সৌভিক ঘোষ
বাবরি নামে ভারতে একটা মসজিদ ছিল।
৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২- সেই ইমারত ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
হাতুড়ি, গাঁইতি, শাবল এবং আরও যা কিছু দিয়ে আঘাত করা যায়- সবই প্রয়োগ করা হয়েছিল।
যা কিছু মাথায় চেপে বসলে স্রেফ ঘৃণার কারনে একটা ইমারত গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, প্রয়োগ হয়েছিল তাও।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের অন্তর্গত অযোধ্যায় যা ঘটেছিল, তাকে স্বাধীন ভারতের লজ্জা বললেও কম বলা হবে। বর্বরদের সংখ্যাগরিষ্ঠের গাজোয়ারিটিও বর্বরোচিতই বিবেচিত হয়, গণতান্ত্রিক হয় না। আমাদের দেশের সংবিধান সেই মূল্যবোধেই নির্মিত। আর তাই লালকৃষ্ণ আদবানি যা বলেছিলেন সেটাই মনে রাখতে হয়- ওখানে কোনও সময় মন্দির ছিল কি ছিল না, মাটির তলায় বিজ্ঞানসম্মত খননকার্যে কি প্রমাণ পাওয়া গেছে বা যায়নি এগুলি কোনও আলোচনার বিষয়ই নয়, আসল কথা হল দেশের বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস ওটাই রামের জন্মস্থান। অর্থাৎ, সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগের অজুহাতে দুর্বৃত্তির ন্যায্য হয়ে ওঠার যুক্তি হাজির করা।
এহেন বর্বর, নির্লজ্জ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি আমাদের দেশে আগে থেকেই ছিল?
ইতিহাস তেমন কিছুর প্রমাণ দেয় না।
‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি,
দুটি যদি জোটে অর্ধেক তার,
ফুল কিনিও হে অনুরাগী’
এই হল ফুল প্রসঙ্গে হজরত মহম্মদের নির্দেশ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনুবাদ করেছিলেন। এমন নির্দেশ যে বইতে লেখা রয়েছে তাকেই আমরা হাদিস বলে চিনি। মানবিক চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সেই নির্দেশকেই বাংলা কবিতার ছন্দে এনেছিলেন কবি। বিপরীত উদাহরণও কম না। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরেই ইউরোপ আমাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে বলে প্রচার করেন যারা এবং তাতে আকণ্ঠ বুঁদ হয়ে মজেন যে ভক্তকূল তারাও জেনে রাখুন, মির্জা গালিব নামে একজন ছিলেন। ধর্মপ্রাণ ছিলেন না একথা বলা যাবে না, বরং ঈমান সম্পর্কিত অনুভব কবিকে একটু বেশিই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।
‘জাহিদ, সরাব পিনে দে
মসজিদ মে বৈঠ কর।
ইয়া ফির উও জগা বতা দে-
যাঁহা খুদা না হো’
নিছকই ধর্মপ্রাণ হলে এমন কথাবার্তা কেউ লিখে রাখে না, মির্জা কবি ছিলেন বলেই যুক্তিজালের এমন অলংকার। ভারতীয় সভ্যতার অহংকার বলে যদি কিছু হয় তা হয়ত এমনই ঐতিহ্যে নিহিত।
এসবই আমাদের দেশের ইতিহাস, দেশের বুকে বসবাসকারীদের সমবেত জীবনচর্চার ইতিহাস।
ষড়যন্ত্রের শিকড় সন্ধানে প্রথম ঘটনাঃ
অভি তো পহেলি ঝাঁকি হ্যায়,
কাশি মথুরা বাকি হ্যায় –
বলে চিৎকার করতে শিখেছিল যে কৈশোর, যে যৌবন তারা কি আদৌ জানত ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে এদেশের জনসাধারণ যাকে নিজেদের কম্যান্ডার ঘোষণা করেছিল তার নাম জাফর- বাহাদুর শাহ জাফর। যদিও সেইবার যুদ্ধ শেষে পরাজিত হই আমরা। ভারতের শেষ স্বাধীন সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ’কে দেখা যায় নিজের দরারের মেঝেয় বসে থাকতে।
মাটিতে বসে রয়েছেন কেন বাদশাহ?
