Lessons of the November Revolution and Today’s Times – Srutinath Praharaj

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ এ জন্মের তীর্থদর্শনের’ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এইভাবে;
“রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।
চিরকালই মানুষের সভ্যতায় এক দল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তাঁরাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব-চেয়ে কম খেয়ে কম পরে কম শিখে কি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা উপোস করে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে—জীবনযাত্রার জন্য যত কিছু সুযোগ সুবিধে, সবকিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে—উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।

আমি অনেক দিন এদের কথা ভেবেছি, মনে হয়েছে এর কোনো উপায় নেই। এক দল তলায় না থাকলে আরেক দল উপরে থাকতে পারেনা। অপচ উপরে থাকার দরকার আছে। উপরে না থাকলে নিতান্ত কাছের সীমার বাইরে কিছু দেখা যায় না;–কেবলমাত্র জীবিকা নির্বাহ করার জন্যে তো মনুষ্যত্ব নয়। একান্ত জীবিকাকে অতিক্রম করে তবেই তার সভ্যতা। সভ্যতার সমস্ত শ্রেষ্ঠ ফসল অবকাশের ক্ষেত্রে ফলেছে। মানুষের সভ্যতায় এক অংশে অবকাশ রক্ষা করার দরকার আছে। তাই ভাবতুম, যেসব মানুষ শুধু অবস্থার গতিকে নয়, শরীর-মনের গতিকে নিচের তলায় কাজ করতে বাধ্য এবং সেই কাজেরই যোগ্য, যথাসম্ভব তাতে শিক্ষা -স্বাস্থ্য-সুখ -সুবিধার জন্যে চেষ্টা করা উচিত।

মুশকিল এই, দয়া করে কোন স্থায়ী জিনিস করা চলে না; বাইরে থেকে উপকার করতে গেলে পদে পদে তার বিকার ঘটে। সমান হতে পারলে তবেই সত্যকার সহায়তা সম্ভব হয়। যাই হোক, আমি ভালো করে কিছুই ভেবে পাইনি—অথচ অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে, অমানুষ করে রেখে তবেই সভ্যতা সমুচ্চ থাকবে এ-কথা অনিবার্য বলে মেনে নিতে গেলে মনে ধিক্কার আসে।“

মস্কোতে রবি ঠাকুর

নভেম্বর বিপ্লবই প্রথম এই আলো এবং অন্ধকারে থাকা সব মানুষকেই সম মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করবার পথ দেখিয়েছিল। শোষণ বঞ্চনা কে এড়িয়ে সব মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে একটা রাষ্ট্র, তা এর আগে কেউ করে দেখায়নি যা সোভিয়েত ইউনিয়ন পেরেছিল। একটা দেশের সমাজ ব্যবস্থার বদল দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষকে শেকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার সাহস জুগিয়েছে। যেহেতু শুধু ভারতবর্ষে নয়, শোষণ, বঞ্চনা, বৈশম্য সারা দুনিয়া জুড়ে বাড়ছে, তাই নভেম্বর বিপ্লব আজও প্রাসঙ্গিক। এই অসম ব্যবস্থা বদলের স্পর্ধা প্রকাশ পায় নভেম্বর বিপ্লবের অনুপ্রেরণায়।

নভেম্বর বিপ্লবের উন্মাদনা যক্ষা রোগাক্রান্ত বিপ্লবী কিশোর কবি সুকান্তকেও স্বপ্ন দেখার সাহস যুগিয়ে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার’ কথা বলতে পেরেছিলেন অবলীলায়। এ যে সম্ভব তা তিনি অনুভব করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখে।

বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির দুনিয়া জুড়ে দাপট বেড়েছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যেকার বিরোধ অতীতের তুলনায় স্তিমিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, ন্যায় বিচার ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের ক্ষেত্র যেখানেই প্রস্তুত হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী ব্লকের জোটবদ্ধ আক্রমণ সেখানে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। প্যালেস্টাইনের উপর ইজরায়েল বাহিনীর নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে আনার পেছনে মার্কিন দুনিয়া সহ ন্যাটো বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ার মত। গোটা পশ্চিম এশিয়া জুড়ে তেল ভান্ডারের দখলদারি সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই আক্রমণের জমি তৈরি হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর সংকটের বোঝা নামিয়ে আনছে। উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তির আগ্রাসন বিশ্বজুড়ে বেকারি, দারিদ্র, বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে সংগঠিত ক্ষেত্রে স্থায়ী কাজের সুযোগ কমছে, অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক বাড়ছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে যেমন ইচ্ছে নিয়োগ ও ছাঁটাই এর পাশাপাশি অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ তীব্র হয়েছে। গ্রামীন কৃষিজীবী মানুষও এই বিশ্বায়নের শিকার।

