Karl Marx and India শিরোনামে ২০১৭ সালে মার্ক্সিস্ট পত্রিকার জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় অধ্যাপক ইরফান হাবিবের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। আজ কার্ল মার্কসের জন্মদিবসে সেই প্রবন্ধেরই সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ দুই পর্বে রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হল। ইরফান হাবিব তাঁর মূল প্রবন্ধে মার্কস-এঙ্গেলসের রচনাবলী (মস্কো অথবা লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজি বই) থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, সেই সকল উদ্ধৃতির বঙ্গানুবাদও অনুবাদকের।
প্রথম পর্ব
কার্ল মার্কস ভারত সম্পর্কে অনেককিছুই লিখেছিলেন, অথচ এক দীর্ঘ সময় যাবত দুনিয়াজুড়ে মার্কসবাদীরা সেইসব রচনাগুলির প্রসঙ্গে অবহিত ছিলেন না। ১৮৫৩ থেকে ১৮৬১, এই সময়কালে ‘নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’ পত্রিকায় মার্কস ভারত এবং চীন প্রসঙ্গে একের পর এক প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘দ্য অ্যাকুম্যুলেশন অব ক্যাপিটাল’ লেখার সময় রোজা ল্যুক্সেমবুর্গ কিংবা ‘ইম্পিরিয়ালিজম, দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অফ ক্যাপিটালিজম’ রচনার সময় লেনিন পর্যন্ত সেইসব লেখার বিষয়ে জানতে পারেননি। ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রবন্ধগুলি ছাড়াও মার্কসের আরও কিছু লেখা নোট আকারে অপ্রকাশিত রয়ে যায়। নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে লেনিন কিংবা ল্যুক্সেমবুর্গ যদি মার্কসের এইসকল রচনাগুলি পড়ার সুযোগ পেতেন তবে উপনিবেশ প্রসঙ্গে তাঁদের নিজেদের রচনাগুলি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও বেশি সমৃদ্ধ হতে পারত।
রাশিয়ায় সোভিয়েত বিপ্লবের পরবর্তীতে মার্কসের সংগৃহীত রচনাবলী (কালেক্টেড ওয়ার্কস) প্রকাশ করা শুরু হয়, তখনই ভারত প্রসঙ্গে মার্কসের নাম-সহ ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি প্রথম সবার নজরে আসে। ভারতে এই সকল প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৪-৩৭ সময়কালে, সোশ্যালিস্ট বুক ক্লাব প্রকাশনার চতুর্থ খণ্ডে, সম্পাদনা করেছিলেন মুলক রাজ আনন্দ। ১৯৪০ সালে লন্ডন থেকে ‘মার্কসঃ আর্টিকলস অন ইন্ডিয়া’ বইটি প্রকাশিত হয়, এই বইতে এক দীর্ঘ মুখবন্ধ লেখেন রজনী পাম দত্ত। ১৯৪৩’এ বোম্বাই থেকে সেই বইটির প্রথম ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। অতীত যুগ এবং উপনিবেশ হিসাবে তৎকালীন ভারত প্রসঙ্গে ১৮৫৩ সালে মার্কস যা লিখেছিলেন, তারই গভীর প্রভাব পড়ে রজনী পাম দত্তের প্রখ্যাত রচনা ‘ইন্ডিয়া টুডে’তে। ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়া টুডে’র প্রথম লন্ডন সংস্করণ প্রকাশিত হয়, বোম্বাই থেকে ভারতীয় সংস্করণ বেরোয় আরও ছ-বছর পরে।
মার্কসের নাম সহ প্রকাশিত ট্রিবিউন প্রবন্ধাবলী কার্যত উপনিবেশ প্রসঙ্গে মার্কসের ভাবনাচিন্তার একটি অংশকেই চিনতে শেখায়, ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত ঐ একই বিষয়ে তিনি আরও অনেককিছু লিখেছেন – সেইসব প্রবন্ধ লেখকের নাম ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২০ এবং ১৯৩০’র দশকে মস্কোর মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন ইন্সটিটিউট কার্ল মার্কসের লেখা চিঠিপত্র, নোটবুকস, ঈষৎ বিক্ষিপ্ত আকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাজোখা সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা চালায়, দেখা যায় নাম ছাড়া প্রকাশিত ট্রিবিউন প্রবন্ধাবলীতে কিছু এঙ্গেলসের রচনাও রয়েছে। এই গবেষণাতেই সন্ধান মেলে ১৮৫৭’য় ভারতে মহাবিদ্রোহ সম্পর্কিত একটি রচনার যা ১৯৫৩ সালে ‘মার্কস-এঙ্গেলসঃ অন ব্রিটেন’ বইতে মস্কো থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের দুটি খন্ড প্রকাশিত হয়েছিল, প্রথমটি ‘মার্কস-এঙ্গেলসঃ অন কনোলিয়ানিজম’ এবং দ্বিতীয়টি ‘মার্কস-এঙ্গেলসঃ দ্য ফার্স্ট ইন্ডিয়ান ওয়র অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’, পরবর্তী সংস্করণগুলিতে আরও কিছু লেখা যুক্ত করা হয়। এই সকল রচনাই আমাদের জন্য এক বিরাট সম্পদ যা ভারত সম্পর্কে মার্কসের প্রজ্ঞার আরও বিস্তৃত ধারনা পেতে সাহায্য করে।