তার সামনে একটি বিশাল থালায় করে চাদর মূড়ে পেশ হতে চলেছে এক ভেট। সেই ভেট এসেছে ব্রিটিশ রাজের পক্ষ থেকে। হিন্দুস্তানের বাদশাহের প্রতি ব্রিটিশ রাজের শেষ উপহার।
বাহাদুর শাহ জাফর তখন ৮৭ বছরের বৃদ্ধ- মুঘল রাজপরিবারে কবিতা, সুর ও সংস্কৃতির অপূর্ব সমাহার যে দুজনের মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে দুজনেই অভিশাপের জীবন কাটিয়েছেন। প্রথমজন দারাশুকো- উপনিষদের ফার্সি অনুবাদ করেছিলেন এমন এক শাহজাদা। তার সেই অসামান্য কাজেরই বদান্যতায় সারা পৃথিবীতে প্রাচীন ভারতের দর্শন সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়, ইংরেজরাও জানতে পারে প্রাচীন ভারতে দর্শন বলতে আসলে কি ছিল, কেমন ছিল।
দ্বিতীয়জন জাফর নিজে। বাহাদুর শাহ জাফর। ইংরেজ বাহিনী তখৎ দখল নিতে আসছে শুনে যিনি রাজসভার মালিকে ডেকে হুকুম করেন যে রাস্তা দিয়ে সাদা চামড়ার সেনাবাহিনী ধুকবে সেই গোটা রাস্তাটাই গোলাপের বাগিচায় পরিণত করতে হবে। ওরা কতটা বর্বর সেকথা ওরা নিজেরাই জানেনা, আমরা ওদের বোঝাব- শত্রুকে আহ্বান করতে গিয়েও মুঘলরা গোলাপ ফুল এগিয়ে দেয়।
সেই জাফর আজ নিজেরই রাজসভার মেঝেতে বসে রয়েছেন।
উপহারের থালাটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। জাফরের চোখ কি একটু কম দেখছে, নাকি তার চোখে জল? কাছে আসতে দেখলেন থালার উপরে সাদা চাদরের তলায় চাপা রয়েছে কিছু যেন। লাল রক্তে রাঙা হয়ে উঠছে সেই চাদর একটু একটু করে।
বাদশাহের সামনে নামিয়ে রাখা হল সেই উপহারের ডালি। শীর্ণ আঙ্গুলে তুলে ধরলেন চাদরের একটা খুঁট। রক্ত… আর তিনটি নরমুণ্ড। একবারেই চিনলেন বাদশাহ, তার দুই সন্তান ও নাতি। একটু আগেই কেল্লার দখল নিয়েছে ব্রিটিশ সেনানায়ক হাডসনের বাহিনী। পরাজিত হয়েছে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ- ১৮৫৭ সাল।
রাজপরিবারের সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে- কেল্লায় ঢুকেই হাডসন অর্ডার দিয়েছিলেন। যারা গ্রেফতার করলেন তারাও জানতেন না এর পরে কি হতে চলেছে। সাধারণ সেনা মানে তো হুকুমের চাকর, সাম্রাজ্যবাদের বাহিনী মানে তো আরও বর্বর। হাত বেঁধে সামনে আনা মাত্রই দুজন কিশোর ও একটি শিশুর বুকে পিস্তল চেপে ধরলেন হাডসন। তিনি ব্রিটিশ অহংকারের প্রতীক- খুব ভালো করেই জানেন, ভারতীয়দের বুকে ত্রাস জাগিয়ে তুলতে না পারলে তারা আবার জেগে উঠবে। তাই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি চালিয়ে দিলেন, দুটি কিশোর দেহ সটান মাটিতে ছিটকে পড়ল।