প্যালেস্টাইনের উপর ইজরায়েল বাহিনীর নৃশংস আক্রমণ

উল্টোদিকে এই সময়ে এর বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে ব্যাপক অংশের মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলনও গড়ে উঠছে যা মূলত বামপন্থী অভিমুখে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে বামপন্থীদের লড়াই তীব্র হচ্ছে। ইউরোপের দেশ গুলিতেও শ্রমজীবী মানুষ এই শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে জঙ্গি লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন। সাম্রাজ্যবাদী সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠছে। দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই এই সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী আন্দোলন। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সংগ্রামকে শক্তিশালী করে তোলা প্রতিটি কমিউনিস্ট কর্মীর কাছে এই সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের দেশও তার বাইরে নয়। বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের শক্তিই মানবজাতির মুক্তির ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে উত্তরণের আলোকবর্তিকা হতে পারে। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা এটাই, অধিকার বুঝে নিতে হয়, অধিকার কেড়ে নিতে হয়। বিনা সংগ্রামে কিছু মেলে না।

একথা সবাই জানে, ছকে বাঁধা নিয়মে পাঁজি পুঁথি দেখে রাশিয়ায় বিপ্লব হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ায় পুঁজিবাদের অগ্রগতি তখনও তেমন ভাবে ঘটেনি। বরং বিপ্লবের অনেক বেশি উপাদান মজুত ছিল জার্মানিতে যা রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবখনেট খুন হওয়ার কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। লেনিন মার্কসবাদের বোঝাপড়ায় পুঁজিবাদের বিকাশের নিয়ম গুলির উপর ভিত্তি করেই সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ এর প্রয়োগ ও বিকাশ ঘটিয়েছিলেন তৎকালীন রাশিয়ায়। ফরাসি বিপ্লবের অভিজ্ঞতায় শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক মৈত্রী গড়ে তোলার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ওই সময়ে রাশিয়াই ছিল সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থি যেখানে সঠিক আঘাত হানতে পারলে শ্রেণী ভারসাম্যের পরিবর্তন সর্বহারার অনুকূলে আনা সম্ভব। রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর সামনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে আন্তঃ-সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করার ডাক দিয়ে সফল হন তিনি। এভাবেই ১৯১৭ সালে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল যা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম দেয়। সেই হিসেবে বলা যেতে পারে, এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থি হল পুঁজির শাসন। এই পুঁজির শাসনের অবসানে আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচিকে সংগঠিত করতে হবে।

রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবখনেট

মার্কস এঙ্গেলসের দেখানো পথে লেনিন দুনিয়া বদলের লক্ষ্য নিয়ে নতুন করে কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিক গড়ে তোলেন পৃথিবীর অনেকগুলি দেশের সোশালিষ্ট, কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টি গুলিকে নিয়ে। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষায় ভারত চীন ভিয়েতনাম সহ অনেকগুলি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এর দ্বারা গতিপ্রাপ্ত হয়। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একটি বিশ্ব প্রক্রিয়া। মর্মবস্তু ও চরিত্রের দিক থেকে নানা রকমের বিপ্লব তার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য শুধু এই নয় যে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে পৃথিবীর বহু দেশে। একই সাথে এই বিপ্লবের এমন সব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে যা স্বকীয় রূপে বেশ কিছু দেশেও লক্ষ্য করা গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটে। তারপর কিউবায় বিপ্লব সংঘটিত হয় ফিদেল কাস্ত্রর নেতৃত্বে। নভেম্বর বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ক্রমবর্ধমান শক্তিতে তা ছড়িয়ে পড়েছে ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দুনিয়ার বিরাট এলাকা জুড়ে। সেই সব দেশের মুক্তিকামী মানুষ নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে নিজেদের জাতীয় স্বাধীনতা অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে তবু আজ ও সেই মুক্তি আন্দোলনের ধারা বহমান। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষায় প্রত্যয়ের জায়গা একটাই, সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামের সুচিমুখকে তীব্র ও নির্দিষ্ট করতে পারলে শোষণমুক্ত সমাজের লক্ষ্যে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করা সম্ভব। হতাশার কোনো জায়গা নেই। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের কিছু নির্দিষ্ট কারণ ছিল যা চিহ্নিত হয়েছে। এখানে তার পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, সমাজ বদলের মার্কসীয় বীক্ষায় কোনো গলদ ছিল না। গুরুতর ভ্রান্তি ছিল সমাজতন্ত্র নির্মাণ পর্বে এর প্রয়োগে। গত তিন দশকে পরিস্থিতির অনেকটাই গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। এর থেকে শিক্ষা নিয়েই একুশ শতকের সমাজ বিপ্লবের লড়াই চলছে।

নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা থেকেই এদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চে প্রথম পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলেছিলেন যার মর্মবস্তু ছিল দেশবাসীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার হস্তান্তর হলেও আজও সেই স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে। বরং অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য আরো তীব্র হয়েছে। আর এস এস ও স্বরাজের কথা বলে। তবে তা স্ব-রাজ অর্থাৎ হিন্দু রাজ বা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সব মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন নয়। কমিউনিস্টরা সেই কারণে আর এস এসের ঘোষিত শত্রু।

