বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ ও তাঁর ডেপুটি তথা “দেশকে গদ্দার…” স্লোগান খ্যাত অনুরাগ ঠাকুর ইংরাজি ও হিন্দি তে সাংবাদিক সম্মেলন করে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’ ঘোষণা করল। ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা শুনলেই মনে হবে বিপুল টাকা …খুব স্বাভাবিক। যে দেশে প্রায় ৭০ ভাগ মানুষের দৈনিক রোজগার ১২০ টাকার কম মানে মাস গেলে ৩৬০০ টাকার কম সে দেশের সরকার করোনার এই ভয়াবহ সংক্রমণের সময়ে বাধ্য হয়ে লকডাউন করছে গোটা দেশ জুড়ে। ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা অনেক তো বটেই । কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে এই পরিমাণ টাকা আদৌ অনেক নয়…তবে নিঃসন্দেহে বেশ কিছুটা বিশেষত এইরকম মহামারির সময়ে। এটা যথেষ্ট নয় এইটুকু বলাই যায়। কারণ ?
১. ভারতের ২০১৯-২০ সালের আনুমানিক জিডিপি হল ২০৪.৪ লক্ষ কোটি টাকা ! অর্থাৎ ভারত সরকার তার জিডিপি-র মাত্র ০.৮% শতাংশ এর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে এই ভয়াবহ মহামারির সময়ে লকডাউনের জন্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা এই একই সময়ে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের , টাকার হিসেবে ধরলে ১৬৬ লক্ষ কোটি টাকার। আমেরিকার জিডিপি-র ১০% বরাদ্দ করা হয়েছে এই মহামারি রুখতে ও লকডাউনের সময়ে সমস্ত মানুষের বেঁচে থাকার রসদ পৌঁছে দিতে। জার্মানি ব্যয় করছে জিডিপির ১২% । আমেরিকার মত উন্নত পরিকাঠামোর , শক্তিধর দেশ তার জিডিপির ১০% ব্যয় করছে সেখানে ভারত সরকার ব্যয় করছে মাত্র ০.৮% ।
২. দেশ জুড়ে প্রায় ২২ লক্ষ ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা এই ভয়াবহ কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে, আক্রান্তদের সুস্থ করতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করছেন। ইতালি সহ বিভিন্ন প্রথম বিশ্বের দেশে আমরা দেখেছি কীভাবে এঁরা সবথেকে বেশি সংক্রমণের ভয়কে উপেক্ষা করে লড়াই করছেন এমনি অনেকের মৃত্যুও ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এদের প্রত্যেকের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমা করা প্রশংসার যোগ্য। এর জন্য সরকাকরের ব্যয় হবে আনুমানিক ১১০০ কোটি টাকা। কিন্তু এর সুবিধা তখনই পাওয়া যাবে যখন তারা নভেল করোনা আক্রান্ত হবেন। অর্থাৎ, আসলে প্রিমিয়ামের টাকা পকেটে পুরে লাভবান হবে বীমা কোম্পানিগুলো। এই মুহুর্তে এই ২২ লক্ষ মানুষই আমাদের সবথেকে বড় আশা ভরসা। এঁদের কারুর সংক্রমণ মানে ভয়াবহ বিপদ। অথচ এঁদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে যথেষ্ট পরিমাণ N95 mask, PPE(Personal Protective Equipment), hand sanitizer এর ব্যবস্থা করলে বরং এই মানুষগুলো অনেক বেশি স্বস্তি বোধ করতেন।
৩. ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। অপুষ্টির এই দেশে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। একটি বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবার মাস গেলে মাথা পিছু ৭ কিলো করে চাল/গম পায়। ভারতের মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশকে আগামী ৩ মাস অতিরিক্ত সমপরিমাণ চাল/গম দেওয়া হবে বিনামূল্য এছাড়া পরিবার প্রতি ১ কেজি করে ডাল ও দেওয়া হবে আগামী ৩ মাস। টাকার পরিমাণ হিসাব করলে প্রায় ৪৫০০০ কোটি টাকার প্রকল্প এটি। কিন্তু বাস্তব হল এটাই যে FCI এর Buffer Stock এর পরিমাণ ৭.৫৩ কোটি টন- ভারতের ইতিহাসে সর্বাধিক পরিমাণ মজুত ! পরবর্তী শস্য সংগ্রহের মরসুম আসন্ন তার আগে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যের কোন একটা ব্যবস্থা সরকারকে করতেই হত নাহলে তা নষ্ট হত। বাস্তবে এই ৪৫০০০ কোটি টাকা সরকারকে অতিরিক্ত খরচ করতেই হচ্ছে না কারণ এই খাদ্যশস্য ইতিমধ্যেই সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকদের থেকে সংগ্রহ করেছে এখন তার খরচটা তারা বলেছে মাত্র !