বাদশাহ জাফরের দুই সন্তান মির্জা মুঘল ও মির্জা সুলতান।
আরেকবার চলল কোল্ট পিস্তলের গুলি। এবার একটি শিশু ধপ করে মাটিতে পড়ে একবার কেঁপে উঠেই থেমে গেল। এই লাশ বাদশাহ জাফরের নাতি মির্জা আবুবখ্তের।
সাম্রাজ্যবাদ ঠাণ্ডা মাথাতেই খুন করে। কিন্তু হাডসন আরও বেশি কিছু চাইছিলেন। অনেক কষ্টে বিপ্লবকে পরাজিত করা গেছে। এতো বড় দেশ, আরেকবার একসাথে মিলে জেগে উঠলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বন্দুকে অত গুলি নেই যত মানুষ ছুটে আসবে।
তাই এমন শাস্তি চাই যাতে জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টি করা যায়। সেই সন্ত্রাসবাদীর চামড়ার রঙই এমন যে নিশ্চিন্তে বলা যায় শ্বেতসন্ত্রাসের সামনে শুধু লাল ফৌজ লড়েনি, এদেশেও তার উদাহরণ আছে।
তিনটি মৃতদেহের মাথা কেটে ফেলার হুকুম দেওয়া হল। কেটে নেওয়া হল।
মুণ্ডহীন তিনটি লাশ ঝুলিয়ে দেওয়া হল চাঁদনি চকে… তিনদিন…. ওখানেই… ওভাবেই।
মাথাগুলির কি হবে?
এইবারেই ব্রিটিশ সভ্যতার আসল পরিচয় পাওয়া যাবে। সেনানায়ক হাডসন তিনটি কাটা মাথা সাদা চাদরে মূড়ে পাঠিয়ে দিতে বললেন বাদশাহের দরবারে, উপহারের ডালি সাজিয়ে সেই কাটা মাথা পৌঁছাল জাফরের রাজসভায়।
ততক্ষণে পরাজিত বাদশাহের চারদিকে ঘিরে রয়েছে ব্রিটিশ সেনা… সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন হাডসন নিজে।
আর হিন্দুস্তানের শেষ স্বাধীন বাদশাহ মাটিতে বসে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তাকেই নিজেদের কম্যান্ডার ঘোষণা করেছিল।
শীর্ণ আঙ্গুলে তুলে ধরলেন চাদরের একটা খুঁট। রক্ত… আর তিনটি নরমুণ্ড। একবারেই চিনলেন বাদশাহ, তার দুই সন্তান ও নাতি। পেশ হওয়া উপহার যত দুর্বিনীতই হোক তা গ্রহণ করতে হয়- এটাই মুঘল শিভ্যালরি।
হাডসনের মুখে তখন বিজয়ীর হাসি। একটা লম্বা সময় তিনি ভারতে কাটিয়েছেন… অশিক্ষিতের মতো ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দু তিনিও বলতে শিখেছিলেন…
সন্তানের কাটা মাথা হাতে নিয়ে বসে থাকা পরাজিত বাদশাহের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সেনানায়ক লাম্পট্যের দু কলি ছুঁড়ে দিলেন, থুতুর মতোই…
‘দমদমে মে দম নেহি,
অব খ্যায়ের মাঙ্গো জান কি।
ইয়ে জফর ঠন্ডি হুই,
নঙ্গে হিন্দুস্তান কি।।’
বাদশাহ… মুঘল বাদশাহ… যখন একের পর এক দেশিয় রাজন্যবর্গ ব্রিটিশের সামনে মাথা নামিয়ে চলেছেন… কিছু পাওয়ার আশায়, নাহলে ভয়ে তখন বাহাদুর শাহ জাফর রাজী হয়েছিলেন প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের কম্যান্ডার হতে।