ট্রিবিউনে (১৮৫৩, ২৩ জুন) প্রকাশিত নিজের সাক্ষরিত প্রবন্ধাবলীতে মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্রিটেন আধুনিকতার নামে যা কিছু ভারতের উপরে চাপিয়ে দিচ্ছে সেইসবের ধংস্বাত্বক ও শোষণমূলক প্রভাবকে বড় করে না দেখার কথা বলেন মার্কস। এই প্রসঙ্গেই তিনি গ্যেটে’র রচনা থেকে সেই উদ্ধৃতি দেন – যেখানে সুগন্ধি উৎপাদনে ফুলের হত্যা প্রসঙ্গে একটি গোলাপের কুঁড়ি নিজের অভিযোগ জানায়। ১৮৫৭ সালে ভারতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেলে ট্রিবিউনে প্রকাশিত যে সকল প্রবন্ধগুলিতে মার্কসের নাম নেই, দেখা যাবে তিনি নিজের পুরানো অবস্থান বদলেছেন। এইসব প্রবন্ধে তিনি সরাসরি বিদ্রোহীদের সমর্থন জানাচ্ছেন, এমনকি আশা করছেন তারা দিল্লি নিজেদের দখলে ধরে রাখতে সক্ষম হবে। বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের নৃশংসতার তীব্র নিন্দা করার সঙ্গেই ১৮৫৭’র বিদ্রোহকে ‘বিপ্লব’ বলেও অভিহিত করেছেন।
১৮৫৩ সাল নাগাদ অতীত ভারতের সমাজ সম্পর্কে মার্কসের নিজস্ব মতামত ছিল ‘প্রতিরোধবিমুখ ও অচলায়তন বিশেষ’ (ট্রিবিউনে প্রকাশিত ৮ অগাস্ট, ১৮৫৩ সালের প্রবন্ধ), এহেন ধারনার সাথে পরবর্তীকালে (১৮৫৭ ও তার পরে প্রকাশিত ট্রিবিউন প্রবন্ধাবলীতে) তিনি ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামের ধারনাকে সংযুক্ত করতে পেরেছিলেন। ‘ফিলজফি অব হিস্টরি’তে হেগেল ভারতীয় সমাজ প্রসঙ্গে যা কিছু লিখেছিলেন মূলত তারই ভিত্তিতে মার্কস নিজেকে সঞ্জাত করেছিলেন। ১৮৫৭’র পরে মার্কস-এঙ্গেলসের রচনায় ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে সেই পুরানো অবস্থান আর কখনই ফিরে আসেনি।
ট্রিবিউনে লেখার সময়েই (১৮৫৩-৬৩) মার্কস ভারত সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন করেন যার ফলে প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে তাঁর ধারনা আরও বিস্তৃত হয়। মার্কস উপলব্ধি করেন ইউরোপের সামন্তবাদী কাঠামোর তুলনায় ভারতীয় সমাজের অতীত দিনের বৈশিষ্ট অনেকটাই আলাদা। ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশের সময়েও মার্কস-এঙ্গেলস প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের কেবলমাত্র দুটি রূপ সম্পর্কেই অবহিত ছিলেন, একটি প্রাচীন রোমান সমাজব্যবস্থা, আরেকটি হল মধ্যযুগের ইউরোপীয় সমাজ। অনেকটা পরে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হতে, দাসব্যবস্থা এবং ভূমিদাসত্ব, দুয়ের থেকেই ভিন্ন আরেকধরনের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে পরিচিত হলেন মার্কস। নিজের মতামত খসড়া লিখতেন যে নোটবুকে (এখন গ্রুন্ড্রিজ বলে প্রকাশিত), তাতে উল্লিখিত রয়েছে, প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থায় মূলত দুটি কাঠামো ভিত্তি হিসাবে সক্রিয় ছিল। গোষ্ঠীগত কৃষিকাজের অস্তিত্বহীন গ্রামীণ সমাজ এবং এক স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা (যাকে মার্কস প্রাচ্যদেশীয় স্বেচ্ছাচার বলে উল্লেখ করেছেন)। এহেন রাষ্ট্র সেই সময়েই কর আদায় করত যা কার্যত জমিদারের খাজনারই সমান। দাসব্যবস্থা কিংবা ভূমিদাসত্ব উভয় হতেই এহেন সমাজকাঠামো পৃথক। এই উপলব্ধি থেকেই ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘আ কন্ট্রিউবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’ বইতে প্রাচীন, সামন্তবাদী এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন কাঠামোর সঙ্গেই মার্কস বিশেষভাবে ‘এশিয়’ উৎপাদন কাঠামোরও উল্লেখ করেন।
