ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ তৎকালীন ভারতবর্ষ। ১৯৪০ সালে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ (ইউসিএল) থেকে পাশ করে এসে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসাবে নিজের নাম নথিভুক্ত করলেন একজন বাঙালী, জ্যোতিরিন্দ্র বসু। যদিও আদালতে ব্যারিস্টার হিসাবে নিজের নাম নথিভুক্তি করাটা শুধুমাত্র অভিভাবকদের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতেই করেছিলেন। দেশে ফেরার তাগিদ ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
কলকাতার হ্যারিসন রোডে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালী পরিবারে বড় হওয়া জ্যোতিরিন্দ্র বসু দেশে ফিরেই আরেকটি খাতায় নিজের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন – সেটা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদের নথি।বিলেতে ছাত্র থাকাকালীনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশে ফিরে কমিউনিস্ট রাজনীতিই করবেন।
সেই জ্যোতিরিন্দ্র বসুই পরে ভারত সহ গোটা পৃথিবীর রাজনীতিতে জ্যোতি বসু নামে পরিচিত হন।
১৯৪৩ সালে তৎকালীন বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি নিজের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে মানুষকে বাঁচানোর কাজে নামে – সংগ্রামের ইতিহাসে সেও এক অনন্য নজির। মানুষের দুর্দশা এবং সরকারের অপদার্থতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে একটি ছোট পুস্তিকা (হ্যান্ডবুক) প্রকাশিত হয়, শিরোনাম ছিল ‘দ্য ম্যান মেড ফ্যামিন’। ইংরেজিতে সেই লেখা ছিল জ্যোতি বসুরই।

আজ তার ১০৯তম জন্মদিবসে রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে সেই লেখারই বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হল।
গত দুইবছর কোভিড-১৯ সংক্রমনে মহামারী দেখেছে গোটা পৃথিবী। আমাদের রাজ্যে বামপন্থী ছাত্র-যুব-মহিলারা গড়ে তুলেছেন রেড ভলান্টিয়ার – এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন সারা রাজ্যের অগুনতি মানুষজন, রচিত হয়েছে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষকে বাঁচাতে মানুষের সংগ্রামের নয়া ইতিহাস। নিজেদের ঐতিহ্য, উত্তরাধিকারকে পুনঃস্মরণের সাথেই লেখাটি আজকের প্রজন্মের জন্য নিজের শিকড় চিনে নিতেও উৎসাহ যোগাবে।
কোভিড দুর্বল হলেও মানুষখেকো আসল মহামারীটি এখনও যথেষ্ট প্রবল – তার নাম পুঁজিবাদ। তাই লড়াই চলবে।
আজকের পরিস্থিতি
আজ, মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক অন্যতম ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ভারতের অত্যন্ত জনবহুল অঞ্চলগুলির উপর আছড়ে পড়েছে, যার কবলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা ইতিমধ্যেই দশ কোটি ছাড়িয়েছে। খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে কড়া রকমের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এই ভয়াবহ সত্যিটা কে চেপে রাখা সম্ভব হয়নি ব্রিটিশ সরকারের প্রায় গলা টিপে রাখার নীতির কঠোর প্রয়োগ সত্ত্বেও। যেটুকু খবর প্রাপ্ত হচ্ছ, তা যেন মধ্যযুগের ‘ব্ল্যাক ডেথের’ রোজনামচার মত শোনাচ্ছে। “ডেইলি হেরাল্ড” পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছেঃ “শিশু ও তাদের পিতামাতাদের দেখা যাচ্ছে নর্দমার ধারে জানোয়ারদের সাথে খাদ্য ভাগাভাগি করে নিতে, ক্ষুধার্ত পিতা কে দেখা যাচ্ছে সন্তানের মুষ্টি থেকে খাবার ছিনিয়ে খেতে এবং সন্তানকে স্তন্যদানে অপারগ রুগ্ন মায়েদের… নদীর ধারে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার কুন্ডলী আকাশের হাল্কা লাল অস্তরাগে মিলিয়ে যাচ্ছে। শ্মশানগুলি কে প্রস্তুত করা হচ্ছে পরের দিনের কর্তব্যপালনের জন্য। ধীরগতিতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার শহর আজকের কলকাতা”।