সামনে কাটা মাথা আর থুতুর মতো দু কলি কবিতার মুখোমুখি সেই বাদশাহ ধীরে ধীরে চাদরটা আবার চাপা দিয়ে দিলেন।
এবার সোজাসুজি হাডসনের চোখের দিকে তাকালেন।
লুটেরা বেনিয়ার মতোই নীল চোখ হাডসনের দিকে তাকিয়ে সেদিন বাদশাহ জাফর যা উচ্চারণ করেছিলেন তাকে স্বাধীনতার এসেন্স বলা যায়… আবার মুঘল সংস্কৃতির সার কথাও বলা চলে।
হাডসনের দিকে তাকিয়ে জাফর ইঙ্গিত করলেন চাদরে ঢাকা নরমুণ্ডগুলির দিকে…
লাল রক্তে মাখা সন্তানের মাথা হাতে নিয়ে এক পিতার অহংকার উচ্চারিত হল-
‘মুঘল শাহজাদে ইসি তর্হা সুর্খ হো কর বাদশাহ কে সামনে আতে হ্যাঁয়’…
অর্থাৎ, বাদশাহের সামনে হাজির হওয়ার সময় মুঘল শাহজাদাদের মুখ এমন লাল হওয়াই তো দস্তুর।
বিজয়ী হাডসন বুঝলেন এমন রুচির নাগাল পাওয়া তো দূরের কথা, খুঁটে তুলতেও তিনি শেখেননি।
তাই অপমান হজম করে হুকুম দিলেন লাশগুলি তিনদিন ঝুলিয়ে রাখা হবে চাঁদনি চকে… প্রকাশ্যে।
ব্রিটিশ সভ্যতার সেই হুকুমের সামনে পরাজিত বাদশাহ বলে উঠলেন-
‘গাজিও মে বু রহেগি,
যব তলক ঈমান কি।
তখ্ৎে লন্ডন তক চলেগি,
তেগ হিন্দুস্তান কি।।’
উর্দু বুঝতে সমস্যা হলে জেনে রাখা যায়- এর অর্থ ‘যতদিন বিপ্লবীদের শরীরে ঈমানের গন্ধ রয়েছে, লন্ডনের সিংহাসন অবধি হিন্দুস্তানের তেজ অনুভূত হবে’। হাডসন তো বটেই, খোদ ইংরেজ শাসনও বুঝেছিল ভারতীয়দের ‘ডিভাইড’ করতে না পারলে এদেশে ‘রুল’ করার মতো অওকাত তাদের নেই। আমরাই বরং সেকথা বুঝিনি। আজকের শাসকও সেই একই রাস্তায় এগোচ্ছে। আর তাই মুঘল জমানাকে ভারতের ইতিহাস থেকে বাদ দিতে আইন পাশ হয়। শুধু তথ্য নয় আসলে বদলে দিতে চাওয়া হচ্ছে ইতিহাস চর্চার আসল কথাটাই- যাকে শাস্ত্রীয় ভাষ্যে হিস্টিরিওগ্রাফি’ বলে, সহজ কথায় ইতিহাস জানা, বোঝা ও লেখার কাজ। একবার ব্যাপারটা ঘটে গেলে তখন তথ্যের পাহাড় ছাড়া ইতিহাসে আর কিছু পড়ে থাকবে না, কোনটা ইতিহাস আর কোনটা নয়- সেই ফারাক উপলব্ধি করা যাবে না।ষড়যন্ত্রের শিকড় সন্ধানে দ্বিতীয় ঘটনাঃ
প্রতিক্রিয়ার দর্শনই হোক কিংবা নিকৃষ্টের ষড়যন্ত্র- দুয়েরই একটা দুর্বলতা থাকে। এরা উভয়েই কোনও ঘটনাকে স্থানিক, স্বতস্ফুর্ত বলে ঢাক পেটায়। আসলে আড়াল করতে চায় জাগতিক নিয়মের প্রধান শর্তটি। সেই শর্ত বলে সবকিছুকেই একটা গতির মধ্যে বিবেচনা করতে হয়, সবেরই একটা শুরু আছে, অভ্যন্তরীণ নানা পরিবর্তন রয়েছে যার পরে ঘটে তার বিকাশ এবং একেবারে শেষে গুনগত রূপান্তর। আর তাই ‘উই শ্যুড নট টেক দ্য ম্যাটার অ্যাজ ইট ইজ, উই মাস্ট কন্সিডার ইট উইদিন ইটস মোশন’। সুতরাং ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২-র ঘটনাকে বুঝতে আমাদের আরও পিছনে যেতে হবে।
