল্লা হয়ে ওঠে প্রতীক। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের নাড়া ছিল চলো দিল্লি এবং লাল কেল্লাতেই আজাদ হিন্দের বন্দিদের বিচার হয়েছিল এবং স্বাধীনতার পরে লালকেল্লায় উপরেই ভারতের তেরঙ্গা ঝান্ডা উত্তোলন করা হয় প্রতীকী ভাবে।মুঘল যুগের রোমান্টিক ছবি আঁকাও উচিত নয়। মুঘল যুগে দুর্ভিক্ষ ছিল , কৃষক বিদ্রোহ ছিল, শিখ গুরুদের উপর অত্যাচার ছিল। কিন্তু সেই যুগেই হিন্দুস্তানের সংস্কৃতি , শিল্পকলা , স্থাপত্যের বিকাশ হয়। সেই সামগ্রিকতার ছবি ইতিহাসে থাকা উচিত। ভারতের ছাত্রদের মুঘল ইতিহাস না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিজেদের অতীতের সম্পর্কে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া।

লেখক পরিচিতি: ঐতিহাসিক অধ্যাপক শুভ বসু , বিশ্বভারতী , জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমানে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় , মন্ট্রিল, কানাডায় কর্মরত। বড় দুটি কাজ চটকল উপনগরী গুলির শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস , সাংস্কৃতিক ভাবনা এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭২ এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস চর্চা।

Spread the word

Leave a Reply