৪. “প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার আওতায় কৃষকদের পিএম–কিষাণ যোজনার আওতায় এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই প্রথম কিস্তির ২ হাজার টাকা মিটিয়ে দেওয়া হবে। এই কর্মসূচির আওতায় ৮ কোটি ৭০ লক্ষ কৃষক উপকৃত হবেন। “ টাকার অঙ্কে ১৬০০০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালে নির্বাচনের আগেই এই প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সরকার গঠনের পরে ২০২০-২১ এর বাজেটে এর জন্য বরাদ্দ অর্থের প্রথম কিস্তি দেওযা হচ্ছে মাত্র।
৫. “পিএম গরিব কল্যাণ যোজনার আওতায় নগদ হস্তান্তর– প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনার আওতায় ২০ কোটি ৪০ লক্ষ মহিলা অ্যাকাউন্টধারীকে আগামী তিন মাস প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে এককালীন অনুদান দেওয়া হবে।
পিএম গরিব কল্যাণ যোজনার আওতায় আগামী তিন মাস ৮ কোটি দরিদ্র পরিবারকে নিখরচায় রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার দেওয়া হবে।“
৫০০ টাকা করে ৩ মাসে ১৫০০ টাকার ক্ষেত্রে মোট খরচের হিসাব ধরা হয়েছে ৩১০০০ কোটি টাকা কিন্তু এটাও কোন প্রকল্প খাত থেকেই বরাদ্দ করা হবে , পরিকল্পনা বহির্ভূত কোন খরচ নয়।
মাত্র ৩ মাস বিনামূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়ার জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১৩০০০ কোটি টাকা। যদিও এই লকডাউনের কারণে আদৌ সিলিন্ডার refill করা ও তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছানো কতটা সহজ হবে বলা মুশকিল। এছাড়া ৩টে সিলিন্ডার না ফুরালে সেগুলো পরবর্তীতে ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটাও স্পষ্ট নয়।
৬. “সংগঠিত ক্ষেত্রে কম আয়ের মানুষদের সহায়তা – ১০০ জনের কম শ্রমিক রয়েছেন, এমন ব্যবসায় মাসিক ১৫ হাজার টাকার কম উপার্জনকারীদের সহায়তা দেওয়া। কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন, এই ঝুঁকির নিরিখেই উক্ত সহায়তার কথা বলা হয়েছে। এই প্যাকেজের আওতায় সরকার আগামী তিন মাস কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন এমন শ্রমিকদের ভবিষ্যনিধি অ্যাকাউন্টে ২৪ শতাংশ অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এই অনুদানের ফলে কর্মীহীন হয়ে পড়ার প্রবণতা খানিকটা কম হবে।”
এই খাতে ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রথমত এই সংস্থাগুলোকে কীভাবে নির্ধারন করা হবে তার কোন রূপরেখা বলা হয়নি, দ্বিতীয়ত শ্রমিকদের উপার্জনের সুস্পষ্ট তথ্য ভান্ডার আদৌ সরকারের কাছে আছে কিনা জানা নেই।
৭. “প্রবীণ নাগরিক (ষাটোর্ধো), বিধবা ও দিব্যাঙ্গদের সহায়তা– কোভিড–১৯ সংক্রমণের প্রেক্ষিতে অর্থনীতির ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়তে চলেছে, সেকথা বিবেচনায় রেখে দিব্যাঙ্গ শ্রেণীর প্রায় ৩ কোটি বয়স্কা বিধবা ও মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।সরকার এদের সকলকে আগামী তিন মাস কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে ১ হাজার টাকা করে অনুদান দেবে।”
এইখাতে ৩০০০ কোটি টাকা খরচ হবে, কিন্তু এই টাকার যোগান কোথা থেকে হবে জানা নেই আর মাত্র ১০০০ টাকায় তিনমাস চালানো মানে দৈনিক ১১ টাকায় কীভাবে জীবনধারণ সম্ভব জানা নেই।
৮. “এমজিএনআরইজিএ– প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার আওতায় এমজিএনআরইজিএ বাবদ মজুরির পরিমাণ পয়লা এপ্রিল থেকে ২০ টাকা করে বাড়ছে। এই মজুরি বৃদ্ধির ফলে এমজিএনআরইজিএ – এর কর্মীদের বার্ষিক ২ হাজার টাকা অতিরিক্ত উপার্জন হবে।এর ফলে, প্রায় ১৩ কোটি ৬২ লক্ষ পরিবার উপকৃত হবে। “
সরকারি হিসাবে ১৮২ টাকা থেকে মজুরি বাড়িয়ে ২০২ টাকা করা হয়েছে। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক কৃষি শ্রমিকদের জন্য ভোক্তা মূল্য সূচকের উপর ভিত্তি করে একটি সূত্র অনুসরণ করে (Consumer Price Index for Agricultural Labourer -CPI-AL) )প্রতি বছর মজুরি সংশোধন করে এবং প্রতি বছর এপ্রিলের শুরুতেই এই কাজটি করা হয়। এর জন্য যে ৫৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দর ঢক্কানিনাদ সরকার করছে তা আসলে বাজেটেই বরাদ্দ ছিল , কোন অতিরিক্ত খরচ করা হচ্ছে না । তাছাড়া এই মজুরি পাওয়া যায় কাজের ভিত্তিতে , লকডাউনে যেখানে কাজ বন্ধ সেখানে এই টাকা কৃষি শ্রমিকদের কাছে কিভাবে পৌঁছাবে একটা বড় প্রশ্ন সেটাই।
