শ্রমজীবী জনগণের দুঃখ কষ্ট নিরসনের জন্য বহু বছর ধরে বহু মানুষ নানা পন্থার কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথাও বলেছেন। কিন্তু দুঃখ কষ্টের কারণ কী, কীভাবেই বা তা দূর করা যায়, তার বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি তারা খুঁজে পাননি। মার্কস-এঙ্গেলসই প্রথম, যাঁরা দেখান সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি। ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এ পুঁজিবাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে মার্কস-এঙ্গেলস বলেন, ‘বুর্জোয়াশ্রেণি সৃষ্টি করছে সর্বোপরি তারই নিজের কবরখনকদের। বুর্জোয়ার পতন এবং প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ, দু-ই সমান অনিবার্য।’ কমিউনিস্টদের আশু লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেন, ‘প্রলেতারিয়েতকে শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত করা, বুর্জোয়া আধিপত্য উচ্ছেদ করা, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার করা।’ ১৮৫২-র ৫ মার্চ একটি চিঠিতে মার্কস লেখেন, ‘ নিজের পক্ষ থেকে আমি বলতে পারি, বর্তমান সমাজে শ্রেণি বা শ্রেণি সংগ্রামের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহু পূর্বে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা এই শ্রেণি সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশ ব্যাখ্যা করেছেন, এবং অর্থনীতিবিদেরা শ্রেণিসমূহের অর্থনৈতিক গঠন বর্ণনা করেছেন।
নতুনের মধ্যে আমি শুধু নিম্নলিখিত বিষয় প্রমাণ করেছি:
১. উৎপাদনের বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ের সাথেই কেবল শ্রেণিসমূহের অস্তিত্ব জড়িত;
২. শ্রেণি সংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব;
৩. যে-অবস্থায় শ্রেণিসমূহের বিলোপ ঘটবে এবং শ্রেণিহীন সমাজের পত্তন হবে, শ্রমিকশ্রেণির এই একনায়কত্ব হচ্ছে সেই অবস্থায় উত্তরণের পথ মাত্র।’
এই লক্ষ্য পূরণে দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম পদক্ষেপ প্যারি কমিউন। ১৮৭১ সালে ১৮ মার্চ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের জোরে দখল করে রাষ্ট্র ক্ষমতা। গঠন করে শ্রমিকশ্রেণির সরকার। কিন্তু এই সরকার বেশিদিন টিকে থাকতে পারিনি। ৭২ দিন বাদে এই সরকারের পতন ঘটে। এই পতনের পর ফ্রান্সের বুর্জোয়া নেতা তিয়ের দম্ভ করে বলেন, ‘সমাজতন্ত্রকে খতম করে দিয়েছি।’ বুর্জোয়াশ্রেণি এটা ভেবে উল্লসিত হয় যে, সমাজতন্ত্র আর কোনও দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
৪৬ বছর পর ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রমিক ও কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করে বলশেভিকদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় নভেম্বর বিপ্লব। সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার সফল অভিযানের সূচনা হয়। আর এই কাজ পরিচালনা করেন যিনি, তিনি হলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। প্যারি কমিউনের পতনে গোটা বিশ্বের শ্রমজীবীরা যখন বিমর্ষ, তখন মার্কস প্যারি কমিউনের পতনের কারণগুলিকে চিহ্নিত করেন। প্যারি কমিউন সম্পর্কে মার্কসের শিক্ষাকে লেনিন গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলসের শিক্ষাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জোরের সঙ্গে প্রয়োগ করে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বকে। মার্কস-এঙ্গেলসের দর্শনের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে লেনিন শুধু গ্রহণই করেননি, তাকে বিকশিতও করেন।
‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এ মার্কস-এঙ্গেলস বলেন, ‘শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবে প্রথম ধাপ হলো প্রলেতারিয়েতকে শাসক শ্রেণির অবস্থানে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করা।’ মার্কস-এঙ্গেলসের শিক্ষাকে অনুসরণ করে ১৯১৯-এর ১৬ ডিসেম্বর লেনিন বলেন, ‘প্রলেতারিয়েতকে প্রথমে বুর্জোয়া শ্রেণিকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং নিজেদের জন্য জয় করে নিতে হবে রাষ্ট্রক্ষমতা এবং তারপর সেই রাষ্ট্রক্ষমতাকে অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বকে ব্যবহার করতে হবে মেহনতী জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সহানুভূতি জয় করবার উদ্দেশ্যে নিজেদের শ্রেণির হাতিয়ার হিসাবে।’ মার্কস-এঙ্গেলসের মতে, এমন একটা সময় ছিল যখন রাষ্ট্র ছিল না। সমাজ বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং শ্রেণি বিরোধ ও শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। রাষ্ট্র হল শ্রেণি শোষণের যন্ত্র। রাষ্ট্র কোনও শ্রেণি নিরপেক্ষ সংগঠন নয়, কিংবা সমাজের বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোন শক্তিও নয়। লেনিন রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করলেন ‘শ্রেণিবিরোধের অমীমাংসেয়তার ফল ও অভিব্যক্তি’ হিসাবে। যেখানে যে-সময়ে যে-পরিমাণে বাস্তব ক্ষেত্রে শ্রেণিবিরোধের সমাধান হতে পারছে না, সেখানে রাষ্ট্রের জন্ম। আর, রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রমাণ করে শ্রেণিবিরোধ অমীমাংসেয়।
সমাজ বিকাশের ধারায় রাষ্ট্রেরও বিকাশ ঘটে। বিভিন্ন পর্ব অতিক্রম করে সামন্ততন্ত্রকে পেছনে ফেলে যে-বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই অগ্রগতি। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে সার্বজনীন ভোটাধিকার সহ যে-গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা গণতন্ত্রের সংগ্রামে অগ্রগতির সূচক হিসেবে গণ্য। রাষ্ট্রপতি-প্রধান কিংবা সংসদীয় ব্যবস্থা যে-রূপই হোক না কেন, সভা-সমাবেশ করার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, সংবাদপত্রের অধিকার, আইনের চোখে সবাই সমান এমনসব গণতান্ত্রিক অধিকার থাকলেও বুর্জোয়া গণতন্ত্র মর্মবস্তুর দিক থেকে বুর্জোয়াশ্রেণির একনায়কত্বের রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছুই নয়। লেনিনের কথায়, ‘সর্বাপেক্ষা গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত পুঁজিপতিদের হাতে শ্রমজীবীদের দমন করবারই এক যন্ত্র মাত্র, পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বেরই এক উপকরণ, বুর্জোয়াশ্রেণির একনায়কত্বেরই হাতিয়ার মাত্র: অন্যরকম কিছু কখনও হয়নি, হতে পারতও না। গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ঘোষণা করা হয়, কিন্তু জমি ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা-স্বত্ব বজায় থাকা পর্যন্ত বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র তার ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতিকে কখনও কার্যে প্রয়োগ করতে পারে না।’
লেনিনের শিক্ষা অনুসরণ করে সিপিআই(এম) ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব’-এ আজকের পুঁজিবাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলে,’পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের রূপ যাই হোক না কেন, রাষ্ট্র আসলে সর্বদাই বুর্জোয়াদের একনায়কত্ব। সমকালীন সাম্রাজ্যবাদের আমলে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির স্বার্থপূরণে তার যখন যেমন প্রয়োজন সেইভাবে পাল্টায় রাষ্ট্রের ভূমিকা। অনেক সময়েই রাষ্ট্র চলে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির অঙ্গুলিহেলনে। তাই রাষ্ট্র যখন সামাজিক দায়িত্ব ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা পরিত্যাগ করে, তার অর্থ এই নয় যে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে রাষ্ট্র নিজেকে অপসারিত করছে। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির স্বার্থ নির্লজ্জভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা পাল্টায়। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র শুধু সামাজিক দায়িত্ব ত্যাগ করে না, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবদমিত করে। আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের সার্বভৌমত্বের অন্তর্ঘাত করে এবং বেশি করে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে(২.১৮ অনুচ্ছেদ)।’