ক্ষুধার বলি

১১ই অক্টোবরের “দ্যা টাইমস” পত্রিকা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ মানুষ প্রত্যেকদিন মাছির মত মারা যাচ্ছেন কলকাতার পথেঘাটে; ৪৪০০ জন ক্ষুধার জ্বালায় অসুস্থ মানুষকে কলকাতার বিবিধ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ১৬ই আগস্ট থেকে ২৮শে আগস্টের মধ্যের সময়কালে, যাদের মধ্যে প্রায় ১০০০ জনের ইতিমধ্যেই মৃত্যু ঘটেছে। শহরে অতি দুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ২,৩০,০০০ এ পৌছেছে। ক্ষুধার্ত শিশুদের হাসপাতালে এনে খানিক সুস্থ করেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে আবারো ক্ষুধার শিকার হওয়ার জন্য। তবুও কলকাতার অবস্থা তুলনামূলকভাবে খানিকটা উন্নত গ্রামাঞ্চলের থেকে, যেখানে মানুষের দুর্গতির সবচাইতে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের দ্বারা কৃত এক জরিপে দেখা যাচ্ছে যে কৃষি মজদুর এবং কৃষকেরা এই মন্বন্তরে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে থেকে দৈনিক প্রায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটছে না খেতে পেয়ে। “ক্যালকাটা স্টেটস্ম্যান” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে বিশ্বস্ত সূত্র হতে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ক্ষুধায় মানুষের মৃত্যুর হার বাংলায় দৈনিক প্রায় ৮০০০ থেকে ১১০০০। একদা বাংলার খাদ্য ভান্ডার হিসাবে খ্যাত বড়িশাল জেলায় শিশু কিশোরদের বিক্রি করা হচ্ছে অর্থ বা খাদ্যের বিনিময়ে। ভূমিহীন শ্রমিক, সর্বস্বান্ত নর,নারী, শিশু, শয়ে শয়ে ক্ষুধাপীড়িত পরিবার বাংলা-আসাম সীমান্তে নিত্যদিন এসে পৌছচ্ছেন, শহরে যদি কিছু খাদ্য পাওয়া যায় এই আশায়, কিন্তু তাদের নির্মমভাবে নিরাশ হতে হচ্ছে এবং খিদেয় মারা যাচ্ছেন।
বস্ত্রের অভাব
জীবনযাত্রা নির্বাহের খরচ প্রায় ৬০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রায় সকল স্তরের মানুষ আজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বাংলার আইন পরিষদে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২৯শে সেপ্টেম্বর ঢাকায় চালের দাম প্রায় ২০ গুণ বেড়ে মণ প্রতি ৮০ টাকা হয়েছে। গরিব কৃষকদের অবস্থা বোঝাতে তুলনা করা যেতে পারে যে এ দেশে (ইংল্যান্ডে) যদি একটি পাঁউরুটির দাম ৪ টাকা হয়ে যায়; এই তুলনা তবুও ঠিক হবে না কারণ ইংল্যান্ডের দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেশ কয়েকগুণ বেশি ভারতের দরিদ্র মানুষের তুলনায়।
ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চল
মন্বন্তরের কবলে কেবল বাংলাই নয়, অন্যান্য প্রদেশ ও রয়েছে এবং গোটা দেশেই মন্বন্ততরের করাল ছায়া অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ৩০শে সেপ্টেম্বরের “টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে উড়িশ্যার অবস্থাও অতি দ্রুত বাংলার মতই হতে চলেছে। “অবজার্ভার” পত্রিকায় ১৭ই অক্টোবর সংখ্যায় কাঁথি এবং তমলুক কে “প্লেসেস অফ দ্যা ডেড” বলা হয়েছে। মন্বন্তরের থাবা বাংলা ছাড়িয়ে সুদূর মাদ্রাজ প্রদেশেও বিস্তৃত হয়েছে। প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ সেখানে ক্ষুধায় পীড়িত সেখানে। ভারত উপদ্বীপের দক্ষিণার্ধ জুড়ে মন্বন্তরের প্রকোপ বাংলার সমতুল্য।
দুর্ভিক্ষ থেকে রোগভোগ