১৯৩৪ সাল। সাধুর বেশে অযোধ্যায় আসে একজন।
অভিরাম দাস।
হনুমান মন্দিরের পুজারি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, আশেপাশের এলাকায় ক্রমশ তার প্রভাব বিস্তৃত হয়।
আরেকজন যুগল কিশোর ঝা। নির্মোহী আখড়ায় সে নিজের ভাইদের সাথেই থাকতো।
১৯৪৯ সালের শীতকাল। ২২শে ডিসেম্বর, রাত এগারোটা নাগাদ অভিরাম দাস দরজা ঠেলে তাদের ঘরে ঢোকে। যুগলের বড় ভাই উপেন্দ্রনাথের হাত ধরে সে বলে আজ রাতে সে যে কাজে যাচ্ছে তার ফলে সে আর কোনোদিন নাও ফিরে আসতে পারে। সকাল হওয়ার পরেও যদি অভিরাম না ফেরে তবে তার উত্তরসূরি হিসাবে যেন যুগল কিশোরকে মেনে নেওয়া হয়। এটুকু বলেই অভিরাম বেরিয়ে পড়ে। তার পিছনেই চলে যুগল কিশোর ও তার আরেক ভাই ইন্দুশেখর ঝা।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ইন্দুশেখর ঝা সরাসরি বলেছেন তৎকালীন অযোধ্যায় কর্মরত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে কে নায়ারের কথা। নায়ারের সাথে প্রায়ই গোপন বৈঠক করতেন অভিরাম দাস।
১৮৮৫ সালে রঘুবীর দাস নামের এক পুরোহিত রামের জন্মস্থানের দাবীতে বাবরি মসজিদ চত্বরের পাশেই অস্থায়ী ছাউনি গড়ে তোলে, সেই জায়গাতেই পূজা করার অনুমতি চেয়ে ফৈজাবাদ আদালতে একটা মামলাও দায়ের হয়েছিল।
১৯৪৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর রাতে বাবরি মসজিদের তালা ভেঙ্গে রামলালার মূর্তি রেখে আসা হয়। যুগল কিশোর নিজের সঙ্গীর সাথেই হাতে খুরপি নিয়ে মসজিদের গা থেকে যতটা সম্ভব ঐস্লামিক চিহ্ন নষ্ট করতে থাকেন, একইসাথে রঙয়ে ডোবানো তুলির সাহায্যে মসজিদের নান জায়গায় রাম, সীতা লিখে চলেন। অবশ্য এমনটা করার আগে তারা মসজিদের বাসিন্দা অর্থাৎ মুয়াজ্জেমদের রোজকার সামগ্রীটুকু ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন।
পরের দিন সকাল থেকে প্রচার শুরু হয়- ঈশ্বর নিজেই নিজের জন্মস্থান চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন, তাই রামলালা প্রকট হয়েছেন।
ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার কর্মসূচি শুরু হয় এইবার।
অযোধ্যার সেই যে ম্যাজিস্ট্রেট, কে কে নায়ার- তার কি হল?
