Satyaki Roy
পুঁজিবাদের এক বিশেষ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি।এই পর্যায়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো পুঁজি সম্পর্কের সার্বজনীন আধিপত্য এবং একই সাথে বিত্ত পুঁজির কর্তৃত্ব। বিশ্বায়নের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত রকম উৎপাদন পক্রিয়া ও সম্পর্ক গুলিকে পুঁজির অধীনে আনা সম্ভব হয়েছে- যে সমস্ত সম্পর্ক পুঁজি সম্পর্কের বাইরে তারাও আজ বিশ্বায়িত বাজারের মাধ্যমে পুঁজির অধীনস্ত হতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে যা লক্ষ্যনীয় তা হলো মুনাফা বৃদ্ধির হার, পুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার অথবা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক বেশী- অর্থাৎ মুনাফার সঙ্গে উৎপাদনের সম্পর্কটা যেন আলগা হয়ে আসছে। উৎপাদন ছাড়াই অর্থ যেন বর্ধিত অর্থ তৈরি করছে এবং যেহেতু আজকের পৃথিবীর বেশিরভাগ মুনাফা আর্থিক ক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত হচ্ছে তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যেন মুনাফা-পুঁজি ও শ্রমের শোষণমূলক সম্পর্কটা গৌণ হয়ে পড়েছে। একথা অনস্বীকার্য যে বিত্ত পুঁজি আজকের দিনে এক স্বকীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে কিন্তু এর মানে এই নয় যে আর্থিক ক্ষেত্রে উদ্ভূত মুনাফা স্বয়ম্ভূ – অর্থাৎ এর সাথে পুঁজির শোষণমূলক অবর্তের কোনো সম্পর্ক নেই। উৎপাদনে নিযুক্ত পুঁজি ও ফিন্যান্স পুঁজি বা বিত্ত পুঁজির সম্পর্কটা যথেষ্ট জটিল। পুঁজিবাদের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ সম্পর্কটাও বদলেছে। মার্কস ক্যাপিটালের তৃতীয় খন্ডে ‘ সুদ সৃষ্টিকারী পুঁজি'( interest bearing capital)-র আলোচনা করেছেন। পরবর্তী কালে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন জার্মানি মার্কসবাদী তাত্ত্বিক রুডলফ হিলফার্ডিং এবং তারও পরে লেনিন তার সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক আলোচনায় দেখিয়েছেন বর্তমান সময়ে ফিন্যান্স পুঁজির চরিত্র আরও পরিবর্তিত হয়েছে, এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক, পুঁজিবাদী আবর্ত ভূমিকা প্রসঙ্গে মার্কসের মৌলিক ধারনাটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক । মার্কস পুঁজির আবর্তটিকে সামগ্রিক ভাবে দেখেছিলেন – অর্থাৎ উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি , তা করায়ত্ব করা ও বন্টন করা এটা একটা সামগ্রিক অবর্ত, ক্যাপিটালের প্রথম খন্ডে, মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির আলোচনা করেন।কিন্তু উদ্বৃত্ত মূল্য মুনাফায় রূপান্তরিত করতে গেলে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হতে হবে, এবং এই খুচরো প্রক্রিয়াটিতে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পুঁজি পালন করে থাকে। মার্কস এই পরিবর্তিত রূপ গুলির আবির্ভাব কে পুঁজির ‘মেটামরফসিস’ হিসেবে দেখেছিলেন। পুঁজির দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ডে মার্কস সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের বন্টনের বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই সব ধরনের পুঁজিরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ধার দেওয়া , কাঁচামাল কেনা , উৎপাদন করা, বিদেশী মুদ্রা বা অন্যান্য লেনদেনে সাহায্য করা, উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা এই সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন পুঁজির নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে এবং যেগুলি এই সামগ্রিক পুঁজি সম্পর্কে কার্যকরী করতে সমান গুরুত্বপূর্ণ। মোট যা উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হচ্ছে তা এই সব ধরনের পুঁজিপতিদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং শুধু তাই