মন্বন্তরের দুর্ভোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়াবহ মহামারির কারণে যার ফলে হাজারে হাজারে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। নিরন্ন, রুগ্ন মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে কলেরা, টাইফয়েড জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতুবরণ করছেন। যেখানেই খাদ্যাভাব, সেই সব অঞ্চলেই বিশেষ করে কলেরার প্রকোপ লক্ষ্যণীয়। কলকাতার হাসপাতালগুলি পূর্ণ উদ্যমে কাজ করে যাওয়া সত্ত্বেও কলেরার কারনে মৃত্যুহার হ্রাস পাচ্ছে না। কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০০ মেইল দূরের কোচিন বা ত্রিবাঙ্কুরেও কলেরার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মালাবার জেলার কলেরা আক্রান্ত ৩০ হাজার মানুষের মধ্যে মৃত্যুহার প্রায় ৮০%। মাদ্রাজ প্রদেশের প্রায় সকল জেলায় কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে, এমনটাই বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। হাসপাতালগুলি থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে দিনে প্রায় ৫০ জন করে কলেরা রুগী একেকটি হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন। পরিস্থিতি এতখানি দুরূহ যে রোগী বা ক্ষুধার্ত মানুষের অবস্থা মৃতপ্রায় না হওয়া অবধি হাসপাতাল ভর্তি করছে না এবং সামান্যতম সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে, এমন মানুষকে রাস্তার ধারেই ফেলে রাখা হচ্ছে।
সরকারের কর্তব্য পালন!

প্রশ্ন উঠতে পারে যে সরকার কী করছে এই সামগ্রিক সঙ্কটের সময়? যথারীতি সরকার ক্ষুধার্ত জনগণ, যারা খিদের জ্বালায় খাদ্য দ্রব্যের দোকান গুদাম লুঠ করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের উপর গুলি চালাচ্ছে নয়ত’ রাতে মৃত মানুষের শব স্থানান্তর করছে। সরকারের নিজেদের হিসেব অনুযায়ীই আগস্ট মাসের শেষার্ধ্বেই সরকারী কর্মীরা প্রায় ২৫০০ শবদেহ সৎকার করিয়েছে শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই! সরকার তাঁর কর্তব্য পালন করছে বৈকি!
রাজনৈতিক তর্জা বাদে আর কিছুই করেনি সরকার এই সঙ্কটকালে। সরকার কি ন্যুনতম চিন্তা ভাবনা করেছিল’ খাদ্য দ্রব্যের রেশনে বিতরন করার দাবি কে মান্যতা দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করার? চাল রপ্তানি করা হল’ যে সময়ে অন্নাভাবে মানুষ ক্ষুধার্ত রইল’।
মজুতদারি নিয়ে বিভ্রান্তি
ভারতের শাসকবর্গ এ দেশের মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে এখন উদ্যত হয়েছে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে এই ভয়াবহ মন্বন্তরের জন্য। বলির পাঁঠা খুঁজে বার করার পুরনো পন্থায় আবারো অবতীর্ণ হয়েছে ব্রিটিশ সরকার। বলা হচ্ছে মজুতদারেরাই শুধুমাত্র এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। কিন্তু এই কৈফিয়ত কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
প্রথমতঃ এই বিপুল সংখ্যক ভূমিহীন কৃষক, যারা অভাবনীয় দারিদ্যে দিন কাটায়, তাদের পক্ষে খাদ্যদ্রব্য বেশি পরিমাণে কিনে আগে থেকে মজুত করে রাখা কি আদৌ সম্ভব? ভারতবর্ষে মজুতদারি করতে সক্ষম, এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। যদিবা তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় ও যে মানুষ তাঁদের ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কিছু কিছু খাদ্য দ্রব্য আগে থেকেই মজুত করে রাখছিলেন, তাতেও কি এই ভয়াবহ আকারের দুর্ভিক্ষ ঘটানো সম্ভব? যে কোনো দেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা সরকারের এই বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেবে।
যদি ধরেও নেওয়া হয় যে কিছু পরিমাণ মজুতদারি ঘটেছে, সরকার এই যুদ্ধকালীন সময়ে তার ন্যায্য ধর্ম পালন করে সেই সকল মজুতদারদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কেন?