বোঝাই যায়, ততদিনে মার্কস এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে দাসব্যবস্থা এবং সামন্তবাদ (যে দুটি ধারা ইউরোপে দেখা যায়) উভয় হতেই ভারতীয় সমাজ কাঠামো ছিল ভিন্ন। যদিও, এহেন সমাজব্যবস্থা শ্রেণিহীন ছিল না, মার্কসের লেখায় অতীত দিনে ভারতের গ্রামীণ সমাজে একাধিক শ্রেণির উল্লেখ রয়েছে। স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রের এক বিরাট কাঠামোর মধ্যেই শাসক শ্রেণিগুলি ছিল যারা উৎপাদিত উদ্বৃত্তের বিশাল অংশই নিজেদের দখলে রাখত। এই প্রসঙ্গেই নিজের লেখায় ‘এশিয় ব্যবস্থা আদৌ কোন শ্রেনিবিভক্ত সমাজ নয়, একে খুব বেশি হলে শ্রেণি সমাজের সবচাইতে প্রাথমিক স্তরবিশেষ বলা যায়’ উল্লেখ করে, হবসবম সবটা সঠিক বলেননি। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময়ে ভারতে আসা ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাংকোয়েজ বার্নিয়ারের লিখিত অভিজ্ঞতা পড়ার পর থেকেই মুঘলদের শাসনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে মার্কস বিশেষ আগ্রহী ছিলেন, সেই অভিজ্ঞতায় তৎকালীন ভারতে কর ব্যবস্থার বিবরণ রয়েছে। সাধারণ বিচারেও বোঝা যায়, এক বিরাট চেহারার রাষ্ট্র যখন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জনগণের থেকে কর আদায় করছে তখন তাকে কোনভাবেই প্রাথমিক স্তরের সমাজব্যবস্থা বলা চলে না।
ভারতীয় সমাজ নিশ্চিতভাবেই প্রাক-পুঁজিবাদী চরিত্রের ছিল। সেই কারনেই ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত পুঁজি (ক্যাপিটাল) গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে মার্কস প্রাচীন ভারতের সমাজকাঠামো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা যুক্ত করেন। সেই আলোচনায় উল্লিখিত রয়েছে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার সংশ্রব ব্যাতিরেকেই কিভাবে একটি সমাজব্যবস্থা নিজেকে সক্রিয় রাখতে পারে। একদিকে সাধারণ হস্তশিল্প সংক্রান্ত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এক প্রকারের শ্রমবিভাজন ছিল, অন্যদিকে ঢাকা’য় দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট মসলিন তৈরি হত যুগ যুগ ধরে উত্তরাধিকার সুত্রে অর্জিত দক্ষতা ও অতি সাধারণ সব যন্ত্রপাতির উপরে ভর করে। মেশিন আবিস্কারের আগেই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ঠেলায় পড়ে এহেন শ্রমবিভাজন বিভিন্ন ক্ষুদ্র উৎপাদনের পর্যায়ে বিস্তৃত হয়, নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। মার্কস এও লক্ষ্য করেন ভারতে ধনীবর্গেরা নিজেদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী নির্মাণে হস্তশিল্পীদের নানারকম কাজ দিতেন, এভাবেই উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের এক নিরবিচ্ছিন্ন ও ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া নিজের জোরেই সক্রিয় ছিল, কোথাও পূঁজির কোনরকম হস্তক্ষেপ ছিল না।
কৃষিকাজ ও হস্তশিল্প সমেত ভারতের এক বিরাট অংশেই অ-পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল, এরই সঙ্গে কিছু নিয়ন্ত্রণ সহ পুঁজিবাদী বন্দোবস্তও সক্রিয় ছিল, মূলত পণ্য সঞ্চালনায় অর্থের ব্যবহারের ক্ষেত্রে। প্রাক-আধুনিক ভারতীয় অর্থনীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মার্কস উল্লেখ করেছেন, “উৎপাদিত উদ্বৃত্তই কেবলমাত্র পণ্যে রূপান্তরিত হত, অবশ্য সেই উদ্বৃত্তেরই আরেকটি অংশ রাষ্ট্রের হস্তগত হলে তবেই এমন রূপান্তর ঘটত” (ক্যাপিটাল-২য় খন্ড, মস্কো থেকে ১৯৫৭ সালে ইংরেজি প্রকাশনা)। অন্যভাবে বলা চলে, গ্রামীণ ভারতে এক স্বাভাবিক অর্থনীতি প্রচলিত ছিল, তার বাইরে শহর এবং বাজারগুলিতে পণ্য সঞ্চালিত হত। মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে কোনো বিনিময়েই অর্থের ব্যবহার হয়, উৎপাদনের সব ক্ষেত্রেই পণ্য-নির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে ভাষান্তর করেছেন সৌভিক ঘোষ