২৩শে ডিসেম্বর, ঠিক পরেদিন ভোর পাঁচটা। যুগল কিশোরের আরেক ভাই অবোধ কিশোর ঝা, নিজের ঘরে উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে ঘটনাস্থলে হাজির হয়। তখন সেখানে নায়ারও উপস্থিত ছিলেন। কিশোর অবোধ নিজের স্মৃতিচারণায় বলেছেন ২৩ তারিখ ভোরবেলা তিনি নিজে শুনেছিলেন নায়ার তার বড় ভাইকে বলছেন এখনই রামলালা’কে একা ফেলে রেখে কোথাও যাওয়া চলবে না। লোকজনকে শুনিয়ে চিৎকার করার পরামর্শ দেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব- অবোধ কিশোর তাকে কো-অপারেটিভ বলে মনে রেখেছেন।
এহেন কে কে নায়ার পরবর্তীকালে জনসংঘের হয়ে লোকসভায় এমপি হিসাবে নির্বাচিত হন।
তাই ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় কিংবা আরও নয় বছর পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে খুব একটা আশ্চর্য হতে নেই।
অন্য সব কিছুর মতোই এসবেরও ইতিহাস রয়েছে, ধারা রয়েছে।
বাবরি মসজিদের মাটির তলা থেকে যাকিছু মিলেছে সেইসব মন্দির-মসজিদের বিতর্কে গুরুত্ব পায়নি, মানুষের মধ্যেকার আইনি বিবাদে স্বয়ং ঈশ্বর কিভাবে একটি পক্ষ হিসাবে বিবেচিত হবেন একথা আর কেউ বলছেন না- কারণ সুপ্রিম কোর্টের তরফে রায় দেওয়া হয়ে গেছে। ভারতের জনসাধারণও নতুন করে সাম্প্রদায়িক হানাহানি চান না- তাদের আচরণে এটুকু স্পষ্ট। তবু মোদী সরকারের চোখে ঘুম নেই কেননা ভারতে ‘এক দেশ- এক ভাষা’ না থাকায় তাদের ‘কাজে’ বিস্তর বাধা ঘটছে।
যারা জেগে ঘুমোতে অভ্যস্ত তারা মনে রাখতে পারেন, এক দেশ, এক ভাষা, এক পরিধান এমনকি এক রুচি-সংস্কৃতি বলে আরএসএস-বিজেপি যা কিছু করতে চাইছে সেসবই ধান্দার পুঁজির প্রেসক্রিপশন। পুঁজির অবাধ চলাচলের জন্যই সবকিছুকে অমন জোর করে এক রেখায় টেনে দাঁড় করাতে হয়- নাহলে মুনাফার হার প্রত্যাশিত গতিতে এগোতে পারে না। ভারতে সেই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ধান্দায় লগ্নী পুঁজি অনেকদিন আগে থেকেই সচেষ্ট ছিল, ২০১৪ সালে আরএসএস-বিজেপি’র সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সেই কাজে তারা যোগ্য দোসর খুঁজে পেয়েছে। এটাই কর্পোরেট-কমিউনাল নেক্সাসের অন্যতম ভিত্তি।
গত বছর দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ইচ্ছানুযায়ী রামনবমীর দিনে সূর্যালোক যেন ঠিক বিগ্রহের মুখ আলো করে দিতে পারে দেশের বিজ্ঞানীদের সেই গবেষণায় রত থাকার কথা সামনে এসেছিল। খবরে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছিল, সে কাজে অনেকটা এগিয়ে যাওয়াও প্রায় শেষ। কি ঘটল? মধ্যপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ডের মতো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাম নবমী উপলক্ষে মিছিলের সময় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি ইঙ্গিত করে বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণাত্মক সশস্ত্র মিছিল হয়েছিল। ঐ সকল মিছিলে একটিই সাধারণ বৈশিষ্ট ছিল। সংখ্যালঘু নিবিড় এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় উস্কানিমূলক স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। পাথর ছুঁড়ে মারামারি চলে৷ খোদ রাজধানীতে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে, তার আগে বিভিন্ন এলাকায় ঘৃণাভাষণ চলেছিল। জেএনইউ ক্যাম্পাসে, রাম নবমীর নামে সংঘ পরিবার অনুমোদিত সংগঠন এবিভিপি একটি হোস্টেল ক্যান্টিনে মেস কর্মীদের উপর আক্রমণ করে। প্রথমে কর্মীদের আমিষ খাবার পরিবেশন করতে বাধা দেওয়া হয়, পরে তাদের উদ্ধারে আসা ছাত্রছাত্রীদের উপর আক্রমণ চলে। বিহারে পুলিশের উপস্থিতিতেই একটি মসজিদে গৈরিক পতাকা লাগানো হয়।
মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট এবং বিহারে প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত সন্দেহজনক ছিল। জরুরী ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই সংখ্যালঘু অঞ্চলের মধ্য দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। মধ্যপ্রদেশে কোনরকম আইননানুগ প্রক্রিয়া ছাড়াই, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় সকলকেই ‘দাঙ্গাকারী’ বলে অভিযুক্তদের সম্পত্তি ভাঙচুর করা হয়।
সুত্রঃ সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি, ১২ এপ্রিল- ২০২২
সামনের বছর সেই মন্দিরের উদ্বোধন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মালব্য অ্যান্ড কোম্পানি নেমে পড়েছে- যেন অর্থনীতি থেকে অনাসৃষ্টি অবধি যাবতীয় সমস্যা এতে মিটে যাবে।
কেউ ওদের বলে না, মূর্তিতে আলো পড়ুক তাতে নতুন করে ক্ষতি আর বিশেষ হবার নেই কিন্তু যে অন্ধকার গোটা দেশের মুখে তারা টেনে এনেছেন এবং এনেই চলেছেন সাধের ডিজিটাল ইন্ডিয়া তা কাটাবে কিভাবে?
জি-২০ বৈঠকের ছুতোয় রাতারাতি দেশের নাম বদলে দিয়ে?
পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার মুল্যের অর্থনীতির নামে ভাঁওতার জোরে?
দেশীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের জোরে সফল চন্দ্রাভিযানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে নিজেকে ঈশ্বরের বরপুত্র ঘোষণায়?
উত্তর কাশীতে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে গিয়ে ১৭দিন আটকে থাকা আলো-আঁধার ঘেরা মজুরের হাসি মুখের ছবি ছেপে?
নাকি কাসুন্দিটা কিছুটা পুরানো হলেও ঝাঁঝ রয়ে গেছে এমন আশায় আবার সিএএ-এনআরসি’র প্রচার শুরু হবে?
ওরা অবশ্য আজকাল এসব কথা খানিক কম বলছেন! মণিপুরে যা ঘটেছে তার প্রভাবেই হয়ত কৌশল বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তো দিকে দিকে তৃতীয় ও ষষ্ঠ সুরের সম্মিলিত আহ্বান। গোটা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যারা হেরে ভুত হয়েছে তাদেরই নাকি হাওয়া গরম! জয়ী বিজেপি বিধায়কদের অন্তত একটা কাজ অবশ্য আছেই।
নির্বাচনের আগে বিজেপি’র তরফে ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল এই যে তারা ‘বিনি পয়সায়’ লোকজনকে মন্দির ঘুরতে নিয়ে যাবেন। অন্য কি কি বলেছেন সেসব নিজেরাই ভুলে গেছেন, বাকিরাও যাতে ভুলে যান আপাতত সেই চেষ্টা চলছে। করোনার সময় রোজগার হারানো দুঃস্থ পরিবারগুলির জন্য মাত্র ৭৫০০ টাকা ক্যাশ ট্রান্সফারের মুরোদ যাদের হয়নি, তারাই এমন একটা ব্যাপার কিভাবে কি করে শুধু এটুকু দেখতেও ধাক্কাধাক্কি তো রীতিমত সম্ভাবনাময়!
তথ্যসুত্রঃ ১) দ্য ডেস্ট্রাকশন অফ দ্য বাবরি মসজিদ, আ ন্যাশনাল ডিসঅনর; এ জি নূরানি, তূলিকা বুকস, ২০১৪ ২) দ্য অ্যাগনি অফ দিল্লী; খাজা হাসান নিজামি, রেয়ার বুক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া