মজুতদারিকেই এই মন্বন্তরের একমাত্র কারণ সাব্যস্ত করাটা সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক হলেও তা শেষ বিচারে সরকারেরই অপদার্থতার পরিচায়ক। সরকার কি অস্বীকার করতে পারে যে তারা নিজেরাই সামরিক প্রয়োজনে খাদ্যশষ্যের বিরাট অংশ আগে থেকেই কিনে মজুত করে রাখতে গিয়েই খাদ্যশষ্যের দাম বৃদ্ধি করিয়েছে? সামরিক উৎপাদনের সাথে জড়িত শিল্পের কর্মীরা বিনামূল্যে খাদ্যদ্রব্য পাচ্ছেন তাদের কতৃপক্ষের তরফে, যারা স্বপ্ল মূল্যে সেই খাদ্য দ্রব্য সরকারের থেকে সংগ্রহ করছে যাতে বাংলায় সামরিক প্রয়োজনে উৎপাদন ব্যাহত না হয় দুর্ভিক্ষের কারণে। ব্রিটিশ সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী কিছু বড় ইউরোপীয় হোটেলে এলাহি পানভোজনের আইয়োজন রয়েছে যেখানে ক্ষুদার্ত, ক্লিন্ন মানুষ সেই সব হোটেলের জানালা দিয়ে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সরকারের তরফে মজুতদারি কিংবা খাদ্য দ্রব্যের কিছু বিশেষ আমদানি বাদে এই ধরনের এলাহি ভূরিভোজের আয়জন কিভাবে সম্ভব মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের জন্য যাদের এ সরকার স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে না কারণ তারাই এই সরকারের জন্য একটি সুরক্ষাবলয় নির্মাণ করেছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপ্রতীপে, যাদের কোনো সমর্থন নেই এই সরকারের প্রতি। মজুতদারি হয়ে থাকলেও তা সাধারণ মানুষের দ্বারা ঘটেনি বরং সরকার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে থেকেই করা হয়েছে।

বর্মা চাল/ রেঙ্গুন চাল
বর্মা থেকে চালের আমদানির বিষয়ে প্রচুর দাবি করেছে এই সরকার। সেই আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়াই এই মন্বন্তরের কারণ, এমনটাও দাবি করে এই সরকার। কিন্তু এই বক্তব্য’ও অত্যন বিভ্রান্তিকর কারণ বর্মা থেকে আমাদানিকৃত চালে দেশের সামগ্রিক চাহিদার মাত্র ৫% পূরণ হত’ এবং বাকিটা এ দেশেই উৎপাদিত হত’। আরেকটি বিষয় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় যে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া চালের পরিমাণ বর্মা থেকে আমদানি করা চালের তুলনায় বেশিই ছিল’। তাহলে এই খাদ্যাভাবের কারণ কী? শষ্যের ফলনে ঘাটতি নেই যেখানে। এই খাদ্যাভাবের একমাত্র সম্ভাব্য কারণ হল’ সরকারের অদূরদর্শিতা যার ফলে এখনো অবধী ভারত থেকে খাদ্য শষ্য রপ্তানি করা হয়ে চলেছে মধ্যে প্রাচ্যের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য। তদুপরি, ১৯৪২ সনের শুরুতেই জাপানি সেনার ভারতের সীমান্তের দিকে ক্ষিপ্র অগ্রসরতার কারণে সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের তরফেই বিপুল পরিমাণে খাদ্য দ্রব্য কিনে মজুত করতে শুরু করে দেয় যার ফলে খাদ্যদ্রব্যের অতি দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির সূচনা হয়। এর ফলে সঙ্কট যে ঘনাচ্ছে, তা সহজবোধ্য ছিল। সরকারের কাছে জোরালো দাবি রাখা হয় খাদ্যে শষ্যের বন্টনের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করার। সেই সময়ে উপরোক্ত দাবি যদি সরকার মেনে নিত’ তাহলে আজকের এই মর্মান্তিক দুরবস্থাকে অনেকখানি প্রতিহত করা যেত’।
কর্তৃত্বের অভাব?