৯. “স্বনির্ভর গোষ্ঠী – ৬৩ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠির মাধ্যমে ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ পরিবারকে সহায়তা। কোনও রকম বন্ধক ছাড়াই ঋণ সহায়তার পরিমাণ ১০ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ লক্ষ টাকা।”
এক্ষত্রে খরচ ধরা হয়েছে ১৩৯০০ কোটি টাকা যার সংস্থান হবে বিভিন্ন খাত থেকে। বাস্তবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ঋণের পরিমান বৃদ্ধি করা এর সাথে সংযুক্ত ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ পরিবারের কাছে অর্থহীন কারণ বর্তমানে লকডাউনে এদের সমস্ত কাজ থমকে গেছে। তাদের টিঁকে থাকতে এবং সুস্থ থাকতে অর্থ সাহায্য প্রয়োজন।
১০. “সংগঠিত ক্ষেত্র – কর্মচারী ভবিষ্যনিধি তহবিল সংক্রান্ত নীতি-নির্দেশিকাগুলি সংশোধন করা হবে, যাতে তহবিলে জমাকৃত মোট অর্থের ৭৫ শতাংশের অথবা ৩ মাসের বেতনের যেটা কম সেই নন-রিফান্ডেবল অ্যাডভান্সকে রিফান্ডেবল হিসাবে গণ্য করে মহামারীজনিত পরিস্থিতিকে সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্দেশিকায় সামিল করা যায়। এর ফলে, কর্মচারী ভবিষ্যনিধি তহবিলের আওতায় নথিভুক্ত ৪ কোটি শ্রমিক পরিবার উপকৃত হবে।” বাস্তবে এতে সরকারের কোন খরচই নেই কারণ এক্ষেত্রে কর্মচারিরা তাদের সঞ্চিত অর্থই তুলছেন।
১১. “ভবন ও অন্যান্য নির্মাণ কর্মী কল্যাণ তহবিল – একটি কেন্দ্রীয় সরকারি আইনের আওতায় ভবন ও অন্যান্য নির্মাণ কর্মীদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এই তহবিলে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লক্ষ নথিভুক্ত শ্রমিক রয়েছেন।আর্থিক সমস্যা থেকে এই শ্রেণীর শ্রমিকদের সুরক্ষা দিতে রাজ্য সরকারগুলিকে সংশ্লিষ্ট তহবিল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে।”
৩১০০০কোটি টাকা রাজ্যগুলোর কাছে এই খাত বাবদ রয়েছে কোন অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয়নি। সেক্ষত্রেও এই টাকা রাজ্যগুলো কোন শর্তে ও কীভাবে খরচ করবে তার সুস্পষ্ট কোন গাইডলাইন দেওয়া হয়নি।
১২. “জেলা খনিজ তহবিলের আওতায় কোভিড–১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও অন্যান্য জরুরি বিষয়ে যোগান ও সরবরাহ বাড়াতে রাজ্য সরকারগুলিকে সংশ্লিষ্ট তহবিল ব্যবহারে অনুমতি দেওয়া হবে। এছাড়াও, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার কাজেও এই তহবিল সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে।”
প্রথমত, এই খাতে কত পরিমাণ টাকা আছে জানা নেই । দ্বিতীয়ত, এই খাতের টাকা রাজ্য সরকারগুলো ঋণ হিসাবে নাকি সঞ্চয় থেকে খরচ হিসাবে ব্যবহার করবে তারও কোন সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়নি।
বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসা বা আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বিপুল অংশ এখনও তাদের নিজদের ঘরে ফিরতে পারেননি। শ্রম মন্ত্রকের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও অতীতের অর্থনৈতিক সমীক্ষাগুলোর হিসাব অনুসারে ভারতের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ২০% ই পরিযায়ী। লকডাউনের ফলে বিভিন্ন স্থানে আটকে থেকে তারা আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। তাদের ও তাদের পরিবারগুলোকে এই ২১ দিনের লকডাউনে বেঁচে থাকার রসদ কীভাবে যোগান হবে তার কোন কথাও এই প্যাকেজে বলা হয়নি। এছাড়া অসংগঠিত ও স্বরোজগার শ্রেনীভুক্ত ঠ্যালা-রিক্সা-অটো চালক, মুচি, দর্জি, ছোট দোকানদার এই যে বিপুল জনসংখ্যা তারাও কীভাবে এই প্যাকেজে উপকৃত হবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ কোটি টাকা কর্পোরেটদের করছাড় দেওয়া সরকার এই ভয়াবহ সঙ্কট মুহূর্তেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের প্রতি তার কর্তব্য বিস্মৃত হল।