শ্রমিকশ্রেণির শাসন বুর্জোয়া শাসনের চেয়ে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। এই নতুন ধরনের গণতন্ত্রে জনগণের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকশ্রেণির জন্য প্রয়োগ করা হয় ব্যাপকতম গণতন্ত্র এবং মুষ্টিমেয় বুর্জোয়াশ্রেণির জন্য প্রয়োগ করা হয় একনায়কত্ব। মানুষ কর্তৃক মানুষকে শোষণের বুর্জোয়া একনায়কত্বের অবসান ঘটাবার এবং শ্রমজীবী মানুষের পূর্ণ মুক্তির জন্য
সিপিআই(এম) তার গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, ‘পার্টির লক্ষ্য হলো- সর্বহারার একনায়কত্বের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ অর্জন।’
বুর্জোয়াদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার সাথে সাথেই তাদের বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রামের অবসান ঘটে না। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বুর্জোয়া শ্রেণি অনেক বেশি শক্তি নিয়ে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা করে। তাছাড়া পুরনো সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধেও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালানোর প্রয়োজন হয়। ‘বামপন্থী কমিউনিজম শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ গ্রন্থে লেনিনের বিশ্লেষণ:’ শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব হল অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে, বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে নতুন শ্রেণির সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সবচেয়ে কঠোর সংগ্রাম। ক্ষমতাচ্যুত (এক দেশে হলেও) হওয়ায় এদের প্রতিরোধ দশগুণ বেড়েছে ।এদের শক্তি শুধু আন্তর্জাতিক পুঁজির জোরে নয়, শুধু বুর্জোয়াশ্রেণির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জোর ও স্থায়িত্বে নয়, সে শক্তি অভ্যাসের টান ও খুদে উৎপাদনের শক্তিতেও। কারণ দুর্ভাগ্যক্রমে ছোটখাটো উৎপাদন প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়, স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপকভাবে পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়াশ্রেণির জন্ম দিচ্ছে। এইসব কারণেই শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রয়োজন। দীর্ঘকাল অত্যন্ত কঠোর বেপরোয়া জীবন-মরণ সংগ্রাম চালিয়ে তবেই বুর্জোয়াশ্রেণির উপর জয়লাভ সম্ভব। সেই লড়াইয়ে চাই শৃঙ্খলা, চাই দৃঢ়তা, অদম্যতা আর চিন্তার ঐক্য।’ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করে শ্রেণি পার্থক্যের অবসান ঘটিয়ে শ্রেণিহীন সমাজ তথা সাম্যবাদী সমাজে উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব বজায় রাখতে হবে।
স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি লেনিনের শিক্ষা ও সতর্কতা থেকে বিস্মৃত হয়ে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের জায়গায় ‘সমগ্র জনগণের রাষ্ট্র’-র ভ্রান্ত ধারণা প্রতিস্থাপন করে। শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রে বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনার কর্তব্য থেকে সরে আসে। এইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পথকে সুগম করে তোলে। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থে লেনিন স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রূপে অনেক পার্থক্য আছে। কিন্তু তাদের মর্মবস্তু একই। তা হলো, যাই রূপ হোক না কেন এই সবকটি রাষ্ট্র চূড়ান্ত বিশ্লেষণ অনিবার্যভাবেই বুর্জোয়া একনায়কত্ব। পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উত্তরণ নিশ্চিতভাবে প্রচুর ধরনের রাজনৈতিক রূপের জন্ম না দিয়ে পারে না। কিন্তু মর্মবস্তু হবে অনিবার্যভাবে একই সর্বহারার একনায়কত্ব।’ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা এই কথাগুলি বেমালুম ভুলে গেলেন। তারা এটাও ভুলে গেলেন যে, শ্রেণি মানে পার্টি নয়। শ্রেণির একনায়কত্ব, আর পার্টির একনায়কত্ব এক নয়। ফলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র যুগপৎ বিকাশের মৌলিক কর্তব্য গুরুতরভাবে অবহেলিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় লেনিনের শিক্ষা থেকে বিচ্যুতির পরিণতিকে নির্দেশ করে।