সরকারের পক্ষ থেকে আরেকটি অজুহাত খাড়া করা হয়েছে যে খাদ্যের বিষয়টি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রদেশগুলির নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সেই কারণে কেন্দ্রীয় সরকার কোনো একটি প্রদেশ কে বাধ্য করতে পারেনা আরেকটি প্রদেশ কে খাদ্য সরবরাহ করতে। কিন্তু, যে ব্যাক্তিরই এ দেশের শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে ন্যুনতম ধারণা রয়েছে, তাঁর কানে এই অজুহাত সম্পূর্ণ উদ্ভট শোনাবে। ১৯৩৫ সনের ভারত সরকার আইন এবং ভারতরক্ষা আইন মোতাবেক বড় লাট একনায়োকচিত ক্ষমতার অধিকারী এবং প্রত্যেকটি প্রদেশের গভর্ণর রা সেই সকল প্রদেশেও একচ্ছত্র প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী এবং শুধুমাত্র বড় লাটের নির্দেশাধীন। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলি ব্রিটিশ ভারতের অর্ধের বেশি অংশ। সেই প্রদেশগুলি এই সময়কালে সম্পূর্ণ আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং অন্যান্য প্রদেশগুলি যেখানে স্বায়ত্ত্বশাসন খাতায় কলমে ছিল, সেখানেও গভর্নরদের বিপুল ক্ষমতা এবং সকল ভারতীয় মন্ত্রী ব্রিটিশ আমলাদের দ্বারাই পরিবৃত ছিলেন, যারা বকলমে শাসন পরিচালনা করে থাকে। কিছুকাল আগেই যখন জাতীয় কংগ্রেস কে দমন করে, মানুষের কন্ঠরোধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত হয়, এই আমলারাই সেই কাজটি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিল’। ভারতের সরকার দমননীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে চিরকালই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্ত আজ যখন জাতীয় জীবনে এত বড় একটি সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে, তখন তারাই প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের কৃত্রিম অজুহাত খাড়া করছে।
বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ
এই নিদারুণ সঙ্কটের সময় সরকারের দায় প্রসঙ্গে জনাব ফজলুল হকের বাংলায় আইনভায় রাখা বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্পষ্ট অভিযোগ করেছেন যে গভর্নরের তরফে আমলাদের উৎসাহিত করা হয়েছে ভারতীয় মন্ত্রীদের কতৃত্ব কে অগ্রাহ্য করতে যেন তাঁদের কোনো অস্তিত্বই নেই! তিনি আরো অভিযোগ করেছেন যে সরকারের এজেন্টদের তরফ থেকে চালের ব্যবসার ক্ষেত্রে বল্গাহীন ফাটকাবাজি করা হয়েছে যার ফলে গ্রামাঞ্চলের প্রবল খাদ্যাভাবের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা থেকে চাল রপ্তানি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এই আশ্বাস দেওয়ার পরেও যে রপ্তানি বন্ধ থাকবে। জনাব ফজলুল হকের আরো বলেছেন যে সরকারের তরফে এক ব্রিটিশ আমলা কে ‘রাইস কন্ট্রোলার’ হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে সংস্লিষ্ট মন্ত্রকের সাথে কোনো রকম আলোচনা না করেই, যেই মন্ত্রক খাতায় কলমে নাকি স্বাধীন তাঁর নিজস্ব কাজের ক্ষেত্রে এবং যে মন্ত্রকের তরফে দাবি ছিল কোনো অভিজ্ঞ ভারতীয় কর্মচারীকেই এই পদে নিযুক্ত করার। প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্থ ব্যাক্তির এই সকল বক্তব্য স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা সর্বৈব মিথ্যা। আরেকটি বিষয় এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে জনাব ফজলুল হকের তরফে এই দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে একটি রয়াল কমিশন নিয়োগের দাবিকেও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে।
মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ
ব্রিটিশ সরকার যে এই সঙ্কটের মোকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, তা বেশ কিছু ব্রিটিশ সংবাদপত্রেও লেখা হয়েছে। “ক্যালকাটা স্টেস্ম্যান” পত্রিকা, যার অচলা রাজভক্তি প্রশ্নাতীত, তারা অবধি লিখেছে যে “সবচাইতে চোখে পড়ার মত বিষয় হল’ কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক, দুই স্তরেই এ দেশের সরকারের অদূরদর্শীতা এবং পরিকল্পনার সমূহ অভাব”। “আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে বাংলার এই দুর্ভিক্ষ ১৯৩০ এবং ১৯৩১ সালের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরে সর্ববৃহৎ প্রশাসনিক ব্যর্থতা… বর্তমান কালের প্রশাসনিক ব্যবস্থার নিরিখে বলতে হয় যে এই ব্যর্থতার দায়ভার সম্পূর্ণরূপে সরকার ও তাদের এ প্রদেশের প্রতিনিধিদের ওপর বর্তায়”।
“ডেইলি মেল” পত্রিকাতেও উপরোক্ত সুরেই লেখা হয়েছে। এই পত্রিকা অনুযায়ী “ব্রিটিশ সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কেই মিলিতভাবে এই দুর্ভিক্ষের দায় ও দায়িত্ব নিতে হবে”। “অবজার্ভার” পত্রিকায় বলা হয়েছে “খাপছাড়া পদক্ষেপ এবং সেকেল প্রশাসন” এই অবস্থার আরো অবনতি ঘটিয়েছে। “টাইমস” পত্রিকাও ১লা সেপ্টেম্বরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে “এই সঙ্কট বৃদ্ধি পেয়েছে সরকারের তরফে অনেক দেরিতে হস্তক্ষেপের কারণেই” এবং ১১ই অক্টোবরে ঐ পত্রিকাতেই বলা হয়েছে “বাংলা এই দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করছে এক ভেঙ্গে পড়া প্রশাসন সম্বল করেই”। এই সকল স্পষ্ট বক্তব্য যা কিনা ব্রিটিশপক্ষের সমর্থকদের থেকেই শোনা যাচ্ছে এই মারাত্মক সঙ্কটের অভিঘাতে, বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আদতে দায়িত্ব টা কাদের। এর দায় এই ব্রিটিশ সরকারের।
প্রস্তাবিত পদক্ষেপ
এখন,তাহলে করণীয় কী? সরকারের নেওয়া সকল পদক্ষেপ ই যে অপ্রতুল সেটা তাদের নিজেদের তরফের বক্তব্যেই স্পষ্ট। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কলকাতা শহরে যে রেশন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার কথা ছিল, তা নভেম্বরের মাঝের আগে শুরু হবে না, এমন টা জানিয়েছে “টাইমস” পত্রিকা। মিস্টার এমেরি’র নেতৃত্বাধীন এ দেশের শাসকরা তাদের সেই চূড়ান্ত অসভ্য উদাসীনতা দেখিয়ে যাচ্ছে যা তাদের এ দেশ শাসনের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গী। ভারতের মানুষ ক্ষুধার্ত রয়েছে যে সময় অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার কাছে উদবৃত্ত খাদ্যশষ্য রয়েছে। অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রী, মিস্টার উইলিয়াম স্কালি ঘোষণা করেছেন যে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে বাংলা এবং দেশের অন্যান্য দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলগুলির প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য শষ্য পাঠানো সম্ভব এবং শুধুমাত্র তা জাহাজে চাপিয়ে পৌঁছে দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি এই সকল জাহাজে করে খাদ্য আমাদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে যাতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই দেশের মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি করা সম্ভব হয় দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণেঃ ১। ভারতের মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ এতটাই নেমে গেছে যে তা আর নামানো সম্ভব নয়; ২। অতি নিকট ভবিষ্যতে সবচাইতে বড় সামরিক অভিযানের সম্ভাব্য অঞ্চল হল’ বাংলা যা কিনা প্রবলভাবে দুর্ভিক্ষপীড়িত। “টাইমস” পত্রিকার প্রতিবেদন থেকেই আবারো বলা যেতে পারে যে “বাংলার সামরিক গুরুত্বের কারণেই এই প্রদেশে দুর্ভিক্ষের নিবারণে দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থা করা একটি সামরিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক কর্তব্য”।