নয় পুঁজিবাদী উৎপাদন সংগঠনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পুঁজির আপেক্ষিক গুরুত্ব ও মোট উদ্বৃত্ত মূল্যে অংশীদারত্ত্ব বদলাতে থাকে। আজকের সময়ের বৈশিষ্ট হল পুঁজিবাদী উৎপাদন সংগঠনে ও মুনাফা চক্রে বিত্ত পুঁজির আধিপত্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। অতএব উৎপাদনশীল পুঁজি ও বিত্ত পুঁজির মধ্যে সংঘাত যে নেই তা নয় কিন্তু একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং মার্কস ক্যাপিটালের তৃতীয় খন্ডে আলোচনা করেন যে সুদের হার যতক্ষন পর্যন্ত সাধারণ মুনাফা হারের চেয়ে কম থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মহাজনী পুঁজির উপর নির্ভরশীলতা উৎপাদনশীল পুঁজিকে লাভের হার বাড়াতে সাহায্যই করে। সবচেয়ে বড় কথা হল দেয় সুদের অংশ যখন বাড়তে থাকে তখন মুনাফার হারকে ধরে রাখার একমাত্র রাস্তা হলো মজুরির খরচ কমানো এবং সে প্রশ্নে সব পুঁজিপতিরা সহজেই এক হয়ে যায়। এই কারনেই কোন দেশের আর্থিক ক্ষেত্রের সংস্কারের সাথে সাথে শ্রম সংস্কারে প্রক্রিয়া অনিবার্য ভাবেই কার্যকরী করা হয়।
নয়া উদারবাদী আর্থিক কাঠামোয় পৃথিবীর সব দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য অর্থনৈতিক চাহিদার উপর দুভাবে প্রভাব ফেলে। প্রথমত, এটি সামগ্রিক চাহিদাকে সঙ্কুচিত করে কারণ গরিব লোকের আয় পিছু প্রয়োজনীয় ব্যয়ের অংশ বড়লোকেদের চেয়ে বেশি। একারণে দেশে মোট আয় যত বেশি ধনীদের হাতে কুক্ষিগত হবে ততবেশি চাহিদার সংকট তৈরি হয়। উন্নত দেশগুলি এবং আমাদের মত দেশে প্রধানত উচ্চমধ্যবিত্ত এর চাহিদা মেটানোর একটা সাময়িক সুরাহা হল ধার নির্ভর ব্যয় (credit financed consumption )। উন্নত দেশগুলিতে চাহিদার সংকট বিলম্বিত করার একটি অন্যতম উপায় হলো ফাইন্যান্স নির্ভর ভোগের প্রচলন । যা আমাদের মত দেশে শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের উপরের অংশের মধ্যে সীমিত । অন্যদিকে ধনীদের হাতে যে বিপুল পরিমাণ।
সম্পদ জমা হচ্ছে তা এক ধরণের চাহিদা তৈরি করে সেটা হলো ফিন্যান্সিয়াল অ্যাসেট’র চাহিদা। ধনীদের যেহেতু বর্তমানের ভোগের জন্য গাড়ি, বাড়ি বিনোদন বিলাস ইত্যাদির চাহিদা পরিপূর্ণ সেজন্য ভবিষ্যতের আয় নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার লক্ষ্য অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । এবং এ কারণেই সে ধরনের সম্পদ একটি নিশ্চিত আয়ের সম্ভাবনা সুরক্ষিত করে সেই ধরনের asset’র এর চাহিদা বাড়তে থাকে। অর্থাৎ আর্থিক বৈষম্য গরীব লোকের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যে চাহিদার সংকট তৈরি করে। বড়লোকেদের financial asset-এর চাহিদা বাড়িয়ে তোলে। এ কারণেই নয়া উদারবাদী আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এক গভীর দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। মুনাফার কেন্দ্রিভবন বৈষম্য তৈরি করে যা সাধারন মানুষের চাহিদাকে পূরণ করার সুযোগ দেয় না। অন্যদিকে চাহিদার সংকট মেটানোর উপায় হয়ে দাঁড়ায় বড়লোকেদের financial asset-এর চাহিদা পুরণ করা। অর্থাৎ আর্থিক বৃদ্ধির ক্রমাগত বিত্ত পুঁজির পছন্দের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কিন্তু মুশকিল হলো এই আর্থিক নীতি যা ক্রমাগত বৈষম্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে যা রাজনৈতিক ভাবে এতটাই ভঙ্গুর হয়ে যায়-এবং সে কারনেই শাসক শ্রেণীর কাছে একটি স্বৈরাচারী রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে আবার একই সাথে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আঘাত শ্রমজীবী মানুষের প্রতিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/05/IMG_20200505_043250.jpg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/05/IMG_20200505_043121.jpg)
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/05/IMG_20200505_043821.jpg)