মার্কস-এঙ্গেলসের বৈপ্লবিক শিক্ষাকে স্মরণ করিয়ে লেনিন বলতেন,’ আমাদের শিক্ষা কোন আপ্তবাক্য নয়, আমাদের শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে পথনির্দেশক- মার্কস-এঙ্গেলস সর্বদাই এ কথা বলতেন এবং যারা কয়েকটি সূত্র আয়ত্ত করে কেবল তার পুনরাবৃত্তি করতো তাঁরা তাদের বিদ্রুপ করতেন। এই সূত্রগুলি সম্বন্ধে এ পর্যন্ত বলা যায় যে, সেগুলি কেবল সাধারণভাবে কাজের মোটামুটি রূপরেখা দিতে সক্ষম: ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকটি পর্যায়ের বাস্তব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিবার্যভাবেই এই কাজের রূপান্তর ঘটায়। এই অবিসংবাদী সত্য প্রত্যক্ষ করা একান্ত প্রয়োজন যে, মার্কসবাদীকে বাস্তব জীবনের প্রকৃত তথ্যের অনুশীলন করতে হবে, গতকালকার মতবাদকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না।’
সিপিআই(এম) ‘তার সমস্ত কর্মকাণ্ডে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দর্শন ও নীতিসমূহের দ্বারা পরিচালিত হয়।’ এই দর্শন ও নীতিকে ভিত্তি করেই ভারতের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করে সিপিআই(এম) তার ‘পার্টি কর্মসূচি’, ‘গঠনতন্ত্র’, ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব’, রাজনৈতিক প্রস্তাব, রাজনৈতিক লাইন এবং সাংগঠনিক কর্তব্য নির্দিষ্ট করেছে।
সিপিআই(এম) তার ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয়ে সম্পর্কে প্রস্তাব’-এ একথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, ‘সর্বহারা একনায়কত্বের রূপ অবশ্য অনড় বা অপরিবর্তনীয় নয়। সমাজতান্ত্রিক সামাজের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর রূপও বিভিন্ন ও পৃথক পৃথক পর্বের মধ্যে দিয়ে যায়।’
বুর্জোয়া একনায়কত্বের নিকৃষ্টতম রূপ হলো ফ্যাসিবাদ। বুর্জোয়া একনায়কত্বের অধীনে শ্রমজীবী জনগণ যেসমস্ত অধিকারগুলি অর্জন ও ভোগ করে ফ্যাসিবাদ তা নির্বিচারে কেড়ে নেয়, মানবাধিকারকে তছনছ করে এবং সর্বোপরি বুর্জোয়া গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করে। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণিকেই অর্জিত গণতন্ত্র রক্ষা করার সংগ্রাম করতে হয়। ফ্যাসিবাদের বিপদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াই চালাতে হয়। পুঁজিবাদের গভীরতম সংকট ফ্যাসিবাদের বিপদকে ডেকে আনে। এই বিপদ থেকে মানব সমাজকে রক্ষা করার জন্য পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালানো প্রয়োজন।
মানুষ কর্তৃক মানুষকে শোষণ, শ্রেণি কর্তৃক শ্রেণিকে শোষণ, জাতি কর্তৃক জাতিকে শোষণের আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে মুক্তির জন্য একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বুর্জোয়া একনায়কত্বের জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে হবে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বকে। এই প্রতিস্থাপনের ভিত্তি হবে বিকশিত গণতন্ত্র। সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই সুনির্দিষ্ট করতে হবে একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রে বিকশিত গণতন্ত্রের রূপ, যার মর্মবস্তু হবে আবশ্যিকভাবেই শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।
লেনিন আমাদের মার্কসবাদের বৈপ্লবিক মর্মবস্তুকে সঠিকভাবে বুঝতে শিখিয়েছেন। নভেম্বর বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র নির্মাণে তা প্রয়োগ করেছেন। মার্কসবাদকে বিকশিত করেছেন। আমাদের সামনে বিপ্লবী শিক্ষা রেখে গেছেন। একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লেনিনের শিক্ষাকে আত্মস্থ করা অত্যন্ত জরুরি।