আমরা আরো দাবি জানাচ্ছি ভারত সরকারের কাছে যে ভারত থেকে অন্যত্র খাদ্যশষ্যের রপ্তানি, তা যদি এই মুহূর্তে চালু থাকে, তা অবিলম্বে বন্ধ করা হোক। এই যুদ্ধের গোটা সময়কালে ভারতকে খাদ্যশষ্যের আমদানির জন্য চিহ্নিত করা হোক, রপ্তানির পরিবর্তে। এ দেশের এই মুহুর্তে খাদ্যের চাহিদা মারাত্মক। গ্রেগরি কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী এ দেশে বার্ষিক ১০ লক্ষ টন খাদ্যশষ্যের আমদানি করা উচিত বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন না ঘটা অবধি এবং তার মধ্যেও বাড়তি আরো ৫ লক্ষ টন প্রথম বছরেই আমদানি করা উচিত কেন্দ্রীয় স্তরে রিজার্ভ সৃষ্টি করার জন্য।
তদুপরি ভারত সরকারের তরফে জরুরি অবস্থার মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করে রাখা প্রয়োজন এবং প্রাদেশিক স্তরে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, যার ফলে এই সঙ্কট আরো ঘনীভূত হচ্ছে, তাকে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে একটি জাতীয় স্তরে প্রতিনিধিত্বমূলক খাদ্য বোর্ড গঠন করা হোক যাতে খাদ্যের নিয়মিত যোগানের লক্ষ্যে সকল প্রশাসনিক স্তরের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো যায়, খাদ্যদ্রব্যের দাম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং কেন্দ্রীয় খাদ্য শষ্যের রিজার্ভ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বন্টন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা যায়। শ্রী পি সি যোশী অভিযোগ করেছেন যে স্বেচ্ছা ও স্বাধীন উদ্যোগে গঠিত খাদ্য কমিটিগুলির কাজকে ব্যাহত করা হয়েছে সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা। বাংলার গভর্নরকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে এই সকল খাদ্য কমিটিগুলির কাজ ব্যাহত না করা হয় এবং তাদের সাথে সহযোগীতা নিশ্চিত করা হয়।
রেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে অন্ততঃ শহরাঞ্চলে। কিন্তু সবচাইতে বড় কাজটা হল’ বৃহদাকারে খাদ্যশষ্যের আমদানির ব্যবস্থা কে শক্তিশালী করা। ত্রাণের ব্যবস্থার জন্য এটিই সর্ব প্রথম প্রয়োজন।
যে মহামারি শুরু হয়েছে তাকেও মোকাবিলা করতে হবে ক্ষিপ্রগতিতে ও সুষ্ঠুভাবে। যুদ্ধোত্তর ইউরোপের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য প্রচুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ইংল্যান্ডে তথা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থা এবং ত্রাণ সমিতি গঠন করা চলছে সেই উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভারতে, যেখানে কিনা কোনো জার্মান বাহিনী এই ধরণের ত্রাণের উদ্যোগকে ব্যাহত করার জন্য দাঁড়িয়ে নেই, সেইখানে এই ধরণের উদ্যোগের অভাব বড় প্রকট। অবিলম্বে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত মেডিকাল রিলিফ কমিটি ভারতে প্রেরণ করা প্রয়োজন এই মহামারি কে প্রতিরোধ করার জন্য। যে সকল ডাক্তারদের এই কাজে নিয়োজিত করা হবে তারা এক অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবেন অন্যত্র এই ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে। এই মহামারি ভারতে আরো দুর্বিষহ সঙ্কট সৃষ্টি করার আগেই এই মেডিকাল রিলিফ কমিটি পাঠানোর উদ্যোগ প্রয়োজন।