১৯৭৬ সালে জরুরী অবস্থা চলাকালীন সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনের মধ্য দিয়ে ভারত সরকার প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি যোগ হয়।

স্বাধীনতার পর জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে যে ত্রি-স্তরীয় মিশ্র অর্থনীতি গৃহীত হয় তার একটা বড় অংশ ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণ। তখন সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি ছিল না তবু সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তি ছিল গ্রহণমূলক জাতীয়তাবাদ, আরএসএসের উগ্র বর্জনমূলক জাতীয়তাবাদ নয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ভারী শিল্প সহ পরিকাঠামো নির্মাণের শিল্প, বীমা, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে গড়ে তোলা সেই আলোকে তৈরি। পরবর্তীকালে ব্যাংক ব্যবস্থা রাষ্ট্রয়াত্তকরণ একই ভাবনার প্রয়োগ। ১৯৭৬ সালে জরুরী অবস্থা চলাকালীন সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনের মধ্য দিয়ে ভারত সরকার প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি যোগ করে।

উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের কোপে পড়ে ঐ সব রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেপরোয়া বিরাষ্ট্রীয়করণ ঘটছে। ব্যাংক, বীমা, রেল, প্রতিরক্ষা– সর্বত্র এক চিত্র। বিজেপি সরকার আসার পর পরিকল্পনা কমিশন তুলে দেওয়া হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার আইনি বন্দোবস্ত পাকা করা হয়েছে। আর এস এস সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে কারণ তাদের মতাদর্শগত অবস্থান সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীতে। ২০০৮ সালে এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা এক বিজেপি সাংসদদের মামলায় বিচারপতি কে জি বালকৃষ্ণানের নেতৃত্বে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ বলেছিল, ” সমাজতান্ত্রিক শব্দটা নিয়ে এত আপত্তি কিসের। কেন এটা কে শুধু সংকীর্ণ ভাবনায় কমিউনিস্টদের ব্যবহার করা শব্দ ভাবছেন? এর বৃহত্তর অর্থ হলো জনকল্যাণ যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পূর্ব শর্ত।” তাতেও ভবি ভুলবার নয়। তখন কোর্টে দাবি করেছিল সমাজতন্ত্র নাকি একপেশে দর্শন তাই একে সব মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এখন আর এস এস বলে যেহেতু গোড়ায় সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই দুটি শব্দ ছিল না, এখন আর তা রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। দূরাত্মার যে ছলের অভাব হয় না, এর থেকে তা পরিষ্কার।

ফ্যাসিস্টদের কাজের ধারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জর্জি দিমিত্রভ তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, ” ফ্যাসিস্টরা চরম সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে, কিন্তু জনগণের সামনে হাজির হয় বঞ্চিত জাতির মুখোশ পরে, ‘ আহত জাতীয় আবেগে ঘা দিতে”।” মুসোলিনি ও হিটলারের ভাবশিষ্য মুঞ্জে-হেডগেওয়ার-গোলওয়ালকার বাহিনীর বর্তমান উত্তরসূরীরা সেই এক কৌশল নিয়ে ‘হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, এর জন্য দায়ী বহিরাগত মুসলমান আর খ্রিস্টানরা’ — এই মিথ্যা চেতনা তৈরি করে সংখ্যালঘু মানুষদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে ঘৃণা তৈরির চেষ্টা চলছে। ঠিক যেভাবে হিটলার উগ্র জার্মান জাত্যাভিমানের জমি তৈরি করে কয়েক লক্ষ ইহুদি নিধন করেছিলেন। দেশছাড়া করেছিলেন ইহুদিদের। এদেশেও একই কাজ করছে মোদি-শাহ নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ব ব্রিগেড। দেশ জুড়ে নানা অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ সেই কারণে বাড়ছে। হিন্দু মৌলবাদীদের কার্যকলাপ সংখ্যালঘু মৌলবাদীদের উৎসাহিত করছে, ফলে দেশ জুড়ে অস্থিরতা বাড়ছে। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম মৌলবাদ একে অন্যকে পুষ্টি জোগাচ্ছে। ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী ঐতিহ্য, দেশের ঐক্য ও সংহতি আজ বিপন্ন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন হিটলারের মোকাবিলা করেছিল জান কবুল লড়াই করে। সেই ইতিহাসের পুনরুল্লেখ না করে নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে শুধু এইটুকু বলা যায় এদেশে এই ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট বাহিনীর মোকাবিলা করা সম্ভব এবং তা করতে পারে কমিউনিস্টরাই অন্য সব বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বৃহৎ সমাবেশ ঘটিয়ে। এটাই এই মুহূর্তে সিপিআইএম সহ অন্য বাম দলগুলির সামনে সবচাইতে জরুরী কাজ।

Lenin-Engels-Marx
Spread the word

Leave a Reply