আমাদের শেষ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল’ ভারতের জনগনের নেতাদের কারাবাস থেকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক যাদের কে লজ্জাজনক ভাবে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে এবং তাদের সকল প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হোক এই পরিস্থিতিকে সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করার স্বার্থে। জনগণের সমর্থন তাঁদের সাথে রয়েছে এবং সেই কারণেই শুধুমাত্র তাঁদের পক্ষেই সম্ভব সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া।
ভবিষ্যৎ

এ দেশে ব্রিটিশ সরকারের শাসনের রেকর্ড খুব একটা গৌরবোজ্জ্বল নয়। মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের দাবির ক্ষেত্রে বর্বর চন্ডনীতির প্রয়োগ সেই রেকর্ডের অংশ। এই সরকার ইতিমধ্যেই এ দেশ শাসন করার অধিকার হারিয়েছে। কিন্তু তাদের দ্বারাই সৃষ্ট এই সঙ্কটের সামনে তারা যদি তাদের সেই চিরাচরিত উদাসীনতা বজায় রাখে এবং এত বিপুল পরিমাণে মানুষকে মৃত্যুমুখে পতিত করে, ব্রিটিশদের সাথে ভারতীয়দের আত্মিক বিচ্ছিন্নতা চরম আকার ধারণ করবে। কোন রকমেরই মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে তারা তাদের এই সাঙ্ঘাতিক অপরাধের থেকে নিষ্কৃতি পাবে না এবং এই দেশ তাদের এই চরম অপরাধ কোনোদিন ভুলতে পারবে না।
ব্রিটেনের জনগণ! ভারতের মানুষের সম্মিলিত দাবি এই মুহূর্তে খাদ্য ও স্বাধীনতার। আপনাদের মধ্যে যারা সেই সকল নীতিসমূহে আস্থাশীল, যা রক্ষা করার স্বার্থে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ লড়া হচ্ছে আজ, আপনাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করেন যে প্রতিটি মানুষই নিজেকে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী এবং নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হওয়ার অধিকার রাখেন, এই সকল দাবিসমূহের মধ্যে খুঁজে পাবেন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে একটি জাতির ন্যায্য দাবি যা কিনা আপনাদের ও মৌলিক দাবিগুলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আমরা এই কারণে আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি যে আপনারা আপনাদের সরকার এবং ভারতের শাসকদের উপর চাপ সৃষ্টি করুন যাতে এই পরিস্থিতির প্রশমনে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ভারতের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক যদি ভবিষ্যতে উন্নত করতে হয়, যদি অক্ষশক্তিরsস প্রচারকদের রসদ যোগানো বন্ধ করতে হয়, ভারতকে সাহায্য পাঠানো এই মুহূর্তে অত্যাবশ্যক।
ভারতের প্রয়োজন আজ মারাত্মক, ভারতের অবস্থা আজ অত্যন্ত কঠিন এবং মুহুর্তকাল বিলম্বের ও সময় নেই।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ বাবিন ঘোষ
* মূল প্যাম্ফলেটটি ব্রিটিশ লাইব্রেরির সগ্রহ থেকে সুচিন্তন দাশের সৌজন্যে প্রাপ্ত। দিল্লীর সাংকৃত্যায়ন-কোসাম্বি পাঠচক্র এটি পুনঃপ্রকাশ করে ২০২২ সালের মে মাসে। অধ্যাপক উৎসা পট্টনায়েক সেই সংস্করণের ভূমিকা লিখে দেন। মূলপাঠের প্রতিলিপি করেন শশী সিংহ ও রাজর্ষি অধিকারী। প্রমাদ সংশোধন ও সম্পাদনা করেন বিঘ্নেশ টেকরিওয়াল, অনন্য চক্রবর্তী ও সুচিন্তন দাশ।